ধরুন আপনি ২২ বছরের যুবক যিনি ভাগ্যের সন্ধানে নতুন একটি দেশে যাওয়ার কথা ভাবছেন। আগামীকাল সকালে পশ্চিম ইউরোপের আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী কোন বন্দর থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে ২ টা জাহাজ ছেড়ে যাবে। একটি মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে অন্যটি যুক্তরাষ্ট্রের। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় আপনি যুক্তরাষ্ট্রের পথে যাওয়া জাহাজেই উঠবেন। কিন্তু সময়টা ২০২১ না হয়ে ১৬৫০ হলে আপনি কোন জাহাজটায় উঠতেন বলে আপনার মনে হয়? আপনি উঠতেন মেক্সিকোর জাহাজে। কারন সেই সময়ে মেক্সিকো ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চলের একটি। মায়া, অ্যাজটেক আর ইনকাদের থেকে পাওয়া সম্পদ আর সভ্যতা, সেই সাথে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের বিপুলতা শুধু মেক্সিকো না, সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকাকে করে তুলেছিল ইউরোপীয়দের কাছে এক আরাধ্য গন্তব্য। সোনা, রুপা, লোহার মতো মূল্যবান খনিজ থেকে শুরু করে প্রচুর চাষযোগ্য জমি, দাস বানানোর মতো প্রচুর আদিবাসী মানুষ সবই ছিলো দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায়। তার উপর আবহাওয়া ছিলো উষ্ণ যা বসবাসের জন্য খুবই উপযোগী। যেমন বর্তমান আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স শহরটি নামকরণ করা হয়েছে দুইটি স্প্যানিশ শব্দ “বুয়েনস” এবং “এয়ার্স” থেকে। যার অর্থ নির্মল বাতাস।
অন্যদিকে উত্তর আমেরিকা অর্থাৎ বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ছিলো তুলনামূলক দূর্গম, বসবাসের অযোগ্য, প্রচন্ড ঠান্ডা। না ছিলো দক্ষিণের মতো সোনা, রুপা না ছিলো দাস বানানোর মতো আদিবাসী মানুষ। চাষযোগ্য জমি ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই ছিলো না। তাও আবার দক্ষিণের মতো সারাবছর চাষযোগ্য না, শীতের সময় ফসল হয় না। ইংরেজ আর ফরাসিরা যে আমেরিকার উত্তরাংশে ঔপনিবেশ স্থাপন করেছিলো সেটা এজন্য না যে উত্তরাংশ বেশি উৎপাদনশীল বরং এজন্য স্থাপন করেছিলো যে আমেরিকার বাকি অংশ স্প্যানিশ ও পর্তুগীজদের দখলে ছিলো এবং তাদের কাছ থেকে দক্ষিণের কোন অংশ ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা ইংরেজ ও ফরাসিদের ছিলো না। তাহলে ঠিক কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আজ উত্তর আমেরিকা একসময়ের সম্মৃদ্ধ দক্ষিণ আমেরিকার তুলনায় অনেক বেশি উন্নত? ( দক্ষিণের তুলনায় উত্তর আমেরিকার মাথাপিছু আয় প্রায় ৯ গুণ বেশি।)

