৬০০-৮০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই গ্রহে সর্বপ্রথম নিউরন সেল বিবর্তিত হয় বলে জানা যায়। সরল নিউরাল নার্ভের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নিডারিয়ার মতো প্রাণীদের মাঝে, যা অঙ্গ-সঞ্চালন ও সংবেদনশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সকল প্রাণীর মস্তিষ্ক আছে। নিউরন সেল প্রাণীদের অনেক প্রাচীন একটি অভিযোজন, যা অন্যান্য জীবেরও আছে। এমনকি যে সকল প্রাণীর সম্পূর্ণ ব্রেন স্ট্রাকচার নেই, তাদেরও নার্ভাস সিস্টেম আছে, তাদের মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক তথ্য প্রসেস করার জন্য একসাথে কাজ করে। বৃক্ষের ব্রেন নেই, তাদের এমন কোনো সেল নেই যার মাধ্যমে তারা তথ্য প্রসেস করতে পারে। বৃক্ষ ও প্রাণীর মধ্যে অনেক তারতম্য আছে।
বৃক্ষরাও দুর্দান্তভাবে পরিবেশকে জবাব দিতে জানে! প্যারিস জ্যাপোনিকা নামক এক বৃক্ষ আছে, বৃক্ষটির জিনোম মানুষের চেয়ে ৫০ গুণ বড় (১৪৯ বিলিয়ন বেজ পেয়ার) কিন্তু তারা জটিল কোনো কাজ করতে পারে না। আর এজন্য গাছ কাটা বা কোনো ফুল ছিঁড়ে ফেলা এত সহজ। কিছু বৃক্ষ সূর্যের দিকে উদীত হয়, কিছু বৃক্ষ নিজেকে সহায়তা করার জন্য অন্যকিছুকে আঁকড়ে ধরে এবং এমন অনেক বৃক্ষ আছে যাদেরকে স্পর্শ করলে পিছিয়ে যায় বা নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
প্রাণীদের মতো দেখতে একটি বৃক্ষ আছে যার নাম ভিনাস ফ্লাইট্র্যাপ। ভিনাস ফ্লাইট্র্যাপ এমন এক মাটিতে বিবর্তিত হয় যেখানে বিশেষ কিছু পুষ্টির ঘাটতি আছে। তারা সেই পুষ্টি অর্জনের জন্য কীট-পতঙ্গ শিকার করে। তাদের মধ্যে প্রাণীদের শিকার করার জন্য, ঝিনুকের মতো একটি মুখের বিবর্তন ঘটেছে, যে মুখটি যখন “হা” হয় তখন নেক্টার সংগ্রহ করার জন্য পতঙ্গরা উড়ে আসে, ঠিক তখনই ভিনাস ফ্লাই তার মুখটি বন্ধ করে দেয়! যখন ঝিনুকের মতো দেখতে দুটি ঠোঁটের পাতা ট্রিগারড হয়, তখন এমনটা হয়ে থাকে। এর ফলে মেকানিক্যাল ও কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের একটি পরম্পরা সংঘটিত হয়। ফলশ্রুতিতে, লোবটি বন্ধ হয়ে যায় এবং বৃক্ষরা ডাইজেস্টিভ এনজাইম নিঃসরণ করে।
আপনি ভিনাস ফ্লাইট্র্যাপকেও ইনফরমেশন প্রসেসিং সিস্টেম হিসেবে চিন্তা করতে পারেন। পরিবেশ থেকে যে উদ্দীপনা আসে তা সিগনালে পরিণত হয়। সিগনালের মধ্য দিয়ে তারা বুঝতে পারে কে তার কাছে অথবা দূরে রয়েছে। যদিও এই সিগনাল বেশ জটিল মেকানিক্যাল প্রক্রিয়ায় কাজ করে থাকে। লক্ষ্য করুন, ইনফরমেশন প্রসেসিং বৃক্ষের নিজের মেকানিক্সের ভেতরেই সংঘটিত হয়। এই মেকানিজম রি-অ্যারেঞ্জ বা চেঞ্জ করে ইনফরমেশনকে ভিন্নভাবে প্রসেস করা অসম্ভব।
