অনেকেই হয়তো অবাক হতে পারেন যে প্লেটো, যাকে প্রায়শই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা পিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তার ‘ডায়ালগ’ বা সংলাপগুলোর একটিতে প্রধান একটি চরিত্র হিসাবে তিনি একজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মানটিনিয়ার ডাইওটিমার সাথে ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের প্রকৃতি নিয়ে তার আলোচনা প্লেটোর বিখ্যাত কাজগুলো একটিতে -‘সিম্পোজিয়াম’ – অমর হয়ে আছে। তবে, ডাইওটিমা নিজে রহস্যময় রয়ে গেছেন, অনেকেই যুক্তি দিয়েছেন যে, আদৌ তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আর এই কঠিন ধাঁধাঁটি ধারণার ইতিহাসে ডাইওটিমার সম্ভাব্য অবদান অনেকাংশেই আবৃত করে রেখেছে, যা এখনো সম্পূর্ণভাবে মূল্যায়ন কিংবা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার শিক্ষাগুলো, যদি আসলেই সেগুলো তার হয়ে থাকে, দুই হাজার বছর পরে এখনো মূল্যবান।
প্লেটোর ডায়ালগগুলোয় বর্ণিত অল্প কয়েকজন নারী চরিত্রের একজন ছিলেন ডাইওটিমা। অন্য আরেকজন ছিলেন মাইলিটাসের আসপাসিয়া, ‘মেনেক্সেনাস’ সংলাপে যাকে বিশেষ ভূমিকা দেয়া হয়েছিল। ডাইওটিমা কিংবা আসপাসিয়া, দুইজনের কেউই তাদের নিজস্ব অধিকারে এই সব সংলাপে বক্তা হিসাবে আবির্ভূত হননি। এর পরিবর্তে সক্রেটিস তার পুরুষ শ্রোতা বা আলোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে এই দুইজনের সাথে তার পূর্ববর্তী কোনো সংলাপের বর্ণনা দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় প্লেটোর একাডেমিতে শিক্ষার্থী হিসাবে বেশ কয়েকজন নারীও ছিলেন, তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ফ্লিয়াসের অ্যাক্সিওথিয়া এবং মানটিনিয়ার লাসথিনিয়া।
দর্শনের ইতিহাসে এমন একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাবের কথা যদি বিবেচনা করি, আমরা হয়তো বিস্মিত হতে পারি, সত্যিকারের ঐতিহাসিক কোনো চরিত্রের চেয়ে বরং পুরাণ সদৃশ ডাইওটিমাকে কেন বিদ্যায়তনিক দার্শনিকরা উপেক্ষা করেছিলেন। কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ভালো দার্শনিক বলতে কী বোঝায় সেটির উদাহরণ দিতে গিয়ে স্বয়ং প্লেটোই ডাইওটিমাকে সাহিত্যের একটি কৌশল হিসাবে সৃষ্টি করেছিলেন। ধারণা করা হয় এটি ‘সিম্পোজিয়ামের’ মূল আলোচক আগাথনের তর্কশৈলীর সাথে খাপ খাইয়ে নেবার একটি কৌশল ছিল। সক্রেটিস যেমন ‘ফিড্রাস’ সংলাপে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, বাচনভঙ্গির পূর্ণ শক্তি অর্জন করতে হলে, আত্মাকে কীভাবে প্ররোচিত করতে হবে সেটি অবশ্যই আগে জানতে হবে, এবং সেটি সফলভাবে করতে হলে, আপনার কথোপকথকদের আত্মা সম্বন্ধে অবশ্যই জানতে হবে। বিতর্কে একজন নারীকে তার সঙ্গী হিসাবে উপস্থাপন করা হয়তো তার অবস্থানটি আরও বেশি প্ররোচনা সমর্থ অর্থাৎ বোধযোগ্য করে তোলার একটি উপায় ছিল।
