Can't find our books? Click here!
জেন সাধু হওয়ার ব্যর্থ সাধনা

জেন সাধু হওয়ার ব্যর্থ সাধনা

স্বর্গ কোথায় থাকে? মৃত্যু পরবর্তী কোন জগতে স্বর্গ বলে কিছু আছে কিনা আমি জানি না। তবে এই দুনিয়ায় স্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা হচ্ছে একুশ বছরের তরুনের মন। তো সেই একুশ বছর বয়সে আমি এক অসম্ভব রূপবতী তরুনীর প্রেমে পড়েছিলাম। ও কতটা রুপবতী ছিলো তার একটা উদাহরণ দেই। ওকে নিয়ে একবার বানিজ্য মেলায় গিয়েছিলাম। ওখানে চারটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ওকে ওদের প্রতিষ্ঠানের কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলো ওদের পণ্যের মডেল হতে চাইলে যেন যোগাযোগ করে। ভার্সিটিতে ওর সাথে কোথাও বসে হয়তো গল্প করছি আশেপাশের সবাই যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে আমি বুঝতে পারতাম। ওকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেলে বন্ধুরা সবাই ওর সাথে একটা ছবি তোলার জন্য অস্থির হয়ে যেতো। আমার পরম সৌভাগ্য বলতে হয় যে ও আমার প্রেমে সাড়া দিয়েছিলো।ওর সাথে পরিচয় হয়েছিলো ইউনিভার্সিটি গ্যালারিতে। আমার ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস কোর্সের একটা এসাইনমেন্টের কপি ছিলো ক্লাসের এক বন্ধু মিথির কাছে। তখন বাজে সাড়ে বারোটা। একটার ক্লাসে এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। মিথিকে ফোন করলাম। ও বললো গ্যালারিতে যেতে। গ্যালারিতে মিথির সাথে ও বসেছিলো। একটা মানুষের সাথে প্রথম পরিচয়ে তার দিকে ঠিক কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়? এক দিকে ভদ্রতা অন্য দিকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার তীব্র আকর্ষণে আমার তখন দিশেহারা অবস্থা। ও মিথির স্কুল ফ্রেন্ড। আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে। তবে ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। প্রথম পরিচয় ঐটুকুই। ওর নামটা বলতে পারছি না বলে দুঃখিত। ধরে নিই ওর নাম রুপাই।রুপাইয়ের সাথে পরিচয়ের পর দুই সপ্তাহ আমার কেটেছে অসহ্য রকমের এক অস্থিরতায়। মিথির সাথে ক্যালকুলাস ক্লাসে দেখা হলেই ভাবতাম ওকে বলি রুপাইকে ফোন দিতে। আবার যেন রুপাইয়ের সাথে একটু দেখা হয়। কিন্তু লজ্জায় সংকোচে বলতে পারতাম না। আমি বরং ক্যাম্পাসের এ’মাথা ও’মাথা ঘুরতাম যদি রুপাইকে দেখতে পাই তাহলে নিজ থেকেই এগিয়ে গিয়ে কথা বলবো। কিন্তু পরের দুই সপ্তাহে একদিনও দেখিনি ওকে। দুই সপ্তাহ পর একদিন আমাকে দেখে পেছন থেকে রুপাই নিজেই ডাক দেয়। আমাদের ক্যাম্পাসের আট নম্বর গেইট খুবই বিখ্যাত। কারণ এখানে দাড়িয়ে আমার মতো পোংটা পোলাপান সিগারেট খায়। তো সেখানে দাড়িয়ে সিগারেট টানছি এমন সময় পেছন থেকে একটা অপরিচিত কন্ঠ আমার নাম ধরে ডাক দেয়। পেছনে তাকিয়ে দেখি রুপাই। আমি ভদ্রতার বশে সিগারেট ফেলে দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে যাই। টুকটাক কথা হয়। জানতে পারি আমার বাসার কাছেই ওর বাসা। মোটামুটি আমার বাসা থেকে জোরে একটা চিৎকার দিলে ওর বাসায় শোনা যাবে এতোটা কাছে। সেদিনের মতো আমার ক্লাস শেষ। প্ল্যান ছিলো সিগারেট টেনে লাইব্রেরিতে বসে কাফকার দ্যা ক্যাসেল পড়বো। ও বাসায় যাবে শুনে প্ল্যান বদলে ফেলে বলি “চলো একসাথে বাসায় যাই।”ওর রিকশা ডাকতেই আমি বললাম “চলো হাঁটতে হাঁটতে যাই।”ও রাজি হলো।

