Can't find our books? Click here!

কেন বিবর্তন সত্য?

কাজী মাহবুব হাসান

বইটির প্রথম অধ্যায়ে বিবর্তন কী – এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করেছেন জেরি কয়েন। তিনি শুরু করেছেন বিবর্তনের ধারণাটির মূল কাঠামোটিকে চিহ্নিত করে, প্রতিটি অংশকে বিবরণের আওতায় এনে প্রদর্শন করেছেন কীভাবে বিজ্ঞান কাজ করে সেটি যেন পাঠকরা বুঝতে পারে, সেই সাথে তত্ত্ব শব্দটি সংশ্লিষ্ট সব অনভিপ্রেত অপব্যবহারের বিষয়টিও নিয়ে তিনি সতর্ক করেছেন – বিশেষ করে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা যখন বিবর্তন ‘শুধুমাত্র একটি তত্ত্ব’ হিসেবে তাদের যুক্তিটি উপস্থাপন করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত। ফরাসী জীববিজ্ঞানী জ্যাক মনো’র বিখ্যাত সেই উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু হওয়া প্রথম অধ্যায়ে আমাদের তিনি জানান বিবর্তন তত্ত্বের একটি অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে সবাই মনে করেন এটি তারা বুঝতে পেরেছেন। সত্যি কী তাই? এই প্রশ্নটি বিবর্তন বিরোধীদের প্রতি স্বভাবসুলভ বিনয়ের সাথে উত্থাপন করে তিনি ব্যাখ্যা করেন বিবর্তন বলতে আসলে কী বোঝায়। কারণ বিবর্তনের আধুনিক তত্ত্বটির মূলসার অনুধাবন করা আসলেই কঠিন নয়। এবং এমনকি একটি বাক্য (যদিও খানিকটা দীর্ঘ বাক্য) দ্বারা সেটি প্রকাশ করাও সম্ভব বলে মনে করেন কয়েন। আর সেই বাক্যটি হচ্ছে হচ্ছে: ‘এই পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তন হয়েছে ক্রমান্বয়ে আদিম একটি প্রজাতি থেকে সূচনা করে – সম্ভবত একটি স্ব-অনুলিপন-সক্ষম কোনো অণু – প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন (সাড়ে তিনশ কোটি) বছর আগে যা জীবিত ছিল। সময়ের সাথে সাথে এটি বহু শাখায় বিভাজিত হয়েছে, যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আর বিচিত্র বহু প্রজাতি। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে (কিন্তু সব নয়) বিবর্তনীয় পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটির মূল পদ্ধতিটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন’। যদি এই বাক্যটিকে আপনি খণ্ড খণ্ড করে বিশ্নেষণ করেন, আপনি দেখবেন বাক্যটির মোট ছয়টি অংশ আছে: বিবর্তন, ক্রমান্বয়ে সংঘটিত পরিবর্তন বা গ্র্যাজুয়ালিজম, প্রজাত্যায়ন, কমন অ্যানসেস্ট্রি বা একটি সাধারণ বংশঐতিহ্য, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন নয় এমন কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তনীয় পরিবর্তন।   

কেন বিবর্তন সত্য?

প্রথমে বিবর্তন ধারণাটি, এর অর্থ সময়ের সাথে প্রজাতিদের মধ্যে জিনগত পরিবর্তন হয়, এবং সেই পরিবর্তনগুলো বহু প্রজন্মের পরে কোনো প্রজাতিকে ভিন্ন কোনো প্রজাতিতে বিবর্তিত করে এবং সেই সব পরিবর্তনগুলোর উৎস ডিএনএ-ভিত্তিক পরিবর্তন, যাদের সূচনা হয় মিউটেশন বা পরিব্যক্তি হিসেবে। বিবর্তন ধারণাটির দ্বিতীয়াংশটি হচ্ছে গ্যাজুয়ালিজম, কোনো উল্লেখযোগ্য বিবর্তনীয় পরিবর্তনের জন্য বহু প্রজন্ম অতিক্রান্ত হতে হয় – অর্থাৎ বিবর্তন প্রক্রিয়াটি ঘটছে ধীরে ক্রমান্বয়ে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলো পুঞ্জীভূত হয়ে – ধীর কিন্তু নিরন্তর একটি প্রক্রিয়া, যেমন, সরীসৃপ থেকে পাখিদের বিবর্তন। বিবর্তন ধারণাটির পরের অংশ দুইটির মূল বিষয় একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। লক্ষণীয় একটি বাস্তবতা হচ্ছে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে যদিও প্রচুর পরিমানে জীবিত  প্রজাতির অস্তিত্ব আছে – আমরা সবাই – আমি, আপনি, হাতি কিংবা ক্যাকটাস – কিছু একই মৌলিক বৈশিষ্ট্য বহন করছি। এদের মধ্যে যেমন একটি হলো শরীরের কোষে প্রয়োজনীয় শক্তি তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে একই জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া, আমাদের সেই চার নিউক্লিওটাইড বেস দিয়ে তৈরি ডিএনএ অণুর সংকেত এবং যে প্রক্রিয়ায় প্রোটিন সংশ্লেষণে এই সংকেত ব্যবহৃত হয়। এই বিষয়গুলো প্রমাণ করে, প্রতিটি প্রজাতি সাধারণ একটি পূর্বসূরি থেকেই এসেছে, এমন কোনো পূর্বসূরি যার এইসব বৈশিষ্ট্যগুলো ছিল এবং সে তার উত্তরসূরিদেরও সেই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রদান করেছে। কিন্তু যদি বিবর্তন মানে শুধুমাত্র কোনো একটি প্রজাতির ক্রমান্বয়ে জিনগত পরিবর্তনের কথা বোঝাতো, তাহলে এতো বিচিত্র জীব প্রজাতি নয়, আমরা কেবল একটি মাত্র প্রজাতি পেতাম – সেই প্রথম প্রজাতিরই অতিমাত্রায় বিবর্তিত কোনো উত্তরসূরি। কিন্তু আমরা জানি সেটি ঘটেনি – ১০ মিলিয়নেরও অধিক সংখ্যক প্রজাতির সাথে এই পৃথিবীতে আমাদের বসবাস, আপাতত খুঁজে পাওয়া সব জীবাশ্ম থেকে আমরা আরও সিকি মিলিয়ন প্রজাতির কথা আমরা জানি। জীবন স্পষ্টতই বিচিত্র। একটি মাত্র আদি রূপ থেকে তাহলে কীভাবে এই বৈচিত্র্যের উদ্ভব হয়েছে? এখানে আমাদের দরকার বিবর্তনের তৃতীয় ধারণা, বিভাজনের, আরও সঠিকভাবে প্রজাত্যায়ন ( প্রজাতি সৃষ্টি) প্রক্রিয়ার । এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমেই ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীতে জীবদের বিবর্তন ঘটে – যে গোষ্ঠীর সদস্যরা অন্য কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে প্রজনন করতে পারে না – মানে এই গ্রুপগুলো পারস্পরিক জিন বিনিময় করতে পারে না। এই গোষ্ঠীগুলোকে পৃথক পৃথক প্রজাতি হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। তবে কোনো একটি সাধারণ প্রজাতির বিবর্তিত হয়ে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী সৃষ্টি হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। সাধারণ পূর্বসূরি জীব থেকে ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে বিচ্ছিন্ন হবে কী হবে না সেটি নির্ভর করে কিছু পরিস্থিতির উপর – পরিস্থিতিটি কী সেই জীব জনগোষ্ঠীতে এমন কোনো বিবর্তনীয় পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পেরেছে, যে তারা নিজেদের মধ্যে আর আন্তঃপ্রজনন করতে পারে না। বেশির ভাগ প্রজাতি – প্রায় ৯৯ শতাংশ – বিলুপ্ত হয় কোনো উত্তরসূরি না রেখে।    আরও পড়ুন: দ্য সেলফিশ জিন

কমন অ্যান্সেস্ট্রি বা একটি সাধারণ বংশঐতিহ্যের ধারণা ডারউইনবাদের চতুর্থ মূলনীতি – যা প্রজাত্যায়নের ওপিঠ। এর মানে হচ্ছে আমরা চাইলে যে-কোনো সময় ডিএনএ অনুক্রম বা জীবাশ্ম ব্যবহার করে অতীতের অভিমূখে তাকাতে পারি যেখানে আমরা ধারাবাহিক উত্তরসূরিদের সাথে পূর্বসূরিদের সংযোগ দেখতে পাই। বিভিন্ন প্রজাতির ডিএনএ নিউক্লিওটাইড বেসের অনুক্রম নির্ণয় করে এবং এই অনুক্রমের সাদৃশ্য বিবেচনা করে আমরা তাদের বিবর্তনীয় সম্পর্কটি পুনঃসৃষ্টি করতে পারি। বিবর্তন তত্ত্বের পঞ্চম অংশটি হচ্ছে, যা ডারউইন নিজেই তার শ্রেষ্ঠতম বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন হিসেবে ভাবতেন, সেটি হচ্ছে – প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটি বৈপ্লবিক এবং অস্বস্তিকর একই কারণে: এটি আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির ডিজাইনকে বিশুদ্ধভাবে বস্তুবাদী প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, যার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির সৃষ্টি বা নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। সময়ের সাথে কোনো জনগোষ্ঠী তার পরিবেশের সাথে ক্রমশ মানানসই হয়ে উঠবে, যখনই উপকারি মিউটেশন বা পরিব্যক্তি (পরিবর্তন) উদ্ভব হবে এবং জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেটি ছড়িয়ে পড়বে, এবং একইভাবে ক্ষতিকর সব মিউটেশনগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুনিতে বাদ পড়ে – এর জন্য দরকার কোনো একটি প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে জিনগত ভিন্নতা – যে ভিন্নতাগুলো একক সদস্যদের সেই পরিবেশে টিকে থাকা ও প্রজনন-সফলতাকে প্রভাবিত করে। আর প্রাকৃতিক নির্বাচন দক্ষ কোনো প্রকৌশলী নয় বরং বলা যাবে একজন হিসাবী বুদ্ধিমান কারিগর, একেবারে শুরু থেকেই সেরা কোনো পরিকল্পনা সে সৃষ্টি করতে পারে না বরং ইতোমধ্যে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো পরিশীলিত করেই নির্বাচন ‌‘‌প্রয়োজন’ মত গড়ে পিটে খাপ খাইয়ে নেবার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো ‘তৈরি‌’ করে নেয়। বিবর্তন হচ্ছে সেই স্থপতির মতো একেবারে শুরু থেকে যিনি কোনো কিছু পরিকল্পনা করতে পারেন না, তাকে অবশ্যই এর আগে থেকেই বিদ্যমান কাঠামোর সাথে খাপ খাইয়ে নতুন কোনো কাঠামো তৈরি করতে হয়, আর আগের কাঠামোটির উপযোগিতাও যেন কোনোভাবে হ্রাস না পায়, সেটিও খেয়াল রাখতে হয়। সুতরাং প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাছে ডিজাইনের দিক থেকে নিখুঁত কিছু সৃষ্টি করা নয়, বরং এর আগে যে কাঠামোগুলো ছিল সেগুলোরই প্রয়োজনীয় উন্নতি সাধন করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি সর্বশ্রেষ্ঠ কোনো জীব নয় অপেক্ষাকৃত সুঅভিযোজিত এবং সুপ্রজননক্ষম জীব সৃষ্টি করে। আর এই বিষয়টি আমাদের নিয়ে আসে বিবর্তন তত্ত্বের ষষ্ঠ অংশে: প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়াও অন্যান্য প্রক্রিয়াও বিবর্তনীয় পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে।

কেন বিবর্তন সত্য?

