Can't find our books? Click here!
ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ

ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ

আপন দাস

সময়টা ২০২০ সাল, যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতন বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস। চারিদিকে তখন লকডাউন আর সেলফ আইসোলেশনের বিভীষিকায় মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়া মানুষের ঠাঁই নেবার অন্য কোনো জায়গা নেই। মহামারিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই নতুন, অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে গুজবের নৌকার পালে যেন এক নতুন হাওয়া লাগতে শুরু করে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। সেই সময়ে কাকতালীয় অথবা কোকিলতালীয়ভাবে ‘ফ্যাক্টওয়াচ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বরাতে আমার ফ্যাক্ট চেকিং এর হাতেখড়ি হয়। কিছুদিন শেখার পর টের পাই, এ এক নেশার মতন। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগের সাহায্যে কিছু কলাকৌশল প্রয়োগ করেই এটি করা যায়। শুরুতে আশ্চর্য লাগত এটা লক্ষ্য করে যে, একটা সময়ে যে সমস্ত সংবাদমাধ্যমে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম, সেই সংবাদমাধ্যমগুলো থেকেও ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়। যেসকল মানুষদের অনেক সচেতন এবং দায়িত্বশীল হিসেবে জানতাম, অবাক হতাম তাদেরও গুজবের ফাঁদে পা দিতে দেখে। ধীরে ধীরে তখন বুঝতে শুরু করি, ডিজিটাল যুগের নয়া বাস্তবতা ক্রমশই আমাদের জীবন-যাপন কে যে দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তারই একরকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাজির হয়েছে অনলাইন তথ্য বিভ্রাট যার সহসা কোনো সমাধান নেই।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২৮ লাখ। উক্ত পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে, বর্তমানে দেশের একটি বৃহৎ অংশ ইন্টারনেটের আওতায় রয়েছে এবং এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাবে। করোনা মহামারি আমাদের আগের তুলনায় আরও বেশি ইন্টারনেট নির্ভর করে তুলেছে, আবার অনেক দুরত্বে থেকে বিভিন্ন ধরণের কাজ চালিয়ে যাবার অপার সম্ভাবনাও উন্মোচন করেছে। পূর্বের যেকোন সময়ের তুলনায় স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট এখন অনেক বেশি সহজলভ্য। এর প্রভাবে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, বিনোদন সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে স্মার্ট ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্য এখন আরও সহজলভ্য, বলা চলে প্রায় সর্বস্তরের মানুষের একদম হাতের মুঠোয়। নেট দুনিয়ায় কিছু লিখে সার্চ করলে নিমিষেই ভূরি ভূরি তথ্য হাজির হচ্ছে।

ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ
ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ


তথ্যের এই সহজলভ্যতার পাশাপাশি তৈরি হয়েছে এক নতুন সংকট। এত এত তথ্যের ভীড়ে কোনটি আসল আর কোনটি ভেজালযুক্ত এই ভাবনা এখন আমাদের জন্য অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তথ্যের এই সংকট মোকাবেলায় নতুন নামে হাজির হয়েছে সাংবাদিকতার পুরনো এক চর্চা, যার নাম ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ বা তথ্য যাচাই। গুজবের ভিড়ে সঠিক তথ্যটি খুঁজে পেতে ফ্যাক্ট চেকিং এর কলাকৌশল এখন বয়স, পেশা এবং শ্রেণীভেদে প্রায় সকল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জানা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত সঠিক তথ্য শিক্ষিত ও সচেতন সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইতিহাস জুড়ে দেখা যায়, তথ্যাভিজ্ঞ মানুষরাই তাদের জীবন ও গোষ্ঠী সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তগুলো ঠিকঠাকভাবে নিতে পারেন।


