মহাবিশ্ব শূন্য থেকে এসেছে? নাকি ঈশ্বরের সৃষ্ট ল্যাব প্রজেক্ট? কেউ কেউ বলবে,মহাবিশ্ব শূন্য থেকে আসতেই পারে না! অসম্ভব! ঈশ্বরই মহাবিশ্বকে তার অদৃশ্য ল্যাবরেটরিতে তৈরি করেছেন! কিন্তু মিচিও কাকু তার প্যারালাল ইউনিভার্স বইতে দাবি করেন, মহাবিশ্ব যদি শূন্য থেকে না আসত, তবে মহাবিশ্ব একটি টাইম মেশিনের মতো আচরণ করত! আপনি একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখতেন, আপনি ডায়নোসরের সময় চলে গেছেন! আপনি হতেন একজন টাইম ট্রাভেলার।
আমার এসব কথাবার্তা শুনে, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ওয়াও! এটা কীভাবে সম্ভব! আজ রাতে একবার টেলিস্কোপে মহাকাশে চোখ রাখুন। আপনি দেখবেন, মহাবিশ্বের গ্রহ, নক্ষত্র এবং ছায়াপথ সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছে। অন্য কথায় মহাবিশ্বের প্রতিটি গ্রহ অথবা ছায়াপথের ভিন্ন ভিন্ন স্পিন আছে। কিন্ত শুনলে অবাক হবেন, মহাবিশ্বের নিজের কোনো স্পিন অথবা ঘূর্ণন নেই। একদম স্থির। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ৩৬৫ দিনে একবার আবর্তিত হয়, আর ২৪ ঘন্টায় নিজ অক্ষে একবার। এজন্য প্রতিদিন একই সকাল-বিকেল হয়, প্রতি বছর জানুয়ারির এক তারিখ বার বার ফিরে আসে।
মনে করুন, মহাবিশ্ব নিজেই মাল্টিভার্সকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এখন? এখন কি মহাবিশ্ব নিজেই টাইম ট্রাভেল করবে না। ইয়েস। এ মুহূর্তে মহাবিশ্ব টাইম ট্রাভেল করে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর অতীতে চলে যাবে? আর হয়তো আপনি নিজেই টাইম ট্রাভেলের সাক্ষী হবেন কারণ প্রতিদিন আপনার জীবনে একই অভিজ্ঞতা ফিরে আসবে। আপনি টাইম ট্রাভেল মুভির মতো একটি ইনফিনিট লুপে আটকে যাবেন। ইন্টারেস্টিং, রাইট?
মনে করুন, মহাবিশ্ব নিজেই মাল্টিভার্সকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এখন? এখন কি মহাবিশ্ব নিজেই টাইম ট্রাভেল করবে না। ইয়েস। এ মুহূর্তে মহাবিশ্ব টাইম ট্রাভেল করে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর অতীতে চলে যাবে? আর হয়তো আপনি নিজেই টাইম ট্রাভেলের সাক্ষী হবেন কারণ প্রতিদিন আপনার জীবনে একই অভিজ্ঞতা ফিরে আসবে। আপনি টাইম ট্রাভেল মুভির মতো একটি ইনফিনিট লুপে আটকে যাবেন। ইন্টারেস্টিং, রাইট?
এ মুহূর্তে প্রশ্ন করতে পারেন, বুঝলাম। কিন্তু এসবের সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক কী? আছে! আছে! সম্পর্ক আছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের নেট স্পিন জিরো। এটা তখনই সম্ভব যদি মহাবিশ্ব শূন্য থেকে আসে। কোনো সিস্টেম যদি বাহ্যিক বল বা টর্কের (torque) প্রভাব মুক্ত থাকে, তাহলে তার মোট কৌণিক ভরবেগ পরিবর্তিত হয় না। মহাবিশ্ব যদি আদিতে কোনো নির্দিষ্ট স্পিন বা ঘূর্ণন নিয়ে শুরু হতো, তবে সেটার উৎস কী, সেটা ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ। যেহেতু বিগ ব্যাং-এর সময় কোনো বাহ্যিক ফ্রেম বা বল ছিল না, তাই পুরো মহাবিশ্বের মোট কৌণিক ভরবেগ জিরো থাকাই যৌক্তিক। ঈশ্বর যদি মহাবিশ্বকে তৈরি করতেন, তবে মহাবিশ্বের স্পিন শূন্য হওয়ার কথা ছিল না । অন্যকথায় মহাবিশ্ব একটি টাইম মেশিনে পরিণত হতো! কারণ এটি তখন বারবার অতীত থেকে ভবিষ্যতে আবর্তন করত। তবে এ ধরনের মহাজাগতিক আবর্তনের জন্য আমাদের এক গুগলপ্লেক্স বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন প্রশ্ন, মহাবিশ্বে কী সত্যিই একজন ঈশ্বর আছেন?