আসলে আমি চাচ্ছিলাম যতোটা সম্ভব বেশি সময় ওর সাথে থাকতে। হাঁটতে হাঁটতে গেলে কিছুটা সময় বেশি পাওয়া যাবে। তো বাসায় যেতে যেতে ২০ মিনিটে অনেক কথা হলো। ফোন নম্বর নিলাম। ফেইসবুক আইডি নিলাম। রাতে নক দিলাম মেসেঞ্জারে। টুকটাক চ্যাট হলো। ও নিজ থেকেই বললো পরের দিন ভার্সিটিতে গেলে যেন ওকে ফোন দেই। এরপর সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারিনি। একটার পর একটা সিগারেট টেনেছি। কারণ ততক্ষণে আমার মাথায় চেপেছে আরেক নতুন চিন্তা। একেতো আমি নিশ্চিত নই সে সিঙ্গেল কি না। তার উপর সুদর্শন হ্যান্ডসাম পুরুষ বলতে যা বোঝায় আমি তা নই। আবার পয়সাওয়ালা বলতে যা বোঝায় তার ধারে কাছেও আমি নাই। মানে সে সিঙ্গেল হলেও তাকে পটানোর কোন রকমের যোগ্যতাও যে আমার নেই এই চিন্তাটা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলো।নিতান্তই ভাগ্যের জোরে রুপাই আমাকে ভালোই পাত্তা দিচ্ছিলো। ক্যাম্পাসে প্রতিদিন দেখা হতো। আবার বাসা কাছাকাছি হওয়াতে বিকেলে বা সন্ধ্যায় আড্ডা দিতাম।

woman holding hands with person facing ocean

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যারা থাকেন তারা কম বেশি জানেন ৬ বছর আগে ডি ব্লকের পর বসুন্ধরাকে আর শহর বলেই মনে হতো না। মনে হতো গ্রাম। মেহেদি মার্টের পাশে রোড ডিভাইডারের ঘাসের উপর বসে আমরা গল্প করতাম আইসক্রিম খেতাম। কি যে আশ্চর্য সুন্দর ছিলো সময়গুলো!মাস খানেক পরের কথা। ততো দিনে আমরা এক জন আরেক জনের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছি। যদিও ঠিক প্রেম করছিলাম না। তবে আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের চেয়ে দুই ডিগ্রি বেশি এইটুকু নিশ্চিত। আর আমি বুঝতে পারছিলাম রুপাই এটাকে চার ডিগ্রি উপরে নিতে চায়। মেহেদি মার্টের ছাদে বারবিকিউ রেস্তোরা ছিলো। ওখানে বসে বারবিকিউ চিকেন খাচ্ছিলাম। খাওয়া প্রায় শেষ। ওর পায়ের দিকে চোখ যায় আমার। তার আগের দিন ও নতুন জুতা কিনেছিলো। আমি ছিলাম ওর সাথে জুতা কেনার সময়। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি “কালকের কেনা নতুন জুতা পড়োনি কেন?””তোমার জন্যইতো পড়তে পারি না। হাই হিলের জুতা পড়লে তোমার পাশে আমাকে বেশি লম্বা লাগে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না।”একজন খাটো মানুষের জীবনে এর চেয়ে মধুর খোঁচা আর কি হতে পারে?

