নিঃসন্দেহে আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস এর মধ্যে মহাকর্ষ বল একটা। চারটা মৌলিক বলের মধ্যে ( দূর্বল নিউক্লিয় বল, সবল নিউক্লিয় বল, তাড়িৎ চুম্বক বল এবং মহাকর্ষ বল)। বাকি তিনটাকে আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারলেও মহাকর্ষ বলকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি না। স্যার আইজাক নিউটন এর মতে মহাকর্ষ হলো একটা বল। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন তার জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটতে দেখান যে মহাকর্ষ কোন বল না এটা মূলত স্পেস-টাইম এর বক্রতা। মানে স্পেস-টাইমের কার্ভেরচার এর ফলে সৃষ্টি হয় এই মহাকর্ষ বল। এই বক্রতা বুঝানোর জন্য আমাদের টিচাররা বা বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে একটা চাদরের উপরে ভারী বস্তু রেখে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখানো হয় ঐ চাদরটা কিভাবে বক্র হয়ে যায়। এর থেকে আমরাও ছোট থেকে এটাই ভেবে এসেছি যে স্পেস সত্যি একটা চাদরের মতো। কিন্তু স্পেস-টাইম যদি সত্যি চাদরের মত হয় তাহলে ঐ চাদরটা কিসের উপরে অবস্থিত?
মূলত আমাদের মহাকর্ষ বিষয়টা সহজে বুঝানোর জন্য দ্বিমাত্রিক চাদর ব্যবহার করা হয় আদতে স্পেস কোন চাদরের মতো না আর এটা বক্রও হয় না। স্পেস-টাইম মূলত একটা ত্রিমাত্রিক কাঠামো। কিন্তু স্পেস এর বক্রতা বুঝানোর জন্য যে ছবি দেখানো হয় সেখানে একটা মাত্রা বাদ দিয়ে ছবিগুলো দেখানো হয় তাই দেখা যায় স্পেস বক্র হচ্ছে এবং গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে আদতে গর্ত বলতে কিছু নাই স্পেস মূলত বড় হচ্ছে। মানে স্পেস মোটেও চাদরের মতো কিছু না এটা ত্রিমাত্রিক জিনিস যা সত্যি সত্যি বাঁকে না লম্বা হয় বলে বেঁকেছে ধরে নেওয়া হয়।
কিন্তু আইন্সটাইনের এই জেনারেল রিলেটিভিটি মহাকর্ষ বলকে কোয়ান্টাম লেভেলে ব্যাখ্যা করতে পারে না। মানে মহাকর্ষ বল যদি সত্যি স্পেস-টাইমের বক্রতার কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে সাব-অ্যাটমিক লেভেলে এটা কেমন কাজ করে সেটা নিয়ে জেনারেল রিলেটিভিটি কিছু বলতে পারে না।।
আর তখন এই সমস্যা সমাধানে আসে স্ট্রিং থিয়োরি। এই থিয়োরি অনুসারে, মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক জিনিস হলো স্ট্রিং বা তারের মতো অতি ক্ষুদ্র কিছু যার বিভিন্ন কম্পনের ফলে আলাদা আলাদা জিনিস এর সৃষ্টি। মানে আপনার হাতের ফোন আর আপনার হাত একই জিনিস। কিন্তু এর মধ্যে থাকা স্ট্রিং এর আলাদা কম্পনের ফলে এদের আকৃতি গঠন আলাদা হয়েছে।