ভিনাস ফ্লাইট্র্যাপ বিবর্তিত হয়েছে এমন কিছু নিয়ম দিয়ে, যা শুধু কাছের জিনিসকেই শনাক্ত করতে পারে। বিবর্তন এটাকে আর জটিল করতে পারেনি। আমরা আগেই বলেছি, প্রায় সব প্রাণীরই মস্তিষ্ক আছে। তবে ব্যতিক্রম হলো – সি স্পঞ্জ। সি স্পঞ্জ কোনো কাজ করতে পারে না। তবে এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকে। তার ভেতরে একটি মেকানিজম আছে, যার মাধ্যমে সে সমুদ্রের পানি থেকে পুষ্টি সংগ্রহ এবং আবর্জনা ত্যাগ করতে পারে। এটা আসলে খুব চমৎকার কোনো জীবন নয়। সি স্পঞ্জ এমন একটি প্রাণী, যার কোনো মন নেই, সে শুধু খায় আর বর্জ্য ত্যাগ করে! যত দ্রুত প্রাণীদের নিউরন সেল ও নার্ভাস সিস্টেম উন্নত হয়, তাদের কর্মের জটিলতা ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এটি ঘটার কারণ হলো- নিউরন একটি ফ্লেক্সিবল সিস্টেমের বিল্ডিং ব্লক, যা বিবর্তন ব্যবহার করে অধিক থেকে অধিকতর ইনফরমেশন প্রসেসিং অ্যালগোরিদম হিসেবে।
জেলিফিশের খুব সাধারণ একটি নার্ভাস সিস্টেম আছে কিন্তু এর কোনো প্রকৃত ব্রেন নেই। জেলিফিশের মাত্র ৮০০টি নিউরন রয়েছে কিন্তু ভিনাস ফ্লাইট্র্যাপ থেকে তার কর্মকান্ড অনেক বেশি জটিল। ব্রেনের আকার বড় হতে থাকলে, আকস্মিকভাবে যাদু সংঘটিত হয়। যে সকল প্রাণীর হাজার হাজার নিউরন রয়েছে, আমরা তাদের মাঝে উড্ডয়ন ও চলনশক্তির মতো জটিল কর্মকান্ড দেখতে পাই। মিলিয়ন মিলিয়ন নিউরন তৈরি হলে আমরা দেখতে পাই ইঁদুরের মতো প্রাণী যারা ধাঁধা সমাধান করতে পারে এবং তাদের বাচ্চাদের জন্য বাসা তৈরি করতে পারে।
বিলিয়ন নিউরন তৈরি হলে আমরা মানুষের মতো প্রাণী দেখতে পাই, যারা আবার একে অন্যের মস্তিষ্কের সাথে কোয়াড্রিলিয়ন নিউরাল সিগনাল আদান প্রদানের মাধ্যমে জন্ম দেয় মেগামাইন্ড। যার ভেতরে গড়ে ওঠে সিম্ফোনি ও স্পেসশিপ। ৬০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে জন্ম নেওয়া নিউরাল নেটওয়ার্কে ২০২২ সালে আজকের দিনে মহাবিশ্ব জেগে ওঠে।

এই নিউরাল নেটওয়ার্ক জানে, মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি। তারা জানে, কীভাবে বিগ ফ্রিজের সময় চিন্তাকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বছর পর্যন্ত ধীর করে, কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে অন্য মহাবিশ্বে চলে যেতে হয়! মহাবিশ্বের তেরো বিলিয়ন বছর অতীতকে স্ক্যান করার জন্য স্পেসের সকল মহাজাগতিক বাধা অতিক্রম করে, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ লঞ্চ করা হয় একুশে[1]।
তারা আজ আন্তঃনাক্ষত্রিক বিপর্যয়কেও চাইলে ঠেকাতে পারে কিন্তু ঠেকাতে পারে না তাদের ক্ষুদ্র কিছু অনুভূতি ও আবেগ! তারা অতিক্রম করতে পারে না তাদের হিংস্রতা, আগ্রাসন, স্বার্থপরতা ও বিষাক্ত যুদ্ধের মনোভাব; রাশিয়া ও ইউক্রেন যার এক জীবন্ত স্বাক্ষর। তারা মাধ্যাকর্ষের প্রভাব থেকে বের হতে পারে কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরাল সিগনালে অবরুদ্ধ! কেন? কেন ২০২২ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে উইল স্মিথকে তার আবেগের কাছে পরাজিত হতে হলো? স্নায়ুবিজ্ঞানে কি এর ব্যাখ্যা আছে? মস্তিষ্ক এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে জটিল অর্গান! কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা এর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। একটি রকেট পরিচালনা করতে হলে তার কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রয়োজন হয়, অথচ মানব মস্তিষ্ক সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেই আমরা প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছি।
মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের বিবর্তনে আমরা যে অপটিমাল সিস্টেম অর্জন করেছি, সেই বিশ্বস্ত সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতার উপর। এটা আমাদের প্রজাতির জন্য খুবই ভয়ানক এক অভিজ্ঞতা হতে পারে! কারণ আমরা ইউনিভার্সের সবচেয়ে জটিল নভোযানটির সিস্টেম সম্পর্কে কোনোপ্রকার ধারণা না রেখেই তার পাইলট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি! এবং এটি হয়তো যেকোনো মুহূর্তে মানবজাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে পারে।
দ্য ব্রেন : দ্য স্টোরি অব ইউ বইটিকে আমি মূলত এজন্যই টার্গেট করেছি। আমি এটাকে সবক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুবাদ না করে সাম্প্রতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সাধারণের বোধগম্যতার ভেতর উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্ত করেছি আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও অভিমত ( কোথাও কোথাও ভাব ও ভাষাগত অসঙ্গতি হয়তো থাকবে যা আমার বিজ্ঞ পাঠকগণ আমাকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে স্নেহের সহিত জানাবেন, এটা আমার অনুরোধ) আমি কে? আমার মস্তিষ্কের ভেতর কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে? কে নিয়ন্ত্রণ করে আমাকে নিউরনের ভেতর? কীভাবে আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি? কেন আমার অন্য কারো নিউরন প্রয়োজন? ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি আমার আমিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমাদের উত্তরসূরীদের ব্রেনকে কি প্রযুক্তি এমনভাবে বদলে দেবে যে তারা পূর্বে কী ছিল তারই রহস্য উদ্ধার করার জন্য তারা সারাজীবন যুদ্ধ করবে?

আজ আমরা মানসিকভাবে আমাদের ৭০ হাজার বছর অতীতের পূর্বসূরীদের নিউরাল সার্কিটে বাস করছি। আমাদের ব্রেন হার্ডওয়্যার তাদের থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। আমরা এখনো আদিম পূর্বসূরীদের স্নায়ুতন্ত্র ছিঁড়ে বের হতে পারিনি কিন্তু আমাদের পরবর্তী গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট, গ্রেট চিল্ড্রেনের ব্রেন নেটওয়ার্ক কি আমাদের মত হবে? একসময় আমার আমি বিবর্তিত হয়েছিলাম ফিজিক্সের সূত্র মেনে, নিজের অজ্ঞাতে। ফিউচার টেকনোলজি কি ‘আমি কে হবো’ তার সমস্ত দায়িত্ব ও ক্ষমতা আমার সচেতনতার হাতে তুলে দেবে? মিচিও কাকুর মতে, আমাদের মস্তিষ্ক ভার্সের খুবই জটিল অবজেক্ট। এ মস্তিষ্কের ভেতর ৮৬ বিলিয়ন নিউরন। প্রতিটি নিউরন দশ হাজার নিউরনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এভাবে ২০০ ট্রিলিয়ন নিউরাল কানেকশন জন্ম হয় মস্তিষ্কের নিউরনের ভেতর। এ নিউরাল কানেকশনকে বলে “কানেক্টম”VII !