যাই হোক এমন সময় ওর বাবা ফোন দেয়। ও যখন কথা বলছিলো আমার মাথায় হুট করেই একটা প্রশ্ন আসে। ও আমার ফ্যামিলি বিষয়ে খুঁটিনাটি সব আমাকে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিলো। কিন্তু আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এতোটাই ঘোরের মধ্যে ছিলাম যে আসলে কোন দিন ওর বাবা কি করে এটাও জিজ্ঞেস করিনি। ফোন রাখতেই ওকে ওর বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। উত্তরে ও যা বললো তাতে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। ওর বাবা সম্পর্কে এখানে সরাসরি বলাটা সমীচীন না। তবে এইটুকু বলতে পারি উনি এতোটাই ক্ষমতাধর মানুষ যে আমার সাথে ওনার মেয়ের প্রেম ভালোবাসায় যদি উনি বিরক্ত হন তাহলে ওনার ঠেঙ্গানি সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। একটা মাস ভালোই যাচ্ছিলো। এরপর আবার আমার রাতের ঘুম হারাম। একদিকে মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো আবার কিছুতে মন থেকে ওর চিন্তা সরাতে পারছি না। এই সময়ে আমি এনালগ ইলেকট্রনিকসের কোর্সটা করছিলাম। যে স্যার কোর্সটা নিতেন উনি জাপানে পড়াশোনা করেছেন। সেই সূত্রে জেন দর্শনের সাথে ওনার পরিচয়। জেন দর্শন দ্বারা উনি বেশ প্রভাবিত ছিলেন। ক্লাসে মাঝেমধ্যে জেন সাধুদের গল্প বলেন। একদিন একটা গল্প আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিলো। তো সেই গল্পটা আগে বলি। এক জেন সাধুর প্রতিবেশী এক তরুনী মেয়ে ছিলো। অবিবাহিত মেয়েটা হঠাৎ একদিন জানতে পারে সে গর্ভবতী। মেয়ের মা বাবাও জানতে পারে ব্যাপারটা। মেয়েটাকে খুব জোরাজুরি করার পর মেয়েটা বলে ঐ জেন সাধু তার অনাগত সন্তানের বাবা। মেয়ের মা জেন সাধুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে উনি কিছুই বলেন না। চুপচাপ থাকেন। নিরবতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ ধরে পুরো গ্রাম রটে যায় এই কাহিনী। একজন সম্মানিত জেন সাধুর দ্বারা এমন একটা কাজ হতে দেখে সবাই তাকে নিয়ে ছি ছি করতে থাকে। তার সম্মান ধূলোয় মিশে যায়। এক সময় মেয়েটা একটা ছেলে সন্তান প্রসব করে। মেয়ের মা শিশুটিকে নিয়ে ঐ সাধুর ঘরে রেখে আসে। সাধু শিশুটার সর্বোচ্চ যত্ন নেয়। এভাবে বছর খানেক পার হলে একদিন মেয়েটা জেন সাধুর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে সবার সামনে সত্যিটা স্বীকার করে যে বাচ্চার বাবা আসলে ঐ জেন সাধু না। সে বিপদে পড়ে সাধুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিলো। এরপর সবাই ভুল বুঝতে পেরে গ্রামের সবাই সাধুর কাছে ক্ষমা চেয়ে শিশুটিকে ফেরত নিতে আসে। সাধু তখন ধ্যানে বসে ছিলেন। পাশে বসে একজন পুরো ঘটনা বলে। পুরো ঘটনা শুনে সাধু খুশি বা বেজার কিছুই হলেন না। শুধু বললেন “ও এই ব্যাপার তাহলে?” এই বলে তিনি আবার ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলেন। মূলত জগৎ সংসারের প্রতি জেন দর্শনের উদাসীনতা বোঝাতে এই গল্প। ক্লাসে স্যারের মুখে এই গল্প শুনে আমিও জেন সাধুর মতো হতে চাইলাম। এমন গুরুতর পরিস্থিতিতেও যদি একজন মানুষ এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারেন তাহলে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে দিশেহারা হচ্ছি কেন আমি?

সপ্তাহ খানেক রুপাইকে খুব এড়িয়ে চলি। ফোন দিলেও খুব বেশি কথা বলি না। ক্যাম্পাসেও দেখা করি না। আমাকে বাসার নিচে আসতে বললেও আসি না। কোন না কোন ছুতোয় না করে দেই। কিন্তু আমি পাপী মানুষ। জেন সাধু না। তাই ওর কথা ভাবতে ভাবতে যখন অস্থির হয়ে উঠি আমি ধ্যানে বসি না। উড়াধুরা সিগারেট খাই। কিন্তু কিছুতেই রুপাইকে মাথা থেকে সরাতে পারি না। একদিন সেই স্যারের অফিস রুমে যাই। জেন সাধুদের নিয়ে বা জেন বুদ্ধিজম নিয়ে আরও বেশি জানতে কি বই পড়তে পারি এই বিষয়ে স্যারের কাছে পরামর্শ চাই। জেনদের নিয়ে আগ্রহ দেখানোয় স্যার খুশিই হলেন। আমাকে ছোট একটা বই দিলেন। নাম ”জেন ফ্লেশ জেন বোন”। বললেন পড়া শেষ করে ফেরত দিতে। আমি বাসায় এসে বইটা পড়া শুরু করি। আগে বইয়ের প্রথম গল্পটা বলি।এক জেন সাধুর কাছে এক যুবক গেলো জেন বুদ্ধিজমের দীক্ষা নিতে। ছেলেটার সামনে এক কাপ চা ছিলো। সাধু একটা টি পট থেকে সেই কাপে আরও চা ঢালতে থাকলেন। কাপ উপচে চা টেবিলে পড়ছিলো দেখে ছেলেটা সাধুকে বললো “থামুন। কি করছেন আপনি? ভরা কাপে চা ঢেলে তো আপনি সব নোংরা করছেন।”সাধু হেসে বললেন “তোমার অবস্থাও এই কাপের মতোই। তোমার মন মগজ সব জাগতিক আবর্জনায় ভর্তি। তাই আমি এখানে জেন বুদ্ধিজমের শিক্ষা দিলে তা উপচে পড়ে তোমাকে নষ্ট করবে। আগে জাগতিক সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে আসো।

