সেপিয়াঞ্জার জর্জিও প্যারিসি একাডেমিয়া ডি লিঞ্চির ভাইস প্রেসিডেন্ট তার ২০২১ সালের নোবেল প্রাইজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাইকুরো মানবে ও ম্যাক্সপ্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের ক্লাউস হ্যাসেলম্যানের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। এ এওয়ার্ডকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ” কমপ্লেক্স ফিজিক্যাল সিস্টেম বোঝার অগ্রযাত্রায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে”! প্যারিসি হলেন একজন ইলেক্ট্রিক ফিজিসিস্ট যার গবেষণা ফান্ডামেন্টাল পার্টিকেল, কনডেন্স ম্যাটার, স্ট্যাটিক্যাল ফিজিক্স এবং ডিস-অর্ডার ম্যাটারিয়ালস পর্যন্ত বিস্তৃত। ন্যাচারের সূত্রমতে, নোবেল কমিউনিটি তার এ অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন, এমন একটি আবিষ্কার হিসেবে যা অতি-ক্ষুদ্র পারমাণবিক ফিজিক্যাল সিস্টেম থেকে শুরু করে প্লানেটারি স্কেলের বিশৃঙ্খলা ও দোদুল্যমানতার( Disorder and Fluctuations) সাথেও আন্তক্রিয়া করে।
কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে এটা ভেবে যে যখন প্যারিসিকে রিপোর্টার নোবেল প্রাইজ ঘোষণার পর তার অনুভূতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন তিনি বলেন, আমি খুবই খুশি কিন্তু আমি এটি প্রত্যাশা করিনি। তাদের এ কমপ্লেক্স সিস্টেমের গবেষণা নিউরোসায়েন্স থেকে শুরু করে মেশিন লার্নিং পর্যন্ত প্রভাবিত করবে বলে ন্যাচারে বলা হয়। এদিকে মানাবে যিনি ২০২১ ফিজিক্সের কেন্দ্রীয় নোবেল প্রাইজ উইনার, তিনি বলেন, আমি খুবই বিস্মিত কিন্তু আমি যে কাজ করেছি সে ধরণের কাজের জন্য কেউ নোবেল প্রাইজ পায়না! ক্লাইমেটের ধবংসাত্মক পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন একজন নাগরিক হিসেবে আমি মানাবে, ক্লাউস এবং প্যারিসির ২০২১ সালের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তি নিয়ে খুবই উত্তেজিত এবং আমি খুবই খুশি যে এ প্রাইজ যোগ্য ব্যক্তিদের কাছেই পৌঁছাতে পেরেছে।
বর্তমানে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেডিকশন ও তা মানব সভ্যতার অনুকূলে রাখতে আমাদের অসংখ্য বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সম্মিলিত উপস্থিতি প্রয়োজন আর এ জন্য আমি মনে করছি, নোবেল কমিউনিটি ক্লাইমেট বিশেষজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে, অন্যদের মস্তিষ্ককেও এই মেগাপয়েন্টে সেন্ট্রালাইজ করতে সক্ষম হয়েছে এবং এতে করে অন্যান্য বিশেষজ্ঞরাও এ ফিল্ডে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে। বিগত দশকে মানাবে ক্লাইমেটের মডেল তৈরিতে যে অবদান রেখেছেন এবং সে মডেলের উপর ভর করে আমরা কীভাবে বুঝতে পেরেছি গ্রীনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধি গ্লোবাল ওয়ার্মিং- এ ভুমিকা রাখে এদিকটিও গুরুত্ব পেয়েছে।
কতটা জটিল আবহাওয়া ও জলবায়ু প্রক্রিয়াঃ