এর উত্তর হলো, না নেই। আইনস্টাইনের থিওরি আমাদের টাইম ট্রাভেলের অনুমোদন দেয়, আর টাইম ট্রাভেল যদি সফল হয়, তবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হবে। কিন্তু কেন? মনে করুন, আপনি অতীত ভ্রমণ করে আইনস্টাইনকে হত্যা করলেন, তার মানে আপেক্ষিতা তত্ত্ব আবিষ্কার হবে না, আপনার পক্ষে টাইম মেশিন তৈরি করাও সম্ভব হবে না আর আপনি অতীত ভ্রমণ করে আইনস্টাইনকে হত্যাও করতে পারবেন না। এটি একটি ইনফিনিট লুপ তৈরি করবে। মানুষের মতো ক্ষুদ্র একটি প্রাণী যদি অতীত ভ্রমণ করে, ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে দিতে পারে, তবে এটি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কারণ মানুষ নিজেই ঈশ্বরের টাইম লাইন পরিবর্তন করে দিতে পারে। এখন মনে করুন, আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে চলে গেলেন কিন্তু আপনি অতীত পরিবর্তন করতে পারছেন না। মানে কী? এর মানে, আপনি ঈশ্বরের স্ক্রিপ্ট মেনে কাজ করছেন, আপনার কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই। যদি মহাবিশ্বে ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া আর কারও ইচ্ছা না থাকে, আপনার দ্বারা কোনো পাপ কাজ করা সম্ভব না। নিউটনের মাধ্যাকর্ষ তত্ত্ব অনুযায়ী একটি বস্তু যখন ফেলা হয়, তখন সেটি মাটিতে পড়ে যায়— ঈশ্বরের অনুমতির দরকার হয় না, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটে। তেমনি টাইম ট্রাভেল প্রাকৃতিক ঘটনা। আপনি অতীত ভ্রমণ করে আইনস্টাইনকে হত্যা করতে পারবেন না, কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম মেনে এখানে মিলিয়ন মিলিয়ন প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি হয়ে যাবে, আর আপনি সেই ইউনিভার্সে প্রবেশ করবেন, যেখানে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি আবিষ্কার করেনি।
মহাবিশ্বে যে ঈশ্বর যে নেই তা আমাদের সর্বপ্রথম দেখিয়েছিল WMAP স্যাটেলাইট। ২০০৩ সালে WMAP স্যাটেলাইট আমাদের শিশু মহাবিশ্বের ছবি দিয়েছিল। এটি এমন এক সময়ের ছবি যখন মহাবিশ্বের বয়স ছিল মাত্র ৩,৮০,০০০ বছর। অনেকে দাবি করেছিলেন, এটি স্বয়ং ঈশ্বরের ছবি। মহাবিস্ফোরণের ১০,০০০ বছর পর মহাবিশ্ব ছিল প্লাজমা। যেখানে ইলেক্ট্রন ও প্রোটন একসঙ্গে ভেসে বেড়াত। ফোটন তখন মুক্ত ইলেক্ট্রনের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে বেশিদূর যেতে পারত না আর তাই মহাবিশ্বে কোনো আলো ছিল না। মহাবিশ্ব যখন সম্প্রসারিত হয়েছিল, এটি ধীরে ধীরে শীতল হয়। মহাবিস্ফোরণের ৩,৮০,০০০ বছর পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কমে ৩০০০ কেলভিনে আসে। এই তাপমাত্রায় ইলেক্ট্রন ও প্রোটন মিলিত হয়ে নিউক্লিয়াস গঠন করে। আর আলোর ফোটন স্বাধীনভাবে চলাচল করতে শুরু করে। আর এটাই হলো কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন। কিন্তু কীভাবে বিজ্ঞানীরা আদি মহাবিশ্বের ছবি তুলেছিল?