গবেষকরা, যেমন মারি এলেন ওয়াইথ তার ‘এ হিস্টরি অব উইমেন ফিলোসফারস’ (১৯৮৭) বইয়ে ডাইওটিমাকে একজন ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিলেন। আর আমরা কেন এই দৃষ্টিভঙ্গিটি হয়তো গ্রহণ করতে পারি, তার কিছু কারণ আছে। এটি সত্য যে, ডাইওটিমা নামে কোনো দার্শনিক কখনো এথেন্সে এসেছিলেন এবং সক্রেটিসের সাথে তারা দেখা হয়েছিল ও তিনি তাকে দর্শন শিক্ষা দিয়েছিলেন কিনা, সেই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। তবে, আমরা জানি যে, প্লেটোর সংলাপগুলোয় আবির্ভূত বহু চরিত্রের আসলেই অস্তিত্ব ছিল, আর সেটি হয়তো ডাইওটিমার বাস্তব অস্তিত্ব সম্ভাব্য করে তুলেছে। ‘মেনো’ সংলাপে যেভাবে তিনি বিজ্ঞ পুরুষ ও নারীদের নিকট থেকে উপদেশ সংগ্রহ করার বিষয়টির প্রতি তথ্যনির্দেশ করেছিলেন, সেটি অনেককেই বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করেছে যে, সম্ভবত সক্রেটিস নারীদের মতামতও সংগ্রহ করতেন। এবং ডাইওটিমার মত কোনো নারীর সাথে যে তিনি ভালোবাসার প্রকৃতি বিষয়ে আলাপ করেছিলেন, সেটি হয়তো খুব অসম্ভাবনীয় কিছু নয়। আমরা হয়তো আরও ভাবতে পারি, তিনি যে একটি কাল্পনিক চরিত্র ছিলেন সেই দাবীগুলোর সম্ভবত জন্ম হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে এমন বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ কোনো নারীর আদৌও অস্তিত্ব থাকতে পারে এমন অবিশ্বাস থেকে।
এমনকি যদি ডাইওটিমা প্লেটোর কল্পিত এক চরিত্র হয়ে থাকে, তারপরও দর্শনের ইতিহাসে একজন গুরুত্বপূর্ণ নারী হিসাবে তাকে স্বীকৃতি দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। কাল্পনিক কিংবা বাস্তব, সক্রেটিসের প্রস্তাবিত যুক্তিগুলোর উপর তার কণ্ঠের একটি শক্তিশালী প্রভাব ছিল, আর সেকারণে আমাদের জানা দর্শনের ইতিহাসেও তার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, ডাইওটিমার অস্তিত্ব ছিল কিনা সেটি এখানে আমাদের মূল চিন্তার বিষয় না। আসুন শুধুমাত্র স্বীকার করে নেই যে, আমাদের প্রথম দর্শনের রানি খানিকটা রহস্যময় এক প্রহেলিকা ছিলেন।
যেভাবে আমরা উল্লেখ করেছি আগেই, ডাইওটিমার চরিত্রটি প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়াম’ সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করেছে। আর শুধু ‘সিম্পোজিয়াম’ সংলাপটি ডাইওটিমার সাথে সংশ্লিষ্ট দর্শন নিয়ে আমরা যা কিছু জানি তার সবটাই ধারণ করছে। একটি ‘সিম্পোজিয়াম’ হচ্ছে পুরুষদের একটি জমায়েত, যেখানে বিচিত্র ধরনের দার্শনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়, সাধারণত ভোজসভা আর মদ্যপানের অনুষ্ঠানের পরেই এটি সংঘটিত হতো। যদিও, প্লেটোর ‘সিম্পোজিয়ামে’ মৌলিক