Can't find our books? Click here!
মিথ্যা-স্যাম হারিস

মিথ্যা-স্যাম হারিস

স্যাম হারিসের মিথ্যা বইটি পড়ার পূর্বে মিথ্যা সম্পর্কে আমার ধারণা কেমন ছিলো আমি জানিনা। আমি প্রয়োজনে অথবা অপ্রয়োজনে নির্দোষ মিথ্যা বলেছি কিন্তু আমি অনুমান করতে পারিনি  আসলে এর  ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। ধৈর্য নিয়ে এ লিখাটি পড়বেন? আমি স্যাম হারিসের বইটি পড়ে যা শিখেছি তা আপনাদেরও জানা প্রয়োজন বলে গভীরভাবে অনুভব করি। স্ট্যানফোর্ডে আন্ডারগ্রেজুয়েট অবস্থায় স্যাম হারিস “দি এথিকাল এনালিস্ট” একটি  সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন, এ পুরো সেমিনারটি সক্রেটিক সংলাপ রুপে পরিচালনা করেছিলেন অসাধারণ মেধাবী একজন অধ্যাপক, রোল্যাণ্ড এ. হাওয়ার্ড। তারই আলোকে এ মিথ্যা বইটি লিখা। তো আমি মিথ্যা বইটি থেকে আমার ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি বিভাজন করছি। যদিও আমার বক্তব্যের সংক্ষিপ্ততা পুরো বইটির গভীরতা উত্তোলন করতে পারবেনা তবুও অন্তত আমাদের মধ্যে মিথ্যা সম্পর্কে একটি পূর্ব সতর্কতা তৈরি করতে পারে যেটাকে আমরা প্রাত্যহিক জীবনে সম্পূর্ণ পাশ  কাটিয়ে যাই –

১.  আমি নিজেকে যতটা প্রদর্শন করি আমি ঠিক ততটা সুন্দর নয়৷ একজন নারী নিজেকে সুন্দর প্রমাণ করার জন্য প্রসাধনী ব্যবহার করে। যা হয়তো তাকে সে যতোটা সুন্দর নয় তার চেয়েও অধিক সুন্দর ভাবে সমাজের মস্তিষ্কে উপস্থাপন করে,  সমাজকে সে প্রসাধনীর মাধ্যমে নিজের সম্পর্কে ভুল বুঝায়, নিজের অজান্তেই সে নিজে যা নয়  নিজেকে সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু সত্য হলো সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর মোটেও আমি এতটা সুন্দর ছিলাম না।

২. আপনি কেমন আছেন? প্রশ্নটি দ্বারা মূলত আমরা কী জানতে চাইছি? এ প্রশ্নটি অনেককিছুই নির্দেশ করছে? আপনি কী আমার পেটের অবস্থা জানতে চাইছেন নাকি আপনি আমার অফিশিয়াল অবস্থা জানতে চাইছেন ? এ প্রশ্নটি আসলে নির্দিষ্ট নয়! আমি কেমন আছি এটা আমার ভেতর ও বাহির দুটোকেই নির্দেশ করে, আমি কে? আমি ৭ অক্টিলিওন এটম, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেলের তৈরি। আমার শরীরের এক একটি অর্গান এক একটি অবস্থায় আছে। কিছু ভালো কাজ করছে আবার  কিছু  ভালোভাবে কাজ করছেনা, আর আমি নিজেই সবকিছু কেমন আছে জানিনা।  অতএব যখন আমাকে প্রশ্ন করা হয় আমি এ প্রশ্নটির সামষ্টিক উত্তর দিতে পারিনা, আমি এক এক করে বলিনা যে আমার শরীরের কোন সেলটি কোন অবস্থায় আছে, আমার বুট কেমন আছে অথবা আমার মন জগত সম্পর্কে কেমন অনুভব করছে। আমি স্রেফ পাশ কাটিয়ে যাই এবং বলি যে- ভালো আছি বা নেই । কিন্তু এটা কোনো পরিকল্পিতভাবে বলা  মিথ্যা নয়।