এখন এই স্ট্রিং থিয়োরিও মহাকর্ষ বলকে একটা মৌলিক বল হিসেবে ব্যাখ্যা করে। মানে স্ট্রিং থিয়োরি মতে বাকি তিনটা মৌলিক বলের মতো মহাকর্ষ একটা বল এবং এটি সৃষ্টিতেও রয়েছে গ্র্যাভিটন নামক একটা কণিকা। এ ক্ষেত্রে স্ট্রিং থিয়োরি সরাসরি জেনারেল রিলেটিভিটির বিরুদ্ধে যায় ৷ এছাড়াও এই থিয়োরিকে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রয়োজন ১১ টি ডাইমেনশন যা নিতান্তই সাইন্স মনে না হয়ে সাইন্স ফিকশন মনে হওয়ার কথা। এই কারণে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন আমাদের মহাবিশ্ব অনেকগুলো সুপার ইউনিভার্স এর একটি স্লাইস মাত্র। যাকে বলা হয় মেমব্রেন। মানে আমরা যখন পাউরুটি খাই তখন সেখানে অনেক গুলো স্লাইস এ পাউরুটির টুকরো ভাগ হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি আমাদের এই মহাবিশ্বও একটা সুপার মহাবিশ্বের একটা টুকরো হতে পারে ৷
এই স্ট্রিং থিয়োরি এতো রোমাঞ্চকর তথ্য দিতে পারার ফলেও, সেই সোনার হরিনি মহাকর্ষকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতেই পারেনা। সুতরাং এই সমস্যা সমাধান করার জন্যই জন্ম হলো এই লুপ- কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি থিয়োরির। এখন পর্যন্ত এই থিওরি মহাকর্ষ বলকে অনেকটা নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছে।
রাশিয়ান বিখ্যাত পদার্থবিদ ম্যাটভেই ব্রনস্টেইন (Matvei Bronstein) ১৯৩০ সালে, স্থানকালের সম্ভাব্য কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দেন। ব্রনস্টেইনের হিসাব অনুসারে, স্থান নিরবিচ্ছিন্ন নয় এটি কোয়ান্টাইজ মানে স্থান অনেকগুলো ছোট বিন্দুর সমন্বয়, যেমন আমাদের সোয়েটার বা টি-শার্ট কে দূর থেকে দেখলে স্মুথ মনে হয় কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখলে এটির মধ্যে ছোট ছোট ফোটার মতো দেখা যায়। ঠিক তেমনি স্পেসও দূর থেকে স্মুথ মনে হলেও মাইক্রোস্কোপিক্যালি এটি ছোট ছোট অংশে বিভক্ত। স্থানকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বিভাজন করা সম্ভব। এই সীমা হলো, L(p)
এখানে, ћ ( এইচ কাট) = রিডিউসড প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক ( যার মান h/2π) G = নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, এবং c = আলোর বেগ। এই তিনটি ধ্রুবক একই সমীকরণে ব্যবহার করার মানে হলো, এই থিয়োরি এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, যেটা মাধ্যাকর্ষ (G), আপেক্ষিকতা (c), এবং কোয়ান্টাম-মেকানিক্স (ћ) তিনটির সাথেই সম্পৃক্ত। উপরের সমীকরণকে সমাধান করা হলে, L(p)এর মান পাওয়া যায় 10^-35 মিটার।
মানে এই কোয়ান্টাইজ স্পেস এর দৈর্ঘ হলো 10^-35 মিটার। এবং এর ক্ষেত্রফল হলো 10^-70 মিটার^২ এবং এর আয়তন হলো 10^-105 মিটার^৩ । এই L(p)কে বলে প্ল্যাঙ্ক-দৈর্ঘ্য।
এই থিয়োরি অনুযায়ী সর্বনিম্ন প্ল্যাঙ্ক-আয়তনে ১০^১৯ গিগা-ইলেকট্রন ভোল্টের বেশি শক্তি কখনোই থাকতে পারবে না। এর থেকে বেশি শক্তি এতো ক্ষুদ্র স্থানে আসলে সেটা বিকর্ষন করতে থাকে যার ফলে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে থাকে, অর্থাৎ এই থিয়োরি বিগ ব্যাংকেও অনেকটা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
আবার এই থিয়োরি অনুযায়ী সময়ও স্মুথ নয় এরও একটা সর্বনিম্ন মান রয়েছে আর সেটি হলো 10^-43 সেকেন্ড। মানে এর থেকে আর কম সময়, আয়তন, দৈর্ঘ এবং ক্ষেত্রফল সম্ভব নয়। এর থেকে আমরা বলতে পারি ব্ল্যাকহোলের সিংগুলারিটিরও একটা আয়তন আছে।