তারপর তোমাকে জেন সাধু হওয়ার শিক্ষা দিবো।”বইতে জেন সাধুদের নিয়ে ১০১ টা গল্প ছিলো। আমি প্রথম গল্পটা পড়েই বুঝে গেলাম সামনের গল্প পড়ে বৃথাই আমার সময় নষ্ট হবে। আমার মন মগজ সব রুপাইয়ের চিন্তায় ভর্তি। শুধুশুধু তাই জেন সাধু হওয়ার আশা করা বৃথা। পরের দিন স্যারকে বইটা ফেরত দিয়ে রুপাইয়ের সাথে আবার সময় কাটাতে শুরু করি। এতোদিন যা বন্ধুত্বের দুই ডিগ্রি উপরে ছিলো এখন তা ছয় ডিগ্রি উপরে উঠেছে পার্থক্য এইটুকুই।মাস ছয়েক পরের কথা। সামার সেমিস্টার শেষ হয়েছে। সেমিস্টার ব্রেকে বাড়ি যাবো বলে ব্যাগ গুছিয়েছি। রাত বারোটায় লঞ্চ। দশটায় বাসা থেকে বের হবো। সাড়ে আটটায় রুপাই আমাকে ফোন করে বলে “বন্ধুরা মিলে বান্দরবান যাবো। আমাদের মধ্যে কেউই আগে কেওক্রাডং যায়নি। তুমি যেহেতু আগে গিয়েছো এখন আমাদের গাইড হিসেবে চলো আমাদের সাথে।” পকেটে আছে তিন হাজার টাকা। বান্দরবান ভ্রমণে এই টাকা যথেষ্ট না। আমার রুমমেটের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে দশটায় সদর ঘাটের বাসের বদলে নদ্দায় বান্দরবানের বাসস্ট্যান্ডে হাজির হই। এসে দেখি কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে রুপাই একাই দাড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করি “কি ব্যাপার তোমার বন্ধুরা কোথায়?””কেন শুধু আমাকে নিয়ে বান্দরবান যেতে কোন আপত্তি আছে?”আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি “বাসায় কি বলে এসেছো?””আমার যা ইচ্ছা বুঝিয়েছি।

তোমার এতো কিছু না জানলেও চলবে। এখন বাসে ওঠো।”আমার সব কিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছিলো। জীবনে এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভয় আর ভালো লাগার এক মিশ্র অনুভূতিতে আমি তখন দিশেহারা। কিন্তু একটা সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষ হিসেবে আমি ভালোই বুঝতে পারি ও আমার কাছে কি চাইছে। বাস চলতে শুরু করে। ও আমার বাম বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁ্ধে মাথা রাখে। এমনিতে রুপাই অনেক কথা বলে। কিন্তু সেদিন ও একদম চুপ। বাস মেঘনা গোমতি ব্রিজের উপর জ্যামে পড়লে রুপাই প্রথম কথা বলে।”আমাদের এশিয়ান কালচারে প্রেমের সবচেয়ে বড় ট্র‍্যাজেডি কি জানো?””কি?” আমি জিজ্ঞেস করি।”এখানে মহৎ প্রেম বলতে প্রেমিক প্রেমিকাকে কাছে পায়নি এমন প্রেমকেই বোঝায়। লাইলি মজনু বা রাধা কৃষ্ণ সব মহৎ প্রেমের গল্পই প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরকে না পাওয়ার গল্প। আর প্রেমিক প্রেমিকা কোন ভাবে একবার বিছানায় যেতে পারলেতো আমরা আর সেটাকে প্রেমের গল্পই বলতে রাজি না। ওটা তখন লাম্পট্য আর চরিত্রহীনতার গল্প হয়ে যায়। এই ব্যাপারটা তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হয় না?””আমি আসলে এতো কিছু ভেবে দেখিনি।”আবার সব চুপচাপ। আমি শুধু ঘুমে ভারী হয়ে আসা ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।আমরা অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর কেওক্রাডং যাইনি।

বগালেক পর্যন্ত গিয়েছিলাম। সেখানে তিন দিন থেকেছিলাম। কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি আমার জীবনে এর চেয়ে সুন্দর তিনটি দিন কখনোই আসবে না। ফেরার পথে বাসে বসে ওকে জিজ্ঞেস করি “আমার কাছে সব কিছুই কেমন অদ্ভুত লাগছে। তুমি কেন হুট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলে?””আসলে আমি তোমার আত্মাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। এভাবে তোমাকে কাছে না পেলে তা সম্ভব ছিলো না।”কথাটা আমার কাছে খুবই দুর্বোধ্য ঠেকেছিলো। মানুষের আত্মাকে কি আসলেই ছুঁয়ে দেখা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমার অপেক্ষা করতে হয়েছিলো প্রায় তিন বছর। তত দিনে রুপাইয়ের সাথে বিভিন্ন কারণে আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। একদিন অনলাইন পোর্টালে স্যারের দেয়া জেন ফ্লেশ জেন বোন বইটার একটা পিডিএফ খুঁজে পাই। বইটা আবার পড়তে গিয়ে একটা গল্প পাই বইতে। সেই গল্পটাই আগে বলি।এক জেন সাধুর ঘরে একবার চোর ঢোকে। জেন সাধু তখন ঘরে ছিলেন না। ভেতরে ঢুকে চোর অবাক। ঘরে নেয়ার মতো কোন আসবাব নেই। নেই টাকা পয়সা বা স্বর্ণ অলংকার। এই সময় জেন সাধু বাইরে থেকে এসে ঘরে ঢোকেন। চোরকে পালাতে দেখে তিনি ধরে ফেলেন। তারপর বলেন “আমার ঘরে নেয়ার মতো কিছু নেই। আমার নিজের বলতে গায়ের চাদরটা আছে। এটাই নিয়ে যাও।”চোর বেচারা ভেবাচেকা খেয়ে শেষ পর্যন্ত চাদরটা নিয়ে চলে যায়। সাধু ঘরের দরজায় দাড়িয়ে চাঁদের আলোয় চোরের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আফসোস করে বলেন ” বেচারা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে আমার পাশে বসলে আমি তোমাকে এই জোছনা দিয়ে দিতে পারতাম।

