জেয়ার্ড ডায়মন্ড তার “The Third Chimpanzee” গ্রন্থে একটি মাইন্ড ব্লোয়িং দাবি করেছিলেন আর তা হলো মানুষ বুদ্ধিমান নয়, বুদ্ধিহীন ও ধ্বংসাত্মক একটি প্রজাতি। মানুষের সমাজে পরিবেশগত ধ্বংস ও প্রজাতির বিলুপ্তির একটি দীর্ঘকালীন ইতিহাস আছে। ডায়মন্ড প্রস্তাব করেছিলেন, মানব প্রজাতির একটি প্রবণতা আছে অতিরিক্ত সম্পদ ভোগ করার এবং তাদের আচরণ পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতির পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য ফ্যাক্টর।
এ চ্যালেঞ্জ মানুষের বিশেষত্বের ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিকোণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং নির্দেশনা দেয় যে, মানুষ সহজাতভাবে বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, কিন্তু তারা এ গ্রহকে উন্নত ও শাসন করে তাদের অভাব, অভিযোজন ও ধ্বংসাত্মক আচরণের সমন্বয়ে। এ প্রসঙ্গ খুবই বিতর্কিত কারণ এটি পৃথিবীর পরিচালক হিসেবে মানুষের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং পরামর্শ দেয় যে, আজ আমরা যে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি তার পেছনে আমাদের আচরণ একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।
কল্পনা করুন, একটি গ্রুপের কথা যারা একটি জঙ্গলের পাশে বাস করে। তারা টিকে থাকার জন্য জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে কারণ এটি তাদের খাবার, আশ্রয় ও অন্যান্য সম্পদ প্রদান করে। প্রাথমিকভাবে, তারা জঙ্গলের সাথে রিজোন্যাট হয়ে বাস করেছিল, কেবল তাই গ্রহণ করেছিল যা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় এবং তারা জঙ্গলকে পুনরুৎপাদিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল।
কিন্তু সময়ের সাথে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং তাদের চাহিদাও বাড়ে। তারা আগুন জ্বালানোর জন্য গাছ কেটে ফেলে, মাংস ও চামড়ার জন্য পশু শিকার করে এবং নতুন কিছু প্রজাতির সূচনা করে যেমন গৃহপালিত পশু যারা ইকোসিস্টেমের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে।
প্রথমত, এ প্রভাব দৃশ্যমান হয়নি এবং মানুষ নিরবচ্ছিন্নভাবে সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু যেহেতু তারা অবিরাম জঙ্গল নিধন করছে, তারা একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করে। মাটি ডিপ্লেট বা ক্ষয় হয়ে যায় ও পানির সাপ্লাই কমে যায় এবং কোনো এক সময়ের সমৃদ্ধ বন্য জীবন অদৃশ্য হয়ে যায়।
এ সতর্কতামূলক সংকেতের পরও, মানুষ তাদের সংক্ষিপ্ত সময়ের অর্জনকে গুরুত্ব দিতে থাকে, তাদের দীর্ঘকালীন স্থিতিশীলতার ওপরে। তারা আরও বেশি বেশি গাছ কাটে, শিকার করে এবং আরও অধিক ল্যান্ড পরিস্কার করতে থাকে, তাদের আশা ছিল তারা তাদের ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যা টেকশই করবে। কিন্তু অবশেষে, জঙ্গল আর তাদের প্রয়োজনীয়তা সমর্থন করতে পারে না এবং তাদের সোসাইটি কলাপ্স করে।
এ উদাহরণ আমাদের কাছে বর্ণনা করছে কীভাবে দীর্ঘকালীন দৃষ্টিকোণ প্রত্যাহার করে শর্ট-টার্ম অর্জনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে একটি সমাজ ফাঁদে পড়ে যায়, যা তাদের নিজেদেরই পতনের কারণ হয়। তাদের কর্মের দীর্ঘকালীন প্রভাব মূল্যায়ন করার অক্ষমতা ইকোসিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা ও তাদের আচরণের সাথে মিসম্যাচ তৈরি করে। এটি পরিবেশগত ডিগ্রেশন, রিসোর্চ ডিপ্লেশন এবং চূড়ান্তে সোসাইটাল কলাপ্সের কারণ হয়।
জেয়ার্ড ডায়মন্ড মানব প্রজাতির এ দীর্ঘকালীন কনসিকোয়েন্স চিন্তা না করে করে শর্ট-টার্ম চাহিদা মূল্যায়ন করার বিবর্তনীয় প্রবণতার ওপর একটি হাড় শীতল করা বই লিখেছিলেন “The Last Tree on Easter Island” নামে যে বই ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এ গল্প আর অন্য কারও নয় ইস্টার আইল্যান্ডের সে দুর্ভাগা মানুষগুলোরই, যারা প্রকৃতির সাথে ঐক্যতান রেখে খুব সুন্দরভাবে জীবন শুরু করেছিল। টিকে থাকার জন্য তারা নির্ভরশীল ছিল কৃষি ও মাছের ওপর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে তাদের চাহিদা ও চাওয়া বৃদ্ধি পায়, তারা আশঙ্কাজনক হারে দ্বীপের গাছ কাটতে থাকে, একবারের জন্যও তারা তাদের কর্মের প্রভাব চিন্তা করেনি।
যে দ্বীপ একসময় প্রচুর বৃক্ষে পরিপূর্ণ ছিল এবং দ্বীপবাসীদের যা প্রয়োজন সবকিছু দিয়েছিল সেটি একসময় অদৃশ্য হতে শুরু করে। তারা ফিউচারের কথা একবারও ভাবেনি, তারা অবিচ্ছিন্নভাবে গাছ কেটেছিল, শেষ পর্যন্ত কেবল একটি গাছই দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর, হতাশার এক মুহূর্তে তারা শেষ গাছটিও কেটে ফেলে!
