১১ই আগস্ট,১৬৭৬। ইতালির সিসিলির এক গির্জায় তখন প্রার্থনা সঙ্গীতের প্রস্তুতি চলছে। সমবেত সন্ন্যাসিনীদের একজন খেয়াল করলেন, সিস্টার মারিয়া তাদের সঙ্গে নেই, যিনি নিয়মিতই প্রার্থনা সঙ্গীতে অংশ নিতেন। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বেশ কয়েকজন সন্ন্যাসিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কনভেন্টে ( খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীদের আবাস) সিস্টার মারিয়াকে তাঁর নিজের ঘরের বা সেলের মেঝেতে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, সারা মুখ ছিল কালি দিয়ে মাখা। সিস্টারের পাশে খুঁজে পাওয়া গেল একটা চিঠি, যাতে রহস্যময় সংকেতে কিছু একটা লেখা ছিল। সিস্টারের দাবি, তাঁর ওপর লুসিফার বা শয়তান ভর করেছিল এবং তাঁকে দিয়ে কিছু একটা লিখিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু যে সময়টা জুড়ে এ ঘটনাটা ঘটে, তার কিছুই সিস্টার মনে করতে পারলেন না। সেই রহস্যময় চিঠি প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর ২০১৭ সালে অবশেষে ডিকোডেড হয় এবং একই সাথে জানা যায় চিঠির পেছনের আসল সত্যটা।
কে এই সিস্টার মারিয়া?
পুরো নাম মারিয়া ক্রোসিফিসা দেলা কনসেজিও। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল ইসাবেলা তোমাসি। বহু ভাষায় চমৎকার দক্ষতা ছিল তাঁর। মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি সিসিলিতে আসেন এবং সেখানেই সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। বন্ধুসুলভ এবং ঈশ্বর ভক্ত হিসেবে খুব দ্রুতই তিনি সন্ন্যাসিনীদের মধ্যে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পান।
সমস্যার সূত্রপাত……
সবই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু একদিন সমবেত সঙ্গীতের সময় হঠাৎ তাঁর কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ে যায় এমনভাবে যেন কেউ তাঁকে স্ট্যাবিং করেছে এবং সাথে সাথেই তিনি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারান। এরপর থেকে প্রায়ই প্রার্থনাকালীন, এমনকি প্রার্থনার বাইরেও প্রতি রাতে তার নিজের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসত এবং অবশেষে একদিন তাঁকে নিজের ঘরেই এই রহস্যময় চিঠি সমেত খুঁজে পাওয়া যায়।
চার্চের সিদ্ধান্ত
চিঠিটা যে সম্পূর্ণ শয়তানের বা লুসিফারের কীর্তি, সে সম্পর্কে তৎকালীন চার্চের কেউই সন্দিহান ছিলেন না। মারিয়া সেরাফিকা নামে আরেকজন সন্ন্যাসিনীর বরাতে জানা যায়, লুসিফার মারিয়াকে দিয়ে ঐ চিঠিতে সই করিয়ে নিতে চেয়েছিল, যা তাঁর তীব্র প্রতিরোধের মুখে ব্যর্থ হয়। মোটকথা, মারিয়ার অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, চিৎকার করা- এসবই লুসিফার বা শয়তান মারিয়ার ওপর ভর করেছিল বলেই ঘটেছিল বলে দাবি করা হয়।
বিজ্ঞানের হাতে যখন রহস্য সমাধানের আসল চাবিকাঠি