WMAP স্যাটেলাইট শিশু মহাবিশ্বের ছবি তুলতে পেরেছিল, কারণ রাতের আকাশ টাইম মেশিনের মতো আচরণ করে। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা থিওরি অনুসারে, আলোর গতি সসীম। প্রতি সেকেন্ডে 299,792 কিলোমিটার। আলোর গতি সসীম হওয়ায় রাতের আকাশ থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে সময় লাগে। আমরা রাতের আকাশে যে সব নক্ষত্র দেখি, সেগুলো আজকের নয়, অনেক পূর্বের। চন্দ্র থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে এক সেকেন্ড সময় লাগে। আমরা যখন চন্দ্রের দিকে তাকাই, তখন আমরা এক সেকেন্ড অতীতের চন্দ্র দেখি। আমরা যখন সূর্যের দিকে তাকাই আমরা আট মিনিট অতীতের সূর্য দেখি। মহাকাশে আমাদের পরিচিত এমন অনেক নক্ষত্র আছে, যেগুলো থেকে আমাদের চোখে আলো আসতে ১০-১০০ বছর সময় লাগে। অন্য কথায় তারা ১০-১০০ আলোকবছর দূরে। এক আলোকবর্ষ সমান ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। মহাবিশ্বে অসংখ্য ছায়াপথ আছে, যারা মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন লাইট ইয়ার্স দূরে অবস্থান করছে। আমরা মহাকাশে এমন অনেক ফসিল আলো দেখি, যা ডায়নোসর থেকেও অনেক পূর্বে যাত্রা শুরু করেছিল। কোয়েসার ও গ্যালাক্টিক ক্লাস্টার আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের একদম শেষ প্রান্তে অবস্থান করে, তারা আমাদের থেকে ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন বছর অতীত। আর WMAP স্যাটেলাইট মহাবিশ্বের এমন এক সময়ের রেডিয়েশন শনাক্ত করেছিল, যা তৈরি হয়েছিল মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরপর, যা আনুমানিক ১৩.৭ বিলিয়ন বছর প্রাচীন। আমরা টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশ্বের আর গভীরে প্রবেশ করতে পারি না, কারণ এর চেয়ে গভীরে মহাবিশ্বে আর কোনো আলো নেই, এটি সীমাহীন অন্ধকার। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন মহাবিশ্বের ফসিল রেকর্ড, এটি মহাবিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে আছে, আর এই বিকিরণের তাপমাত্রা সর্বত্র সমান , ২.৭২৫ কেলভিন।
আপনি যদি শিশু মহাবিশ্বের ছবির দিকে তাকান। আপনি দেখবেন, এটি অনেকগুলো বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো বিন্দুর সমাবেশ। আপনার কাছে এ ছবিটি দেখে অবান্তর ও উদ্ভট মনে হতে পারে। কিন্তু এই বিক্ষিপ্ত বিন্দু দেখে বিজ্ঞানীরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কারণ আপনার কাছে এগুলো এলোমেলো ডট মনে হলেও, এ বিক্ষিপ্ত বিন্দু কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের একটি প্রমাণ। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে, শূন্যতা আসলে শূন্য নয়, এটি অস্থিতিশীল।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে মহাশূন্যে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশন ঘটেছিল, জোড়ায় জোড়ার কাল্পনিক কণা ও প্রতিকণা তৈরি হয়েছিল, আদি মহাবিশ্বে এই শক্তির উঠানামা থেকে শিশু মহাবিশ্বের এক এক জায়গায় এক একরকম শক্তির প্যাটার্ন তৈরি হয়েছিল। আর মহাবিস্ফোরণের পর এই বিক্ষিপ্ত বিন্দুর সমাবেশ সমস্ত মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির বিন্দু গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্টিক ক্লাস্টারে পরিণত হয়। অন্যকথায় আজ আমরা মহাবিশ্বে যে সব গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্টিক ক্লাস্টার দেখি, সেগুলো আদি মহাবিশ্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির বিন্দু ছিল। আর এ শক্তির বিন্দু সমস্ত মহাবিশ্বে বিস্তারিত হয়ে মহাকাশে গ্যালাক্সি ও গ্যালাক্টিক ক্লাস্টারের ছবি অংকন করে।