আবহাওয়া হলো আমরা প্রতিদিন ও প্রতিঘন্টায় যা যা দেখি। আবহাওয়া শুধু জলবায়ুর সাথে জড়িত। আর ক্লাইমেট হলো কয়েক দশকের আবহাওয়ার গড় যেটি সমুদ্র এবং পৃথিবী পৃষ্ঠ দ্বারা প্রভাবিত । আবহাওয়া এবং জলবায়ু খুবই জটিল কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন ফিজিক্যাল প্রসেসের সাথে বিজড়িত। এটি জড়িত সুবিস্তৃত ক্রমধারার স্থানিক ও সাময়িক মাত্রার এয়ার মোশন থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের প্রবাহ পর্যন্ত, যেমন আলোকরশ্মি, পানির জলীয় বাষ্প পর্যন্ত। এ সিস্টেম অবিশ্বাস্যভাবে জটিল ও আন্তসম্পর্কযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি বর্জ্রঝড়, একটি মহাদেশের আবহাওয়ার সিস্টেমকে প্রভাবিত করতে পারে।
১৯৫৫ সালের পূর্বে, আবহাওয়াবিদরা পূর্ববর্তী দিনের আবহাওয়ার ভিত্তিতে পরবর্তী দিনের আবহাওয়া বোঝার চেষ্টা করতেন , তারা সরল কিন্তু শ্রমনির্ভর একটি পদ্ধতি ব্যাবহার করতেন যা আংশিকভাবে পরিমাণগত এবং আংশিক অভিজ্ঞতা নির্ভর।
ক্লাইমেট মডেলের জন্মঃ
১৯৫০ সালে সালে ক্রমবর্ধমানভাবে উন্নয়নশীল ডিজিটাল কম্পিউটারের মাধ্যমে আবহাওয়ার প্রেডিকশন করা সম্ভব হয়ে উঠেছিল ওয়েদার মডেল রান করার মাধ্যমে। আবহাওয়ার মডেল হলো একটি ইকুয়েশন সিস্টেম যা আবহাওয়া পরিচালিত করে এমন ভৌত আইনগুলোকে প্রকাশ করে। “Running” ওয়েদার মডেল বলতে বোঝায়, কম্পিউটারে ইকুয়েশন সলভ করা, আজকের ডেটা ব্যবহার করে, আগামীকাল বোঝা। আংশিকভাবে কম্পিউটারের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রথম ওয়েদার মডেল শুধুমাত্র পৃথিবীর একটি অংশকেই কাভার করতো যেমন___ নর্থ আমেরিকার মত। কিন্তু ১৯৬০ সালের প্রারম্ভে দ্রুতগামী কম্পিউটার তৈরি করা হয় যা এমন একটি মডেল তৈরি করে যা সম্পূর্ণ গ্লোবাল এটমোস্ফিয়ার রিপ্রেজেন্ট করে। আর মানাবে, এ ধরণের একটি মডেল তৈরি করেছিলেন, হাজার হাজার ইকুয়েশনের আন্তঃসম্পর্কযুক্ত ওয়েব দিয়ে যা ক্লাইমেট সিমুলেট করতে পারে এবং ক্লাইমেটের পরিবর্তনকেও। এই মডেলের মাধ্যমে মানাবে ও তার সহকর্মীরা মসৃ্ণভাবে একটি রিয়ালিস্টিক সিমুলেশন তৈরি করতে সক্ষম হয় যেমন- জেট স্ট্রিম ও মৌসুমি বায়ু। আজকের গ্লোবাল ওয়েদার প্রেডিকশন ও ক্লাইমেট মডেল যে এত ক্ষমতাবান তার পেছনে মানাবের সেই প্রাচীন মডেলই কাজ করছে। যখন মানাবে ১৯৬০ সালে প্রথম কাজ করতে শুরু করেন, কিছু বিজ্ঞানী ইতোমধ্যেই সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছিলেন আবহাওয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধি বৈশ্বিক উষ্ণায়নে নেতৃত্ব দেবে।
১৯৬৭ সালে মানাবে ও তার সহকর্মী ওয়েথেরাল্ড একটি সরলীকৃত ভার্সনের ক্লাইমেট মডেল তৈরি করেন জলবায়ুতে কার্বন-ডাই অক্সাইডের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির ইফেক্ট পরিমাপ করার জন্য। কার্বন-ডাই অক্সাইড যে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বাড়ায় তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি, তারা দেখিয়েছিল যে উষ্ণ বাতাসে জলীয় বাষ্প সামগ্রিক উষ্ণতা আরো বৃদ্ধি করে কারণ জলীয় বাষ্প নিজেই একটি গ্রীনহাউজ গ্যাস।
প্রেডিকশন মেকিংঃ