শয়তানের থিওরি আর যাই হোক বিজ্ঞানসম্মত নয়, অতএব এবার বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে ঘটনার রহস্যভেদ করতে হবে। এখানে রহস্য মূলত দুটো — এক. শয়তান ঠিক কী বলেছিল সিস্টারকে, আর দুই. সিস্টার সত্যিই শয়তান দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন কিনা।প্রথমে আসা যাক চিঠির রহস্যে। Ludum Science Centerএর ডিরেক্টর ডেনিয়েলি অ্যাবেট বলেন, “ঐতিহাসিক কিছু ডিক্রিপশনের সময় লেখকের মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এই সন্ন্যাসী সম্পর্কে যতটা সম্ভব তাই আমাদের জেনে নেওয়া দরকার ছিল।” “চিঠিটা দেখে মনে হয়েছিল এটা শর্টহ্যান্ডে লেখা। আমরা ধারণা করেছিলাম যে মারিয়া একটি নতুন শব্দভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন সেইসব বর্ণমালা দিয়ে, যেগুলো তিনি জানতেন।” শর্টহ্যান্ড হলো প্রচলিত অ্যালফাবেটের বিকল্প, যে পদ্ধতিতে বিভিন্ন আকৃতির চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। নিশ্চিত হবার জন্য গবেষকদল প্রথমে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে যা বিভিন্ন ভাষার শর্টহ্যান্ড সংকেত শনাক্ত করতে সক্ষম। গবেষকদের প্রত্যাশার বাইরে গিয়ে একটি উন্নত এলগোরিদম যা ফলাফল দেয়, তা হলো চিঠিটি মোটেও হিজিবিজি অর্থহীন কতগুলো সংকেতের সমষ্টি নয়, বরং তা ছিল গ্রিক, ল্যাটিন, আরবীয় এবং রুনীয় বর্ণের আশ্চর্য সম্মিলন। চিঠির সারবস্তু হলো এই– “Holy Trinity বা ঈশ্বরের ত্রিতত্ত্ব মিথ্যে বা মৃত। ঈশ্বর ভাবেন যে তিনি মরণশীল মানুষদের মুক্ত করে দিতে পারবেন, কিন্তু এই ব্যবস্থাটি কারো ক্ষেত্রেই কাজ করে না।” মূলত চিঠিতে লুসিফার মানবজাতিকে বিদ্রূপ করেছে ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাস করার জন্য।
আসল লুসিফার যখন মানসিক সমস্যা
তবে চিঠির বিষয়বস্তু যাই হোক, এখানে আসল প্রশ্নটা হলো, লুসিফার কী সত্যিই সিস্টার মারিয়ার ওপর ভর করেছিল, নাকি অনেক ভাষায় দক্ষ মারিয়া নিজেই চিঠিটার মূল লেখক? এই প্রসঙ্গে অ্যাবেট বলেন, “চিঠিটা ইঙ্গিত করে যে সিস্টার মারিয়া মূলত সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলেন। শয়তানের ছবি এই ধরনের ডিজঅর্ডারে প্রায়ই এসে উপস্থিত হয়।”
এবার আসি সিজোফ্রেনিয়ার প্রসঙ্গে। একজন সিজোফ্রেনিক রোগীর হেলুসিনেশন, প্যারানয়া, বিভ্রমের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। হেলুসিনেশনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে গায়েবি কণ্ঠস্বর শ্রবণের মধ্য দিয়ে, যা কখনো কখনো এমনকি স্বাদ, গন্ধ, দর্শন ও স্পর্শের দ্বারাও অনুভূত হতে পারে। বিভ্রম গুলো সাধারণত নিগ্রহসূচক হয়, অর্থাৎ রোগীর মনে হয় কেউ তার ক্ষতি করছে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। কিছু ক্ষেত্রে রোগীর মনে হয় যেন তার অনুভূতি বা চিন্তাগুলো তার নিজের নয়, জোরপূর্বক তার ভেতর সঞ্চারিত করা হয়েছে। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে আরও আছে চিন্তার স্থবিরতা, অসংলগ্ন কথাবার্তা ইত্যাদি। মোটকথা, সিজোফ্রেনিয়া এক ধরনের সাইকোসিস যেখানে ভিকটিম বাস্তব এবং কল্পনার জগতকে পৃথক করতে ব্যর্থ হয়।
কেন হয় সিজোফ্রেনিয়া?