বৃক্ষটি যখন পতিত হয়, একইসাথে পতিত হয় আইল্যান্ডারদের সকল আশা ও স্বপ্ন । তাদের আর কোনো কাঠ ছিল না, তাদের আর বাড়ি তৈরি করার কোনো উপাদান ছিল না অথবা ছিল না আগুন! তাদের ফিশ ও ফার্ম কিছুই ছিল না, কেবল ছিল অবারিত শূন্যতা আর হাহাকারে জর্জরিত বন্ধ্যা ভূমি ও বিধ্বস্ত পরিবেশ। মন খারাপ করা ব্যাপার হলেও “The Last Tree on Easter Island” সম্ভবত সমগ্র মানব সভ্যতারই অন্তিম পরিণতি!
এ একই পরিণতির আরও একটি রিয়েল টাইম উদাহরণ হলো মায়া সভ্যতার পতন যেটাকে অ্যামেরিকার একটি অন্যতম প্রাক-কলোম্বিয়ান উন্নত সভ্যতা হিসেবে বিচার করা হয়। এটি উন্নতির চরম উচ্চতায়, এখনো মেক্সিকো, বেলিজ, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের বিশাল অংশকে ঘিরে রেখেছে যেটাকে চিহ্নিত করা হয় শিল্প, স্থাপত্য, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও কৃষির এক অনবদ্য অর্জন হিসেবে।
যাইহোক, অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীতে, মায়া সভ্যতা তাদের শহরগুলো পরিত্যাগ ও পতনের এক অবিচ্ছিন্ন পরম্পরার শিকার হয়। পন্ডিতরা অনেকগুলো ফ্যাক্টর প্রস্তাব করেছিলেন যা মায়া সভ্যতার পতনের কারণ যার মধ্যে আছে যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন ও রোগ।
পরিবেশগত ডিগ্রেশন বা অবক্ষয়ের পেছনে একটি প্রধান কারণ ছিল টেকশই কৃষির অনুশীলনের অনুপস্থিতি। মায়ারা এক ধরনের স্ল্যাশ-এন্ড-বার্ন কৃষির চর্চা করত, আর এ পদ্ধতির সবচেয়ে খারাপ দিক ছিল বিশাল জঙ্গল পরিস্কার করে ফেলা ও ফার্মল্যান্ড তৈরি করার জন্য গাছপালা পুড়িয়ে ফেলা। এ প্রক্রিয়া কেবল জঙ্গল বিলুপ্তই করেনি, মাটি ক্ষয় ও পুষ্টির অবক্ষয় করেছে এবং সময়ের সাথে ফসল উৎপাদন করা কঠিন করে তুলেছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল, মায়ারা কৃষির চর্চাকে আরও সুতীব্র করে যা আরও বেশি পরিমাণে জঙ্গল ও মাটির অবক্ষয় ঘটায়।
এটি খাবার সংরক্ষণ ও পরিবেশগত পতনের একটি দুষ্ট চক্র তৈরি করেছিল যেটি সবশেষে সে সভ্যতার পতনে অবদান রেখেছিল। আজ, মায়া সভ্যতার শহরের ধ্বংসাবশেষগুলি মানব সভ্যতার দীর্ঘমেয়াদী বেঁচে থাকার জন্য টেকসই পরিবেশগত অনুশীলনের গুরুত্বের প্রতি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে।
ডায়মন্ড দাবি করেছিলেন, বিবর্তনীয় ইতিহাস জুড়ে মানুষ অতিরিক্ত পরিমাণ সম্পদ ভোগ করেছিল এবং তারা পটভূমি এমনভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছিল যে পরিবেশ ও অন্যান্য প্রজাতির ওপর এটি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে। মানুষ বিশাল ম্যামথ ও দৈত্যাকার গ্রাউন্ড স্লথ শেষ করে দেয়। মানুষ কৃষির জন্য জঙ্গল ধ্বংস করে দেয়, জলবায়ু পরিবর্তন করে দেয় এবং গ্রহের ওপর অনিশ্চিত প্রভাব তৈরি করে।