এই লুপ কোয়ান্টাম গ্রেভিটি থিওরির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো এটি জেনারেল রিলেটিভিটি এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্স উভয় থিয়োরিকেই মান্য করছে। লুপ কোয়ান্টাম গ্রেভিটি থিয়োরি অনুযায়ী স্পেস যে ছোট ছোট বিন্দুর মতো লুপ দ্বারা গঠিত এই লুপ গুলোই সময় এবং মহাকর্ষের নির্মাণ করে। আমরা জানি কোয়ান্টাম দুনিয়ায় সবকিছুই অলওয়েজ কাঁপতে থাকে তেমনি এই লুপগুলোর কম্পনের ফলেই সৃষ্টি হয় সময় এবং স্থানের। আবার যখন কোন ভর এই লুপের উপরে আসে তখন এই লুপগুলো বক্র হয়ে যায় ( লম্বা হয়ে যায়) আর তখন সেখানে সময় স্লো হয়ে যায় বাকি স্থানের হিসেবে।
এতো কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারলেও এই থিয়োরি বিজ্ঞানীদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। তাই এই থিয়োরিকে থিয়োরি অব এভরিথিং বলা চলে না। এটি জাস্ট কোয়ান্টাম গ্রেভেটির একটা অংশ। তবে এখনো এই থিয়োরি গবেষণার পর্যায়ে । ভবিষ্যতে হয়তো এটা থিয়োরি আরো ডেভেলপ হবে নাহলে অন্য কোন অনুত থিয়োরি আসবে। দেখা যাক কি হয়।।।
এবার স্ট্রিং থিওরি এবং লুপ-কোয়ান্টাম গ্রেভিটির মধ্যে কিছু পার্থক্য জেনে আসা যাক।
১. স্ট্রিং তত্ত্ব চারটি মৌলিক বলের মিথস্ক্রিয়াটিকে একত্রিত করার একটি তাত্ত্বিক প্রচেষ্টা। আর লুপ কোয়ান্টাম গ্রেভিটি চারটি মৌলিক মিথস্ক্রিয়া একত্রিত করার চেষ্টা করে না। এটি কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণের একটি তত্ত্ব মাত্র।
২. স্ট্রিং তত্ত্ব কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৌলিক দিকগুলি থেকে শুরু হয়। লুপ কোয়ান্টাম গ্রেভিটি অন্যদিকে, সাধারণ আপেক্ষিকতার উপর নির্ভর করে এবং মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের পরিমাণ নির্ধারণ করে।
৩. স্ট্রিং থিয়োরি উচ্চ মাত্রিক স্থানে কাজ করে যেমন এটিকে ব্যাখ্যা করতে ১১টি মাত্রার প্রয়োজন পরে। তবে, লুপ কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ উচ্চতর মাত্রার প্রয়োজন হয় না।
৪. স্ট্রিং থিওরি মহাকর্ষকে একটা বল হিসেবে ব্যাখ্যা করে। তবে লুপ কোয়ান্টাম গ্রেভিটি অনুযায়ী স্পেসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লুপ এর কম্পনে মহাকর্ষের সৃষ্টি।
এটি স্ট্রিং তত্ত্ব এবং লুপ কোয়ান্টাম গ্রেভিটির মধ্যে প্রধান পার্থক্য । যদিও উভয় তত্ত্ব কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বকে মডেল করার চেষ্টা করে তবে তারা তাত্ত্বিকভাবে খুব আলাদা। এই নিবন্ধটি উভয় তত্ত্বের মৌলিক দিকগুলি এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।।
সোর্সঃ
চা কফি আর জেনেরাল রিলেটিভিটি ( নাঈম হোসেন ফারুকী)
Reality Is Not What It Seems: The Journey to Quantum Gravity (Carlo Rovelli & Simon Carnell। )