এজন্য মূলত দুটো ফ্যাক্টরকে দায়ী করা হয়– জিনগত এবং পরিবেশগত। ‘Schizophrenia Exome Sequencing Meta-Analysis’ নামে একটি বৈশ্বিক কনসোর্টিয়াম প্রায় ২ বছরব্যাপী রোগীদের এক্সোম সংগ্রহ করতে শুরু করে। এক্সোম হলো এক্সোনের সেট, আবার এক্সোন হলো RNA-এর সেই অংশ যা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের নিয়ন্ত্রক প্রোটিন কোড করতে পারে। বিষয়টা হচ্ছে, DNA- তে বিভিন্ন বেসপেয়ারের যে কম্বিনেশন জিনের কাজ করে, ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে RNA যখন সেখান থেকে কপি নেয়, তার কিছু অংশ প্রোটিন সিনথেসিসে অংশ নেয় আর কিছু অংশ নেয় না। যারা অংশ নেয় তারাই হলো এক্সোন। বিজ্ঞানীরা ২৪০০০ সিজোফ্রেনিক রোগীর এবং ৯৭০০০ সুস্থ মানুষের সংগৃহীত এক্সোন থেকে পরিসংখ্যান করে খুঁজে পান অন্তত ১০টি জিনের ত্রুটি সিজোফ্রেনিয়ার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এ যাবত প্রাপ্ত জিন নিয়ন্ত্রক ৭২০টি জেনেটিক মার্কারের মধ্যে ( মার্কার হলো DNA এর এমন বিশেষ ধরনের সিকোয়েন্স ক্রোমোজোমে যার ফিজিক্যাল অবস্থান জ্ঞাত, এই ধরনের সিকোয়েন্স নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী অজ্ঞাত জিন ট্র্যাকিং এর কাজে ব্যবহৃত হয়) ২টি জিন , GRIN2A এবং SP4 ওভারল্যাপ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,GRIN2A এবং তৃতীয় আরেকটি জিন GRIA3 সেই সব ব্রেইন রিসেপ্টর এনকোড করে যেগুলো মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার গ্লুটামেট সংশ্লেষ করে। দীর্ঘদিন ধরে গবেষকগণ সন্দেহ করতেন যে গ্লুটামেট পাথওয়ে সিজোফ্রেনিয়ার সাথে সম্পর্কিত কেননা PCP এবং ক্যাটামিন নামের দুটো ড্রাগ এর রিসেপ্টরকে ব্লক করে দেয় যার ফলে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। বর্তমান গবেষণার ফল সেটা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করে। ১০টি জিনের বাকিগুলো সরাসরি মার্কারের সাথে ওভারল্যাপ না করলেও সিন্যাপটিক ও নিউরাল প্রসেস যেমন ডোপামিন সংশ্লেষণ, ক্যালসিয়াম চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির সাথে সম্পর্কিত বলে এই রোগের বিস্তারিত উন্মোচনে সহায়ক হতে পারে।
সিজোফ্রেনিয়ার পরিবেশগত প্রভাবের মধ্যে রয়েছে ইনফেকশন, গর্ভকালীন মায়ের ওপর
শারীরিক-মানসিক পীড়ন ও অপুষ্টি, শৈশবকালীন ট্রমা ও বৈষম্যমূলক আচরণ, নগরায়ন, ড্রাগসের ব্যবহার ইত্যাদি।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার ও ধর্ম
ধর্মীয় বিভিন্ন ক্যারেক্টারের সঙ্গে ইন্টারেকশন এবং এর ফলে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভ বাইপোলার ডিজঅর্ডারের সাথে সম্পর্কিত, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রম বা ডিলিউশন যেমন- প্যারানয়েড ডিলিউশন, ডিলিউশন অব রেফারেন্স, ডিলিউশন অব গ্র্যান্ডিয়ার ইত্যাদি। “শয়তান আমাকে দেখছে, অনুসরণ করছে, অপেক্ষা করছে আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য, যদি আমি এমন কিছু করি যা তার পছন্দ নয়”, অথবা, “যদি আমি জুতো পরি, ঈশ্বর আমার জুতোয় আগুন ধরিয়ে দেবে তাই আমার সর্বদা খালি পায়ে থাকা উচিত”– এ ধরনের চিন্তা হলো প্যারানয়েড ডিলিউশন। কোনো ঘটনার পেছনে বিশেষ কোনো মেসেজ খুঁজে পাওয়া বা কোনো গূঢ় অর্থ বা উদ্দেশ্য আছে, এমন ভাবনার নাম ডিলিউশন অব রেফারেন্স। “ঈশ্বর আমাকে তোমাদের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন, সাধারণ মানুষ। তিনি বলেছেন আমার কোনো সাহায্যের দরকার নেই, কোনো ওষুধের দরকার নেই। আমিই কেবল স্বর্গারোহন করব আর তোমরা সকলে নরকে যাবে” অথবা, “আমার মধ্য দিয়ে যীশুর পুনর্জন্ম হয়েছে” —- এ ধরনের প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় ডিলিউশন অব গ্র্যান্ডিয়ার। আরও পড়ুনঃ হারুন নিজেই তার ব্রেন হ্যাকার
এবার তাহলে আপনারাই বলুন, লুসিফার সত্যিই সিস্টারের ওপর ভর করেছিল কিনা।
তথ্যসূত্র:
- Satan’s Enigma: ‘Possessed’ Nun’s 17th-Century Letter Deciphered
- Sister Maria Wrote an Evil Letter Dictated By Satan
- Intensive DNA search yields 10 genes tied directly to schizophrenia
- Religious Factors in Bipolar Disorder