৩. মিথ্যা ও ছলনার পার্থক্যটি অস্পষ্ট। অনেক সময় সত্য বলেও ছলনা করা যায়। যেমন – আমি যদি হোয়াইট হাউজের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সেলফোন ব্যবহার করে ফেসবুক হেড কোয়ার্টারে ফোন করে জোর গলায় মার্ক জাকারবার্গের সাথে কথা বলতে চাই,  তবে এটি হয়তো সত্য হতে পারে কিন্তু এটাকে ছলনা মনে হবে।

৪. আমরা মিথ্যা কেনো বলি?  জাদুকর বা পোকার খেলার জুয়াড়িও মিথ্যা বলে কিন্তু তা সমাজের কাছে সহযেই সনাক্তযোগ্য। এটা ক্ষতিকর নয়। আমরা বিশেষত মিথ্যা বলি, নিজের সম্পর্কে অন্যের কাছে এমন কিছু উপস্থাপন করার জন্য যা আমি নই। অথবা মিথ্যা বলে আমরা অন্যের মনে এমন কিছু বিশ্বাস তৈরি করার চেষ্টা করি যা সত্য নয়। স্যাম হারিস বলেন, মানুষ বহু কারণেই মিথ্যা বলে। বিব্রতকর কোনো পরিস্থিতি এড়াতে, নিজেদের অর্জনকে অতিরঞ্জিত করতে এবং কোনো ভুল কাজ গোপন করতে তারা মিথ্যা কথা বলে। রক্ষা করার কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই তারা প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা তাদের সেবা ও উৎপাদিত দ্রব্যের ত্রুটিগুলো লুকিয়ে রাখে। সুবিধা পেতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিভ্রান্ত করে। তাদের অনুভূতিতে আঘাত না-করার উদ্দেশ্যই আমরা অনেকেই আমাদের বন্ধু আর পরিবারের সদস্যের কাছে মিথ্যা বলি।

৫.  অন্যের মন রক্ষা করতে কী আমাদের মিথ্যা বলা প্রয়োজন? হারিস এ নিয়ে চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন। হারিসের  বন্ধু সিতা তার একবার তার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলো। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ব্যস্ততা বা সময়ের সংক্ষিপ্ততার কারণে সে বন্ধুর জন্য কোন উপহার কিনতে পারেনি। বার্থরুমের জন্য যে সাবান ও শ্যাম্পু কিনেছিলো সেগুলো নতুন ছিলো।  তড়িঘড়ি করে হোটেলের ফন্ট ডেস্ক থেকে ফিতা সংগ্রহ করে সেগুলো বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলো বন্ধুর বাসায়। বন্ধু যখন প্রশ্ন করলো, এগুলো কোথায় থেকে নিয়েছো? আকষ্মিক এ প্রশ্ন সে যে একটা অনুচিত কাজ করেছে সে ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে তোলে, হতবাক হয়ে পরে নিজেকে কোনোমতে স্থির করে।   ভারসাম্যটি সে কোন রকমে পুনরুদ্ধার করলো এই বলে যে , এইতো এই মাত্র

হোটেলের গিফট শপ থেকে কিনলাম।  এরপরের শব্দ গুলো তার অবুঝ নিস্পাপ শিশুর মুখ থেকে এসেছিল- না মা, তুমি এগুলো বার্থরুম থেকে নিয়ে এসেছো। এই দুই নারীর চেহারা কেমন হতে পারে এবার সেটি কল্পনা করার চেষ্টা করুন, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বিব্রত হয়ে অনঢ়, তারপর ক্ষমা প্রার্থনা আর ক্ষমা সুলভ হাসিতে সমর্পন। সাময়িক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য এমন কোন কথা বলা উচিত নয় যা আপনার ভারসাম্য সম্পূর্ণ শেষ করে দেয়!