কানেক্টমকে বোঝার জন্য আপনার জিনোমের কথা চিন্তা করুন। আমাদের ডিএনএ হলো একটি দীর্ঘ অণুর শিকল। যাকে বলা হয়- নিউক্লিওটাইড। এটি চার প্রকার; যাদেরকে আমরা চিহ্নিত করি- A, G, T ও C নামে। আপনার জিনোম হলো এই নিওক্লিওটাউড সমূহের সামগ্রিক সিকোয়েন্স। এটি খণ্ডিত কিছু নয়। জিনোম শব্দটি সামগ্রিক ডিএনএ সিকোয়েন্সকে নির্দেশ করে। ঠিক তেমনি কানেক্টম আপনার মস্তিষ্কের আলাদা কোনো নিউরাল কানেকশনকে বোঝায় না। এটা আপনার মস্তিষ্কের সমগ্র নিউরাল কানেকশন।

জিনোমের সাথে কানেক্টমের তারতম্য আছে। আপনার জিনোম ফিক্সড। এটা কখনো পরিবর্তন হয় না। আজ থেকে ৭০ হাজার বছর পূর্বের একজন শিকারী, সংগ্রাহকের জিনোমের সাথে আপনার জিনোমের কোনো তারতম্য নেই। কিন্তু আফ্রিকার সাভানার একজন আদিম পূর্বসূরীর মস্তিষ্কের কানেক্টমের সাথে আইনস্টাইনের কানেক্টমের তারতম্য আছে।
যদি তাই না হবে তবে আজ থেকে ৭০ হাজার বছর পূর্বেই E=mc2 প্রাচীন পূর্বসূরীদের কানেক্টম থেকে বেরিয়ে আসতো। এটি আবিষ্কারের জন্য হাজার হাজার বছর আমাদের অপেক্ষা করতে হতো না।
আপনার ব্রেনের কানেকশন রিওয়াইট, রিকানেক্ট, রিওয়্যার ও রিজেনারেট হয়; এর সাথে আপনার অভিজ্ঞতার সম্পর্ক রয়েছে। আজ থেকে ৭০ হাজার বছর পূর্বের একজন শিকারী সংগ্রাহকের অভিজ্ঞতা আর আপনার অভিজ্ঞতার জগত এক নয়। তাই দুজনের কানেক্টম সম্পূর্ণ আলাদা। জিন ও অভিজ্ঞতা দুটোই আপনার মস্তিষ্কের কানেক্টম গড়ে তোলে। আপনার জিনোমে রয়েছে ২০ হাজার জিন কিন্তু মস্তিষ্কের কানেকশন সংখ্যা ২০০ ট্রিলিয়ন। মানুষ ব্যাতিত অন্য কোনো প্রাণীর ব্রেন কানেকশন হয়তো এভাবে পরিবর্তন হয় না।
২ লাখ বছর পূর্বের একটি সাধারণ প্রাণীর জিনোম ও কানেক্টম আজও প্রায় একই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে জিনোম একই হলেও কানেক্টম সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনার মস্তিষ্ককে যদি সাসপেন্ডেন্ড এনিমেশনের[2] মাধ্যমে ৫০ হাজার বছর থামিয়ে রাখা হয় এবং তারপর পুনরায় চালু করা হয়, তাহলে আপনি সম্পূর্ণ বদলে যাবেন। কারণ পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে সমন্বিত হতে গিয়ে আপনার নিউরাল কানেকশন বদলে যাবে। যদিও আপনার জিনোম তখনও ৫০ হাজার বছর পূর্বেই রয়ে গেছে।
অন্যদিকে একটি ইঁদুর ৫০ হাজার বছর পর ঘুম থেকে জেগে উঠলেও সে তেমনই থেকে যাবে। তার বেসিক ড্রাইভগুলো আগের মতোই কাজ করবে, তার মধ্যে মানসিক কোনো পরিবর্তন পাওয়া যাবে না! আমাদের ব্রেন অনেকটা প্লেট টেকটোনিকের মতো, অভিজ্ঞতা পরিবর্তনের সাথে অভ্যন্তরীণভাবে বদলে যায়! কিন্তু এর কারণ কী?