অনেকেই হয়তো পরিবেশ, সংস্কৃতি, স্প্যানিয়ার্ড আর ইংরেজদের মানসিক পার্থক্য বা এই জাতীয় কিছু বিষয় টেনে আনতে পারেন। তাই তাদের জন্য শুরুতেই দুই নোগালেস শহরের গল্প বলি। একই নামের দুইটি শহর। একটি যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা স্টেটে অন্যটি মেক্সিকোর সনোরা স্টেটে। সত্যি বলতে কি এই দুইটি শহর আসলে একটি শহরই ছিলো। ১৮৪৮ সালের স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ মিলিয়ন ডলারের(বর্তমান মুল্যে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার) বিনিময়ে নিউ মেক্সিকো (বর্তমান নিউ মেক্সিকো, আরিজোনা এবং ক্যালিফোর্নিয়া) কিনে নিলে নতুন করে নির্ধারিত হয় মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত। সেই সময়ে যে সীমান্ত রেখা টানা হয় তা নোগালেস (স্প্যানিশ উচ্চাতনে নোহালেস) শহরের মাঝখান দিয়ে যায় যার ফলে শহরের একটি অংশ পড়ে মেক্সিকোর সনোরা স্টেটে অন্য অংশ পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা স্টেটে। এবারে দুইটি শহরের বর্তমান অবস্থা যদি দেখি তাহলে আমরা দেখতে পাবো আরিজোনার নোগালেস শহরের মাথাপিছু আয় যেখানে ৫০ হাজার ডলারের বেশি সেখানে সনোরার আরিজোনা শহরের মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলারের মতো। এছাড়াও অন্যান্য সূচক বিবেচনায় নিলে দেখা যায় আমেরিকার নোগালেস শহর মানুষের গড় আয়ু, শিক্ষার হার, সামাজিক নিরাপত্তা সব সূচকেই এগিয়ে যোজন যোজন এগিয়ে মেক্সিকোর নোগালেস থেকে। একই ভৌগোলিক অবস্থান, একই পরিবেশ, একই খাদ্যাভ্যাস, একই সংস্কৃতি এবং একই স্প্যানিশ জাতির মানুষ থাকার পরেও কেন আমেরিকার নোগালেস যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, গতিশীল এবং নিরাপদ একটি শহর সেখানে মেক্সিকোর নোগালেস অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এবং চুরি ডাকাতিতে বিপর্যস্ত একটি শহর?এই লেখায় দুই নোগালেস আসলে প্রতিনিধিত্ব করছে দুই আমেরিকার।

সপ্তদশ শতক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর আমেরিকার সুপার পাওয়ায় হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত ইতিহাস বিশ্লেষণ করে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো দুই আমেরিকার অর্থনৈতিক পার্থক্যের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলো। ইউরোপীয়দের আমেরিকা দখলের ইতিহাস থেকেই শুরু করি। আমেরিকা দখল শুরু ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে ক্যারিবিয়ান এলাকা দখলের মধ্য দিয়ে। এরপর আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে প্রথম ইউরোপীয় কলোনি গড়ে তোলেন স্প্যানিশ নাবিক হুয়ান দিয়াজ দে সলিস লা প্লাটা নদীর তীরে ১৫১৬ সালে।