WMAP স্যাটেলাইট আমাদের কেবল মহাবিশ্বের বয়সই বলেনি। এটি আমাদের বলছে, আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব মোটশক্তির মাত্র ৪%, ২৩% ডার্ক ম্যাটার আর মহাবিশ্বের ৭৩% দখল করে রেখেছে অদৃশ্য ডার্ক এনার্জি। ডার্ক এনার্জিকে শূন্যতার শক্তিও বলা হয়। ডার্ক এনার্জির মধ্যে একটি এন্টিগ্রেভেটি ফোর্স থাকে। আর এই এন্টিগ্রেভেটি ফোর্স মহাবিশ্বকে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারিত করে।
মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো যে একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ গ্যালাক্টিক রেড শিফট। যখন কোনো ছায়াপথ আমাদের থেকে দূরে সরে যায়, তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ প্রসারিত হয় এবং একে দেখতে লাল লাগে । যখন কোনো ছায়াপথ আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তখন আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়ে যায় এবং ছায়াপথ নীলছে হয়ে ওঠে, যাকে বলে ব্লুশিফট। এ ব্যাপারটি সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল শনাক্ত করেছিলেন। মনে করুন, আপনি একটা রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, আর দূর থেকে একটা ট্রেন আপনার দিকে এগিয়ে আসছে। যখন ট্রেন কাছাকাছি আসে, তখন এর হুইসেলের শব্দ একটু তীক্ষ্ণ (উঁচু ফ্রিকোয়েন্সি) শোনায়, আর যখন ট্রেন দূরে চলে যায়, তখন শব্দটা ভারী ও গভীর (নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সি) হয়ে যায়। এই ঘটনাকে বলে ডপলার ইফেক্ট। আপনি যদি কখনো টেলিস্কোপ দিয়ে দেখেন, মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো ক্রমশ নীল হয়ে আসছে, তবে বুঝে নেবেন, মহাবিশ্ব অদ্ভুত কোনো কারণে পুনরায় সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে মহাবিপদ। মহাবিস্ফোরণের সাপেক্ষে আমাদের কাছে এরকম অসংখ্য প্রমান আছে। আপনি কখনো পুরনো টিভির সিগন্যালের ত্রুটিজনিত সাদা-কালো ঝিঁঝিঁ শব্দ (static noise) দেখেছেন? এই স্ট্যাটিক নয়েজের প্রায় ১% হলো বিগ ব্যাং থেকে আসা কসমিক মাইক্রোওয়েব রেডিয়েশন। অর্থাৎ, টিভি অন করার পরপরই আপনি প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর অতীত মহাবিশ্বের তরঙ্গ দেখতে পাচ্ছেন! আজকের মহাবিশ্বে প্রায় ৭৫% হাইড্রোজেন ও ২৪% হিলিয়াম, আর এ বিপুল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম কেবল চূড়ান্ত উত্তাপের মধ্যেই তৈরি হয়। আমরা আজ মহাবিশ্বে যে সব হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দেখি, সেগুলো তৈরি হয়েছিল সৃষ্টির প্রথম তিন মিনিটে।
কিন্তু প্রশ্ন, কেন মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনের তাপমাত্রা সমান? আমরা যখন মহাবিশ্বের বিপরীত দুই প্রান্তের দিকে তাকাই, আমরা প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বের সময় দেখছি। মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধীরে ধীরে প্রসারিত হওয়ার কথা ছিল। যদি তাই হতো, তবে মহাবিশ্বের দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানের মধ্যে এ ধরনের সময় ও তাপমাত্রাগত সংযোগ থাকার কথা ছিল না । কিন্তু আমরা মহাবিশ্বের যেখানেই ভ্রমণ করি, যত বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা 2.725 কেলভিন। এটাকে বলে হরাইজন প্রবলেম। এ সমস্যাটি মহাবিস্ফোরণ তত্ব দিয়ে সমাধান করা যায় না। দ্বিতীয়ত, মহাবিশ্বের মোট ঘনত্ব (Density) একেবারে নিখুঁতভাবে ক্রিটিক্যাল ডেনসিটির কাছাকাছি। যদি মহাবিশ্ব খুব বেশি ঘন হতো, তাহলে এটি অনেক আগেই সংকুচিত হয়ে যেত। আর যদি ঘনত্ব কম হতো, তাহলে এটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে যেত। মহাবিশ্বের ঘনত্ব কমও নয়, বেশি নয়, একদম ফ্ল্যাট। এটা কীভাবে সম্ভব? এখান থেকে অনেকে দাবী করেন, মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব মিথ্যা, মহাবিশ্বকে মূলত ঈশ্বর তৈরি করেছেন।