একটি পার্থক্য ছিল: এখানে একজন নারীকে বর্ণনা করা হয়েছিল যার ধারণাগুলো বইটিতে উপস্থাপিত অন্য পুরুষ চিন্তাবিদদের ধারণার সাথে সমপরিমাণ মর্যাদা উপভোগ করেছিল। ভালোবাসার অর্থ নিয়ে বক্তৃতা দিতে সিম্পোজিয়ামের প্রধান চরিত্র বা অধিবক্তাদের প্রতি তাদের আথিত্যকর্থা আগাথন অনুরোধ করেছিলেন। তার সঙ্গীদের নানা যুক্তিতর্ক শোনার পর, সক্রেটিস বলেছিলেন মানটিনিয়ার ডাইওটিমার নিকট থেকে তিনি ‘ভালোবাসার দর্শনে’ শিক্ষিত হয়েছেন। তাকে তিনি একজন বিজ্ঞ নারী, দার্শনিক এবং ধর্মযাজিকা হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। যখন ডাইওটিমাকে সক্রেটিস পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, তিনি আরও দাবি করেছিলেন যে, এথেন্সে একটি মহামারির সম্ভাবনা তিনি আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং এর নাগরিকদের দেবতাদের প্রতি বিসর্জন এবং কিছু আচার অনুসরণ করার নির্দেশনা প্রদান করে সেটি সফলভাবে প্রতিহত করেছিলেন। সেই কারণে ডাইওটিমা চরিত্রটিকে দূরদর্শিতা ও ভবিষ্যৎকথনের সাথে প্রায়শই সংযুক্ত করা হয়। সক্রেটিস এটিকে ডাইওটিমার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, এবং কিছু গবেষক যুক্তি দিয়েছেন, সেখানে উপস্থিত অন্যদের পার্থিব প্রজ্ঞার সাথে তার উচ্চতর প্রজ্ঞার বিভেদ প্রদর্শন করতে ব্যবহার করেছিলেন। ডাইওটিমার মহান প্রজ্ঞা থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা সক্রেটিস স্মরণ করেছিলেন। তিনি দাবী করেছিলেন যে, তার তারুণ্যে তিনি এবং ডাইওটিমা সেই বিশেষ ধরনের আলোচনা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, যে পদ্ধতিটি পরবর্তীতে ‘সক্রেটিক’ পদ্ধতি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল – একটি তর্ক-বিতর্কমূলক কথোপকথন, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে তার দৃষ্টিভঙ্গি বা মতামত সম্বন্ধে ধারাবাহিকভাবে কিছু প্রশ্ন করা হয়, এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সম্ভাব্য বিকল্প একটি অবস্থানের দিকে ক্রমশ আলোচনাটিকে পরিচালিত করা হয়। আর এর নিহিত্যার্থ হচ্ছে ডাইওটিমা সম্ভবত সক্রেটিসকে দর্শনে তার সবচেয়ে মহান অবদানগুলোর একটি শিখিয়েছিলেন: তার মেথোডোলজি বা দর্শন চর্চার পদ্ধতি।
একজন তরুণ শিক্ষার্থী হিসেবে সক্রেটিস, ডাইওটিমার সাথে কথোপকথনগুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এখানে, সৌন্দর্য সংক্রান্ত তত্ত্বটি নিয়ে ডাইওটিমার শিক্ষার একটি রূপরেখা তিনি বর্ণনা করেছিলেন এবং ‘ডাইওটিমাস ল্যাডার’ ( ডাইওটিমার সিঁড়ি) অথবা ‘ল্যাডার অব লাভ’ বা ভালোবাসার সিঁড়ির ধারণাটি উপস্থাপন করেছিলেন, যে কারণে এই সংলাপটি সবচেয়ে সুপরিচিত। ডাইওটিমার সিঁড়ি আকর্ষণীয় একটি শরীরের প্রতি কামনা আর লালসাকে সিঁড়িটির