বিবর্তন তত্ত্বের আলোচনায় তিনি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আভিধানিক সংজ্ঞাটি উপস্থাপন করেন: এমন বক্তব্য যা গ্রহন করা হয়েছে সাধারণ আইন, মূলনীতি অথবা এমন কিছুর কারণ হিসেবে, যা জানা অথবা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, প্রথমটি হচ্ছে বিজ্ঞানে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছ কোনো কিছু সম্বন্ধে প্রস্তাবিত ধারণা থেকেও বেশি, এটি খুব সুচিন্তিত প্রস্তাবনা সমষ্টি যা বাস্তব পৃথিবীতে ‘ফ্যাক্ট’ বা বাস্তব সত্য ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। কোনো তত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক হতে হলে, এটিকে অবশ্যই পরীক্ষাযোগ্য হতে হবে, অর্থাৎ এমন কোনো পর্যবেক্ষণ ভাবা সম্ভব, যা এই তত্ত্বটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবে এবং পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে এমন কিছু পূর্বধারণা বা ভবিষ্যদ্বাণী করারও ক্ষমতা থাকবে। কারণ কোনো একটি তত্ত্ব সত্য বলে গ্রহনযোগ্য হবে শুধুমাত্র যখন এর প্রস্তাবিত দাবী এবং ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয়েছে এবং প্রতিবারই তা সত্যায়িত করা হয়েছে। অবশ্যই এমন কোনো একক মুহূর্ত নেই যখন কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হঠাৎ করে বৈজ্ঞানিক বাস্তব সত্যে পরিণত হয়ে যায়। কোনো একটি তত্ত্ব বাস্তব সত্য হয় যখন এর সমর্থনে বিশাল পরিমান প্রমাণ একত্রিত হয় – এবং কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ এর বিরুদ্ধে থাকে না – এবং প্রকৃতপক্ষে যুক্তি মানেন, এমন সব মানুষই এটিকে গ্রহন করে নেন। এর মানে কিন্তু এই না যে একটি ‘সত্য’ তত্ত্ব কখনোই মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। কারণ প্রতিটি বৈজ্ঞানিক সত্যই প্রাথমিক, সাময়িক – নতুন প্রমাণের আলোকে যা পরিবর্তিত হতে পারে।

বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রক্রিয়ায় কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সাধারণত বিকল্প কোনো তত্ত্বের বিপরীতে যাচাই করা হয়। কিন্তু আমরা কীভাবে জীবনের সৃষ্টি সংক্রান্ত এখনো জনপ্রিয় বিকল্প তত্ত্বের বিপরীতে বিবর্তন তত্ত্বকে যাচাই করতে পারি – যে বিকল্প তত্ত্বটি দাবী করছে বিশেষভাবে জীবন সৃষ্টি করা হয়েছে, এবং সৃষ্টির পর থেকেই যা অপরিবর্তিত রয়েছে। এখানে আসলে দুই ধরনের প্রমাণ আছে। প্রথমটি আমরা পাই ডারউইনবাদের ছয়টি মূলনীতি থেকে – যেগুলো ব্যবহার করে আমরা পরীক্ষাযোগ্য কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে বিজ্ঞানীরা এমন কোনো কিছু দাবী করছেন না, যেমন, ভবিষ্যতে জীবন কীভাবে বিবর্তিত হতে পারে বরং, এটি ভবিষ্যদ্বাণী করছে আমাদের কী খুঁজে পাওয়া উচিত যখন আমরা বর্তমান এবং প্রাচীন প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করব। এমন কিছু ভবিষ্যদ্বাণী হতে পারে যেমন: যেহেতু জীবাশ্ম প্রাচীন জীবনের স্মারক, জীবাশ্ম রেকর্ডে বিবর্তনীয় পরিবর্তনের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া উচিত। সবচেয়ে গভীরতম (এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম) পাথরের স্তরে সেই সব জীবাশ্ম আমরা খুঁজে পাবো যারা প্রাচীনতর প্রজাতিদের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং ভূত্বকের স্তর যতই সাম্প্রতিক হতে থাকবে, কিছু জীবাশ্ম আমার খুঁজে পাবো যারা ক্রমশ আরও জটিলতর হয়ে উঠছে তার প্রমাণ বহন করবে। এবং সেখানে উপস্থিত প্রজাতিরা আরও সাম্প্রতিক স্তরের জীবাশ্ম প্রজাতি সদৃশ হবে। কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে পাবার কথা যে তারা সময়ের সাথে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়েছে – পরিবর্তনের সাথে যা বিবর্তনের চিহ্ন বহন করবে (অভিযোজন)। জীবাশ্ম রেকর্ডে প্রজাত্যায়নের কিছু নমুনা আমরা খুঁজে পাবো, যেখানে কোনো একটি প্রজাতির বংশধারা দুটি বা আরও বেশি বংশধারায় বিভাজিত হয়েছে। এবং প্রকৃতিতেও আমরা নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হবার উদাহরণও খুঁজে পাবো। কিছু প্রজাতিও আমাদের খুঁজে পাবার কথা, যারা বড় জীব গোষ্ঠীগুলো মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করেছে – যাদের সাধারণ বংশধারা আছে বলে আমরা সন্দেহ করছি। যেমন সরীসৃপের সাথে পাখি, উভচরদের সাথে মাছ। উপরন্তু এই ‘মিসিং লিঙ্ক’ বা অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতির জীবাশ্মগুলো আমরা খুঁজে পাবো ভূত্বকের সেই স্তরে, যখন এই দুটি গ্রুপ বিভাজিত হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি।

বহু বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে আশা করা উচিত, আমরা প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে জিনগত প্রকরণ দেখতে পাবো (অন্যথায় বিবর্তন ঘটার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না)। ক্রটি বিবর্তনের চিহ্ন, কোনো বুদ্ধিমান সত্তার সচেতনভাবে সৃষ্টি করা জীবে ক্রটি থাকার কথা না। আমরা  জীবজগতে সেই কারণে ক্রটিপূর্ণ ডিজাইন দেখতে পাবো, কারণ ক্রটিহীন ডিজাইন করার ক্ষেত্রে সচেতন একজন সৃষ্টিকর্তা বা ডিজাইনার যে দক্ষতা দেখাবেন সেটি বিবর্তনের পক্ষে করা অসম্ভব। আমরা প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করছে সেটির উদাহরণও দেখতে পাবো। আর এই সব ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়াও বিবর্তন তত্ত্বকে সমর্থন করে অতীতসংক্রান্ত কিছু ধারণা, বেশ কিছু সত্য এবং উপাত্ত, যা হয়তো বিবর্তন তত্ত্ব পূর্বধারণা করতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু সেগুলো ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিবর্তনের আলোকে। প্রমাণের আলোকে এই সবকিছু বিভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে – প্রাচীন এবং নতুন – যা অনিবার্যভাবে আমদের সেই উপসংহারের দিকে নিয়ে যায়: বিবর্তন সত্য।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে কয়েন পাথরে লেখা বিবর্তনের ইতিহাস বা জীবাশ্ম সম্বন্ধে আমাদের একটি বিস্তারিত ধারণা দেন, সাম্প্রতিককালের কিছু পরিচিত উদাহরণ ব্যবহার করে তিনি বিবর্তনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণগুলোকে চিহ্নিত করেছেন (টিকটালিক এবং টেট্রাপডদের বিবর্তন, ডায়নোসর থেকে পাখিদের বিবর্তন, এবং স্থলবাসী স্তন্যপায়ী থেকে সামুদ্রিক তিমিদের বিবর্তন ইত্যাদি)। যদিও কয়েন জীবাশ্মবিদ নন তবে তিনি ব্যর্থ হননি পাঠকদের ধারণা দিতে যে জীবাশ্ম অনুসন্ধান করতে জীবাশ্মবিদদের আসলেই কী পরিমান কষ্ট সহ্য করতে হয়। এছাড়া তিনি জীবাশ্ম প্রমাণগুলোর শক্তি এবং তাদের সীমাবদ্ধতা, বিবর্তনের প্রকৃত ধারাবাহিকতা প্রমাণে জীবাশ্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অধিকাংশ বইয়ে জীবাশ্ম প্রমাণ সম্বন্ধে সীমিত, হালনাগাদ নয়, এবং ভুল তথ্যের উপস্থিতি থাকে, কয়েন বইটিতে সেই ভ্রান্তিগুলোকে অতিক্রমণ করেছেন। বিবর্তনের প্রমাণের ক্ষেত্রে জীবাশ্মবিদ্যাকে তার সঠিক অবস্থান তিনি নিশ্চিত করেছেন এবং বইটির শুরুতেই অন্য প্রমাণ উপস্থাপনের আগেই তিনি জীবাশ্ম থেকে প্রমাণগুলো অকৃপণভাবে উপস্থাপন করেছেন। বহু বিবর্তন জীববিজ্ঞানের বইয়ের ক্ষেত্রে যা বিশেষ ব্যতিক্রম। হয়তো ক্রমপরিবর্তনশীল ট্যাক্সোনমি এবং কয়েনের দাবী করা গ্র্যাজুয়ালিজম (বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে সংঘটিত পুঞ্জীভূত পরিবর্তনের মাধ্যমে) ইত্যাদি কিছু বিষয় সম্বন্ধে জীবাশ্মবিদদের আপত্তি সত্ত্বেও জীবাশ্মবিদ নয় এমন কারো পক্ষে এটি জীবাশ্ম প্রমাণের অন্যতম সেরা বিবরণ।   

প্রাচীনকাল থেকেই জীবাশ্ম দেখে এসেছে মানুষ, অ্যারিস্টোটল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং পাখির মতো ঠোঁটসহ ডায়নোসর প্রোটোসেরাটপসকে প্রাচীন গ্রিক পুরাণের ভয়ঙ্কর প্রাণী গ্রিফিন কিংবদন্তীর উৎস হিসেবে মনে করা হয়। জীবাশ্ম সৃষ্টি হবার প্রক্রিয়া বেশ সরল, তবে এর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি প্রয়োজন । প্রথমত, কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদকে অবশ্যই পানির কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে, একেবারে নীচে তাকে নিমজ্জিত হতে হবে, কোনোভাবে ক্ষয় হয়ে যাবার আগে বা অন্য কোনো প্রাণীর খাদ্য হবার আগে দ্রুত তাকে পলির আস্তরণের নীচে ডুবে যেতে হবে। এই সব পূর্বশর্ত বিবেচনা করার পর যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, সেটি হচ্ছে জীবাশ্ম রেকর্ড অবশ্যই অসম্পূর্ণ। কিন্তু কতটা অসম্পূর্ণ? ধারণা করা হয় মোট ১৭ মিলিয়ন থেকে ৪ বিলিয়ন প্রজাতির বাস ছিল এই পৃথিবীতে (বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ১০ মিলিয়ন প্রজাতির বাস)। আপাতত আমরা মাত্র প্রায় ২৫০,০০০ প্রজাতির জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছি, পৃথিবীতে য কোনো সময় বেঁচে ছিল এমন জীব প্রজাতির মাত্র ০.১ থেকে ১ শতাংশের জীবাশ্ম প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে- স্পষ্টতই পৃথিবীতে জীবনের ইতিহাসের পরিমানে সেটি খুব সামান্য একটি অংশ।

তা সত্ত্বেও আমাদের হাতে এখন যথেষ্ট পরিমান জীবাশ্ম আছে যা আমাদের একটি ভালো ধারণা দেয় কীভাবে বিবর্তন ঘটেছিল এবং জীবদের প্রধান শ্রেণীগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। সৃষ্টিতত্ত্ব মতবাদীদের মৌলিক ধারণাটি – সব প্রজাতি হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়েছে এবং এরপর অপরিবর্তিত থেকেছে – এমন পূর্বধারণাটির পক্ষে জীবাশ্ম কোনো প্রমাণ দেয় না বরং বহু প্রমাণে আমরা সুস্পষ্টভাবেই দেখি ক্রমান্বয়ে জীবনের বিবর্তন ঘটেছে। সাধারণ মানুষ এবং বিজ্ঞানীদের যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটি হচ্ছে ট্রানজিশনাল ফর্ম, অন্তর্বর্তীকালীন যে রূপটি – দুটি খুবই ভিন্ন ধরনের জীব প্রজাতির মধ্যবর্তী শূন্যস্থানটি পূরণ করে। দুটি গোষ্ঠীর একটি সাধারণ বংশপরিচয়, সেই কারণে প্রমাণ করার জন্যে আমাদের একেবারে সুনির্দিষ্টভাবে একক কোনো প্রজাতির অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই এবং এমন কোনো প্রজাতিরও জীবাশ্মও প্রয়োজন নেই যারা পূর্বসূরি থেকে উত্তরসূরি অবধি সরাসরি বংশধারার কোনো একটি স্তরের প্রতিনিধিত্ব করছে, আমাদের বরং সেই ধরনের প্রজাতির জীবাশ্ম প্রয়োজন, যা দুটি গোষ্ঠীকে সংযোগ করতে পারে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করবে, এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে এই জীবাশ্মগুলো ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডে ঠিক যেখানে থাকা দরকার, ঠিক সেখানে অবস্থান করবে। কোনো একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতি অবশ্যই কোনো আদি পূর্বসূরি প্রজাতির সমতুল্য নয়। এটি শুধুমাত্র একটি প্রজাতি যার মধ্যে আমরা মিশ্র বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবো এর আগে ও পরে আসা প্রজাতির মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান।

কেন বিবর্তন সত্য?