কিন্তু MIT বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ এলান গুথ এই আইডিয়াটিকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তিনি বলেন, মহাবিশ্ব সাড়ে তের বিলিয়ন বছরে তৈরি হয়নি, আমাদের অসীম মহাবিশ্বের পুরোটাই 10 ইনভার্স 32 সেকেন্ডে তৈরি হয়েছিল। এটি এক সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়। অসীম মহাবিশ্ব একসাথে সম্প্রসারিত হওয়ায় মহাবিশ্বের সর্বত্র তাপমাত্রা ও ঘনত্ব সমান। অন্য কথায় মহাবিশ্ব যখন সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে ছিল, এটি সামগ্রিক মহাবিশ্ব আকারেই ছিল, এখনো এটি একই আকারেই আছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য কল্পনা করুন, একটি রাবার ব্যান্ডের কথা। একটা রাবার ব্যান্ডকে টান দিলে এটি প্রসারিত হয় কিন্তু তার মানে এই না এটি অন্য কোথাও থেকে অতিরিক্ত স্পেস ধার করে এনেছে। যখন মহাবিশ্ব ক্ষুদ্র একটি বিন্দু ছিল, তখনও এটি অসীম ছিল, এখনো অসীম কারণ মহাবিশ্বের বাহিরে কোনো স্পেস-টাইমই ছিল না। এজন্য মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য প্রবেশ করতে সময় লাগেনি। এ থিওরিটির নাম হলো কসমিক ইনফ্লেশন থিওরি। অসীম মহাবিশ্বের স্পেস-টাইম এক সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ে তৈরি হলেও, গ্যালাক্সি এবং গ্যালাক্টিক ক্লাস্টার ধাপে ধাপে বিবর্তিত হয়েছিল, আর এজন্য দরকার হয়েছিল সাড়ে তের বিলিয়ন বছর সময়। যেহেতু সাড়ে তের বিলিয়ন বছর সময়ের ভেতরেই মহাবিশ্ব বিবর্তিত হয়েছিল, এজন্য আমরা মহাবিশ্বের যেখানেই যাচ্ছি সাড়ে তের বিলিয়ন বছর পূর্বের রেডিয়েশন দেখতে পাচ্ছি।
ইনফ্লেশন থিওরির ক্ষমতা বোঝার জন্য একটি বেলুনের কথা চিন্তা করুন। মনে করুন, একটি বেলুন ফুলছে। বেলুনের পৃষ্ঠে আপনি নক্ষত্র ও ছায়াপথের ছবি অংকন করে দিন। বেলুন যখন ফুলবে, গ্যালাক্সিগুলোর মাঝে দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বেলুনের ইন্টারিয়র বা ভেতরের দিকে কোনো ছায়াপথ বা নক্ষত্র নেই। এখন মনে করুন, আপনি বেলুনের পৃষ্ঠে একটি আণুবিক্ষণিক বৃত্ত অংকন করলেন। এ বৃত্তটি হলো আমাদের সামগ্রিক ইউনিভার্স। ৯৩ বিলিয়ন লাইট ইয়ার্স ব্যাসার্ধের এ মহাবিশ্বে আমরা যা কিছু দেখছি, সবকিছু হলো এই আণুবিক্ষণিক বৃত্ত। মনে করুন, আমাদের মহাবিশ্ব হলো একটি ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রন, এর মানে আমাদের প্রকৃত মহাবিশ্ব অকল্পনীয় মাত্রার বিশাল। প্রকৃত মহাবিশ্ব এতটাই বিশাল যে আপনি যদি অনন্তকাল আলোর গতিতে মহাবিশ্বের পেছনে ছুটতে থাকেন, আপনি কখনোই রিচ করতে পারবেন না। 10 ইনভার্স 36 সেকেন্ডের ভেতর স্পেস-টাইম আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে অনন্ত অসীম আকার ধারণ করেছিল। এখানে একটি টুইস্ট আছে। বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বলছে, Nothing travels faster than light বা কোনোকিছুই আলোর চেয়ে দ্রুত পথ চলতে পারে না। কিন্তু ইনফ্লেশনের সময় কোনো অবজেক্ট সম্প্রসারিত হয়নি, সম্প্রসারিত হয়েছিল “নাথিং”। তাই এ ইকুয়েশন স্পেস-টাইমের উপর প্রজোয্য নয়, এটি প্রযোজ্য বস্তুর উপর।
পৃথিবী গোলাকার কিন্তু আমরা পৃথিবীর তুলনায় অনেক ছোট, এজন্য পৃথিবীকে আমাদের কাছে ফ্ল্যাট মনে হয়, প্রকৃত মহাবিশ্ব আমাদের থেকে এতটাই বিশাল যে আমাদের কাছে মহাবিশ্বকে ফ্ল্যাট মনে হচ্ছে বা মহাবিশ্বের ঘনত্ব কমও নয়, বেশিও নয়। কিন্তু একটি বেলুন যেমন ভেতরের দিক থেকে থার্ড ডায়মেনশনে বক্র হয়ে আছে, প্রকৃত মহাবিশ্ব নিজেও বিশাল স্কেলে উচ্চমাত্রায় বক্র হয়ে থাকতে পারে।