সবচেয়ে নীচের ধাপে স্থাপন করেছে এবং এই ধাপটি ক্রমশ আমাদের সিঁড়িটির সর্বোচ্চ ধাপ – সৌন্দর্যের ‘ফর্ম’ বা রূপের মূল্যায়ন ও যথাযথ উপলব্ধি দিকে নির্দেশিত করতে পারে। ভালোবাসার এই সিঁড়িতে মোট ছয়টি ধাপ আছে। প্রথম ধাপ, কোনো একটি একক শরীরের জন্য অনুভূত ভালোবাসা। দ্বিতীয় ধাপ, সকল সুন্দর শরীরের জন্য অনুভূত ভালোবাসা। তৃতীয় ধাপ, আত্মা ধারণ করতে পারে এমন সৌন্দর্যের প্রতি অনুভূত ভালোবাসা। চতুর্থ ধাপ, সুন্দর জন-প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুভূত ভালোবাসা। পঞ্চম ধাপ, সাধারণভাবে সব ধরনের জ্ঞানের প্রতি অনুভূত ভালোবাসা। পরিশেষে ষষ্ঠ ধাপে, একজন প্রেমিক, খোদ সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করবে, যা ডাইওটিমা বর্ণনা করেছিলেন, “সুবিশাল একটি সমুদ্র রূপে সৌন্দর্যকে বিবেচনা করা”। সৌন্দর্যের এই ধরনের মূল্যায়ন এর সাথে সদগুণের নৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে বের করে আনে। ডাইওটিমা আরও বলেছিলেন, এমন কেউ যে কিনা খোদ সৌন্দর্যের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করে, সে “জ্ঞানের প্রতি অসীম ভালোবাসায় বহু সুন্দর ও মহান চিন্তা এবং ধারণা সৃষ্টি করবে; যতক্ষণ না সেই সমুদ্র তীরে সে আরও বিকশিত আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এবং অবশেষে একটি একক বিজ্ঞানের মনশ্ছবি উন্মোচিত হবে তার কাছে, সেটি হচ্ছে সর্বত্র সৌন্দর্যের বিজ্ঞান”। সেই কারণে সৌন্দর্য সংক্রান্ত যথাযথ একটি উপলব্ধির জন্য বাহ্যিক রূপের সীমানা অতিক্রম করতে হবে, এবং এর পরিবর্তে সৌন্দর্যের বিমূর্ত ধারণাটিকে অনুধাবন করতে হবে।
এই আলোচনাটি প্লেটোর বিখ্যাত ‘ফর্ম’ (বা আদর্শ রূপ) তত্ত্বটির সাথে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। তার লেখা বহু সংলাপে প্লেটো যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘ধারণা’ অথবা ‘ফর্মগুলো’ হচ্ছে পরিবর্তনশীল এই ভৌত পৃথিবীতে কোনো বস্তুর অভৌত মূলসার। সেই কারণে প্লেটো বিশ্বাস করতেন, ভৌত জগতে কোনো বস্তু সম্বন্ধে আমরা প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ সেগুলো শুধু ফর্মের চিরন্তন জগতের অনুকরণ। শুধু মতামতের বিপরীত, জ্ঞান অর্জন করতে হলে, উপলব্ধি আর ছায়ার এই পৃথিবীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধারণার পৃথিবীর দিকে তাকাতে হবে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হচ্ছে ‘ভালোর’ ফর্ম। যদিও স্পষ্ট নয় ‘ভালো’ অন্য ফর্মগুলোর মত একই উপায়ে ‘ফর্ম’ কিনা, যেমন, ‘সৌন্দর্য’ অথবা ‘ন্যায়বিচার’। ভালোর ফর্ম, প্লেটো তার ‘রিপাবলিকে’ আমাদের যেভাবে বলেছেন, সেটি হচ্ছে ‘অস্তিত্বের সীমা ছাড়িয়ে’ যা ‘সব কিছুকে বোধগম্য’ করে তোলে। এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণটি হচ্ছে প্লেটোর গুহার রূপকটি।