আর তুমি কিনা চাদর নিয়েই পালালে।” এখানে জোছনা বলতে সাধু আসলে জেনদের শিক্ষা আর বিশুদ্ধ মননকে বুঝিয়েছিলেন।এই গল্পটা পড়ার পর থেকেই তীব্র ভাবে আমার রুপাইয়ের কথা মনে পড়তে থাকে। রুপাই আমার আত্মা ছুঁতে চেয়েছিলো। আমি অর্বাচীন তার শরীর পেয়ে আত্মার কথাই ভুলে গিয়েছিলাম। হায়, আমি সেই চাদর চুরি করা চোরের চেয়েও অধম! গল্পটা এখানেই শেষ করেছিলাম। কিন্তু অনেকেই আমাকে ইনবক্সে নক করে জানতে চেয়েছেন রুপাইয়ের সাথে আমার বিচ্ছেদ কেন হয়েছিলো? সেই গল্প বলার আগে অন্য একটা গল্প বলি।চীনের এক সম্রাট একবার তার রাজ্যের সেরা তিন চিকিৎসককে ডেকে পাঠান এবং তাদের কাছে অমরত্ব লাভের ঔষধ বানানো সম্ভব কিনা এই বিষয়ে জানতে চান। প্রথম দুইজন অমুক তমুক জায়গায় অমুক তমুক গাছগাছালি আর ভেষজ বিভিন্ন জিনিসপত্রের কথা বলেন। এইসব আনতে পারলে অমরত্ব লাভের ঔষধ বানানো যাবে বলে মত দেন। তৃতীয় জন বলেন “মৃত্যু একটি অমোঘ সত্য। একে এড়ানোর কোন উপায় নেই।” সম্রাট তখন প্রথম দুই চিকিৎসককে মিথ্যা বলার অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেন। গল্পটা পড়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদের চীন ভ্রমণ বিষয়ক একটা বইতে। তো গল্পটা কেন বললাম সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে রুপাইয়ের সাথে বিচ্ছেদের গল্পটা বলি। রুপাইয়ের সাথে আমার তিন বছরের পথচলার এতো এতো গল্প আছে যে সব লিখলে ১০ হাজার পৃষ্ঠা লেখা যাবে। কিছু মানুষ থাকে যারা আপনার আশেপাশে থাকলে আপনার প্রতিটা মূহুর্ত গল্প হয়ে উঠবে। রুপাই ছিলো তেমন একজন মানুষ। আমি কিন্তু আবেগে আটখানা হয়ে বাড়িয়ে বানিয়ে কিছু বলছি না। আমি যেহেতু মহাপুরুষ শ্রেণির কেউ না তাই রুপাইয়ের পরও জীবনে নারী এসেছে। কিন্তু রুপাইয়ের মতো আসলে কেউ হয় না। একটা ছোট উদাহরণ দেই। বিহারি ক্যাম্পে গেছি বোবার বিরিয়ানি খেতে। বিরিয়ানি খেতে খেতে আমি রুপাইকে বললাম “বিহারিদের ব্যাপারে আমার অনেক কৌতূহল। তাদের ঘর বা জীবন যাত্রা দেখার খুব শখ আমার।” যাই হোক বিরিয়ানি শেষ করে রুপাই এক পান দোকানে পান খেতে খেতে দোকানির সাথে খুব খাতির জমালো। এরপর দোকানিকে বললো “আঙ্কেল আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। কি করতে পারি?” দোকানী ফোন করে তার মেয়েকে আসতে বলে দোকানে। দোকানির মেয়ে এসে সাথে করে আমাদের দোকানির বাড়িতে নিয়ে যায়। প্রথম ৫-৭ মিনিট ও ওয়াশরুমে ছিলো আর আমি তব্দা খেয়ে ঐ দোকানির ড্রয়িং রুমে বসেছিলাম। এর মধ্যেই দোকানির মেয়ে চা নিয়ে আসে। ও ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর দোকানির বাসার সবাই দেখি ওর সাথে ছবি তোলার জন্য ব্যস্ত। সবাই হয় মুখ দিয়ে না হয় চোখ দিয়ে বলে যাচ্ছিলো “মানুষ এতো সুন্দর হয়?” আমি হয়তো আরও এক’শ মেয়ে নিয়ে বিহারি ক্যাম্পে বিরিয়ানি খেতে যেতে পারবো কিন্তু এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতা কখনোই হবে না। যাই হোক তার সাথে আমার প্রেমের করুণ সমাপ্তি কেন হয়েছিলো সেই গল্পেই বরং ফিরে যাই। আসলে সেই গল্পটাও সহজ না।