যাই হোক, WMAP স্যাটেলাইট এখনো আমাদের একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি আর তা হলো ইনফ্ল্যাশনের পেছনে কারণ কী? কোথায় থেকে এন্টিগ্রেভেটি ফোর্স তৈরি হয়েছিল যা আমাদের মহাবিশ্বকে প্রসারিত করেছে? ইনফ্লেশন কীভাবে টার্ন অন অথবা টার্ন অফ করা যায়? আমরা এখনো কেউই জানি না। ইনফ্ল্যাশন কোথা থেকে সেট হয়েছিল। সুপারস্ট্রিং থিওরি অনুসারে, ইউনিভার্স আদিতে টেন ডায়মেনশনাল স্পেসে অস্তিত্বশীল ছিল, এটি আজকের মতো চারমাত্রিক ছিল না। স্ট্রং ফোর্স, উইকফোর্স, গ্রেভেটেশনাল ফোর্স ও নিউক্লিয়ার ফোর্স দশমাত্রিক একটি বাবলে একে অন্যের সাথে একীভূত ছিল। আপনি একটি ত্রিমাত্রিক ক্রিস্টালকে ভেঙ্গে এর ভাঙা টুকরোগুলো দ্বিমাত্রিক স্পেসে জোড়া লাগাতে পারবেন না, আপনাকে এগুলো জোড়া লাগানোর জন্য থার্ড ডায়মেনশনে তুলতে হবে। একইভাবে আমরা যদি মহাবিশ্বের ফান্ডামেন্টাল ফোর্সগুলো কানেক্ট করতে চাই আমাদের দশমাত্রিক স্পেস-টাইম প্রয়োজন। কিন্তু দশমাত্রিক জগত ছিল খুবই অস্থিতিশীল কারণ কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের প্রভাবে সেখানে শক্তির কাঁপাকাঁপি অথবা দৌদুল্যমানতা কাজ করত। এটাকে বলে ইনফ্ল্যাটন ফিল্ড। এটা অনেকটা সোপ বাবলের মতো। সোপ বাবল প্রাকৃতিকভাবে বাতাসে কম্পন করে, কম্পন যখন এক্সট্রিম হয় বাবলটি ফেটে যায়। আজ থেকে আনুমানিক সাড়ে তের বিলিয়ন বছর পূর্বে দশমাত্রিক বাবলটিও কম্পন করেছিল কারণ এ বাবলটির ভেতর বিপুল পরিমাণ শক্তি আটকে ছিল। এটাকে বলে ফলস ভ্যাকুয়াম। ফলস ভ্যাকুয়ামে শক্তির উত্তেজনা যখন চূড়ান্ত হয়, তখন দশমাত্রিক বাবলটি ফেটে যায়, এভাবে ছয়মাত্রিক ও চারমাত্রিক মহাবিশ্ব তৈরি হয়। এ পদ্ধতিকে বলে কোয়ান্টাম টানেলিং। এখান থেকেই এন্টিগ্রেভেটি ফোর্স তৈরি হয় যা মহাবিশ্বকে সম্প্রসারণ করে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসে। আমাদের ইউনিভার্স বর্তমানে ট্রু ভ্যাকুয়াম স্টেটে অবস্থান করছে।
এভাবে ইনফ্লেশনের মাধ্যমে চারমাত্রিক জগত প্রসারিত হয় ও ছয়মাত্রিক জগত পরমাণু থেকেও ১০০ বিলিয়ন ক্ষুদ্র হয়ে যায়। বিজ্ঞানী আন্দ্রে লিন্ডে মনে করেন, একবার যখন ইনফ্লেশন সেট হয়ে যায়, এটি আর থামে না, এটি অনন্তকাল চলতেই থাকে। এটাকে বলে ইটারনাল ইনফ্লেশন। কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের প্রভাবে ইনফ্ল্যাটন ফিল্ডের এক একটি অঞ্চলে শক্তির ভ্যালু এক একরকম হয়, কিছু কিছু অংশ বেলুনের মতো ফুলতে থাকে আবার কিছু অংশ চুপসে যায়। কল্পনা করুন, আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে হতে আকস্মিক দুটি ইউনিভার্সে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারটিকে সমুদ্রের বাবলের সাথে তুলনা করা যায়। একটি বাবল বিভক্ত হয়ে যেমন একাধিক বাবল তৈরি হয়, ইনফ্লেশন স্পেস-টাইমের নতুন নতুন বাবল তৈরি করছে। এগুলোকে বলে পকেট ইউনিভার্স আর আমাদের মহাবিশ্ব হলো অসীম সংখ্যক বাবলের সমুদ্রে ভেসে থাকা একটি ক্ষুদ্র বাবল। এক একটি বাবলের ফিজিক্স ও ফান্ডামেন্টাল কনস্ট্যান্ট আলাদা। কখনো কখনো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বাবলের মধ্যে ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে কানেকশন তৈরি হয়, যা মহাবিশ্বগুলোর ভেতর একপ্রকার নেটওয়ার্ক তৈরি করে। আপনি চাইলে এসব ওয়ার্মহোল দিয়ে এক ইউনিভার্স থেকে অন্য ইউনিভার্সে চলেও যেতে পারেন।
অনেক ভাবতে পারেন, মাল্টিভার্স শক্তির নিত্যতা সূত্র অমান্য করে। কারণ থার্মোডায়নামিক্সের প্রথম আইন অনুসারে, শক্তি সৃষ্টি বা ধবংস হয় না, কেবল নতুন রূপে রূপান্তরিত হয়। একটি ইউনিভার্স তৈরি হওয়ার পর, সেই ইউনিভার্স থেকে নতুন নতুন ইউনিভার্স তৈরির অর্থ হলো, নতুন করে শক্তি সৃষ্টি হওয়া। এ শক্তি কোথা থেকে আসছে? এ প্রশ্নের উত্তর বোঝার জন্য কল্পনা করুন, একটি প্রবাহমান নদীর কথা। নদীর পানি বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখায় প্রবাহিত হতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে নদীতে সামগ্রিক পানির পরিমাণ পরিবর্তন হয়েছে। তেমনি সমগ্র মাল্টিভার্সের সামগ্রিক