তবে, ডাইওটিমার ‘ভালো’ অথবা ‘সৌন্দর্যের’ ধারণাটি প্লেটোর মত একই রকমের কিনা সেটি স্পষ্ট নয়। ডাইওটিমা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, সৌন্দর্য কোনো শেষ পরিণতি নয় বরং আরও বৃহত্তর কিছু অর্জন করার একটি উপায়। এটি এক ধরনের পুনর্জনন অর্জন এবং অমরত্ব অভিমূখে একটি পথ। গর্ভধারণ নিয়ে তার আলোচনায় ডাইওটিমা এটি ব্যাখ্যা করেছিলেন। যখন সক্রেটিস ডাইওটিমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ভালোবাসার কাজ কী’? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘শরীর এবং আত্মা উভয় ক্ষেত্রেই এটি হচ্ছে সুন্দর কিছুর প্রসব’, যখন সক্রেটিস বলেছিলেন, তিনি বুঝতে পারেননি, ডাইওটিমা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সব মানুষই অন্তঃসত্ত্বা, সক্রেটিস, শরীরে এবং আত্মায়, এবং যখন আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠি, স্বাভাবিকভাবেই আমরা কিছুর জন্ম দিতে চাই’। আমাদের একটি বিষয় স্মরণ রাখা উচিত হবে এখানে, ডাইওটিমা কিন্তু প্রথাগত অর্থে গর্ভধারণের কথা বলছেন না। বরং এর পরিবর্তে তিনি প্রায়শই গর্ভধারণ নিয়ে কথা বলেছিলেন, ধারণা এবং সেই সাথে মানুষের পুনর্জননের অংশ হিসেবে। যারা শরীরে অন্তঃসত্ত্বা তারা একজন সঙ্গী অনুসন্ধান করে, যার সাথে তারা সন্তানের জন্ম দেবে, এবং একজন উত্তরসূরি সৃষ্টি করবে। যারা মনে অন্তঃসত্ত্বা তারা এর পরিবর্তে সেই সঙ্গীদের অনুসন্ধান করে যাদের সাথে তারা তাদের জ্ঞান ও সদগুণ বা পূণ্য ভাগাভাগি করে নিতে পারে। ডাইওটিমা আরও বলেছিলেন, “যখন হোমার আর হেসিওড কিংবা অন্য মহান কোনো কবিদের কথা কেউ চিন্তা করেন, তখন সাধারণ কারোর চেয়ে বরং তাদের সন্তান ধারণ করতে কে চাইবে না? তাদের মত সন্তান সৃষ্টিতে তাদের সমকক্ষ বা ছাড়িয়ে যেতে কে চাইবে না, যা তাদের স্মৃতি সংরক্ষণ করেছে এবং চিরস্থায়ী গৌরবের মহিমা দিয়েছে”? অন্যদের সাথে ধারণা ভাগাভাগি কিংবা অন্যদের ধারণা দেবার মাধ্যমে অমরতার চূড়ান্ত রূপটি অর্জন করা যেতে পারে, পরিণতিতে বৌদ্ধিক সন্তান সৃষ্টি করা, যেভাবে হোমার এবং হেসিওড করেছিলেন। এই ধরনের পুনর্জনন, ডাইওটিমা সৌন্দর্যের কর্ম হিসাবে বিশ্বাস করতেন। যেভাবে মেরি এলেন ওয়াইথ মন্তব্য করেছিলেন. “ডাইওটিমার জন্য ‘ভালো’ হচ্ছে স্বার্থপর ভালো, কারও নিজের ভালো মানে হচ্ছে – সৌন্দর্যের ধারণার দ্বারা স্ব-পুনর্জননের মাধ্যমে অমরত্ব অর্জন করা”। সেকারণে ‘ভালো’ আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না কোনো কর্ম।