তবে ইউরোপীয়রা সেখানে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বরং আদিবাসীদের সাথে সংঘর্ষে হুয়ান দিয়াজ নিজেই নিহত হন। তবে আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে প্রথম স্থায়ী ইউরোপীয় কলোনি গড়ে তোলেন স্প্যানিশ নাবিক হার্নান কর্তেজ এজটেকদের রাজধানী তেনোচতিতলান দখলের মাধ্যমে ১৫২১ সালে যা বর্তমান মেক্সিকোর পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। এছাড়াও স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ফ্রান্সিসকো পিজারো ১৫৩১ সালে ইনকা রাজা আতাহুয়ালপাকে পরাজিত করার মাধ্যমে দখল করেন আমেরিকার পশ্চিমাংশ যা বর্তমান বলিভিয়া, পেরু এবং চিলির অংশ। তো এই দখলের উদ্দেশ্য কি ছিলো? আমেরিকার ভূমি দখল করে চাষবাস করা। নাহ বিষয়টি মোটেও এমন ছিলো না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আদিবাসী রাজাদের রত্ন ভান্ডারে থাকা সোনাদানা এবং দামী পাথরগুলো ছিনিয়ে নিয়ে ইউরোপে পাচার করা বা ইউরোপীয় ভদ্র ভাষায় রপ্তানি করা। তো আদিবাসী রাজাদের রত্ন ভান্ডার দখলের যে কৌশল তার উপরেই দাড়িয়ে যায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্প্যানিশ মডেল।এই রত্নভান্ডার দখলের যে কূটকৌশল তার প্রথম শিকার আজটেক রাজা মকটেজুমা এবং ইনকা রাজা আতাহুয়ালপা।
কৌশলটা মোটামুটি এমনঃ প্রথমে ইনকা এবং আজটেকদের শহরে ঢুকে বানিজ্যের কথা বলে সাধারণ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করা। সুযোগ বুঝে ইউরোপে বসন্ত রোগীদের ব্যবহৃত কম্বল বা জামা তাদের উপহার দেয়া। যেহেতু বসন্ত বা পক্স রোগের সাথে আমেরিকার আদিবাসীরা পরিচিত না, তাই কোন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও নেই তাদের শরীরে। ফলাফল রাজ্য জুড়ে বসন্তে হাজার হাজার মানুষ মরতে থাকে। বসন্তের প্রকোপে রাজ্য যখন বিপর্যস্ত তখন সুযোগ বুঝে রাজাকে বন্দী করা। এরপর রাজার মুক্তিপণ হিসেবে স্বর্ণ, রুপা এবং অন্যান্য রত্নপাথর দাবি করা। বিশাল একটা ঘর দেয়া হতো। বলা হতো সেই ঘর সোনা দিয়ে ভর্তি করলে রাজাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সেই ঘর ভরে গেলে রাজার উপর শুরু হতো ভয়ংকর শারিরীক নির্যাতন। বলা হতো এমন আরেকটি ঘর সোনাদানায় ভর্তি না করলে নির্যাতন বন্ধ হবে না। তখন রাজার আদেশে জনগণ রাজ্যের আনাচ কানাচ থেকে সোনাদানা এনে ঘর ভর্তি করতো। সেই ঘর ভর্তি হওয়ার পর সেই রাজাদের ছেড়ে দেয়া হতো ব্যাপারটা এমন না। বরং রাজ্যের সব সোনাদানা হাতিয়ে নেয়ার পর রাজাকে মেরে ফেলা হতো আর রাজ্যের সাধারণ মানুষকে দাস বানিয়ে তাদের দিয়ে কৃষি কাজ করা হতো।
যার ফলে ইউরোপের বাজারে আমেরিকান আলু, মরিচ, ভুট্টা, তামাক প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হতে থাকে। ফলে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে স্প্যানিশ কলোনি এবং স্পেনের মূল ভূখণ্ড। এই আজটেক আর ইনকাদের উপর প্রয়োগ করা এই ঔপনিবেশিক মডেল ফলো করে স্প্যানিশরা অন্যান্য ছোট বড় অনেক রাজ্য এবং রাজ্যের ধন দৌলত দখল করে। কিন্তু যে মডেল স্প্যানিশ কলোনিতে বিপুল ধন সম্পদ এনে দিয়েছিলো সেই মডেলই কালের বিবর্তনে স্প্যানিশ কলোনি তথা দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। কিভাবে?