‘ট্রাস্ট, বাট ভেরিফাই: ফ্যাক্টরস অ্যাফেক্টিং মিডিয়া ট্রাস্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোনো সংবাদমাধ্যমে ভুয়া খবর প্রকাশিত হলে ২২ শতাংশ পাঠকই তা তাৎক্ষণিকভাবে ধরতে পারেন না। জ্ঞানগত পক্ষপাত, তথ্য স্বাক্ষরতার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন, অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সহ বিভিন্ন কারণে প্রতিনিয়ত ভুল ও অপতথ্যের অবাধ সমাগম ঘটছে আমাদের অনলাইন থেকে অফলাইন জগতে। অল্প সময়ে সাম্প্রদায়িক সংঘাত থেকে শুরু করে, গণপিটুনি, মানহানি, নির্বাচন প্রভাবিত করা, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি সহ বিভিন্ন রকমের বিপর্যয় সৃষ্টিতে ইতিমধ্যে গুজবের ভূমিকা ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।


কেউ গুজব ছড়ালে তার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ অনুযায়ী, ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ মিথ্যা তথ্য ছড়ালে তিন বছর থেকে পাঁচ বছর কারাদণ্ডে তিনি দন্ডিত হতে পারেন। অথচ এই আইন পুরোপুরি গুজবের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না, থামাতে পারছে না অপতথ্য প্রচারকারীদের তৎপরতা। কথায় আছে, “প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম”। প্রযুক্তিগত গোপনীয়তার বলয়ে থাকা অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি যে কাজটি এখন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সেটি হচ্ছে গুজব রোধ করা। অর্থাৎ গুজবে বিশ্বাস না করা, গুজব চিহ্নিত করা এবং তা ভাইরাল হতে না দেয়া। গুজব সৃষ্টিকারীর সাথে পাল্লা দিয়ে সঠিক তথ্যটি খুঁজে বের করে সকলের সামনে হাজির করা। বর্তমানে বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বের গুজব পরিস্থিতির যে নাজুক হাল তা কেবল গুটিকয়েক ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থার মাধ্যমে পরিবর্তন সম্ভব নয়। তথ্য মহামারির এই ক্রান্তিলগ্নে ফ্যাক্ট চেকিং কে তাই প্রাতিষ্ঠানিক জায়গা থেকে ছড়িয়ে দিতে হবে ব্যক্তিগত ব্যবহারিক পর্যায়ে, জনসাধারণের মাঝে বাড়াতে হবে তথ্য স্বাক্ষরতার হার।


আশার কথা, বাংলাদেশে ক্রমশ ফ্যাক্ট চেকিং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ২০১৭ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর নতুন নতুন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা গড়ে উঠছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ফ্যাক্ট চেকিং নিয়ে একরকম উদাসীনতা দেখা গেলেও পেশাদার সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যয়নরত প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য ফ্যাক্ট চেকিং জানা আবশ্যক, অন্তত গুজব ছড়ানো থেকে নিজেদের বিরত রাখতে। আমি যখন ফ্যাক্ট চেকিং শুরু করেছিলাম, তখন এমন কোনো বই আমার চোখে পড়ে নি। এখন মনে হয়, যদি বাংলা ভাষায় তথ্য যাচাই সংশ্লিষ্ট কোনো বই তখন পেতাম, তাহলে হয়তো আরও বেশি সমৃদ্ধ হতে পারতাম। সেই ভাবনা থেকেই আমার ফ্যাক্ট চেকিং শেখা এবং চর্চার অভিজ্ঞতাগুলো আগ্রহীদের কাছে তুলে ধরতে এই বইটির কাজ শুরু করেছিলাম। বইটিতে ফ্যাক্ট চেকিং এর কিছু সাধারণ কলাকৌশল ও টুল সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি চেষ্টা করা হয়েছে ফ্যাক্ট চেকিং এর ইতিহাস ও বিভিন্ন রকমের তথ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়ার, বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা হয়েছে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ এবং কিছু কেস স্টাডি। বইটি লিখতে নিজের কর্মঅভিজ্ঞতা ছাড়াও বিভিন্ন বই, গবেষণাপত্র, নিবন্ধ, সংবাদ প্রতিবেদন এবং প্রাসঙ্গিক দলিল থেকে তথ্য-উপাত্তের সাহায্য আমি নিয়েছি।