বেশ তাহলে রহস্যময় মানটিনিয়ার ডাইওটিমা থেকে আমাদের কী শিক্ষা নেয়া উচিত? যখন তার ধারণাগুলো আলোচনা করছিলেন, সক্রেটিস তার নিজের অজ্ঞতাকে শনাক্ত করেছিলেন, তার সুস্পষ্ট প্রজ্ঞা থেকে তার শিক্ষা গ্রহণ করার আগ্রহটিকে শনাক্ত করেছিলেন। সক্রেটিসের সাথে তার আলোচনার সময় তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন, “অবশ্যই আমি সঠিক!”, এবং তিনি তার যুক্তির সাথে তাল মেলাতে সক্রেটিসের অক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যখন সক্রেটিস জিজ্ঞাসা করেছিল, “সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান ডাইওটিমা, যা আপনি বলছেন সেগুলো কী আসলেই সত্য”? তিনি স্মরণ করেছিলেন, সুদক্ষ একজন সোফিস্টের মত তিনি বলেছিলেন, “তুমি সেই বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারো সক্রেটিস”। আর এমন একজন শক্তিশালী নারী দর্শনের ইতিহাসে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়ে যে উপস্থিত থাকতে পারেন, সেটি সর্বত্র নারী দার্শনিকদের জন্য উদাত্ত একটি আহবান হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি কাল্পনিক কিংবা বাস্তব যা-ই হোন না কেন, যে ধারণাগুলোর জন্য তাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এবং ডাইওটিমার আত্মবিশ্বাস আর বুদ্ধিমত্তার বাহক হতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করতে হবে। এমনকি যখন আমরা দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিতার সাথে বিতর্ক করব।
লেখক পরিচিতি:
জোই আলিয়োজি একজন মানবাধিকার কর্মী-গবেষক। তিনি একজন বিদ্যায়তনিক এবং পুরষ্কারপ্রাপ্ত দার্শনিক এবং একই সাথে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী। তার গবেষণার ক্ষেত্র মানবাধিকার, আইন, দর্শন, সক্রিয় আন্দোলন, নারীবাদ, জলবায়ুর পরিবর্তন, নন্দনতত্ত্ব, শিল্পকলা এবং সিনেমাটোগ্রাফি। বর্তমানে তিনি গ্লোবাল ক্যাম্পাস অব হিউম্যান রাইটস, ভেনিসে গণতান্ত্রয়ণ ও মানবাধিকার সংক্রান্ত ইউরোপীয় মাস্টার্স প্রোগ্রামের একজন শিক্ষক।
আরও জানতে:
আর ই. অ্যালেন, প্লেটোস সিম্পোজিয়াম (১৯৯১)
ক্রিশ্চিয়ান কেইমে, দ্য রোল অব ডাইওটিমা ইন দ্য সিম্পোজিয়াম: দ্য ডায়ালগ অ্যান্ড ইটস ডাবল, গ্যাবলিয়েল করনেলির সম্পাদিত, প্লেটোস স্টাইলস অ্যান্ড ক্যারেকটার: বিটউইন লিটারেচার অ্যান্ড ফিলোসফি (২০১৫)
ডেবরা নেইলস, দ্য পিওপল অব প্লেটো: এ প্রপোজোগ্রাফি অব প্লেটো অ্যান্ড আদার সক্রেটিকস (২০০২)
হ্যারি নিউমান, ডাইওটিমাস কনসেপ্ট অব লাভ, আমেরিকান জার্নাল অব ফিলোলজি, ৮৬(১):১৯৬৫,৩৩-৫৯
আনড্রিয়া নাই, দ্য সাবজেক্ট অব লাভ: ডাইওটিমা অ্যান্ড হার ক্রিটিক্স, জার্নাল অব ভ্যালু ইনকোয়েরি, ২৪, ১৯৯০, ১৩৫-১৫৩
আনড্রিয়া নাই, দ্য হিডেন হোস্ট: ইরিগারে অ্যান্ড ডাইওটিমা অ্যাট প্লেটোস সিমপোজিয়াম, হাইপেশিয়া, ৩ (৩), ১৯৮৯, ৪৫-৬২
আনড্রিয়া নাই, সক্রেটিস অ্যান্ড ডাইওটিমা: সেক্সুয়ালিটি, রেলিজিয়ন অ্যান্ড দ্য নেচার অব ডিভিনিটি (২০১৫)
আরও পড়ুন: দ্য ফিলোসফার্স কুইন