বিবর্তন জীববিজ্ঞানে প্রমাণ হওয়া সবচেয়ে সেরা ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর একটি হচ্ছে, ২০০৪ সালে খুঁজে পাওয়া মাছ এবং উভচরদের যোগসূত্রকারী একটি জীবাশ্ম প্রজাতি, ‘টিকটালিক রোজি’, যা আমাদের ধারণা দেয় কীভাবে মেরুদণ্ডী প্রাণীরা স্থলভূমিতে বসবাস করতে শুরু করেছিল। টিকটালিক আমাদের দেখিয়েছে আমাদের পূর্বসূরিরা ছিল চ্যাপ্টা মাথার শিকারি মাছ যারা ছোট নদী বা জলধারার অগভীর জলে বাস করত। এই জীবাশ্মটি অসাধারণ অন্য একটি কারণেও, আগে থেকেই ভূত্বকের যে  স্তরে ও যেখানে আশা করা হয়েছিল ঠিক সেখানেই এর সন্ধান মিলেছে। ডারউইন পাখি এবং সরীসৃপদের মধ্যে প্রথম সংযোগটি সম্বন্ধে জানতেন, যিনি, বিস্ময়করভাবে উল্লেখ করেছিলেন বিষয়টি তার ‘দি অরিজিন’ বইটিতে, তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম কোনো কিছু হিসেবে। আমরা বিস্তারিত যা কিছু অনুমান করি না কেন, ক্রান্তিকালীন জীবাশ্মগুলোর উপস্থিতি – এবং সরিসৃপ থেকে পাখিদের বিবর্তন – বাস্তব সত্য। আর্কিওপটেরিক্সের মতো জীবাশ্মগুলো এবং এর পরবর্তী আত্মীয় প্রজাতিগুলো পাখি এবং সরিসৃপদের মিশ্র বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছে, এবং ভূত্বকের সঠিক স্তরে আমরা তাদের খুঁজেও পেয়েছি। বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই পূর্বধারণা করেছিলেন পাখিদের বিবর্তন ঘটেছে থেরোপড ডায়নোসরদের থেকে, এবং সুনিশ্চিতভাবেই আমরা ‘থেরোপড’ ডায়নোসর খুঁজে পেয়েছি যাদের শরীর পালকে আচ্ছাদিত ছিল। আমরা দেখেছি আদি থেরোপডদের ক্রমেই পাতলা সুতার মত শরীরের আচ্ছাদন বিবর্তন করছে যা ক্রমেই সুনির্দিষ্টভাবে পালকে রূপান্তরিত হয়, যারা সম্ভবত দক্ষ গ্লাইডার বা বাতাসে ভর করে ভাসতে পারতো। আমরা কি এমন কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর সন্ধান পেতে পারি যারা জলে এবং স্থলে উভয় স্থানে বসবাস করে? খুব সহজেই পারি – যেমন হিপোপটেমাস বা জলহস্তী। যারা স্থলবাসী প্রাণীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ সময় পানিতেই বসবাস করে।  একইভাবে সাপ বিবর্তিত হয়েছে গিরগিটি থেকে যারা তাদের পা হারিয়েছে, আর সাপদের আবির্ভাবের বহু আগেই আমরা পাসহ গিরগিটিদের জীবাশ্ম রেকর্ডে খুঁজে পাই।  

জীবাশ্ম রেকর্ড অন্ততপক্ষে তিনটি বিষয় সম্বন্ধে আমাদের শিক্ষা দেয়, প্রথমত, এটি খুব জোরালো ও বাঙময় ভাষায় বিবর্তনের কথা বলে। পাথরের এই রেকর্ড বেশ কিছু বিবর্তনীয় ভবিষ্যদ্বাণীও প্রমাণ করে: কোনো একটি বংশধারায় ঘটা ধীর পরিবর্তন, বংশধারায় বিভাজন এবং খুবই ভিন্ন ধরনের জীবদের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন জীবাশ্মের অস্তিত্ব এবং পরিশেষে, বিবর্তনীয় পরিবর্তন প্রায় সবসময়ই যে-কোনো মাত্রায় হোক না কেন – পুরনো কিছুকে গড়ে পিটে নতুন করে কাজের উপযোগী করে সৃষ্টি করে। আর সেই কারণে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের দাবীকৃত স্বর্গীয় সৃষ্টিকর্তার কোনো কারণই নেই স্থপতির মতো কোনো কিছু একেবারে শুরু থেকে সৃষ্টি না করে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো ওপর ভিত্তি করে প্রজাতি সৃষ্টি করার – কারণ প্রতিটি প্রজাতির একেবারে শুরু থেকে আলাদাভাবে সৃষ্টি করা যেতে পারে আর নিশ্চয়ই কোনো স্বর্গীয় সত্তার পক্ষে কাজটা কঠিন নয়। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে শুধুমাত্র যা বিদ্যমান সেটাকেই প্রয়োজন অনুসারে রদবদল করে। শূন্য থেকে এটি কোনো বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে পারে না। সেই কারণে প্রতিটি নতুন প্রজাতি পুরোনো প্রজাতির পরিবর্তিত সংস্করণ আর জীবাশ্ম প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ এই ভবিষ্যদ্বাণীটি সমর্থন করে।

জেরি কয়েন এই বইটিতে বেশ কিছু প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করেছেন যার সম্বন্ধে সাধারণ বহু পাঠকেরই বিস্তারিত কিছু জানা নেই। তার একটি হচ্ছে কোরাল বা প্রবাল জীবাশ্ম ব্যবহার করে বছরের দিন সংখ্যা নির্ণয় করার প্রক্রিয়াটি। আমরা যেমন জানি জোয়ারের কারণে পৃথিবীর ঘুর্ণায়মান গতি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। সুতরাং অতীতে কোনো একটি সময় দিনের দৈর্ঘ্য বর্তমান দিনের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা কম ছিল। আমরা জানি পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে দিন-রাত্রি হচ্ছে, নিজের অক্ষের ওপর ঘূর্ণায়মান  পৃথিবীর গতির তারতম্য দিনের দৈর্ঘ্যের তারতম্যের কারণ। জোয়ারের ঘর্ষণের হার নির্ণয় করে দিনের দৈর্ঘ্য কেমন ছিল আমাদের পক্ষে পরিমাপ করা সম্ভব। এই বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জন ওয়েলস চমৎকার একটি পরীক্ষা পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি সেই জীবাশ্ম কোরাল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, যারা প্রতিদিন এবং বাৎসরিকভাবে তাদের শরীরে ‘গ্রোথ রিং’ বা বৃদ্ধি-বলয় সৃষ্টি করে। আপনি সেখানে যদি লক্ষ করে দেখেন কতগুলো দৈনিক রিং বা বলয় বাৎসরিক রিং বা বলয়কে পৃথক করে রেখেছে, তাহলে সেই সময়ে বছরে কয়টি দিন ছিল সেটি আপনি নির্ণয় করতে পারবেন। এই জীবাশ্ম প্রবালগুলো প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগের ডেভোনিয়ান পর্বে বেঁচে ছিল। টাইডাল ফ্রিকশন বা জোয়ারভাটার ঘর্ষণের হিসাব মতো তিনি পরিমাপ করে দেখান সেই সময়ে একটি দিনের দীর্ঘ ছিল প্রায় ২২ ঘন্টা, যা বর্তমানের চেয়ে দুই ঘন্টা কম।  যখন তিনি প্রবালগুলোর বৃদ্ধি-বলয় গণনা করেন, কতটা বলয় দিয়ে বাৎসরিক বৃদ্ধি-বলয়টিকে পৃথক হয়ে আছে, তখন তিনি দিনের দৈর্ঘ্য ২১.৯ ঘন্টা পরিমাপ করেছিলেন। সুতরাং তিনি আরও একটি উপায়ে প্রমাণ করে দেখান যে পৃথিবী আসলেই বহু প্রাচীন, এই জীবাশ্ম প্রবালগুলো বহু প্রাচীন এবং সময়ের সাথে সাথে দিনে দৈর্ঘ্য ক্রমশ বাড়ছে।

কয়েন তার একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন এই বইটি লেখার সময় তিনি যে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিতভাবে জেনেছিলেন সেটি হচ্ছে জীবাশ্ম রেকর্ড, যদিও বিবর্তন জীববিজ্ঞানী হিসেবে তার জানা ছিল বিষয়টি, তবে তার গবেষণার ক্ষেত্র ভিন্ন, আর সেই কারণে বহু নতুন আবিষ্কারের বিষয়টি তার নজরে বইটি লেখার সময় এসেছিল, সেই কারণে আমরা তিমি কিংবা পাখিদের বিবর্তনের নতুন আবিষ্কৃত তথ্যগুলো জানতে পারি দ্বিতীয় অধ্যায়ে। কয়েন ব্যাখ্যা করেন কেন জীবাশ্ম রেকর্ড, যদিও অসমাপ্ত তবে এটি পুরোপুরিভাবে সমর্থন করে বিবর্তনকে – সৃষ্টিতত্ত্ববাদকে কখনোই না। সৃষ্টিতত্ত্ববাদী প্রায়শই ‘মিসিং লিঙ্ক’ নিয়ে যুক্তি উত্থাপন করার চেষ্টা করে থাকেন, এবং ট্রানজিশনাল ফর্ম বা অন্তর্বর্তীকালীন অনুপস্থিতিকে তারা বিবর্তনের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি স্থাপন করার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। তবে কয়েন হরহামেশাই খুঁজে পাওয়া ট্রানজিশনাল ফর্মের উদাহরণ দিয়ে তাদের যুক্তি খণ্ডন করেন অনায়াসে।  এছাড়া তিনি সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের আরেকটি প্রিয় যুক্তি – প্রাকৃতিক নির্বাচন জটিল জৈববৈজ্ঞানিক কোনো বৈশিষ্ট্যের উদ্ভাবন করতে পারে না – খণ্ডন করেন প্রায়শই ব্যবহৃত ডানার উদাহরণ ব্যবহার করে। কীভাবে ১ বা ২০ কিংবা ৫০ শতাংশ ডানা কোনো জীবের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে? কয়েন এখানে ধারণা-নির্ভর তবে বাস্তবসম্মত উদাহরণ উপস্থাপন করেন, যা সমর্থন করে চীনে আবিষ্কৃত হওয়া ধারাবাহিক আর বিস্ময়কর সব জীবাশ্মগুলো, যেগুলো কীভাবে পালক এবং উড়বার ক্ষমতা বিবর্তিত হয়েছে সেটি আমাদের বুঝতে সহায়তা করে। এছাড়া আবিষ্কৃত হওয়া তিমির ধারাবাহিক জীবাশ্মগুলো সুস্পষ্টভাবে আমাদের দেখিয়ে দেয় স্থলবাসী স্তন্যপায়ী কীভাবে সামুদ্রিক একটি প্রাণীতে বিবর্তিত হয়েছে ।

তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনায় আমরা পরিচিত হই বিবর্তনের কিছু নীরব সাক্ষীর সাথে – নানা ধরনের নিষ্ক্রিয় অঙ্গ আর অবশিষ্টাংশ এবং অনুপযোগী খারাপ ডিজাইনের বর্ণনা। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের মত অর্থহীন ধারণার বোকামির বিরুদ্ধে যা যথোপযুক্ত জবাব। আর যে-কোনো কিছুর তুলনায় এইসব অকেজো অথবা বাজেভাবে পরিকল্পিত বৈশিষ্ট্যগুলোর অদ্ভুত উদাহরণের উদ্ধৃতি কয়েন মনে করেন বিবর্তনের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি। এবং খুব সহজেই যা সেই সব মানুষদের নিরস্ত্র করে যারা এইসব মিথ্যা ডিজাইন বিতর্কে বুদ্ধিমান সত্তার ডিজাইনের পক্ষে নিজের অবস্থান নেন। কয়েন পরিচিত এবং বেশ কিছু অপরিচিত উদাহরণ ব্যবহার করেছেন যেমন, তিমির কোমর এবং পা,  মানুষের লেজ ইত্যাদি। মানব-শরীরের আরও অনেক বৈশিষ্ট্যই খারাপভাবে ডিজাইন করা, এছাড়া মৃত  জিন এবং আমাদের ডিএনএ ‘জাঙ্ক’ অংশ তো আছে। এইসব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অবশ্যই অদ্ভুত ‘বাম রিকারেন্ট ল্যারিনজিয়াল’ স্নায়ুটি, যে স্নায়ুটি অপ্রয়োজনীয় ঘুর পথে গলা থেকে বুকের মহাধমনির মধ্যে নেমে আসে, এবং আবার উপরে উঠে যায় ল্যারিঙ্কস বা স্বরযন্ত্রে এর চূড়ান্ত গন্তব্যে, যে অঙ্গের এটি স্নায়ু-সংকেত সরবরাহ করে। যেহেতু এটি একসময় বিকাশমান ভ্রূণের গিল বা ফুলকার আর্চের সাথে সংযুক্ত ছিল, সেই কারণেই এটি তার একই অবস্থানে আছে।