তার মানে আপনি জিনের চেয়েও বেশি কিছু, আপনি আপনার কানেক্টম?একটি কম্পিউটারের সাথে আপনার মস্তিষ্কের পার্থক্য হলো- কম্পিউটার নিজের সার্কিট নিজে পরিবর্তন করতে পারে না। কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি আক্রান্ত কম্পিউটার নিজের মাদারবোর্ডের যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামত করে, নিজেই নিজেকে এন্টি ভাইরাস দিয়ে SETI@HOME-সাইটে অ্যালিয়েন হান্টার হিসেবে লগ ইন করতে পারেনা । একটি টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কম্পিউটার নিজের সংযোগ পুনরুদ্ধার করতে পারে না। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক তার নিউরাল নেটওয়ার্ক অভিজ্ঞতার পরিবর্তনের সাথে নিজে নিজে বদলে নেয় এবং অনুপস্থিত কোনো একটি অংশের ক্ষতি সে পুষিয়েও নিতে জানে। মস্তিষ্কের প্রতিনিয়ত এই রিওয়্যারিং-এর জন্যই ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নিউরাল কানেকশন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যদি জিন আমাদের ব্রেন কানেক্টমকে অন্যান্য প্রাণীদের মতো একদম সোজাসাপ্টা প্রোগ্রাম করে রাখতো, তাহলে আজ আমাদের ব্রেন কানেক্টম লক্ষ বছর অতীতে যেমন ছিল তেমনই থেকে যেত।
পৃথিবীতে আইনস্টাইন নামক কোনো মানুষ পাওয়া যেত না। তাই বলে এমনটা ভাবা চরম বোকামি হবে যে, আমাদের ব্রেনের সাথে আদিম পূর্বসূরিদের কোনো মিল নেই। আমরা আগেই বলেছি, আমাদের ব্রেন আমাদের পূর্বসূরীদের স্নায়ুবিক নেটওয়ার্কেই বাস করে। কিন্তু তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য মস্তিষ্কের এই আদিম নেটওয়ার্ক-এর পুনর্বিন্যাস ও সমন্বিত হওয়ার প্রক্রিয়ায়। অতএব, আপনার কানেক্টমই মূলত আপনি। তবে আপনি মূলত কে, তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। আজ থেকে ৭ বছর পূর্বে আপনার দেহে প্রায় ৭ অক্টিলিয়ন অ্যাটম ছিল, সেগুলোর সবক’টি পরিবর্তন হয়ে গেছে! আপনার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরাল কানেকশনও পরিবর্তন হয়ে যায় প্রতি ন্যানোসেকেন্ডে! তবুও আপনার মনে হয়, আপনি এখনো আপনিই রয়ে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে- কেন? আপনার আমিত্ব বোধ কেন অপরিবর্তনীয়? আপনি কী আপনার মেমরির যোগফল?
২০০৭ সালে এপিলেপ্সি থেকে মুক্তির জন্য ক্যামরন [3]নামক একজন মেয়ের মস্তিষ্কের একটি হেমিস্ফিয়ার কেটে ফেলে দেয়া হয়VIII। তার খুলির ভেতরে, মগজের অর্ধেক গর্ত হয়ে যায়। সেখানে ঢেলে দেয়া হয় একপ্রকার তরল রাসায়নিক পদার্থ। কিন্তু অপারেশন শেষ হওয়ার পর ক্যামরন অন্যান্য স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের মতো স্কুলে অংশগ্রহণ করে, সমাজ ও পরিবারের সাথে পূর্বের মতোই যোগাযোগ বজায় রাখে! তার মগজের অর্ধেক বাদ দেয়ার পরেও তার মাঝে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না! কেন? জানা যায়, মস্তিষ্কের নিউরোপ্লাস্টিসিটির কারণে তার মস্তিষ্কের অবশিষ্ট অংশ নতুন নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে। যা বাদ পড়া অংশটির ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারে!