মানুষের ইতিহাসে, খাবার ও অন্যান্য সম্পদ ছিল সীমিত। যে সকল মানুষ এ সময় অতিরিক্ত ভোগ করার মানসিকতা প্রকাশ করেছিল তারাই অন্যদের থেকে টিকে থাকার উপযোগিতা পেয়েছিল। প্রাকৃতিক নির্বাচন তাদেরই সমর্থন করেছিল যারা সংক্ষিপ্ত সময়ে অতিরিক্ত সম্পদ ভোগ করতে সক্ষম ছিল। এতে করে মানুষের জিনের এ ভোগবাদী ভ্যারিয়েশন প্রাকৃতিক নির্বাচনে টিকে যায় ও যে সকল মানুষ সংকটজনক পরিস্থিতিতে ভোগবাদ থেকে পিছিয়ে পড়ে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। সময়ের সাথে সংক্ষিপ্ত সময়ে অতিরিক্ত ভোগ করার প্রবণতা আমাদের মস্তিষ্কের অ্যালগোরিদমে পরিণত হয় এবং আমরা আমাদের অন্ধভোগের দীর্ঘকালীন পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করার প্রবণতা হারিয়ে ফেলি। দারিদ্র্যতা ও অভাব মানুষের দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গের মতোই একটি বায়োলজিক্যাল হার্ডওয়্যার, এটি দূর করার কোনো বিষয় নয়।
এছাড়া আজ থেকে ৪.২ মিলিয়ন বছর পূর্বে আমাদের আদিম পূর্বসূরী আর্ডিওপিথিকাসরা বৃক্ষ থেকে মাটিতে নেমে আসার পর থেকে মানুষের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেখানে ৪.২ মিলিয়ন বছর পূর্বে আর্ডিওপিথিকাসদের মস্তিষ্কের আকার ছিল ৩০০-৩৫০ সিসি, সেখানে ১.৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাসদের মস্তিষ্কের আকার ছিল ৯৫০ সিসি। আর অন্যদিকে মানুষের মস্তিষ্কের আকার ১৩৫০ সিসি। মানুষের মস্তিষ্ক মেটাবলিক্যালি এক্সপেনসিভ এবং গবেষকরা নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, আমাদের পূর্বসূরীরা তাদের এ বড় মস্তিষ্ককে সমর্থন করেছিল পুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে যেমন মাংস ও অন্যান্য অ্যানিমেল ফুড। আর মস্তিষ্কের সম্প্রসারণ আমাদের পূর্বসূরীদের আরও বেশি পরিমাণে সম্পদ অর্জন ও ভোগ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
মানুষের মস্তিষ্ক বড় হওয়ার সাথে সাথে তার জ্ঞানগত ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় যেমন পরিকল্পনা ও ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয়তার প্রতি চিন্তা। এটি আদিম মানুষদের এমন একটি সামাজিক পদ্ধতি উন্নতি করার জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিল যেটি খাবার জমিয়ে রাখে ও সম্পদ ভাগ করে। এ অভিযোজন মানুষকে পরিবর্তনশীল পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে যেখানে খাবারের দুষ্প্রাপ্যতা ছিল খুবই সাধারণ। তারা এখন সংক্ষিপ্ত সময়ে অতিরিক্ত ভোগ করে তাই নয়, তারা এখন সম্পদ জমিয়েও রাখে।
সময়ের সাথে মানুষ আরও বিবর্তিত হয় এবং খাবার অর্জন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে তারা দক্ষ হয়ে ওঠে। এতে করে তাদের সম্পদের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয় ও তারা কৃষির উন্নয়ন ঘটায়। যার মাধ্যমে তারা আরও অনেক বেশি খাবার উৎপাদন করে। যার ফলস্বরূপ, মানুষ খাবার ও অন্যান্য সম্পদ আরও বেশি বেশি ভোগ করতে পারদর্শী হয়ে ওঠে।
যদিও এ অ্যাডাপটেশন তাদের বিবর্তনীয় অতীতে উপযোগী ছিল, এটি আধুনিক সময়ে অসুবিধা সৃষ্টি করে যেখানে খাবার ও সম্পদ প্রাচুর্যময় ও সহজেই উপলব্ধ। বিবর্তনীয় অতীতের সাথে আমাদের আধুনিক বিশ্বের এই মিসম্যাচ স্থুলতা, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের মতো বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে।
আরও পড়ুন: প্রস্তরযুগ থেকে স্ক্রিনওয়ার্ল্ড