অধ্যায় তিনের শুরুতে জেরি কয়েন প্যালিমসেস্টের রূপক ব্যবহার করেন। মধ্যযুগে লেখার উপকরণ হিসেবে চামড়া দিয়ে তৈরি পার্চমেন্ট বা ভেলাম সহজলভ্য ছিল না, বহু মধ্যযুগীয় লেখকই সেই কারণে পুরোনো পাণ্ডুলিপির লেখা ঘষে মুছে তার ওপর আবার নতুন করে লিখতেন, যাকে বলা হয় প্যালিমসেস্ট। প্রাচীন সেই পাণ্ডুলিপির মতো প্রতিটি জীবই ইতিহাসের – বিবর্তনীয় ইতিহাসের প্যালিমসেস্ট। ভেস্টিজ বা প্রায় বিলুপ্ত বা নিষ্ক্রিয় অঙ্গ কোনো প্রজাতির পূর্বসূরি জীবের কোনো অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করছে, কিন্তু সেই অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্য হয় পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে এর উপযোগিতা হারিয়েছে, অথবা অস্ট্রিচের ক্ষেত্রে যেমন আমরা দেখি নতুন কোনো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি নিষ্ক্রিয় তার কারণ এটির কোনো উপযোগিতা নেই তা নয় বরং এর কারণ এটি যে কাজটি করার জন্য বিবর্তিত হয়েছে সেটি আর করে না যেমন, অস্ট্রিচ উড়তে পারে না। এমন পাখিদের জন্য ওড়ার কাজটি বিপাকীয় ক্ষেত্রে অনেক ব্যয়সাধ্য একটি প্রক্রিয়া, যে বাড়তি শক্তিটি তারা প্রজননে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া যেমন আমাদের অ্যাপেনডিক্স, আমাদের তৃণভোজী পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে যে অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু বর্তমানে আমাদের খুব একটা কাজে আসে না। এছাড়া কক্সিক্স বা পুচ্ছাস্থি- আমাদের মেরুদণ্ডের নীচের প্রান্তে একীভূত হয়ে যাওয়া কয়েকটি মেরুদণ্ডের হাড় বা কশেরুকা হচ্ছে  আমাদের নিষ্ক্রিয় লেজ। এই সব প্রায় বিলুপ্ত নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া বা ‘ভেস্টিজিয়াল’ বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমরা কেবল বিবর্তনের আলোকেই ব্যাখ্যা করতে পারি।  

বিবর্তনের আরও একটি একটি প্রমাণ মেলে ‘অ্যাটাভিজম’ বা পূর্বগানুকৃতির মাধ্যমে। মাঝে মাঝে প্রজাতির কোনো সদস্য এমন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়, যা পূর্বসূরি কোনো বৈশিষ্ট্যের পুনরাবির্ভাব, বহু প্রজন্ম ধরে যা পরিলক্ষিত হয়নি। কোনো ঘোড়া হয়তো একটি বাড়তি আঙ্গুল নিয়ে জন্মাতে পারে, কিংবা লেজসহ কোনো মানব শিশু। এই পূর্বসূরি কোনো বৈশিষ্ট্যের কদাচিৎ পুনারির্ভূত হওয়ার ঘটনাটি অ্যাটাভিজম নামে পরিচিত। ভেস্টিজিয়াল বা প্রায় অবলুপ্ত বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কোনো বৈশিষ্ট্য থেকে এটি আলাদা কারণ কোনো কোনো সদস্যের শরীরে এগুলো হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়, প্রতিটি সদস্যদের মধ্যে নয়। বহু প্রজাতির জিনোমে আমরা মৃত বা নীরব জিনদের দেখি, যে জিনগুলো কোনো একসময় উপযোগী ছিল, কিন্তু সেগুলো আর আগের মতো কাজ করতে পারে না, অন্যভাবে বললে এরা হচ্ছে নিষ্ক্রিয় জিন, যেমন মানুষের প্রায় ত্রিশ হাজার জিনের মধ্যে দুই হাজারের বেশি জিনই হচ্ছে ‘সিউডোজিন’। কোনো প্রজাতির একটি মৃত জিন যা-কিনা কোনো আত্মীয় প্রজাতির মধ্যে এখনো সক্রিয় বিবর্তনের জন্য সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ, কিন্তু আরও বিষয় আছে। যখনই জীবিত প্রাইমেটদের মধ্যে আপনি ψGLO জিনটি লক্ষ করবেন, দেখা যাবে দূরবর্তী কোনো  প্রজাতি অপেক্ষা জিনটির অনুক্রম নিকটাত্মীয় প্রজাতির সাথে বেশি সাদৃশ্য বহন করে। সিউডোজিনের বিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা, এছাড়া আমাদের জিনোমে (৩৩) থাকা ‘এন্ডোজিনাস’ বা অন্তর্জনিষ্ণু রেট্রোভাইরাসের জিনোম আবিষ্কার। আর এগুলো ক্রোমোজোমে ঠিক একই জায়গায় আমরা তাদের খুঁজে পাই এইপদের জিনোমে এটি যেখানে আছে। শিম্পাঞ্জি এবং গরিলাদের সাথে আমরা একই বিটা গ্লোবিউলিনের সিউডোজিন ভাগাভাগি করছি, এই তিনটি প্রজাতিতেই জিনটি নিষ্ক্রিয়, তার মানে এইপদের সাধারণ পূর্বসূরিদের মধ্যেই এই জিনটি অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল বহুদিন আগে। সিউডোজিনগুলো বিবর্তনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেয়। আমরা শুধু এই মৃত জিনদের বহনই করছি না, এই জিনগুলো কোনো প্রোটিন তৈরির সংকেত বহন করছে না, শিম্পাঞ্জি, কিংবা গরিলা কিংবা গিবনে তারা জিনোমের সেই একই স্থানে অবস্থান করছে। কীভাবে আমরা এই একই জিনের বংশঐতিহ্য ব্যাখ্যা করতে পারি, যদি না এটি নিষ্ক্রিয় হিসেবে সাধারণ পূর্বসূরি থেকে না পাই? আপাতদৃষ্টিতে কোনো কাজ করে না এমন অঙ্গ, যেমন, আমাদের অ্যাপেনডিক্স, খারাপ পরিকল্পনার উদাহরণ, যেমন, মানব ডিম্বাশয় এবং ফেলোপিয়ান টিউবের মধ্যবর্তী ফাকা অংশ – এইসব কিছুই কেবল বিবর্তন দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, কারণ অনিবার্যভাবে তারা একটি সাধারণ বংশঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয় এবং উপাদান সংযোজন কিংবা বিয়োজন করে কীভাবে বিবর্তন প্রায়শই পুরোনো জিনগত কিংবা বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যকে প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণে(অথবা কোনো কাজের জন্য নয়) গড়ে-পিটে তৈরি করে নিতে পারে ।

খারাপ ডিজাইনের ব্যাপারটিও বিবর্তনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। প্রাকৃতিক পরিবেশে যে-কোনো জীবকে দেখলেই মনে হতে পারে এটি তার পরিবেশের সাথে দারুণভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে অর্থাৎ সুঅভিযোজিত – কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে এই নিখুঁত ডিজাইন আসলে একটি বিভ্রম। খারাপ ডিজাইনের ধারণাটি বুঝতে হবে যে অর্থে, সেটি হচ্ছে যদি জীবদের কোনো পরিকল্পক বা ডিজাইনারের দ্বারা একেবারে শুরু থেকে ডিজাইন করা হতো – যিনি কিনা স্নায়ু, মাংসপেশি,অস্থি ইত্যাদি উপাদান ব্যবহার করেছেন – তাহলে সেখানে আমরা কোনো ক্রটি দেখতে পেতাম না। ক্রটিহীন কোনো নকশা আসলেই কোনো দক্ষ আর বুদ্ধিমান ডিজাইনের প্রমাণ হতে পারতো। কিন্তু ক্রটিপূর্ণ ডিজাইন বিবর্তনের চিহ্ন, বাস্তবিকভাবে আমরা বিবর্তনের কাছে এমনই প্রত্যাশা করি। যেমন, আমরা জানি মাছ পূর্বসূরিদের জননেন্দ্রিয় থেকে বিবর্তিত হবার  কারণে পুরুষদের অণ্ডকোষ দুটিকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়, যা পেটের সামনের দেয়ালে দূর্বল একটি জায়গা সৃষ্টি করে, যেখানে হার্নিয়া হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া পুরুষদের মূত্রনালী যেমন অতিক্রম করে প্রোস্টেট গ্রন্থির ঠিক মধ্য দিয়ে, শেষ বয়সে যে গ্রন্থির বৃদ্ধি মূত্রনালীতে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে। নারীদের ক্ষেত্রেও সমস্যা হয় যখন যখন সংকীর্ণ শ্রোণিচক্রের মধ্যে দিয়ে খুবই কষ্টকর একটি উপায়ে সন্তান জন্ম দিতে হয়, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির আগে যে প্রক্রিয়াটি বহু মা এবং শিশুর মৃত্যুর কারণ ছিল।  

বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা দেখি বায়োজিওগ্রাফি বা জৈবভূগোল থেকে আসা গুরুত্বপূর্ণ বহু প্রমাণ বিবর্তনের পক্ষে কিছু অকাট্য যুক্তি হাজির করে। কারণ বিবর্তন তত্ত্ব শুধু প্রজাতির উদ্ভব ব্যাখ্যা করে না, এটি তাদের ভৌগলিক বিস্তারও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। জৈবভৌগলিক প্রমাণগুলো বিবর্তনের পক্ষে এতো শক্তিশালী প্রমাণ যে, এই প্রমাণগুলোর বিরুদ্ধে কোনো সন্তোষজনক যুক্তি বিবর্তন-বিরোধীরা কখনোই উপস্থাপন করতে পারেনি। এবং বলা যায় তারা চেষ্টাই করেনি বরং তারা এমন ভাব করেছে যেন এই ধরনের প্রমাণের কোনো অস্তিত্বই নেই। এই প্রশ্নগুলো প্রথম ডারউইনের মনেই উত্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু তার পক্ষে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কল্পনা করা সম্ভব ছিল না, যা এখন আমাদের কাছে স্পষ্ট, এর কারণ আমরা এখন ‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ এবং ‘মলিকিউলার ট্যাক্সোনমি’ সম্বন্ধে জানি। কোনো সৃষ্টিতত্ত্ববাদী, সে নুহ নবীর নৌকা বিশ্বাসী বা অন্য কোনো মতবাদী হোক না কেন, কখনোই ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কেন ভৌগলিকভাবে দুটি ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ধরনের প্রজাতি একই ধরনের রূপ নেয়। তারা এর ব্যাখ্যা হিসেবে হয়তো সৃষ্টিকর্তার নিরীক্ষাযোগ্য নয় এমন খামখেয়ালী কোনো ইচ্ছার কথা দাবী করবেন। কিন্তু বিষয়টি বিবর্তন ব্যাখ্যা করে অনেক সহজে – সুপরিচিত একটি প্রক্রিয়া যা পরিচিত ‘কনভার্জেন্ট’ বিবর্তন নামে। কনভার্জেন্ট বিবর্তন অনুযায়ী, প্রজাতিরা যারা একই ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করে তারা একই ধরনের নির্বাচনী চাপের মুখে পড়ে, যার কারণে তারা এই ধরনের অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্য বিবর্তন করে, যাকে বলে ‘কনভার্জ’ বা এক বিন্দু অভিমূখী, তারা দেখতে এবং আচরণে একই রকম মনে হলেও তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।