এখানে আমার বা রুপাইয়ের কারো দোষ নেই বা কেউ কারো সাথে প্রতারণাও করিনি। গল্পটা অসমাপ্ত থাকার জন্যই শুরু হয়েছিলো তাই পরিণতিটা অসমাপ্তই থেকে গেছে। আমার জীবনের অনেক প্রথমের সাথে রুপাই জড়িয়ে আছে। এই যেমন প্রথম চুমু, প্রথম কোন নারীর চুলের গন্ধ, গায়ের কাঁপন, প্রথম কারো বাহু আকড়ে স্বপ্ন দেখা, প্রথম কারো হাতের রেখায় গল্প বোনা, প্রথম কারো ফোনের কলে হঠাৎ করে চমকে ওঠা, ব্লা ব্লা ব্লা….. এমনকি প্রায় তিন বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন সকালের প্রথম কফিটা ওর সাথেই খেয়েছি। কিন্তু এতো সবের পরেও সব প্রথমের চেয়ে যে প্রথম আমাকে আলোড়িত করেছে সবচেয়ে বেশি তা আসলে প্রেম ঘটিত কিছু না। বরং ওর কারণেই প্রথম বারের মতো আমি জীবনের শূন্যতাকে অনুভব করেছিলাম।

man learning on concrete wall

সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা যার পর থেকে আর কখনোই জীবনের মোহ আমাকে স্পর্শ করেনি। ওর মা’র সাথে আমার পরিচয় হয় ওর সাথে পরিচয়ের প্রায় দুই বছর পর ওর বড় বোনের বিয়েতে। ওর মা’কে দেখলে প্রথম নজরে যে কেউই বুঝে যাবে রুপাই আসলে ওর মায়ের ফটোকপি। সেই নাক, সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই হাসি, সেই দুধে আলতা গায়ের রং কিন্তু বুড়িয়ে যাওয়া এবং জীবনের পথ চলায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত একজন মানুষ। ওর মা’র মেরুদন্ডের হাড়ে টিউমার হয়েছে। যার ফলে হাড় ক্ষয় হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে উনি সোজা হয়ে দাড়াতে পারেন না। সারাক্ষণ বিছানাতেই থাকেন বলা যায়। দেশে বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু কেউই ওনাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারেনি। ওর মা’কে দেখার পর জীবন সম্পর্কে যাকে বলে বুদ্ধের মতো বিতৃষ্ণা চলে এসেছিলো। আমার মনে হতে থাকে আমি ওর মা’কে না ওকেই যেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় বিছানায় দেখেছিলাম। রুপাইয়ের সাথে প্রেমের পর থেকে একটা সেকেন্ড আমার মাটিতে পা পড়তো না। ও কতোটা সুন্দর তা নিয়ে অনেক ঘ্যানঘ্যান করেছি। শেষ একটা কথা বলি এই নিয়ে।আমার বর্তমান গার্লফ্রেন্ড রুপাইয়ের ব্যাপারে টুকটাক জানতো। মানে কোন কিছু আমি লুকোতে চাইনি আমি ওর কাছে।

আবার খুব বেশি কিছু বলিনি কারণ নতুন মানুষের সামনে পুরনো মানুষের কথা তুলে স্মৃতিচারণ করাটা আসলে বিরক্তিকর ব্যাপার নতুন মানুষের জন্য। এই ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম। তো হুট করেই একদিন আমার ছোট ভাই ওর সামনে রুপাইয়ের রুপ নিয়ে খুব প্রশংসা করে। এরপর থেকে ও রুপাইয়ের ছবি দেখার জন্য সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করে। একদিন বাধ্য হয়েই রুপাইয়ের তিনটা ছবি দেখাই ওকে। ও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে “মানুষ এতো সুন্দর হয়?”আমি ফাজলামি করে বলি “এখন কি তোমার হিংসা হচ্ছে নাকি ওকে দেখে?”জবাবে ও বলে “হিমালয় দেখে কি কারো হিংসা হয়? হয় না। বরং মাথা নত হয়।”তো যে মেয়েটা এতো সুন্দর যে তার প্রাক্তনের প্রেমিকা তাকে দেখে মাথা নত করে সেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি কি দেখতাম? বিছানায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত বুড়িয়ে যাওয়া ওর মা’কে দেখতাম।