৬. স্যাম হারিস বলেন, অন্তত একটি গবেষণা প্রস্তাব করছে যে স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে ১০ শতাংশ তথ্য বিনিময় হচ্ছে প্রতারণামূলক, আরেকটি গবেষণা আবিষ্কার করেছে যে, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ আদান-প্রদানে মিথ্যা থাকে। তবে, গবেষকরা দেখেছেন, এমনকি মিথ্যাবাদীরাও তাদের প্রতারণাপূর্ণ ক্রিয়া-প্রতিক্রয়াগুলো সত্যনিষ্ঠ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো অপেক্ষা কম সুখকর হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এই আবিষ্কারে ভয়ঙ্কর বিস্ময়কর কিছু নেই : আমরা জানি যে আস্থা ও বিশ্বাস গভীরভাবে প্রশান্তিদায়ক এবং প্রতারণা ও সন্দেহ একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। গবেষণা প্রস্তাব করেছে যে, সব ধরনের মিথ্যা—এমনকি কারো অনুভূতি রক্ষা করতে ব্যবহৃত আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মিথ্যাগুলোও (যাকে বলা হয় ‘হোয়াইট লাইজ’)—অপেক্ষাকৃত নিম্নতর মানের পারস্পরিক সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট।

৭. কেউ যখন একবার সত্য বলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় তখন সে বুঝতে পারে কতটা অস্বাভাবিক এমন কারো সাথে দেখা হওয়া যারা তার মতো একই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সাধারণত বিশ্বাস খুঁজি, একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষের আশ্রয় চাই। যে আমাদের সামনে ও পেছনে একই কথা বলে। এমন মানুষ আমাদের আশ্রয়।  কারণ আপনি জানেন যে সে আপনার ভুলকে ভুল ও সঠিককে সঠিক বলবে! আপনি তার উপর শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পারবেন।

৮. অপরকে কষ্ট না দিয়ে সত্য প্রকাশ কিভাবে করবেন? সত্য কি এমনভাবে উপস্থাপন করবেন যা অন্যের মনোবল ভেঙে দেয়? অন্যকে দূর্বল করে দেয়? তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে? তার প্রতিভা ধবংস করে? আমরা প্রায় দেখি ফেসবুকে অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষও এত আক্রমণাত্মক বা শ্লেষাত্মকভাবে  অন্যের ভুল প্রকাশ করছে যে,  সে মানুষটার সামনে মনোবল হারিয়ে দূর্বল হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনা। যখন একজন বুদ্ধিমান মানুষ কোনো জিজ্ঞাসু মনকে এমনভাবে বিচুর্ণ করে তখন আমাদের হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। কেউ  ভুল করলে অথবা কারো সম্পর্কে নিস্পাপ কোন সত্য তাকে এমন ভাবে ধরিয়ে দেয়া ঠিক নয় যে প্রক্রিয়াটি নিজেই একটা ভুল। আপনার একটি ইতিবাচক মন্তব্যের উপর একজন মানুষের ব্রেন তার ভবিষ্যত তৈরি করে। স্যাম হেরিসের একজন বন্ধু, যে দেখতে কিছুটা স্থুল সে হ্যারিসকে বলল, আমি কী অনেক বেশি স্থুল হয়ে গেছি? হ্যারিস তাকে উত্তর দিয়েছিলেন,

“কেউ তোমাকে  কখনো মোটা বলতে পারবে না কিন্তু আমি মনে করি তুমি সম্ভবত পঁচিশ পাউন্ডের মতো ওজন কমাতে পারো ।