তা নিয়ে আলোচনা করার আগে বরং উত্তর আমেরিকার দিকে কিছুটা নজর দেয়া যাক।ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে স্প্যানিশ আর পর্তুগিজরা যখন আমেরিকায় কলোনি গড়ে বিপুল সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠছে তখন ইংল্যান্ড নিজেদের মধ্যকার গৃহ যুদ্ধ আর চরম দারিদ্র্যে পর্যুদস্ত। কলোনি গড়ে বৈশ্বিক সম্পদ আর ক্ষমতার দাবিদার হওয়ার কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু একটা সময় বাধ্য হয়েই আমেরিকা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ১৫৮৮ সালে স্প্যানিশ রাজা ফিলিপ ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন। যদিও সে যাত্রায় ইংল্যান্ড যুদ্ধে জিতে যায়, কিন্তু এই স্প্যানিশ আক্রমণ তাদের বুঝিয়ে দেয় নতুন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ঔপনিবেশ না গড়ে শক্তিশালী হওয়া যাবে না। আর না গেলে স্প্যানিশ বা পর্তুগীজদের কাছেই নিজেদের অস্তিত্ব হারাতে হবে।

Anglo-Spanish War (1585–1604) – Wikipedia
সেই সময় ১৫৮৮ সালেই ক্যারোলাইনাতে প্রথম কলোনি গড়ে তোলার চেষ্টা করে ইংল্যান্ড। কিন্তু ব্যর্থ হয়। পরে আরও ব্যাপক প্রস্তুতির পর ১৬০৭ সালে সেনা কর্মকর্তা জন স্মিথের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের ভার্জিনিয়া কোম্পানি ৫০০ জন অভিযাত্রী নিয়ে জাহাজ পাঠায় আমেরিকার উদ্দেশ্যে। এই জাহাজ নোঙ্গর করে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের জেমসটাউন শহরে। সেই সময়ে রাজা প্রথম জেমসের নামে নামকরণ করা হয় শহরটির। ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিলো মূলত স্প্যানিশদের মডেলই কাজে লাগানো। অর্থাৎ স্থানীয় রাজাকে বন্দী করে সোনাদানা আত্মসাৎ এবং স্থানীয় জনগণকে দাস বানিয়ে কৃষি কাজ করানো। কিন্ত অল্প দিনেই জন স্মিথ বুঝতে পারেন সেই আশায় গুড়েবালি। যে মডেল দক্ষিণ আমেরিকায় কাজ করেছে তা উত্তর আমেরিকায় কাজ করবে না। এর মূল কারণ হলো ইনকা বা আজটেকদের মতো এদের বড় আকারে কোন নগর রাষ্ট্র নেই, সোনা রুপা নেই বা তারা সোনা রুপা জমানোতে বিশ্বাসী না, এখানকার আদিবাসীরা ইউরোপীয়দের সাথে কোন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে আগ্রহী না এবং এরা ছোট ছোট ক্ল্যান আকারে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
এছাড়াও দক্ষিণের তুলনায় এখানে মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তাই দাস বানিয়ে তাদের দিয়ে কৃষি কাজ করানোর চেষ্টাও বৃথা। বিপুল উৎসাহ নিয়ে শুরু করা এই অভিযানের ফলাফল হলো ভয়ঙ্কর। শীত শুরু হতেই প্রচন্ড খাদ্যাভাব আর বাসস্থান সংকটে পড়লো ইংরেজরা। স্থানীয় আদিবাসীরাও কোন সাহায্য করেনি তাদের। ফলে শীত শেষে ৫০০ অভিযাত্রীর মধ্যে মাত্র ৬০ জন বেঁচে ছিলেন। এরপর নতুন পথ ধরে ইংরেজরা। কৃষক, কামার, জেলে, দর্জি বা এই জাতীয় স্কিলড মানুষ তারা ইংল্যান্ড থেকে আনে। ১৬০৯ সালে জন স্মিথের বদলে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় থমাস গেটসকে। তিনি ও তার সহকারী থমাস ডেলে মিলে জেমসটাউনকে ঘিরে একটা কমিউনিটি শহরের মতো গড়ে তোলেন। অনেকটা কাজের বিনিময়ে খাদ্য নীতির অনুসরণে তিনি সবাইকে কমিউনিটির জন্য কাজ করতে বাধ্য করেন। এছাড়াও কেউ চুরি করলে বা আদিবাসীদের সাথে মেলামেশা করলে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মতো কঠোর আইন করেন। এই পরিকল্পনা প্রথম কিছুদিন কাজ করলেও কয়েক বছরের মধ্যেই ভেস্তে যায়। দেখা গেলো নিজেদের কমিউনিটিতে বসবাস করার বদলে বরং আদিবাসী কোন নারীকে বিয়ে করে তাদের দলে ভীড়ে গেলেই বরং জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়। ফলে নতুন প্ল্যান করতে বাধ্য হয় ভার্জিনিয়া কোম্পানি।