কনভার্জেন্ট বা সমকেন্দ্রী বিবর্তন প্রদর্শন করছে বিবর্তন তত্ত্বের তিনটি প্রক্রিয়া এখানে একই সাথে কাজ করছে: একটি সাধারণ বংশঐতিহ্য, প্রজাত্যায়ন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন। যদি বিবর্তন সত্য হয়ে থাকে তাহলে কোনো একটি এলাকায় বেঁচে থাকা প্রজাতিরা সেখানে বাস করা আরও আগের প্রজাতিদের বংশধর হবে, এবং যদি সেখানে আমরা ভূত্বকের অগভীর স্তরে জীবাশ্ম অনুসন্ধান করি আমরা দেখব তারা বর্তমানে সেখানে বাস করা প্রজাতিদের সদৃশ। এবং বাস্তবেই সেটি আমরা দেখতে পাই। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের পক্ষে এর ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন। যদি তাদের জোর করা হয় ব্যাখ্যা দেবার জন্য, তাদের প্রস্তাব করতে হবে যে ধারাবাহিকভাবে অসীম সংখ্যক একের পর এক সংঘটিত বিলুপ্তি আর নতুন করে সৃষ্টির চক্র ঘটেছে সারা পৃথিবীব্যাপী। এবং প্রতিবারই যে নতুন সেট প্রজাতি সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে একই জায়গায় এর আগে বাস করা প্রজাতির সদৃশ করে। জৈবভূগোলের আরও একটি প্রশ্ন আমরা প্রথম ডারউইনের কাছ থেকেই পেয়েছি –  প্রতিটি প্রজাতির স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি হবার মতবাদে যিনি বিশ্বাস করবেন, তাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, সামুদ্রিক দ্বীপগুলোয় যথেষ্ট পরিমানে সুঅভিযোজিত উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টি করা হয়নি। এবং সামুদ্রিক দ্বীপগুলোয় আমরা অনেক ধরনের প্রজাতিদের স্থানীয়ভাবে অনুপস্থিত দেখি, যেমন, উভচর, সরিসৃপ কিংবা স্তন্যপায়ী প্রাণী, এবং সেই প্রজাতিগুলোকে পরে যখনই সেই দ্বীপ পরিবেশে নিয়ে এসেছে মানুষ, তারা সাফল্যের সাথে সেখানে বসতি গড়েছে। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা কী উত্তর দিতে পারবেন কেন দ্বীপগুলোতে জীব প্রজাতির বিস্তারে আমরা এমন বৈষম্য দেখতে পাই। আর এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারে শুধুমাত্র বিবর্তন।

জীব প্রজাতির বিস্তার ও বৈচিত্র্য ইঙ্গিত দেয় জীবন বিবর্তিত হয়েছে। জীববিজ্ঞান এবং ভৌগলিক বিস্তারের প্রমাণ উভয় একই সাথে সাক্ষী দেয় এই বাস্তবতার। বায়োজিওগ্রাফী বা জৈবভূগোল থেকে আসা প্রমাণগুলো খুবই শক্তিশালী, ভেবে দেখুন সবচেয়ে প্রাচীন ‘মারসুপিয়াল’ (যারা বর্তমানে) জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গেছে উত্তর আমেরিকায় (সম্প্রতি চীনে) কিন্তু কেন? কারণ স্তন্যপায়ী এই প্রাণীগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল এখানে, এরপর তারা দক্ষিণ অভিমূখে সরে গেছে, আন্ট্যার্কটিকা হয়ে অস্ট্রেলিয়ার পথে। কীভাবে সেটি সম্ভব হয়েছিল? কারণ, একটি সময় দক্ষিণ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া একই মহাদেশের অংশ ছিল, গন্ডওয়ানা। যাদের যুক্ত করেছিল অ্যান্টার্কটিকা। এবং কেন স্থানীয় প্রজাতির মাছ, উভচর,সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ীদের সামুদ্রিক দ্বীপে দেখা যায় না? কারণ তারা সেখানে পৌঁছাতে পারেনি। এছাড়াও এই ধরনের দ্বীপে স্থানীয়ভাবে বিবর্তিত স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে দুটি প্রজাতি হচ্ছে বাদুড় এবং পানিতে বাস করা সিল। কেন? কারণ তাদের পূর্বসূরিরা সেই দ্বীপে পৌঁছাতে পেরেছিল। বায়োজিওগ্রাফি বা জৈবভূগোলের প্রধান শিক্ষাটি হচ্ছে যে শুধুমাত্র বিবর্তনই মহাদেশ ও দ্বীপে জীবনের এই বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করতে পারে কিন্তু এখানে আরও একটি শিক্ষা আছে, পৃথিবীতে জীবনের বিস্তার সুযোগ আর নিয়মমাফিক সূত্রের একটি মিশ্রণ।

পঞ্চম অধ্যায়ে বিবর্তনের চালিকা শক্তি -বিবর্তনের ইঞ্জিন- নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। বিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন – নির্বাচন বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনো মেকানিজম বা কার্যসাধনপদ্ধতি নয়, বরং এটি একটি প্রক্রিয়া, যা ব্যাখ্যা করে কোনো জিন যা কিনা সুঅভিযোজিত প্রজাতির জিনপুলে তার সংখ্যা সময়ের সাথে বৃদ্ধি পায়। যখন কোনো জীববিজ্ঞানী বলেন যে-কোনো একটি ট্রেইট বা বৈশিষ্ট্যের উপর ‘নির্বাচন’ কাজ করছে – তার অর্থ হচ্ছে এই বৈশিষ্ট্যটি একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করছে, এবং একই অর্থে মনে রাখতে হবে প্রজাতিরা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য চেষ্টা করে না। এখানে ইচ্ছা শক্তির কোনো ভূমিকা নেই, কোনো সচেতন প্রচেষ্টা নেই। কারণ, পরিবেশের সাথে অভিযোজন অবশ্যম্ভাবী একটি প্রক্রিয়া, যদি সেই প্রজাতির জনগোষ্ঠীতে সঠিক জিনগত ভিন্নতা বা প্রকরণ উপস্থিত থাকে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিতে মোট তিনটি বিষয় কাজ করে, প্রথম, শুরুতে সেই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে জিনগত ভিন্নতা বা প্রকরণ থাকতে হবে (যেমন, কোনো ইঁদুর জনগোষ্ঠীতে সদস্যদের চামড়ার রঙের ভিন্নতা)। দ্বিতীয়ত, এই ভিন্নতার কিছু অংশের অবশ্যই জিনগত ভিত্তি থাকতে হবে ( যাকে বলে ‘হেরিটেবিলিটি’ বা এমন কোনো বৈশিষ্ট্য যা বংশানুক্রমিকভাবে সঞ্চারিত হবে। জিনগত ভিন্নতার কারণ হচ্ছে ‘র‍্যানডোম’ মিউটেশন বা পরিব্যক্তি বা ডিএনএ নিউক্লিটাইড বেস অনুক্রমের (৩৩) পরিবর্তন।  

এখানে ব্যবহৃত ‘র‍্যানডোম’ শব্দটি একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে যা প্রায়শই ভুল বোঝা হয়, এমনকি জীববিজ্ঞানীরাও ভুল করেন, এর মানে হচ্ছে প্রজাতির সদস্যদের জন্য উপযোগী হোক কিংবা না-হোক, মিউটেশন (পরিব্যক্তি) ঘটেই, কারণ ডিএনএ অনুলিপন প্রক্রিয়ায় সাধারণ ভুলই মিউটেশন সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে প্রজাতির কোনো সদস্যের পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাবার সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে এই জিনগত ভিন্নতা। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন সেই অর্থে ‘র‍্যানডোম’ বা নির্বিকার এবং নিয়মমাফিক একটি প্রক্রিয়ার মিশ্রণ, প্রথমে একটি ‘র‍্যানডোম’ প্রক্রিয়া (বা নির্বিকার – প্রজাতির ভালো কিংবা মন্দ হোক সেই অর্থে) – মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট একগুচ্ছ জিনগত ভ্যারিয়ান্ট (প্রকরণ) বা ভিন্নতার সৃষ্টি, ভালো এবং খারাপ দুটোই (ইঁদূরের ক্ষেত্রে যেমন চামড়ার রঙের ভিন্নতা) এবং এরপর একটি নিয়মমাফিক প্রক্রিয়া – প্রাকৃতিক নির্বাচন – যা এই প্রকরণগুলো বাছাই করে – ভালোটা রেখে খারাপটা বাদ দেয় (যেমন, উপকুলের বালিয়াড়িতে বাস করা ইঁদুরদের হালকা রঙের জিন বেড়ে যায় গাঢ় রঙের জিন অপেক্ষা, কারণ হালকা রঙের চামড়াসহ ইঁদুররা শিকারি প্রাণীর নজর এড়াতে পারে বালিয়াড়ির রঙের সাথে একটি বিভ্রম সৃষ্টি করে, গাঢ় রঙের চামড়াসহ ইঁদুররা যে সুবিধাটি পায় না, আর সেই কারণে জনগোষ্ঠীতে হালকা রঙের জিন-বহনকারী সদস্যদের সংখ্যাও বেড়ে যায়, যারা তাদের সেই জিন পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত করারও বেশি সুযোগ পায়)। 

বিবর্তন সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ধারণা: সবকিছু ঘটে ‘চান্স’, দৈবাৎ, আপতনের মাধ্যমে, আসলেই পুরোপুরিভাবে এ ভ্রান্ত কটি ধারণা – কোনো বিবর্তনবাদী – এবং অবশ্যই ডারউইনও কখনো ভাবেননি প্রাকৃতিক নির্বাচন আপতন, দৈবক্রমে ঘটা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। বরং ঠিক এর বিপরীত। এটি সত্য যে, বিবর্তনের কাঁচামাল হচ্ছে প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে বিদ্যমান প্রকরণ- যা আসলেই তৈরি হয় ‘চান্স’ মিউটেশনের মাধ্যমে কিন্তু সেই প্রকরণগুলো প্রয়োজনীয় অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি করতে জন্যপ্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। সুস্পষ্টভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন ‘র‍্যানডোম’ কোনো প্রক্রিয়া নয়। এটি খুব শক্তিশালী একটি ছাকুনি, পরিবর্তন করতে সক্ষম এমন একটি শক্তি, যা প্রয়োজনীয় জিনগুলো পূঞ্জীভূত করে, যাদের পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হবার অধিকতর সম্ভাবনা আছে, এবং সেটি করার মাধ্যমে এটি প্রজাতির সদস্যকে তার পরিবেশের সাথে আরও সুঅভিযোজিত করে তোলে। সুতরাং এটি মিউটেশন ও নির্বাচনের একটি অনন্য মিশ্রণ – চান্স এবং নিয়মসিদ্ধতা- এটাই ব্যাখ্যা করে কীভাবে প্রজাতিরা অভিযোজিত হয় – রিচার্ড ডকিন্সের ভাষায় – the non-random survival of random variants অর্থাৎ র‍্যানডোম ভিন্নতাগুলো থেকে সুনির্দিষ্টভাবে বাছাই করা ভিন্নতাগুলোর টিকে থাকা।