৯. নীরবতার মাধ্যমেও মিথ্যা বলা যায়। কেউ কেউ আপনার সম্পর্কে সবসময় নীরব থাকবে সে আপনার ভালো বা মন্দ কোনোকিছুতেই কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবেনা। সে সবসময় নীরবতা পালন করবে ও আপনার সাথে সব ধরণের প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক ঠিক রাখবে। তার এ নীরবতা আপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা, তার এ নীরবতা থেকে আপনি বিভিন্ন রকম অর্থ তৈরি করতে পারেন, এ নীরবতা আপনার মস্তিষ্কে তার সম্পর্কে অনেক মিথ্যাচার তৈরি করবে, হয়তো এ নীরবতাই আপনার সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ। মিথ্যার ডেফিনিশন অনুসারে, মিথ্যা হলো তা যা অন্যের মনে আপনার সম্পর্কে এমন কোন বিশ্বাস তৈরি করে  যা সত্য নয়। পরিকল্পিত কোন নীরবতা যদি কারো মনে আপনার সম্পর্কে এমন কোন কল্পিত বিশ্বাস তৈরি করে যা আপনার সম্পর্কে সত্য নয় তবে আপনি মিথ্যাবাদী, কোন শব্দ ছাড়াই মিথ্যাবাদী।  শব্দ ছাড়াও মিথ্যা বলা যায়। ( সেপিয়েন্স থেকে হোমো ডিউস) 

১০. আমার মা ক্যান্সার আক্রান্ত। কিন্তু আমার বাবা তাকে জানায়নি। কারণ জানালে মা কষ্ট পাবেন। মা ক্রমশ অসুস্থ্য হতে থাকেন। একদিন তিন টের পান যে তার সাথে যা হচ্ছে তা সঠিক হচ্ছেনা। একটা সময় তিনি লাইব্রেরিতে যান, তার রোগের উপসর্গ  নিয়ে পড়াশুনা করে জানতে পারলেন তার ক্যান্সার। মা খুব দুঃখ্য পেলেন এই ভেবে যে, যদি বিষয়টি বাবা জানতে পারেন তিনি কী ব্যাথাই না পাবেন। মা কখনো বাবাকে তার ক্যান্সার এর কথা বলেননি। বাবা পরিবারের কাউকেও প্রথমে বিষয়টি জানাননি, পরিবারে যাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়। মায়ের মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারি আমরা মায়ের মৃত্যুর কারণ জানিনা। পরে এ নিয়ে গবেষণা করে মূল সত্যটি বেরিয়ে আসে। আমি প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পারি। ক্যান্সারের সত্যটি আমরা সবাই জেনেছি কিন্তু কেউ কাউকে সহযোগিতা করতে পারিনি। আমার মা ও বাবা দুজনেই একা, নির্জনে একই সত্য বহন করেছিলো কিন্তু তারা কেউ কাউকে সে সত্যটি প্রকাশ করেনি। যা দুজনেই জানে তা কেউ কাউকে জানায়নি। মিথ্যা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে, একাকীত্ব দিয়েছে, বিবেকের শাস্তি দিয়েছে, তারা যা জানে তারা তা নিয়ে কথা বলতে পারেনি, মিথ্যা আমাদের কাউকে মায়ের ক্যান্সারের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়নি ( স্যাম হেরিসের গ্রন্থে অনেকটা এমন একটি উদাহরণ আছে যা আমি আমার ভাষায় বর্ণনা করেছি ,তবে আমার বলা ঘটনাটি সাজানো মিথ্যা ছিলো )।

১২. পরম ক্ষেত্রেও  সবসময় মিথ্যা বলা উচিত নয় যেমনটি ফিলোসফার কান্ট মনে করতেন। কান্ট বলেছেন এমনকি  কাউকে হত্যা করে ফেললেও মিথ্যা বলা যাবেনা। হ্যারিস কান্টের কথাটিকে অপ্রকৃতস্থ বলেছেন। চরম ক্ষেত্রেও মিথ্যা বলা উচিত নয় কিন্তু এটাকে পাগলামির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াও ঠিক নয়। যুদ্ধ ক্ষেত্রে আমরা মিথ্যা বলতে পারি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে সত্য বলা জরুরি নয়। কারণ আমরা সত্য তাদেরকেই বলি যাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আছে, যাদের সাথে আমরা সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে চাই কিন্তু দুটি দেশের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয় তখন তারা সকল প্রকার সম্পর্কের সম্ভাবনাকে উপড়ে ফেলে দিয়েই যুদ্ধে নামে। যেখানে সম্পর্কই নেই সেখানে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোন মানেই হয়না। হরিণ বাঘের বিশ্বাসযোগ্য হতে গেলে সে কেবল তার খাদ্যেই পরিণত হবে!