১৬১৮ সালে নতুন আইন করে প্রত্যেক ইউরোপীয় পুরুষ অভিবাসীকে ৫০ একর ভূমি দেয়া হয়। এছাড়াও তার সাথে আসা প্রত্যেক নারী ও কৃতদাসের জন্য তার মালিকানায় আরও ৫০ একর করে ভূমি দেয়ার আইন করা হয়। ফলে অনেক ইংরেজ আগ্রহী হয়ে ওঠে উত্তর আমেরিকার প্রতি। যদিও তা সোনাদানা আর ফল ফসলে ভরা দক্ষিণের মতো অতটা লোভনীয় ছিলো না। কারণ এখানে ফ্রিতে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার সুযোগ ছিলো না। তবে কাজ করে খেতে চাইলে সুযোগ আছে। এছাড়াও এর একবছর পর ১৬১৯ সালে জেমসটাউন জেনারেল এসেম্বলি প্রতিষ্ঠা হয় যার প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দিতেন শেতাঙ্গ পুরুষেরা। যদিও সেখানে নারী এবং কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের ভোট দেয়ার সুযোগ ছিলো না তারপরও সেটিই ছিলো পৃথিবীর প্রথম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সূচনা।
এর ফলে ২ টা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে।১. উত্তর আমেরিকায় স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠী তৈরির সুযোগ কমে আসে। বিনা পরিশ্রমে সোনাদানা দিয়ে ধনী হওয়ার সুযোগ নেই বলে শাসকগোষ্ঠীর চাটুকার কোন অভিজাত শ্রেণিও গড়ে ওঠেনি।২. খুব সামান্য ট্যাক্স আর প্রচুর স্বাধীনতা থাকায় মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটতে থাকে যেখানে দক্ষিণের মতো কোন জমিদার বা রাজাকে সন্তুষ্ট করার মতো বিষয় ছিলো না।এর মধ্যে উত্তরে স্প্যানিশ মডেলের অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়নি এমন না। কৃষি ভিত্তিক সামন্তবাদের মাধ্যমে ক্যারোলাইনা এবং মেরিল্যান্ডে অভিজাততন্ত্রের চেষ্টা করেছিলেন একটা গোষ্ঠী। অনেকটা ভারতবর্ষে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আদলে কিছু জমিদার বা লর্ডকে হাজার হাজার একর জমি দিয়ে তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় ছিলো কৌশল।
দুঃখজনক ভাবে এই পরিকল্পনার বড় সমর্থক ছিলেন ইংরেজ দার্শনিক জন লক। কিন্তু ততোদিনে বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে ১৩ টি কলোনি হড়ে উঠেছে। অভিজাততান্ত্রিক ক্যারোলাইনা এবং মেরিল্যান্ড বাদে অন্য ১১ টি কলোনিতে সুযোগ সুবিধা বেশি থাকায় মানুষ সেইদিকেই আকৃষ্ট হয়। বরং অভিজাততন্ত্রের জের ধরে ক্যারোলাইনা দুই ভাগ হয়ে যায়। যার ফলে সবাই বুঝে যায় সামন্তবাদ বা অভিজাততন্ত্র এখানে কাজ করবে না।
ফলে ১৭২০ সালের মধ্যে ১৩ টি কলোনির শাসন ব্যবস্থা প্রায় একই রকম হয়ে যায় যার ভিত্তি ছিলো গনতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং রাজা বা অভিজাতদের বদলে সম্পদে সাধারণ মানুষের মালিকানা। অন্যদিকে স্প্যানিশ কলোনিগুলোতে খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য তৈরি করে প্রচন্ড ক্ষমতাবান এক অভিজাত শ্রেণির যেখানে সম্পদ একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত হয়। যার ফলে নিজ দেশেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে ওঠে অধিকাংশ মানুষ।
এছাড়াও যেহেতু সম্পদ দখলই ধনী হওয়ার একমাত্র উপায় তাই গড়ে ওঠে বড় বড় সব মাফিয়া চক্র যা তরুণ প্রজন্মকে কাজের বদলে খুন জখমের দিকে বেশি আগ্রহী করে তোলে। দক্ষিণ আমেরিকায় আজকের দিনেও এইসব মাফিয়া চক্র থেকে বের হতে পারেনি।