দেখা যাচ্ছে, কম্পিউটার ও মানব মস্তিষ্ক এক বস্তু নয়! একটি কম্পিউটারকে যদি আপনি মাঝখান দিয়ে ভেঙে দুই ভাগ করে দেন তবে সেটি আর রিস্টার্ট হবে না! একটি টুকরো হয়ে যাওয়া কম্পিউটারের সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়! কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মানব মস্তিষ্কের সিংহভাগ অংশ কেটে বাদ দিয়ে দেয়ার পরও মস্তিষ্ক ট্রান্সফরমার মুভির অপটিমাস প্রাইমের মতো নিজেকে কোনো একভাবে কানেক্ট করতে পারে। এর পেছনে রহস্য কী?তার মানে কি আমাদের ব্রেন হার্ডওয়্যারড নয়? এর জীবন আছে? এটি একটি লাইভওয়্যার্ড? এই বইতে নিউরোসায়েন্সের পোস্টার বয় এবং নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার বুক ‘ইনকগনিটো’-এর লেখক নিউরোসায়েন্টিস্ট ডেভিড ঈগলম্যান এসব কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন! মস্তিষ্কের পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে নিজের নিউরাল নেটওয়ার্ক বদলে ফেলার সক্ষমতার কারণে ঠিক যেভাবে আপনি বদলে যান, ঠিক তেমনি পরিবর্তনশীল অচেনা পরিবেশে মস্তিষ্কের এভাবে সমন্বিত হওয়ার ক্ষমতা টিকে থাকার ক্ষেত্রে অভাবনীয় সফলতা নিয়ে আসে। সেই সাথে বয়ে আনে প্রযুক্তিগত বিপ্লব! কিন্তু কীভাবে?মনে রাখবেন, প্রতিটি প্রাণী নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিবর্তিত। একটি জেলিফিশকে আপনি যদি তার স্থানীয় পরিবেশ থেকে অন্য কোনো পরিবেশে ছুঁড়ে ফেলে দেন তবে সে বিভ্রান্ত হয়ে যাবে! তার পক্ষে টিকে থাকা হয়তো সম্ভব নয়। প্রতিটি প্রাণীর মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট জেনেটিক ইনস্ট্রাকশন মেনে চলে! তাই পরিবেশ বদলে গেলে তার ব্রেনও কাজ করে না! অথচ জল, স্থল অথবা স্পেসশিপ যে কোনো অচেনা পরিবেশে মানুষের ব্রেন খুব অল্প সময়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে! মানব মস্তিষ্কের মাঝে রয়েছে অচেনা-অজানা পরিবেশের সাথে সমন্বিত হয়ে ওঠার দারুণ ক্ষমতা!
আর এজন্য বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের ভেতর যখন কোনো অ্যালিয়েন বা নতুন ডিভাইস ইমপ্লান্ট করেন কোনো অচেনা প্যাটার্নে ইলেক্ট্রিক সংকেতও প্রেরণ করার জন্য, সাময়িক সংঘাতের পর মস্তিষ্ক সেই অ্যালিয়েন সংকেতকেও তার নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করতে পারে! অথচ আপনি সেটা সচেতনভাবে বুঝতে পারেন না।
শুধু অচেনা পরিবেশে সমন্বিত হওয়ার জন্যই মানুষের ব্রেন কানেকশন পরিবর্তন হয় তা নয়; মস্তিষ্ককে কেটে ক্রেনিয়ামের ভেতর অচেনা কোনো যান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে দিলেও, টিকে থাকার স্বার্থে মস্তিষ্ক তার নিউরাল কানেকশন পরিবর্তন করে সেই পরিবেশের সাথে সমন্বিত হয়ে যায়। অপরিচিত কোনো পরিবেশের সাথে সমন্বয়ের জন্য মস্তিষ্ক কী করছে, সে-ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। আপনার সচেতন জ্ঞান না থাকলেও ব্রেন তার নিজস্ব অ্যালগোরিদম মেনে কাজ করে যায়। এর কারণ- আপনার ব্রেন লাখ লাখ বছর ধরে এভাবে কাজ করার জন্য অভিযোজিত।