স্পষ্টতই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটিকে জীববিজ্ঞানে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করার উপযোগী হতে হয়, যেমন কীভাবে ধীরে ধীরে ইতোমধ্যেই বিদ্যমান বৈশিষ্ট্য থেকে প্রতিটি অভিযোজন বিবর্তিত হয়েছে, এবং যে প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ – সেই বৈশিষ্ট্যের অধিকারীকে প্রজনন সাফল্য দেবে। বিবর্তনে অভিযোজনের ক্ষেত্রে কোনো অবনতি নেই, কারণ নির্বাচনের প্রকৃতি অনুযায়ী এমন কোনো ধাপ সৃষ্টি হয় না, যা এর অধিকারীকে সুফল দেয় না। প্রথমত, নীতিগতভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য উপায়ে কোনো একটি অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্যের ক্রমান্বয়ে বিবর্তন হবার প্রক্রিয়াটি কল্পনা করা সম্ভব হবে, যার প্রতিটি ধাপ এটি বহনকারী প্রজাতির সদস্যদের ‘ফিটনেস’ বাড়াবে (অর্থাৎ তারা গড়ে বেশি সংখ্যক সন্তানের জন্ম দেবে, কারণ তারা প্রজনন করা অবধি বেঁচে থাকবে)। খুবই সুস্পষ্ট একটি বিষয় – বিবর্তনের জন্য প্রয়োজন এমন কোনো বৈশিষ্ট্য – ধাপ – বিজ্ঞানীরা পাননি যা কিনা এর বাহকের ‘ফিটনেস’ ( টিকে থাকা ও প্রজনন সফল হবার যোগ্যতা) কমিয়ে দেয়। আরও একটি প্রয়োজনীয়তা আছে, অভিযোজনীয় কোনো বৈশিষ্ট্যকে অবশ্যই এর বাহকের প্রজনন সাফল্য বাড়িয়ে বিবর্তিত হতে হবে। অভিযোজন কোনো গোষ্ঠী কিংবা প্রজাতি নয়, সবসময়ই একক সদস্যদের ফিটনেস বৃদ্ধি করে। আমরা বিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব, আমরা এমন কোনো অভিযোজন দেখব না, যা কিনা প্রজাতির একক সদস্যদের ক্ষতি করে সামগ্রিক প্রজাতিকে সুবিধা দেয় – যা আমরা আশা করতে পারতাম যদি কোনো কল্যাণময় সৃষ্টিকর্তা প্রজাতিদের সৃষ্টি করতেন।

প্রাকৃতিক নির্বাচন ছাড়াও বিবর্তন ঘটে, যদিও অধিকাংশ জীববিজ্ঞানী বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেন কোনো জনগোষ্ঠীতে অ্যালিলদের সংখ্যা বৃদ্ধি (অ্যালিল হচ্ছে কোনো একটি জিনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ যা প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে থাকে), এবং সেই কারণে, বিশেষ করে কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে ভিন্ন ভিন্ন অ্যালিলের সংখ্যা ‘চান্স’-এর কারণে বৃদ্ধি পেতে পারে, নতুন মিউটেশন ঘটতে পারে, এবং র‍্যানডোমভাবে তাদের সংখ্যা কমতে বা বাড়তে পারে, এবং ধীরে ধীরে সেটি জনসংখ্যায় সুনির্দিষ্ট বা শতকরা ১০০ শতাংশ হতে পারে আবার পুরোপুরিভাবে হারিয়েও যেতে পারে। এবং জিনের হারের এই ‘র‍্যানডোম’ পরিবর্তনকে বলা হয় ‘জেনেটিক ড্রিফট’।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের প্রমাণের তিনটি শর্তের মধ্যে দুটোই আমরা কুকুরদের কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। কৃত্রিম নির্বাচন এত দ্রুত যদি শুধুমাত্র কুকুরের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বন্য প্রজাতির কুকুরদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম বৈচিত্র্য যে সৃষ্টি হতে পারে, সেটি মেনে নিতে আমাদের সমস্যা হবার কথা নয়, যখন কিনা প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করেছে আরও দীর্ঘ সময় ধরে। আসলেই প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম এই নির্বাচনের মধ্যে একটি মাত্র পার্থক্য, কৃত্রিম নির্বাচনে প্রকৃতি নয়, কোনো মানুষ প্রজননের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে – যে কিনা কোন প্রকরণটি ভালো আর কোনটি খারাপ সেটি বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যার্থে, মানুষের ইচ্ছার ওপর তাদের প্রজনন সাফল্য নির্ভর করে, প্রকৃতির সাথে অভিযোজনের ওপরে নয়। গরু, ভেড়া, শূকর, ফুল, সব্জী, শস্য – সব কিছুই মানুষ কৃষকদের নির্বাচন – এদের বন্য উত্তরসূরিদের ওপর মানুষের কৃত্রিম প্রজননের কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমেই যেগুলোর উদ্ভব হয়েছে । গৃহপালিতকরণ প্রক্রিয়ায় এইসব প্রজাতিগুলোর কাঙ্ক্ষিত সব বৈশিষ্ট্য আমরা বাছাই করেছি।

যদিও সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা বিপরীত দাবী করেন, কিন্তু প্রমাণ বলছে প্রাকৃতিক নির্বাচন জটিল পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়ার বিবর্তন ঘটাতে পারে। যেখানে কিনা এর প্রতিটি অংশ পরস্পর নির্ভরশীল। বিবর্তন-বিরোধী ‘ইন্টেলিজেন্ট’ ডিজাইন মতবাদীদের দাবী যেমন, রক্ত জমাট বাঁধার জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর বা উপাদান এবং এই প্রক্রিয়াটির জটিল ধাপসমূহ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হতে পারে না। যদিও এই বিষয়ে গবেষণা সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে পক্রিয়াটি বিবর্তিত হয়েছে, একইভাবে তারা রোগপ্রতিরোধ তন্ত্র নিয়েও মন্তব্য করেছেন, তবে ফিলাডেলফিয়ায় ডোভার ট্রায়ালে প্রচুর পরিমানে প্রমাণ এর পক্ষে উপস্থাপন করা হয়েছে – বিবর্তন-বিরোধীরা যদিও দাবী করেছেন যে, এইসব পক্রিয়াগুলো ডারউইনীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানীদের হাতে ক্রমান্বয়ে ঘটা এই প্রক্রিয়াটির যথেষ্ট প্রমাণ আছে। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রোটিনের সন্ধানও পেয়েছেন, যারা অন্য প্রাণী, যেমন সি কিউকাম্বারের শরীরের ভিন্ন কাজের জন্য বিবর্তিত হয়েছে, এবং এখন এটি সুস্পষ্ট যে, অন্যান্য জটিল প্রাণরাসায়নিক প্রক্রিয়ার মতো এই প্রক্রিয়াটিও বিবর্তন সৃষ্টি করেছে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন ব্যবহার করে, এটাই অভিযোজনীয় প্রক্রিয়ার ফসল।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের অত্যন্ত মন্থর গতির জন্য আমরা বিবর্তন প্রক্রিয়ায় বড় মাপের কোনো পরিবর্তন, যেমন কোনো প্রজাতিকে দ্বিবিভাজিত হতে দেখব না ঠিকই, তবে প্রকৃতিতে ছোটখাটো পরিবর্তনগুলো আমাদের অবশ্যই দেখতে পাওয়া উচিত – যদিও ‘ম্যাক্রোইভোল্যুশনারি’ পরিবর্তন ঘটছে আজও, সেটি দেখে যাবার মতো সময় পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমাদের নেই। তবে আমরা জানি এই ধরনের পরিবর্তন হয় আর আমরা জানি এর কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন কী আসলেই জটিলতর বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি করতে পারে?  প্রাকৃতিক নির্বাচন যদি দেখতেই হয় তবে আমাদের এমন প্রজাতি খুঁজতে হবে যারা দ্রুত বিভাজিত হয় – আর আমরা সেটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে দেখেছি। কিন্তু নির্বাচন কী জটিল কোনো অঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে? এই প্রশ্নটির সুযোগ নিয়েই সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা ‘গড অফ দি গ্যাপস’ বা ‘শূন্যস্থানের ঈশ্বর’ যুক্তি ব্যবহার করে থাকেন। এই যুক্তিটির উৎস মূলত আমাদের অজ্ঞতা। এটি আসলেই যা বলছে তা হল কীভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছে সেটি আমরা যদি বুঝতে না পারি, সেটি বোঝার অক্ষমতাই অতিপ্রাকৃত সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। শুধু ডারউইনবাদের দুর্বল সমালোচনা ছাড়া যেহেতু ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাদীরা নিজেরাও কোনো পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব বৈজ্ঞানিক দাবী করতে অক্ষম, এর বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমশ হ্রাস পায় যখন একের পর এক প্রমাণ আমাদের বোঝার পরিধিটি সম্পসারিত করা অব্যাহত রেখেছে।    

উপরন্তু ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাদীদের নিজেদের ব্যাখ্যাটি – কোনো একটি অতিপ্রাকৃত ডিজাইনারের ব্যক্তিগত মর্জি – প্রকৃতিতে কল্পনা করা সম্ভব সব পর্যবেক্ষণই ব্যাখ্যা করতে পারে। কিন্তু আপনি যদি এমন কোনো পর্যবেক্ষণের কথা ভাবতেই না পারেন যা-কিনা কোনো তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে পারবে, সেই তত্ত্ব আসলেই বৈজ্ঞানিক নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাস যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে আমাদের অজ্ঞতাকে জয় করে অনুসন্ধান ও গবেষণা, হাল ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞতাকে সৃষ্টিকর্তার বিস্ময়কর কাজ হিসেবে ব্যাখ্যা দেয়া নয়। ডারউইন বলেছিলেন, অজ্ঞতা প্রায়শই জ্ঞানের বদলে অহংকারী বিশ্বাসের জন্ম দেয়। যারা কম জানে,  তারা যারা বেশি জানে – তাদের চেয়ে অনেক বেশি জোরালোভাবে দাবী করে – এটা কিংবা ওই সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান করতে পারে না। মূল শিক্ষাটি হচ্ছে যে, জীবাশ্ম রেকর্ডে দেখা পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা দিতে প্রাকৃতিক নির্বাচন খুব দক্ষতার সাথেই ইতোমধ্যে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়েছে।  অনেকেই এই প্রশ্ন করার একমাত্র কারণ হচ্ছে যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি কাজ করতে যে সুবিশাল পরিমান সময় প্রয়োজন হয়, তারা সেটি অনুধাবন করেন না (করতে পারেন না)। অবশ্যম্ভাবী উপসংহার হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে ধরে নিতে পারি প্রাকৃতিক নির্বাচনই সব অভিযোজনীয় বিবর্তনের কারণ – যদিও বিবর্তনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নয়, কারণ ‘জেনেটিক ড্রিফট’ এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভূমিকা পালন করে। বিবর্তনের শক্তিটাকে বুঝতে হলে, আমাদের অবশ্যই বহু মিলিয়ন বছর ধরে নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট এইসব ক্ষুদ্র পরিবর্তন, এবং যে বিশাল সময় ধরে এই প্রক্রিয়াটি আসলে প্রকৃতিতে কাজ করেছে তা একত্রে বিবেচনা করতে হবে।