১৩. একবার হ্যারিসকে পুলিশের হাতে পড়েছিলেন। তার নিজের ভাষায় –

সময়টি ছিল ১৯৮৭ সাল, কিন্তু এটিকে অনায়াসে ‘সামার অব লাভ’ বলা যেতে পারে : আমার বয়স তখন বিশ, কাঁধ অবধি লম্বা চুল, ভারতীয় একজন রিক্সা চালকের মত কাপড় আমার পরণে। যারা জাতির মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত তাদের দৃষ্টিতে আমার মালপত্র বিশেষভাবে পরীক্ষা করা দূরদর্শিতার একটি বিষয় হিসাবে অনুভূত হয়েছিল। আনন্দের বিষয় ছিল, আমার সাথে গোপন রাখার মত কিছু ছিল না।

‘আপনি কোথা থেকে আসছেন’? আমার পিঠের উপর ঝোলানো ব্যাগের দিকে সন্দেহজনক একটি দৃষ্টি দিয়ে কর্মকর্তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

‘ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড…’, আমি বলেছিলাম।

‘আপনি কী সেখানে অবস্থান করার সময় কোনো মাদক দ্রব্য গ্রহণ করেছিলেন’?

বাস্তবতা হচ্ছে, আমি মাদক ব্যবহার করেছিলাম। এখানে মিথ্যা বলার প্রলোভন খুবই স্পষ্ট—একজন শুল্ক কর্মকর্তার সাথে আমার নিজের সাম্প্রতিক মাদক ব্যবহার নিয়ে কথা বলার কী দরকার আছে? কিন্তু সত্য না বলারও কোনো প্রকৃত কারণ নেই, শুধুমাত্র সেই ঝুঁকিটি ছাড়া যে, এমন উত্তরের প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই যতটুকু শুরু করা হয়েছে আমার মালপত্রের উপর আরো বেশি বিস্তারিত তল্লাশী চালানো হবে (এবং হয়তো আমার শরীরের উপরেও হতে পারে)।

‘হ্যাঁ’, আমি উত্তরে বলেছিলাম।

কর্মকর্তাটি ব্যাগ তল্লাশী বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন জিজ্ঞাসা করেছিলেন :

‘কী ধরনের মাদক আপনি সেখানে ব্যবহার করেছিলেন’?

‘আমি বেশ কয়েকবার গাজার সিগারেট ব্যবহার করেছিলাম, ভারতে আফিম চেষ্টা করেছিলাম’।

‘আফিম’?

‘হ্যাঁ’।

‘আফিম না হেরোইন’?

‘ওটা আফিমই ছিল’।

‘ইদানীং কেউ আফিম ব্যবহার করছে এমন কথা শোনা যায় না’।

‘আমি জানি, আমি প্রথমবারের মত চেষ্টা করেছিলাম’।

‘আপনি কী সাথে মাদক দ্রব্য বহন করছেন এখন’?