আর এখানেই জন্ম হয় সচেতন ও অবচেতনের পার্থক্য! মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্কের এই রিওয়্যার ও সমন্বিত হওয়ার নিউরোপ্লাস্টিসিটি মস্তিষ্কের সাথে সম্পৃক্ত প্রযুক্তিতে এনে দিয়েছে এক মহাবিপ্লব! এই বইতে আলোচনা করা হয়েছে কেন আমরা গ্রুপিং করতে পছন্দ করি? কেন আমরা ভিন্ন কোনো গ্রুপের সাথে সংঘাত করি? কেন আমাদের মধ্যে যুদ্ধের মনোভাব কাজ করে? একজন বিচারক তার জৈবিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে রায় দিতে সক্ষম কিনা, নাকি তিনি নিজেই তার বায়োলজিক্যাল কারাগারে অবরুদ্ধ? এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, একজন নাস্তিক ও মুক্তমনা নিউরাল দিক থেকে অন্য কোনো ধর্ম ও গোত্রের প্রতি সহানুভূতি বোধ করে কিনা! পেইন ম্যাট্রিক্স কী? জোনোসাইডের নিউরোলজি কী? আমরা কেন রাস্তার মানুষকে ইট, পাটকেল অথবা বিল্ডিং থেকে আলাদা কোনো অবজেক্ট মনে করি না ? কেন আমাদের মধ্যে মরাল ডিলেমা কাজ করে? কেন ভয়ানক পরিস্থিতিতে সময় থেমে যায়? এসবের পেছনের নিউরোলজিক্যাল ব্যাখ্যা কী?শুনলে হয়তো অবাক হবেন, যে নিউরন সেল দিয়ে আমাদের ব্রেন তৈরি, যে নিউরনগুলো একসাথে মিশে আমাদের চেতনা তৈরি করে, যে চেতনার ভেতর এ মহাবিশ্ব প্রকাশিত; সেই নিউরনসেলগুলো নিজেরাই জানে না চেতনা কী? ইউনিভার্স কী? ফিজিক্সের সূত্র কী? শুধু তাই নয়, আপনার মস্তিষ্কের একটা নিউরনও জানে না যে আপনি কে! প্রশ্ন হলো- যদি নিউরনে চেতনা না থাকে, তবে কীভাবে এই নিউরনগুলো আপনার ভেতর চেতনা তৈরি করে? মস্তিষ্কের বিভিন্ন খণ্ড এবং অংশের মিথস্ক্রিয়ায় যদি কনসাসনেস তৈরি হয় তবে একটি মিল ফ্যাক্টরির কনসাসনেস নেই কেন? কেন একটি শহরের কনসাসনেস নেই? চেতনার জন্য কী নিউরন অপরিহার্য? যদি চেতনার জন্য নিউরন অপরিহার্য হয় তবে আমরা নিউরনের বাহিরে কখনো চেতনা তৈরি করতে পারতাম না কিন্তু কেন আমরা খুলির বাহিরেও চেতনাকে রাখতে চাইছি? এর পেছনে বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি কী?
এই গ্রন্থে লেখক দেখিয়েছেন, চেতনা মূলত নিউরনের উপর নির্ভরশীল নয়! চেতনা বায়োলজিক্যাল নয়! আর এজন্যই আমরা মানুষের মস্তিষ্কের কানেক্টমকে কম্পিউটারে সিমুলেট করতে পারি। আমরা মানুষের সিমুলেটেড চেতনাকে থামিয়ে (Pause) রেখে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পর অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে পুনরায় চালু (Reboot) করতে পারি। এ যেন এক ওয়ার্মহোল, আপনি কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই যা আপনাকে এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে নিয়ে যায়। আজ আমরা মহাবিশ্বের তেরো বিলিয়ন বছর অতীতকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ প্রেরণ করি। তবে যদি আমরা সিমুলেটেড কনসাসনেস তৈরি করতে পারি, তাহলে সরাসরি আমাদের চেতনা একদিন মহাবিশ্বের তেরো বিলিয়ন বছর অতীত ভ্রমণ করতে পারবে! কিন্তু কীভাবে? এর পেছনেও মূলত লুকিয়ে আছে গিউলিয়ো টনির বিশ্ববিখ্যাত এক এক্সপেরিমেন্ট! যে পরীক্ষাটি আসলে তুড়ি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার মতো নয়!
সর্বশেষ অধ্যায়ে হাজার বছর পূর্বের চায়নিজ দার্শনিক চুয়াং জু’র এক বিশ্ববিখ্যাত প্রশ্ন ফিরে আসে : স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি একটি প্রজাপতি। কিন্তু আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো যে- আমি এই মুহূর্তে একটি প্রজাপতি, যে স্বপ্ন দেখছে সে একজন মানুষ, যার নাম- চুয়াং জু! আমাদের বাস্তবতা স্রেফ একটি সিমুলেশন নয় তো? এক্সট্রারনাল মহাবিশ্বে এনার্জি ও ম্যাটার ছাড়া কিছুই নেই? তাহলে আমরা শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ এবং এই টেকনিকালার দুনিয়াকে কেন দেখছি! এই মহাবিশ্ব আমাদের স্বপ্ন নয় তো? আমরা নিজেরাই সিমুলেশন নই তো? আমরা কী কারো ব্রেনের ভেতর বাস করছি যেটাকে সঠিক মাত্রায় স্টিমুলেট করার ফলে আমাদের এই বিশ্বের জন্ম হয়েছে?

তথ্যসূত্রঃ The Brain: The story of You!
লেখকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত আরও কয়েকটি বইঃ