ষষ্ঠ অধ্যায়ের যৌন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছে। ডারউইনের একটি সন্দেহ মূলত যৌন নির্বাচনের গুরত্বপূর্ণ কিছু প্রাথমিক অন্তর্দৃষ্টির সূচনা করেছিল: ময়ূর কিংবা পুরুষ বার্ড অব প্যারাডাইস পাখিদের জমকালো বর্ণিল পালক আর নানা অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে করা যাবে না যে, এই সজ্জার কোনো কারণ নেই। কোনো প্রজাতির দুটি লিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে পার্থক্য খুব স্পষ্ট – বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যে যেমন, লেজ, রং এবং গান – এই লিঙ্গ ভিন্নতাই ‘সেক্সুয়াল ডাইমরফিজম’ নামে পরিচিত – গ্রিক ভাষায় যার অর্থ দুইটি রূপ, যার অর্থ একই প্রজাতির নারী এবং পুরুষদের সদস্যরা বাহ্যিক এবং অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতা প্রদর্শন করে। যৌন নির্বাচনের এই ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ‘বিনিময়’ মূল্য হচ্ছে বেঁচে থাকা নয়, বরং সফল প্রজনন। যৌন নির্বাচন দুটি রূপে আমরা দেখতে পাই, স্ত্রী লিঙ্গের সদস্যদের সঙ্গীনি হিসেবে পাওয়ার জন্য পুরুষ সদস্যদের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যেমন, আইরিশ এলকদের সুবিশাল অ্যান্টলার বা শিং আর অন্যটি, যা উইডোবার্ডদের লম্বা লেজের জন্য দায়ী, এবং সম্ভাব্য পুরুষ সঙ্গীদের মধ্য থেকে স্ত্রী সদস্যদের যোগ্য সদস্যদের বাছাই করার প্রক্রিয়া। এই দুই ধরনের যৌন নির্বাচনে, পুরুষরা স্ত্রীদের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। কিন্তু কেন এর বিপরীত কিছু হয় না? খুব তাড়াতাড়ি আমরা জানতে পারব পুরো বিষয়টা নির্ভর করে দুটি ক্ষুদ্র কোষের আকারের তারতম্যের উপর – ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু। কোনো সন্দেহ নেই নারীদের বাছাই করার প্রক্রিয়াসহ বহু লিঙ্গ-নির্ভর বৈশিষ্ট্য বিবর্তনের চালিকা শক্তি। ডারউইন তাহলে ভুল বলেননি।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে এখানে – কেন স্ত্রী লিঙ্গের সদস্যরা বাছাই করার সুযোগ পায়? আর পুরুষরা তাদের মন জয় করার চেষ্টা করে বা তাদের জন্য যুদ্ধ করে? এবং স্ত্রী সদস্যরা কেনই বা বাছাই করে ? বিবর্তনের রহস্যগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে – কেনই বা যৌন প্রজনন বিবর্তিত হয়েছিল? প্রথমত, কেন মাত্র দুটি লিঙ্গ ( কেন তিন বা আরও বেশি সংখ্যক নয়), দ্বিতীয়ত কেনই বা এই দুটি লিঙ্গের তৈরি করা জননকোষগুলো তাদের আকার ও সংখ্যায় ভিন্নতা প্রদর্শন করে ( পুরুষরা প্রচুর সংখ্যক ক্ষুদ্রাকার শুক্রাণু তৈরি করে, অন্যদিকে স্ত্রী সদস্যরা অল্প সংখ্যক কিন্তু আকারে বেশ বড় ডিম্বাণু তৈরি করে)। জনন কোষ বা গ্যামেটের আকারের অপ্রতিসাম্যতাই যৌন নির্বাচনের সব মঞ্চ তৈরি করে, এবং দুটি লিঙ্গের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের প্রজননসঙ্গী এবং প্রজননের কৌশল বিবর্তনের কারণ হয়। পুরুষ ও স্ত্রী সদস্যদের মধ্যে বিবর্তনীয় পার্থক্যটির ভিত্তি মূলত তাদের বৈষম্যসূচক বিনিয়োগ- মূল্যবান ডিমের জন্য বিনিয়োগ বনাম সস্তা শুক্রাণুর জন্য বিনিয়োগ, গর্ভধারণের সময় বিনিয়োগ ( যখন স্ত্রী সদস্যরা নিষিক্ত ডিম্বাণু তাদের শরীরে ধারণ এবং পুষ্টি প্রদান করে) এবং সন্তান প্রতিপালনের সময় বিনিয়োগ (যখন বহু প্রজাতিতে স্ত্রী সদস্যরা তাদের সন্তানদের প্রতিপালন করে)। এই বিষয়গুলোর মূল ফলাফল আমরা দেখতে পারি, সাধারণভাবে স্ত্রী সদস্যদের প্রজনন সঙ্গীনি হিসেবে পাবার জন্য পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, পুরুষরা হয় বহুগামী আর স্ত্রী সদস্যরা সাবধানী,সহজে যারা ধরা দেয় না।

এখনো অবধি ‘গুড’ বা ভালো জিন মডেলই যৌন নির্বাচনের সবচেয়ে সমর্থিত ব্যাখ্যা। যদি অপেক্ষাকৃত কম পরিমান প্রমাণ সত্ত্বেও এই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের বিশ্বাসটি আংশিকভাবে ডারউইনীয় ব্যাখ্যার প্রতি বিজ্ঞানীদের পক্ষপাতিত্বের বিষয়টিও নির্দেশ করে। তারা বিশ্বাস করেন প্রজাতি স্ত্রী সদস্যরা কোনো-না-কোনোভাবে বিভিন্ন পুরুষদের জিনের মধ্যে পাথর্ক্য করতে পারে। তবে সেক্সুয়াল ডাইমরফিজম বা যৌন দ্বিরূপতার একটি তৃতীয় ব্যাখ্যা আছে এবং এটাই সবচেয়ে সহজ। এর ভিত্তি একটি মডেল যা ‘সেন্সরি বায়াস’ মডেল নামে পরিচিত। এটি পূর্বধারণা করে যৌন দ্বিরূপতার বিবর্তন পরিচালিত হয় স্ত্রী সদস্যদের স্নায়ুতন্ত্রে ইতোপূর্বে বিদ্যমান পক্ষপাতিত্ব থেকে। এবং এইসব পক্ষপাতিত্বগুলোকে বলা যেতে পারে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ারই বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত, সঙ্গী/সঙ্গীনি খোঁজা ছাড়াও ভিন্ন কোনো কাজের জন্য যার হয়তো উদ্ভব হয়েছে, যেমন, খাদ্য অনুসন্ধান। প্রাকৃতিক নির্বাচন মাঝেমধ্যে আগে থেকেই পক্ষপাতিত্ব তৈরি করে, যা প্রাণীদের টিকে থাকতে ও প্রজনন করতে সহায়তা করে। পুরুষের নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে এই পছন্দ-অপছন্দগুলোই যৌন নির্বাচন তাদের কাজে লাগাতে পারে।

সপ্তম অধ্যায়ে কয়েন তার নিজের গবেষণার ক্ষেত্র প্রজাত্যায়ন বা প্রজাতি সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় ফিরে আসেন, যে বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যপুস্তকেরও তিনি লেখক । এখানে তিনি প্রজাতির উৎপত্তি সংক্রান্ত ধারণাগুলো নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করেছেন। শুরুতেই আমরা বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ই. ও. উইলসনের (৩৩) একটি উদ্ধৃতি দেখি  ‘প্রতিটি প্রজাতি বিবর্তনের একেকটি মাস্টারপিস, যা মানুষ কখনো পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না, এমনকি জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে আমরা যদি নতুন প্রাণও সৃষ্টি করতে পারি’। আর্নস্ট মায়ার (৩৪) তার পাপুয়া নিউগিনির পাখি প্রজাতির সংখ্যা নির্ণয় করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে লক্ষ করেছিলেন যে, বিজ্ঞানী এবং স্থানীয়রাও একইভাবে বন্য প্রকৃতিতে বিদ্যমান একই প্রজাতি শনাক্ত করতে পারে। খুবই ভিন্ন প্রেক্ষাপটের দুটি সাংস্কৃতিক  গোষ্ঠীর মধ্যে এই সাদৃশ্য মায়ারকে সাহায্য করেছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে –  প্রকৃতিতে প্রজাতির আসলেই কাল্পনিক বা মনগড়া কোনো বিষয় নয় বরং এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক বাস্তব সত্য। আমরা সব প্রাণীদের বিচ্ছিন্ন ক্লাস্টার বা গুচ্ছ হিসেবে দেখতে পাই, এই বিচ্ছিন্ন প্রজাতি হিসেবে পরিচিত, যেখানে প্রজাতির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যৌন প্রজননক্ষম। কয়েন আমাদের জানান ডারউইনের বইটির নাম যদিও ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ বা প্রজাতির উৎপত্তি, তবে এর উপযুক্ত নাম হতে পারতো ‘অভিযোজনের উৎপত্তি’। যদিও ডারউইন সমাধান করতে পেরেছিলেন কেন সময়ের সাথে একটি প্রজাতি পরিবর্তিত হয় ( মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে) তবে তিনি কখনো ব্যাখ্যা দেননি কেন এবং কীভাবে একটি প্রজাতি দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়।

আমরা যদি জীববৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করতে চাই তাহলে শুধু অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে সেটি ব্যাখ্যা করলেই চলবে না, কীভাবে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয় আমাদের সেটি ব্যাখ্যা করতে হবে। কারণ যদি প্রজাত্যায়ন না হয়, তাহলে কোনো জীববৈচিত্র্য থাকত না – শুধু একটি একক, দীর্ঘ সময় ধরে বিবর্তিত হওয়া প্রথম প্রজাতির উত্তরসূরি জীব ছাড়া। আমরা কীভাবে প্রজাতি শনাক্ত করি এই প্রশ্নের উত্তরের সুস্পষ্ট একটি ভিত্তি আছে, কোনো জীব সদস্যদের একটি গোষ্ঠী যারা অন্য কোনো গোষ্ঠীর সদস্যদের তুলনায় অনেক বেশি পরস্পরের সদৃশ, এই সংজ্ঞানুযায়ী, যা পরিচিত ‘মরফোলজিক্যাল স্পিসিস কনসেপ্ট’ বা অঙ্গসংস্থানমূলক প্রজাতি ধারণা – সেখানে টাইগার বা বাঘ শ্রেণীকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এইভাবে – একটি গোষ্ঠী, এশিয়ার সব বিড়াল জাতীয় প্রাণীরা যার অন্তর্ভুক্ত, যারা আকারে পাঁচ ফুট দীর্ঘ এবং শরীরের কমলা রঙের চামড়ায় কালো উল্লম্বভাবে ডোরা কাটা, ও মুখ ও চোখের পাশে সাদা চামড়ার অংশ আছে। কিন্তু দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যগুলো কখন যথেষ্ট পরিমান হবে যে, তাদের আমরা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারব? এই ধারণার সমস্যা হচ্ছে এইভাবে প্রজাতিকে পৃথক করা মূলত মনগড়া একটি অনুশীলন, যখন কিনা আমরা জানি যে, প্রজাতি নৈর্ব্যক্তিক একটি ধারণা, এটি মানুষের কল্পনাপ্রসূত শ্রেণীবিন্যাস নয়। আপনি যখন কোনো প্রজাতির কথা ভাববেন, আপনি সেই ধারণায় পৌঁছাবেন – প্রজাতিরা আলাদা এই জন্য নয় যে, তারা শুধু দেখতে ভিন্ন, বরং এর কারণ প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে একটি সীমারেখা বা প্রতিবন্ধকতা আছে, যা তাদের অন্য কোনো প্রজাতির সদস্যদের সাথে প্রজনন করতে বাঁধা দেয়।

আর্নস্ট মায়ারই প্রথম আমাদের জন্য প্রজাতিকে নিজেদের মধ্যে প্রজননক্ষম প্রাকৃতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, যারা প্রজননগত দিক থেকে অন্য জীবগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন। এবং এর অর্থ কোনো একটি প্রজাতি একটি বিবর্তনীয় সমাজও। প্রজাতি, তাহলে বিবর্তনের একটি একক – এটাই- যা কিনা বিবর্তিত হয়। আমরা যদি ব্যাখ্যা দিতে পারি বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান এই ‘রিপ্রোডাকটিভ ব্যরিয়ার’ বা প্রজননগত প্রতিবন্ধকতা কীভাবে সৃষ্টি হয়, আমরা প্রজাতির উৎপত্তিও ব্যাখ্যা করতে পারব। কীভাবে আপনি একটি প্রজাতিকে দ্বিবিভাজিত করবেন – যারা প্রজনন সীমানা দিয়ে পৃথকীকৃত? মায়ার যুক্তি দেন, এই সীমানাগুলো মূলত প্রাকৃতিক এবং যৌন নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপজাত, যা ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দিকে বিবর্তিত হবার কারণে পরিণত হয়। একটি বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করা জরুরী যে, প্রজাতি, যেমন ডারউইন ভাবতেন, প্রকৃতির কোনো শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য উদ্ভব হয় না। প্রজাত্যায়নসংক্রান্ত গবেষণা বলছে প্রজাতিগুলো হচ্ছে বিবর্তনের দূর্ঘটনা। যদিও জীববৈচিত্র্যের জন্য অপরিহার্য এই জীবগোষ্ঠীগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেগুলো বৈচিত্র্য বৃদ্ধি কিংবা ভারসাম্যময় বাস্তুতন্ত্র সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে বিবর্তিত হয় না। এই বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলো জিনগত প্রতিবন্ধকতার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, যার উদ্ভব হয় যখন ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীগুলো ভিন্ন ভিন্ন দিকে বিবর্তিত হয়।  জৈববৈজ্ঞানিক প্রজাত্যায়ন বহুভাবেই দুইটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ভাষার স্বতন্ত্র ভাষায় পরিণত হবার প্রক্রিয়ার মতো, যা সাধারণ পূর্বসূরি একটি ভাষা থেকে বিবর্তিত হয়েছে (যেমন, জার্মান এবং ইংলিশ দুটি সম্পর্কযুক্ত ভাষা)। জীব প্রজাতিদের মতোই কোনো ধারাবাহিকতার অংশ না হয়ে প্রতিটি ভাষাই বিচ্ছিন্ন সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠী সৃষ্টি করে। যে-কোনো মানুষের ভাষাকে আমরা সুস্পষ্টভাবেই কয়েক হাজার ভাষার কোনো-না-কোনো একটিতে শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারি। এই তুলনামূলক সাদৃশ্য আরও গভীরে যেতে পারে। ভাষার বিবর্তনকে আমরা দূর অতীত অভিমূখেও অনুসরণ করতে পারি, এবং শব্দ আর ব্যাকরণের সাদৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটি ভাষার বৃক্ষ তৈরিও করতে পারি। ঠিক এভাবেই জীববিজ্ঞানীরা পূর্বধারণা করতে পারেন কোনো ‘মিসিং লিঙ্ক’ আর পূর্বসূরি জিন কেমন হওয়া উচিত।  