এদিকে ১৭৫৬ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার যুদ্ধে ইংরেজরা জিতে ১৩ কলোনির স্বকীয়তা রক্ষা করলেও যুদ্ধের খরচ বাবদ অতিরিক্ত কর দাবি করে ১৩ কলোনির কাছে। যার ফলে ১৩ কলোনি বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় ১৭৭৬ সালে। ইংরেজরা এই নিয়ে ঝামেলা শুরু করলেও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে প্যারিস ট্রিটির মাধ্যমে ১৭৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা ছিলো প্রথম কোন ইউরোপীয় কলোনির স্বাধীনতা লাভ। এরপর ব্রিটিশদের কাছে হারানোর ভয়ে ১৮০৩ সালে নেপোলিয়ন উত্তর আমেরিকার ফরাসি কলোনি লুজিয়ানা যা কিনা সেই ১৩ কলোনির মোট আয়তনের সমান, আমেরিকার কাছে ১৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয় (চলতি মূল্যে যা প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার হবে)। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন বেড়ে দ্বিগুণ হয়। নিচের ছবিতে আমেরিকার মানচিত্রের সাদা অংশ ফ্রান্সের কাছ থেকে কেনা লুজিয়ানা। ডান পাশ বা পূর্ব অংশের হলুদ অংশটি ১৩ কলোনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র এবং বাম পাশ বা পশ্চিমের হলুদ অংশ তখনও অনধিকৃত।

এছাড়াও নিচের দিকে বা দক্ষিণাংশের টেক্সাস এবং নিউ মেক্সিকো তখনও স্প্যানিশ কলোনি। আমেরিকার বিশ্ব জয়ের সূত্রপাত এখান থেকেই শুরু হয়। এর মধ্যে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হলে সেই সুযোগটা উত্তর আমেরিকা এবং স্প্যানিশ ও পর্তুগাল নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা ২ ভাবে কাজে লাগায়। স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রিত অংশ সরাসরি শিল্পের কাঁচামাল ও খনিজ সম্পদ রপ্তানি করা শুরু করে ইউরোপে যা সেই রাজার আশির্বাদপ্রাপ্ত অভিজাত শ্রেণিকেই লাভবান করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ সহজ করে নিজেদের দেশে গড়ে তোলে হাজার হাজার ফ্যাক্টরি। বস্ত্রকল, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, শিপ বিল্ডিং, রেল হেন কোন শিল্প নেই যা আমেরিকায় তৈরি হয়নি। দক্ষিণ আমেরিকায় যে শিল্প তৈরি হয়নি ব্যাপারটা এমন না। যা হয়েছিলো তা ঐ সুবিধাপ্রাপ্ত এলিট শ্রেণির হাত ধরে যেখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো না। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের হাত ধরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিপ্লব ঘটে যায়। আইডিয়া থাকলেই খুব সহজে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যেতো যুক্তরাষ্ট্রে।
অন্যদিকে দক্ষিণে ছিলো অভিজাত আর আমলাদের দৌরাত্ম্য। ফলে ভালো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসা দাড় করানোর চেয়ে অভিজাত আর আমলাদের সাথে সখ্যতা তৈরিই ছিলো সফল হওয়ার সহজতম পথ। ১৮২০ এর পর ধীরে ধীরে স্প্যানিশ কলোনিগুলো স্প্যানিদের কাছ স্বাধীন হলেও ক্ষমতা সেই অভিজাত শ্রেণির কাছেই থেকে যায়। এলিট শ্রেণি তাদের স্বার্থ সুরক্ষায় গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। বরং নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন সামরিক জান্তা এবং স্বৈরশাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। ফলে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যুক্তরাষ্ট্রে ছিলো তা ছিলো না মেক্সিকো, পেরু বা চিলিতে।