‘না’।

কিছুক্ষণের জন্য শুল্ক কর্মকর্তা আমার দিকে চিন্তিত দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তারপর আবার আমার ব্যাগ তল্লাশী করতে মনোযোগ দিলেন। বাদানুবাদের প্রকৃতি যেমন ছিল, আমি মেনে নিয়েছিলাম যে আমাকে এখানে দীর্ঘ সময় অবধি থাকতে হবে। সে কারণে, আমি গাছের মতই ধৈর্য্যশীল ছিলাম। আর সেটি বেশ ভালোই কাজ দিয়েছিল, কারণ ভদ্রলোক আমার সব জিনিসপত্র এমনভাবে পরীক্ষা করছিলেন যেন মনে হচ্ছিল এর প্রতিটি সামগ্রী—দাঁত মাজার একটি ব্রাশ, একটি বই, একটি টর্চলাইট, খানিকটা নাইলনের দড়ি—হয়তো মহাবিশ্বের গভীরতম কোনো রহস্য উন্মোচন করতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন :

‘আফিম কেমন’?

এবং আমি তাকে সেটি বলেছিলাম।

বাস্তবিকভাবে, পরবর্তী দশ মিনিট  আমি আইন-রক্ষাকারী এই ভদ্রলোককে মানসিক-অবস্থা রূপান্তর করে এমন দ্রব্যের ব্যবহার বিষয়ে আমার যা কিছু জানা আছে তার প্রায় সবকিছু জানিয়েছিলাম।

অবশেষে তিনি তার তল্লাশী সমাপ্ত করে আমার ব্যাগ বন্ধ করলেন। আমাদের এই সাক্ষাৎকারের শেষে একটি জিনিস সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয়েছিল : আমাদের দুজনেই খুব ভালো বোধ করেছিলাম।

১৪. সমাজে যোগাযোগ করার সময় আমরা অনেক তুচ্ছ মিথ্যা বলি। যা আমরা খেয়ালও করিনা।। আকষ্মিক আমরা কিছুদিন পর বুঝতে পারি যে কেউ আমাদেরকে আর গ্রহণ করছেনা। আপনি যদি কারো সাথে একবার কোন কারণে মিথ্যা বলেন, তবে সে আপনাকে প্রতিবারই মিথ্যাবাদী মনে করতে পারে কিন্তু আপনি যদি কাউকে একবার সত্য বলেন সে আপনাকে বারবার সত্যবাদী মনে করবেনা। মিথ্যা এমনই। একবার একজব ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হয়ে যাওয়ার পর, সমাজ তাকে আর বিশ্বাস করেনা, নিজের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য সে একটা সময় বিপুল সময় ও শক্তি অপচয় করে কিন্তু সবাই তার ব্যাপারে সতর্ক থাকে যে  এ মানুষটি “পটেনশিয়াল লায়ার”!

যাইহোক, পরিশেষে . মিথ্যাবাদীকে অজস্র ইনফরমেশন মনে রাখতে হয়। আপনি যদি গতকাল কাউকে এমন কোন কথা বলে থাকেন যা আসলে সত্যিকারে ঘটেনি তবে আপনাকে সবসময় গতকালকের সে ইনফরমেশনটি মনে রাখতে হবে, এ ইনফরমেশন এর স্রষ্টা আপনি নিজে, এভাবে প্রতিদিন আপনাকে অজস্র তথ্য ধরে রাখতে হবে। আপনি কোনোদিকে ভালোভাবে  মনোযোগ প্রদান করতে পারবেন না। আপনার মনোযোগ বিঘ্নিত হবে। একজন মিথ্যাবাদীর মধ্যে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বেশি, তার স্মৃতিশক্তি দূর্বল। একজন মিথ্যাবাদীকে মনে করে করে কথা বলতে হয়, খুঁটিনাটি মনে রাখতে যেয়ে তার মস্তিষ্কের মেমরির উপর চাপ পড়ে। স্যাম হারিস বলেন, একজন সত্যবাদীর চারপাশের পরিবেশই তার মস্তিষ্কের মেমরি, বিশ্বটাই তার মেমরি,  তাকে কথা বলার জন্য কোন তথ্য তৈরি করতে হয়না, সবকিছু তার সামনেই উপস্থিত থাকে।

তথ্যসুত্র-

মিথ্যা, স্যাম হারিস, ভাষান্তর- মাহবুব হাসান