আমি আসলে বুঝে গিয়েছিলাম জীবনটা খুব ছোট এবং একটা নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই না। ৩০, ৪০ বা ৫০ বছর পর মাটির নিচে পঁচে গলে যাওয়া রুপাইয়ের শরীর যখন লাখ লাখ পরজীবির খাদ্য হবে তখন সেই পরজীবিরা কি কোন দিন জানবে এই মেয়েটার একটুকরো হাসি দেখতে তার ক্যাম্পাসে অসংখ্য তরুন উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকতো? যাই হোক মূলত ওর মা’র অসুস্থতাকে কেন্দ্র করেই আমাদের বিচ্ছেদ হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষমতাধর মানুষের মতোই ওর বাবার কানাডায় সেকেন্ড হোম ছিলো। ওর বোনের ততো দিনে বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বাবা ওকে আর ওর মা’কে নিয়ে কানাডা চলে যাবে একবারে। প্ল্যান ছিলো বছর পাঁচেক পরে যাওয়ার কিন্তু স্ত্রীর সুচিকিৎসার কথা ভেবে আগেই স্বেচ্ছায় রিটায়ারমেন্টে চলে যান। আমার তখনও পড়াশোনা শেষ হয়নি। মধ্যবিত্ত ঘরের আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না ওকে কোন কিছু দিয়ে আটকানো।

ওর মা’কে দেখার পর জীবনের শূন্যতা যদি আমাকে তাড়িয়ে না বেড়াতো হয়তো কিছু একটা করতাম। কিন্তু শূন্যতার খবর জানি বলেই হয়তো এর জন্য কোন ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে ইচ্ছা করেনি। হাসিমুখেই চিরতরে বিদায় দিয়েছি রুপাইকে। মাঝেমাঝেই যখন ওর কথা ভেবে খুব মন খারাপ হয় নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই যে সংসারের চাল ডালের হিসাব ওর সাথে করতে হবে না এইটুকু অন্তত ছেড়ে যাবার প্রাপ্তি। যে জীবন রুপাই আর আমার, আর কারো সাথে তার হয় নাকো দেখা!!হতাশা আর অবসাদের এই গল্প আসলে কাউকে হতাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বলছি না আমি। করলা মুখে দিয়ে তিতা লাগলে কি তা নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু আছে? আপনি করলা মুখে দেয়ার আগেই জানেন এটা তিতা। বরং তিতা স্বাদটাকে সহজ ভাবে নিলেই দেখবেন করলা একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার। আমাদের জীবনটাও তাই। জীবন ক্ষণস্থায়ী এটা এক অমোঘ সত্য। এটা মেনে নিলেই দেখবেন জীবন উপভোগ্য এবং বৈচিত্র্যময়। আর যদি না মানেন? ঐ প্রথমে বলা গল্পের চৈনিক রাজার মতো ভন্ডদের খপ্পরে পড়বেন। আজকাল আর অমরত্ব লাভের ফাঁদে কেউ পা দেয় না।

তবে অন্য এক ফাঁদ আছে যার নাম ধর্ম। এই যে জীবন এতো ক্ষুদ্র আর ক্ষণস্থায়ী এই ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে এক আশ্চর্য ফাঁদ তৈরি করেছে কিছু বুদ্ধিমান ধান্দাবাজ। এদের খপ্পরে পড়ার আগে প্রথমে বলা চৈনিক রাজার গল্পটা মনে রাখবেন। ইউরোপের রেনেসাঁস আর আলোকায়ন যুগ নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু এই দুই যুগের মাঝখানে থাকা বারোক যুগের কথা আমরা ভুলে যাই। রেনেসাঁসের ধাক্কায় ততো দিনে খ্রিস্ট ধর্ম এক অসাড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে ইউরোপে। অন্যদিকে নতুন মহাদেশ আবিস্কার আর ঔপনিবেশিক শাসনের জোরে ধন সম্পদে ফুলে ফেঁপে উঠছে ইউরোপ। সেই সময়ে উন্মেষ ঘটে শিল্পের নতুন ধারার। বারোক শিল্পকলা নামে যা পরিচিত। এই সময়ে আঁকা ছবিগুলোর এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিলো। হয়তো খুব সুন্দরী কোন মেয়ের ছবি আঁকা হলো বা কোন সুরম্য প্রাসাদের সেই ছবির এক কোনে হয়তো ছোট করে একটা মাথার খুলি এঁকে দিবেন চিত্রকর। মানে শত আড়ম্বর আর সুন্দরের ভেতরেও জীবনের শূন্যতাকে মনে করিয়ে দেয়াই ছিলো চিত্রকরের উদ্দেশ্য। একই ঘটনা ঘটেছে বারোক যুগের সাহিত্যের ভেতরেও। শেক্সপিয়র সেই বারোক যুগের সন্তান। জীবনের শূন্যতা তাকে আলোড়িত করেছিলো বলেই তিনি জীবনকে রঙমঞ্চের সাথে তুলনা করেছিলেন। আসলে আমাদের জীবন অতি ক্ষনস্থায়ী। এই বিশাল মহাকালের তুলনায় আপনার আমার জীবন এক নদী জলের ভেতর একটা বুদবুদ ছাড়া আর কিছুই না।