যেমন ১৮২৪ থেকে ১৮৬৭ সালের মধ্যে ৪৩ বছরে ৫২ বার প্রেসিডেন্টের পরিবর্তন হয় মেক্সিকোতে।যুক্তরাষ্ট্রের উন্নতিতে আরেকটি বড় ফ্যাক্টর ছিলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ১৯১০ সালে মেক্সিকোতে যেখানে ব্যাংক ছিলো মাত্র ৪২ টি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক ছিলো ২৭ হাজারের বেশি। তাও আবার মেক্সিকোর মোট ব্যাংক সম্পদের ৬০% ছিলো মাত্র দুইটি ব্যাংকের হাতে কারণ মেক্সিকোতে চাইলেই আপনি ব্যাংক খুলে বসতে পারবেন না। আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে শুধু ব্যাংক না যে কোন ব্যবসা শুরু করাই ছিলো কঠিন কাজ। যার ফলে ব্যাংক ঋণ পেতে সেই এলিট শ্রেণির কাছেই ধর্না দিতে হতো। আপনার ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি আপনার ব্যবসায়িক আইডিয়া না বরং নির্ভর করতো ব্যাংকের হর্তাকর্তাদের সাথে আপনার সম্পর্কের উপর তাও অতি উচ্চ সুদে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো ছিলো ব্যক্তিমালিকানাধীন, অনেকটা আমাদের ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া সমিতিগুলোর মতো। প্রচুর ব্যাংক থাকায় ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ছিলো অনেক। ফলে ব্যবসায়িক আইডিয়া থাকলে খুব অল্প সুদে ঋণ পাওয়া যেতো। ফলে মেক্সিকো বা অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিকশিত হয় অবিশ্বাস্য গতিতে।
সেই অভিজাত আর আমলাদের দৌরাত্ম্য এখনো দক্ষিণে প্রচলিত৷ ছোট একটা উদাহরণ দেই। আমেরিকার অন্যতম ধনী ব্যক্তি বিল গেটস, অন্যদিকে মেক্সিকোর কার্লোস স্লিম। কিন্তু দুই জনের ধনী হয়ে ওঠার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। বিল গেটসের মাইক্রোসফট পৃথিবীর কম্পিউটার ব্যবহারের ধারণাই বদলে দিয়েছিলো, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনী কোম্পানি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ধনী হয়েছিলেন। অন্যদিকে কার্লোস স্লিম ধনী হয়েছিলেন মেক্সিকোর সরকারি মোবাইল ফোন সেবা প্রতিষ্ঠান টেলিমেক্সের শেয়ার কিনে, তাও আবার দূর্নীতি আর সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের ঘুষ দেয়ার মাধ্যমে। মাইক্রোসফট অসম্ভব সফল হওয়ার পরও সামান্য ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্রাউজারকে উইন্ডোজের একমাত্র ব্রাউজার হিসেবে রাখতে পারেননি, অন্যদিকে স্লিম টেলিমেক্সের মাধ্যমে সমগ্র মেক্সিকোর মোবাইল সেবাকে মনোপোলাইজ করে রেখেছেন।
তো এই লেখার মূল পর্যবেক্ষণ ছিলো একটি জাতির সফলতা দুই-চার-১০ বছরের বিষয় না। বরং শত বছরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফসল। মেক্সিকো বা অন্যান্য দক্ষিণ আমেরিকার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সফলতার মূল কারণ মূলত ৩ টি।
- অভিজাতদের তুলনায় মূল ধারার অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
- ব্যবসা সহজিকরণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের গনতান্ত্রিক ধারা বারবার ব্যহত হয়েছে। নব্বইয়ের পর গনতন্ত্র ফিরে এলেও বর্তমানে স্প্যানিশ কলোনিগুলোর মতোই আওয়ামী অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা কি শিখতে পারি বলে আপনার মনে হয়?
লেখকের আরো লেখাঃ সুখী হতে কি লাগে?
তথ্যসূত্রঃ
- Why Nations Fail: A book that explains the reasons behind success and failures of nations
- Good ideas, but missing analysis, Bill Gates, Review , Additional Reference