শক্তি শূন্য, এজন্য নতুন নতুন ইউনিভার্স তৈরি করার জন্য এখানে নতুন কোনো শক্তি যোগ অথবা বিয়োগ করার দরকার হয় না। সমুদ্রে বিলিয়ন বিলিয়ন বুদ্বুদ তৈরি হতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে সমুদ্রের সামগ্রিক পানির পরিমাণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। এছাড়া মহাবিশ্বে আমরা যে সব গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথ দেখি, সবকিছু পজেটিভ ভর ধারণ করে। কিন্তু আপনি যখন কোনো একটি গ্রহকে মহাশূন্যে রাখবেন, এটি তার চারপাশের স্পেস-টাইম বক্র করে দেবে। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে, বস্তুর ভর তার চারপাশের স্পেস-টাইম বক্র করে দেয়। এখান থেকে তৈরি হয় গ্রেভেটি। কিন্তু গ্রেভেটি যে শক্তি ধারণ করে তা নেগেটিভ। আর আপনি যদি পজেটিভ এনার্জিকে নেগেটিভ এনার্জির সাথে যোগ করেন তবে তার যোগফল হবে প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। অন্যকথায় মহাবিশ্ব একদম ফ্রিতেই তৈরি হয়েছে, শূন্য জুল শক্তি থেকে।
উদাহরণস্বরূপ, 1+(-1) = 0 (ওয়ান প্লাস নেগেটিভ ওয়ান ইকুয়াল টু জিরো) আবার 1000+(-1000)=0 ( থাউজেন্ড প্লাস নেগেটিভ থাউজেন্ড ইকুয়াল টু জিরো)। ইনফ্লেশনের সময় মহাবিশ্ব দুটি গ্যাজিলিয়ন এনার্জিতে বিভক্ত হয়েছিল 1 গ্যাজিলিয়ন মেগাওয়াট অব এনার্জি এবং 1 গ্যাজিলিয়ন মেগাওয়াট অব নেগেটিভ এনার্জি। আর তাই মহাবিশ্বের সামগ্রিক শক্তি এখনো শূন্য। এজন্য পদার্থবিদ লরেন্স ক্রস বলেছিলেন, আমাদের ইউনিভার্স একটি আল্টিমেট ফ্রি লঞ্চ ইউনিভার্স।
শেষ প্রশ্ন, মহাবিশ্ব যদি শূন্য থেকে তৈরি হয়ে থাকে, তবে সৃষ্টির শুরুতে সম পরিমাণ ম্যাটার ও এন্টিম্যাটার তৈরি হওয়ার কথা। এন্টিম্যাটারের চার্জ ম্যাটার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্ত সমস্যা হলো ম্যাটার ও এন্টিম্যাটার যখন কাছাকাছি আসবে, তখন তারা একে অন্যকে ধবংস করে গামা রশ্মি ছড়িয়ে দেবে। যদি তাই হতো আমরা মহাবিশ্বে কোনো গ্যালাক্সি অথবা গ্যালাক্টিক ক্লাস্টার দেখতাম না, মহাবিশ্বে গামা রশ্নি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যেত না। কিন্ত আমাদের মহাবিশ্ব গামা রশ্নির তৈরি নয়। অতএব প্রমাণ হয়, মহাবিশ্ব শূন্য থেকে তৈরি হয়নি। কিন্তু রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী আন্দ্রেই লিন্ডে বলেন, মহাবিস্ফোরণ পুরোপুরি প্রতিসম নয়। সৃষ্টির শুরুতে এন্টিম্যাটারের তুলনায় ম্যাটারের আধিক্য ন্যাচারালি একটু বেশি থাকে। এটাকে বলে সিপি সিমেট্রি ভায়োলেশন। মহাবিশ্ব যদি শূন্য হয়, তবে শূন্য হয়তো এবসলিউটলি শূন্য নয়, এখানে সামান্য পরিমাণ অপ্রতিসাম্যতা থাকে, আর এজন্য এন্টিমেটারের তুলনায় ম্যাটারের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হয়। কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনই মূলত আদি মহাবিশ্বের ম্যাটার ও এন্টিম্যাটারের সমতায় দোদুল্যমানতা তৈরি করে। আবার আর একটি থিওরি বলছে, অসীম মাল্টিভার্সের কোনো কোনটিতে ম্যাটার আবার কোনো কোনোটিতে এন্টি ম্যাটারের পরিমাণ বেশি হবে, এটাই ন্যাচারাল। অতএব মহাবিশ্ব তৈরির জন্য কোনো বুদ্ধিমান ঈশ্বরের সহযোগিতা দরকার নেই। কিন্ত কেন মহাবিশ্বে এন্টিম্যাটারের চেয়ে ম্যাটারের পরিমাণ বেশি, এটি এখনো একটি রহস্যজনক প্রশ্ম। তার মানে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে ঈশ্বরের ভূমিকা আমরা পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারি না। এখন প্রশ্ন, ঈশ্বর যদি থেকে থাকে, তার ঈশ্বর কে ছিল? যদি ঈশ্বর নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হয়, তবে মাল্টিভার্স কেন নিজে নিজে অস্তিত্বশীল নয়? আসলে ঈশ্বর আমাদের প্রশ্নের সল্যুশন নয়, এটি একটি সমস্যা কারণ এটি আমাদের আরও অসীম প্রশ্নের দিকে ঠেলে দেয়। এ যেন একটি ইনফিনিট লুপ।