loneliness Painting by Seher Bilgin | Saatchi Art
Sher Bilgin, Turkey

মহাবিশ্বের ১৩’শ কোটি বছর বয়সের তুলনায় আপনার আমার ৭০-৮০ বছর একটা ক্ষণস্থায়ী বুদবুদ ছাড়া আর কি? চীনা দার্শনিক চুয়াং জু’র স্বপ্নের গল্পটাই বরং আমাদের জীবনের জন্য অধিক প্রয়োজনীয়। চুয়াং জু একদিন স্বপ্নে দেখলেন তিনি প্রজাপতি হয়ে গেছেন। তারপর ঘুম থেকে উঠে তার মাথায় প্রশ্ন এলো “আমি একটি মানুষ যে স্বপ্ন দেখছে সে প্রজাপতি নাকি আমি একটা প্রজাপতি যে স্বপ্ন দেখছে সে আসলে মানুষ?” এই যে প্যারাডক্স এর উৎস কোথায়? উৎস আপনার আমার জীবনের ক্ষুদ্রতায়। কিন্তু এই ক্ষুদ্রতা ফেলনা নয়। এই বুদবুদ রঙহীন ধুসর নয়। এই বুদবুদ হাজার রঙে রঙীন। এই ক্ষুদ্রতা নিয়ে তাই কাউকে ব্যবসা করতে দিবেন না, কারো হাতের পুতুল হবেন না। বরং নিজের মতো ভরপুর বাঁচুন। এক জেন সাধুর গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করি।

SOCIALES J - A: Origen y Evolución del Universo
তের বিলিয়ন বছর পরে আমি…

মিং লাই নামের এক জেন সাধু এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তার কাছে আরেক ছদ্ম জেন সাধু আসে। এসে বলে ” তোমার এতো ভক্ত কেন? সামনে যে নদীটা দেখতে পাচ্ছো আমি পায়ে হেঁটে এই নদী পার হতে পারি। এটা আমার জেন সাধনার মিরাকল। তুমি কি এমন মিরাকল জানো যে তোমার ভক্ত অনুরাগী আমার চেয়ে অনেক বেশি?” জবাবে মিং লাই বলেন “এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোন চালাকি আছে। যে চালাকি করে সে শিয়াল হতে পারে জেন সাধু না। আমি একটা মিরাকল জানি। যখন আমার খিদে পায় আমি খাই, যখন আমি তৃষ্ণার্ত হই আমি পান করি, যখন আমার ঘুম পায় আমি ঘুমাই। এটাই আমার মিরাকল।”ভন্ডরা, মিথ্যুকেরা নানান গাল গল্প তৈরি করবে আপনাকে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন ধর্মের নামে হাটে বাজারে এরা যেসব গাল গল্প বেচে সবই ঐ ভন্ড জেন সাধুর মতো চালাকি ছাড়া আর কিছুই না। আপনার আমার জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং ক্ষুদ্র। কিন্তু এই ক্ষুদ্রতা নিয়ে আফসোস করার কিছু নাই। এই ক্ষুদ্রতা নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নাই। বরং এই ক্ষণস্থায়ী বুদবুদকে উপভোগ করুন।বুদ্ধকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো “মানব জীবনের সবচেয়ে বড় পরিহাস কি?” জবাবে বুদ্ধ বলেছিলেন “মানব জীবনের সবচেয়ে বড় পরিহাস এই যে মানুষ এমন ভাবে বাঁচে যেন কোন দিন মরবে না। তারপর একদিন এমন ভাবে মরে যেন কোন দিন বাঁচেইনি।”তাই মারা যাওয়ার আগে ভরপুর বাঁচুন। খিদে পেলে খান, ঘুম পেলে ঘুমান, কারো প্রেম হৃদয়ে দোলা দিলে প্রেমে ভেসে যান। আজকের জন্য বাঁচুন। কারণ কোন মহান, মহৎ উদ্দেশ্য আপনার আমার জীবনে নেই একমাত্র নিজের জীবনকে উপভোগ করা ছাড়া।

লেখকের আরো কিছু আর্টিকেলঃ

দুই আমেরিকার অর্থনৈতিক পার্থক্য

সুখী হতে কি লাগে?