জলবায়ু সমুদ্র ও আবহাওয়া দুটোর সাথে সম্পর্কযুক্ত কিন্তু আদিম মডেল এ দুটোকে সমন্বয় করতে পারেনি। ১৯৬৯ সালে মানাবে এবং তার অসানগ্রাফার প্রথম এমন একটি মডেল তৈরি করেন যা সমুদ্র ও জলবায়ু দুটোকেই অন্তর্ভুক্ত করে। এবং এক্ষেত্রে অগ্রগতির জন্য ১৯৭৫ সালে তারা তাদের সিমুলেশন থেকে প্রাপ্ত ফলাফল থেকে Global Warming using a global climate model নামক একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন। তারা আবহাওয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইডের মোলার ফ্র্যাকশন প্রতি মিলিয়নে ৩০০ টি থেকে ৬০০ টি’তে উন্নিত করেন। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে তারা পৃথিবী পৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, আর্ক্টিকে ছিলো সবচেয়ে কঠিন উষ্ণতা, বরফ ও স্নোকাভারের হ্রাস, বৃষ্টিপাতের গড় বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি ও স্ট্রটস্ফিয়ারের শীতলতা। ১৯৮০ সালে মানবে ও তার দল তাদের মডেল ব্যবহার করে, কিছু কিছু মহাদেশের ড্রাইনেস বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রেডিকশন করেন। তাদের সকল প্রেডিকশন আজ সত্যে পরিণত হয়েছে।
ক্লাইমেট, ওয়েদার ও কেওসের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিঃ
নোবেল প্রাইজ বিজয়ী অবশিষ্ট দুজন হ্যাসেলমেন ও প্যারিসি মানাবের হিমালয় পর্বত সমান আদি গবেষণা অনুসরণ করে সমস্ত বিশ্বব্যাপী কিভাবে বিশাল স্কেলে ইন্টারেকশন কাজ করে সেটি দেখিয়েছেন যা বিশৃঙ্খলা জন্ম দেয় এবং প্রতিদিনকার টাইম স্কেলে হার্ড-টু-হার্ড আচরণের ভবিষ্যতবাণী করার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।প্যারিসি গবেষণা করেছেন কেওসের বিপুল বৈচিত্র্যতাসম্পন্ন ফিজিক্যাল সিস্টেমের বিশৃংখযলার কর্তব্য নিয়ে এবং দেখান যে “এমনকি কেওটিক সিস্টেম সুশৃঙ্খল উপায়ে কাজ করতে পারে”।
পড়ুন- চিকিৎসায় যে জন্য নোবেল পেলেন ডেভিড জুলিয়াস ও আরডেম পাটাপুটান
তার ম্যাথমেটিক্যাল থিয়োরি ছিল বিশৃঙ্খল ক্লাইমেট সিস্টেমের যথাযথ রিপ্রেজেন্টেশন তৈরি করার উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় ধারণা। আর এদিকে হ্যাসেলম্যান ক্লাইমেট ও ওয়েদারকে সংযুক্ত করার জন্য আরো একটি শূন্যস্থান পূরণ করে দেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, জলবায়ুতে খুব কঠিনভাবে বৈচিত্র্যময় এবং আপাতদৃষ্টিতে বিশৃঙ্খল আবহাওয়া “সমূদ্রের মাঝে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সিগনালে পরিণত হয়।”
মানাবে, হ্যাসেলমেন্ট ও প্যারিসির কাজ বিজ্ঞানীদের সক্ষম করে তোলে এটা প্রেডিক্ট করার জন্য যে কীভাবে বিশৃঙ্খলা, জলবায়ুর দ্বিমুখী আচরণ, সমুদ্র এবং ভূপৃষ্ঠ সমন্বিতভাবে সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়। মানব সভ্যতা এ প্রথম বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তাকে এড়িয়ে অবিশ্বাস্য যথার্থতার সাথে জটিল সিস্টেমকে বুঝতে পারবে যেটাকে একসময় শ্রডিঙ্গারের বেড়ালের মতোই অসম্ভব মনে হতো। আর এজন্য আমি মনে করি এ তিনজন সূর্য সন্তানের ফিজিক্সের নোবেল প্রাইজ অর্জন শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, অপরিহার্য। আর এ জন্য নোবেল কমিউনিটি আমাদের পক্ষ থেকে অন্তত এক মিলিয়ন ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত।
তথ্যসূত্রঃ
- Winners of 2021 Nobel Prize in Physics built mathematics of climate modeling, making predictions of global warming and modern weather forecasting possible, the conversation
- Nobel Prize in Physics 2021, Nature
- Press release: The Nobel Prize in Physics 2021
- ২০২১-নোবেল কেনো ক্লাইমেটের জন্য দেয়া হলো? ২০২১-নোবেল কেনো ক্লাইমেটের জন্য দেয়া হলো?