মহাবিশ্ব যে শূন্য থেকে এসেছে তার সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রমাণ রাতের আকাশ! বাইবেলে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের বয়স ১০,০০০ বছর। আবার কোরআনে বলা হয়েছে, মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছিল মাত্র ৬ দিনে। কিন্তু সত্যি যদি মহাবিশ্ব এত অল্পসময়ে তৈরি হয়ে থাকে তবে রাতের আকাশ অন্ধকার হওয়ার কথা ছিল না। মুহূর্তেই রাতের আকাশ বিস্ফোরিত হতো। তাহলে প্রশ্ন, রাতের আকাশ কেন অন্ধকার? ইনফ্ল্যাশন থিওরি অনুসারে, মহাবিশ্ব ৬ দিন অথবা ১০,০০০ বছরে তৈরি হয়নি। এ থিওরি অনুসারে, সৃষ্টির শুরুতে এক সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ের ভেতর মহাবিশ্ব এত অসীম স্কেলে প্রসারিত হয়েছে, মহাবিশ্বের প্রতিটি ছায়াপথ একে অন্য থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে সরে গেছে। তারা এতটাই দূরে চলে গেছে, মহাবিশ্বের অজানা প্রান্তগুলো থেকে আমাদের কাছে এখনো আলো এসে পৌছায়নি। কারণ মহাবিশ্বের দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছানোর জন্য সাড়ে তের বিলিয়ন বছর যথেষ্ট নয়। এজন্য আমাদের কাছে রাতের আকাশকে অন্ধকার মনে হয়। রাতের আকাশ আমাদের কাছে কখনোই অন্ধকার মনে হতো না, যদি মহাবিশ্বের বয়স আরও কয়েকশ ট্রিলিয়ন বছর বেশি হতো। কারণ কয়েকশ ট্রিলিয়ন বছরে দূরবর্তী নক্ষত্রের আলো এসে রাতের আকাশকে আলোকিত করে তুলত। আবার মহাবিশ্ব যদি ৬ দিনে তৈরি হতো, দূরবর্তী নক্ষত্রের আলো অনেক পূর্বেই মহাকাশকে আলোকিত করে তুলত। এ পৃথিবীতে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও কোনো অন্ধকার পাওয়া যেত না। রাতের আকাশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, তুমি সাড়ে তের বিলিয়ন বছর সময়সীমায় আটকে গেছ, তোমার কোনো ঈশ্বর নেই। তুমি যখন মহাকাশেরর অন্ধকারের দিকে তাকাও, তুমি তাকিয়ে থাকো কসমিক সিঙ্গুলারিটিতে। সময় যত এগুচ্ছে, মহাবিশ্ব ততই সম্প্রসারিত হচ্ছে। মহাবিশ্ব এত দ্রুতগতিতে প্রসারিত হয়ে চলছে যে, আমাদের মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো দিন দিন আমাদের দৃষ্টিসীমার বাহিরে চলে যাচ্ছে। আমরা মহাকাশে আজ যে সব গ্যালাক্সি দেখি, সেগুলো রিয়েল নয়, আমরা তাদের ফেলা যাওয়া ফসিল আলো দেখি, তারা অনেক আগেই আমাদের মহাবিশ্বের ঘটনা দিগন্ত ক্রস করে হারিয়ে গেছে অন্য কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সে, যেটাকে বলে কসমোলজিক্যাল প্যারালাল ইউনিভার্স। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, আজ থেকে ১৫০ বিলিয়ন বছর পর ৯৯.৯৯৯৯৯ শতাংশ ছায়াপথ মহাবিশ্বের একদম শেষ প্রান্তে চলে যাবে। এ গ্যালাক্সিগুলো এত দ্রুতগতিতে দূরে সরে যাবে যে, তাদের আলো আমাদের কাছে আসার সময়ই পাবে না। তারা আমাদের টেলিস্কোপ থেকে এতটাই দূরে সরে যাবে যে আমরা তাদের দেখতেই পাব না। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে আমরা আজ প্রায় ১৫০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি দেখি কিন্তু ১৫০ বিলিয়ন বছর পর অল্পকিছু গ্যালাক্সি ও লোকাল সুপারক্লাস্টার দেখা যাবে। আরও পরে আমাদের মহাবিশ্বে ৩৬টি লোকাল গ্যালাক্সি পাওয়া যাবে। বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি আমাদের মহাবিশ্বের ঘটনা দিগন্ত ছেড়ে আড়াল হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো এতটাই দূরে সরে যাবে যে, একসময় আমরা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণই বুঝতে পারব না। আজ থেকে ১৫০ বিলিয়ন বছর পর আমাদের মহাবিশ্বে যদি কোনো বুদ্ধিমান জীবন জন্ম নেয়, তারা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বিশ্বাস করবে না কারণ তারা গ্যালাক্সিগুলোর সম্প্রসারণই পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না।