ফ্যাক্ট চেকিং এ আমার হাতেখড়ি যাদের মাধ্যমে হয়েছিল, যে দুইজন মানুষের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ, তারা হলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ফ্যাক্টওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সুমন রহমান স্যার এবং আমার সাবেক সহকর্মী সাজিয়া শারমিন আপু। এছাড়াও বিডি ফ্যাক্টচেক এবং কদরুদ্দিন শিশির ভাইয়ের প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ, যাদের কার্যক্রম আমাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে, শিখিয়েছে তথ্য যাচাইয়ের অনেক খুঁটিনাটি। পরিশেষে আমার সাবেক দুই সহকর্মী সামস ওয়াহিদ এবং জহিরুল ইসলাম কে স্মরণ করছি, যাদের সাহচার্য আমাকে পেশাদার ফ্যাক্ট চেকার হয়ে উঠতে নিরন্তর প্রেরণা জুগিয়েছে।


ফ্যাক্ট চেকিং এর কলাকৌশলগুলো শুধু বই পড়ে শেখা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। এর বেশিরভাগটাই আসলে হাতে কলমে করে শিখতে হয়। এখানেই বইয়ের সীমাবদ্ধতা এবং প্রশিক্ষণের স্বার্থকতা। আমি ফ্যাক্ট চেকিং এর পাশাপাশি এই বিষয়ে সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী এবং ফ্যাক্ট চেকারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। বইটির একাংশ তাই প্রশিক্ষণের ভাষায় লেখা হয়েছে যা হাতেকলমে শেখানোর ভঙ্গিতে নবাগতদের তথ্য যাচাইয়ের প্রাথমিক ধারণা লাভে সহায়ক হবে। ফ্যাক্ট চেকিং এর ইতিহাস, গুজবের অর্থনীতি ও সমাজ-মনস্তত্ত্ব, বাংলাদেশের গুজব পরিস্থিতি, তথ্য যাচাইয়ের প্রাথমিক কিছু কলাকৌশল ও প্রয়োজনীয় টুলের ব্যবহার, এবং তথ্য যাচাইয়ের নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে ধারণা দিতে এই বইটি শাস্ত্রীয় সীমানা পেরিয়ে প্রায় সকল জ্ঞানকান্ডের শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, অধ্যাপক এবং নবীন ফ্যাক্ট চেকারদের সামান্য হলেও সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি।


ফ্যাক্ট চেকিং করতে গিয়ে প্রায়শই অনেক প্রচলিত বর্ণনাকে আমি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছি। তথ্য যাচাইয়ের পেশাদারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তথ্য স্বাক্ষরতা বিষয়ক তৎপরতায় খানিকটা লিপ্ত থেকেছি। এই বইটির চূড়ান্ত পান্ডুলিপি প্রস্তুত করা শেষে আমার খুঁতখুঁতে মনে একটি স্বভাবসুলভ সন্দেহ দানা বেঁধেছে, অবচেতন মনে আমিও কি এই বইয়ের কোথাও ভুল তথ্য দিয়েছি? যদি ভুলবশত তা করেই থাকি, তবে সেটি খুঁজে বের করার দায়িত্ব বইটির পাঠকদের কাছেই আমি অর্পণ করলাম। বইটি নিয়ে আপনার যেকোনো প্রশ্ন, ভাবনা, এবং মতামত আমাকে লিখে জানাতে পারেন ইমেইলে। বইটি যদি কোনোভাবে কারও কাজে লাগে, ফ্যাক্ট চেকিং এর প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে, তবেই বইটির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের শ্রম স্বার্থক হবে। গুজবের বিরুদ্ধে এই অন্তহীন লড়াইয়ে আপনাকে স্বাগতম!

প্রচ্ছদ মূল্য: 500 টাকা মাত্র। (৩০% ডিসকাউন্ট)

বইটি প্রি-অর্ডার করার জন্য যোগাযোগ করুন: হাইপারস্পেস

আরও পড়ুন: ডোপামিন: দ্য মলিকিউল অব মোর

ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ ফ্যাক্ট চেকিংয়ের প্রথম পাঠ