অষ্টম অধ্যায়ে কয়েন মানব বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছেন। মানব বিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে সমন্বিত গবেষণা হচ্ছে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে। বিবর্তন বৃক্ষে আমাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে জীবাশ্মতত্ত্ববিদ, জিনতাত্ত্বিক এবং অণুপ্রাণবিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম এবং ডিএনএ অনুক্রম ব্যবহার করেছেন। এখন আমরা জানি যে, আমরা এইপ বা নরবানরদের উত্তরসূরি এবং জিনগতভাবে আমাদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় প্রাণী প্রজাতিটি হচ্ছে আরেকটি এইপ, শিম্পাঞ্জি, আফ্রিকায় যাদের পূর্বসূরিরা আমাদের পূর্বসূরিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বেশ কয়েক মিলিয়ন বছর আগে। এই বিষয়গুলো এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। জীবাশ্ম সৃষ্টি হবার কঠোর পূর্বশর্তগুলো ইতোপূর্বেই ব্যাখ্যা করেছে আমাদের কেন এমন কোনো একক প্রজাতি খুঁজে পাবার আশা করা উচিত নয়, যা কিনা মানুষ এবং এইপদের মধ্যে ‘মিসিং লিঙ্ক’ বা হারানো যোগসূত্র । আমরা শুধু আশা করতে পারি যে, বিবর্তনীয় আত্মীয়দের খুঁজে পেতে, যাদের মধ্যে আমরা দুটি প্রজাতির বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি মিশ্রণ দেখতে পাব। তবে ইতোমধ্যেই জীবাশ্মবিদরা সেখানেও বেশ কিছু চমক লাগানো জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছেন। ইথিওপিয়ায় খুঁজে পাওয়া মানব বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ জীবাশ্ম ল্যুসি অবশ্যই মানুষ আর প্রাচীন এইপদের মধ্যে চমৎকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতি বা ‘মিসিং লিঙ্ক’। স্পষ্টত এর পরে আবিষ্কৃত বহু জীবাশ্ম আমাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে এইপ সদৃশ্য পূর্বসূরি থেকে মানব প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে। এটি সত্য যে, প্রায় সাত মিলিয়ন বছর আগে শিম্পাঞ্জিদের পূর্বসূরি থেকে আমাদের পূর্বসুরিরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকায়, এবং বড় মস্তিষ্ক বিবর্তনের আগেই আমাদের পূর্বসূরিরা দুই পায়ে হাঁটার দক্ষতা অর্জন করেছিল। মানব প্রজাতির এই পূর্বসূরিদের শ্রেণীবিন্যস্ত করার ক্ষেত্রে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা এখনো অক্ষম ।

কিন্তু মানব বিবর্তনে চালিকা শক্তিটি কী ছিল? বিবর্তনীয় পরিবর্তনগুলোকে শনাক্ত করার চেয়ে এর পেছনের শক্তি বোঝার প্রচেষ্টা সবসময়ই কঠিন কাজ। অনেক জীববিজ্ঞানীর মতে এই বিবর্তনের সূচনা করেছিল পরিবেশ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন, কোনো-না-কোনোভাবে এই পরিবর্তনগুলো মানব পূর্বসূরিদের বৈশিষ্ট্যসূচক বৈশিষ্ট্য- বাইপেডালিজম বা দ্বিপদী জীবনচর্যা বা দুই পায়ে হাঁটতে পারার ক্ষমতা বিবর্তিত হওয়ার পথ সুগম করেছিল। কিন্তু কেন বিবর্তন হয়েছে সেই রহস্যটা যেন সেই বিতর্কাতীত বাস্তব সত্য থেকে আমাদের মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত না করে – আমরা আসলেই বিবর্তিত হয়েছি। জিনগতভাবে আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জি জিনের পার্থক্য খুব সামান্য হলেও জিনের ডিএনএ অনুক্রম এবং জিন উপস্থিতির পার্থক্য আছে। আমাদের সাথে তাদের পার্থক্য বহু রূপে আমরা দেখতে পাই। জিনদের তৈরি প্রোটিনেই সেই পার্থক্য শুধু না, জিনের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতিও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতার ইঙ্গিত দেয়, এছাড়া জিনের সংখ্যা এবং ভ্রূণবিকাশের সময় কোনো জিনটি প্রকাশ হবে কি হবে না সেখানেও আমরা পার্থক্য দেখতে পারি। শুধু একটি বা কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনের মিউটেশনের ওপর আমাদের মানবিক বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে, এমন কোনো দাবী আমরা করতে পারি না, এবং বিষয়টি বিস্ময়করও নয়, কারণ যদি নিকটাত্মীয়দের সাথে আমাদের অসংখ্য পার্থক্যগুলোর কথা বিবেচনা করি। আর এই পার্থক্য শুধু শারীরিক গঠনেই না, পার্থক্য আছে শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া ( সব এইপদের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে বেশি ঘর্মাক্ত হই, আমরাই একমাত্র এইপ যাদের স্ত্রী সদস্যদের ওভ্যুলেশন বা ডিম্বাণু উৎপাদন ও ডিম্বাশয় থেকে নির্গত হবার প্রক্রিয়াটি গোপনে ঘটে), আচরণ (মানুষরা জুটি বাধে, এইপরা না), ভাষা, মস্তিষ্কের আকার ও গঠনে (নিঃসন্দেহে বহু পার্থক্য আছে কীভাবে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো পরস্পরের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে)। আমাদের অন্যান্য প্রাইমেট জ্ঞাতিদের সাথে সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও এইপ সদৃশ্য কোনো পূর্বসূরি থেকে আমাদের বিবর্তনে কেন এতো উল্লেখযোগ্য পরিমানে জিনগত পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছে।  

মানব জাতির রেস বা বর্ণ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অধিকাংশ জীববিজ্ঞানী সযত্নে এড়িয়ে চলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এর কারণটা বুঝতে পারি। আধুনিক জীববিজ্ঞানের শুরুতেই বর্ণ-নির্ভর শ্রেণীবিভাজন বর্ণবাদী নীতি আর বিদ্বেষের সাথে একই সুত্রে বাঁধা। বিবর্তনেই কারণে আমরা দেখি যে, মানুষের শারীরিক ভিন্নতাগুলো ঘটে একই সাথে বসবাসরত মানবগোষ্ঠীতে। বহু সাহসী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বর্ণ শ্রেণীবিভাগ করার ব্যপারটি নৈর্ব্যক্তিক কোনো প্রচেষ্টায় হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি এখনও। বিভেদের সীমানাগুলো মূলত কাল্পনিক, নৃতত্ত্ববিদদের চিহ্নিত বর্ণ বা রেসের সংখ্যা তিন থেকে ত্রিশ। গত তিন দশকের জিন-নির্ভর গবেষণাগুলোর প্রমাণ জানাচ্ছে বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে ভিন্নতা প্রতিনিধিত্বকারী জিনগত ভিন্নতার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দাবী করতে পারে। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভিন্নতা কোনো একটি বর্ণের বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যেই বিদ্যমান। কিছু জীববিজ্ঞানীদের মতে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের পার্থক্য সূচক জিনগত ভিন্নতা খুব সহজেই নিরীক্ষা করতে পারে সম্ভাব্য প্রজননসঙ্গীরা, যা একটি বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে – যৌন নির্বাচন। কয়েন আমাদের মনে করিয়ে দেন মানব জনগোষ্ঠী জিনগতভাবে যে গতিতে বিবর্তিত হতে পারে তার চেয়ে দ্রুত গতিতে তাদের সংস্কৃতিকে বদলাতে পারে- কিন্তু সাংস্কৃতিক এই পরিবর্তন জিনগত পরিবর্তনও ঘটাতে পারে। বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে পার্থক্য সংক্রান্ত বিতর্ক শুধু তাদের বাহ্যিক শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই নয়, বরং আচরণগত ভিন্নতা সংক্রান্ত। বিবর্তন কী কোনো বিশেষ বর্ণের মানুষদের অন্য বর্ণের মানুষদের তুলনায় বেশি বুদ্ধিমান, শারীরিকভাবে শক্তিশালী, ধূর্ততর করে তুলেছে? এখানে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে কারণ প্রমাণহীন এই দাবী বর্ণবাদ বিদ্বেষের হাতে বিজ্ঞানের অস্ত্র তুলে দেয়।

সুতরাং এক্ষেত্রে বিজ্ঞান কী বলছে? প্রায় কিছুই না। অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন আচরণ থাকতে পারে, তাদের বুদ্ধিমত্তার স্তরও ভিন্ন হতে পারে, এমনকি তাদের যোগ্যতাতে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু এই পার্থক্যগুলোর উৎস যে পরিবেশ ও সংস্কৃতি অর্থাৎ জিনগত নয় এমন সব কারণের ওপর নির্ভর করে না সেটি প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন একটি কাজ। দুটি বর্ণের মানুষদের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো একটি পার্থক্যের ভিত্তি হচ্ছে জিন কিনা যদি আমরা সেটি জানতে চাই, আমাদের অবশই জিন বহির্ভূত সব প্রভাব খতিয়ে দেখতে হবে, এবং তাদের যে কোনো ভূমিকা নেই সেটি প্রমাণ করতে হবে। এই ধরনের গবেষণার জন্য প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষা, যেমন, বিভিন্ন বর্ণের শিশুদের তাদের পিতামাতার কাছ থেকে জন্ম থেকেই আমাদের আলাদা করতে হবে, এবং তাদের একই রকম অথবা রদবদল করা পরিবেশে প্রতিপালন করতে হবে। তারপর যে আচরণগত পার্থক্য অবশিষ্ট থাকবে সেগুলো হবে জিনের কারণে। যেহেতু এই ধরনের গবেষণা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়, কখনোই পদ্ধতিগতভাবে এই গবেষণাগুলো করা হয়নি। কিন্তু আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিবেশে দত্তক নেবার মাধ্যমে প্রতিপালিত হওয়া শিশুদের নিয়ে নানা গবেষণার উদাহরণমূলক সূত্রগুলো বলছে আচরণের উপর সাংস্কৃতিক প্রভাব খুবই শক্তিশালী। সর্বোপরি ডিএনএ উপাত্ত জানাচ্ছে, মানব জনগোষ্ঠীতে জিনগত পার্থক্য খুব সামান্য। মানব জীবাশ্ম রেকর্ডের শিক্ষা তাহলে মানব জিনের সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারের সাথে যুথবদ্ধ হয়ে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে, আমরা হচ্ছে বিবর্তিত স্তন্যপায়ী – গর্বিত এবং নিশ্চিতভাবেই সফল, কিন্তু স্তন্যপায়ীরা সৃষ্টি হয়েছে সেই একই বিবর্তিনীয় প্রক্রিয়ায় – যা কয়েক শত কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীতে জীবনের সব রূপকেই বিবর্তিত করেছে। অষ্টম অধ্যায়ে কয়েন খুব দক্ষতার সাথে সতর্কভাবে রেস বা বর্ণ বিষয়টি আলোচনায় করেছেন। নিঃসন্দেহে খুব কঠিন একটি বিষয়, এবং যে সংযোগগুলো তিনি করেছেন সেগুলো বাস্তব-পরিস্থিতির পটভূমিতে সংবেদনশীলতার সাথে বিষয়টি বিচার করার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক ছিল। ঠিক একইভাবে সামাজিক আচরণের সাথে বিবর্তনের সম্পর্কের অস্পষ্টতার কথা তিনি আলোচনা করেছেন।  

বইটির শেষ অধ্যায়ে বিবর্তনের প্রাসঙ্গিকতায় কয়েনকে আমরা বিজ্ঞান দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে দেখি। অধ্যায়ের শুরুতেই আমরা রিচার্ড ডকিন্সের (৩৫) একটি পরিচিতি উদ্ধৃতি পাই – মোহাবিষ্ট আধ্যাত্মিকায় জীবন কাটাতে অভ্যস্ত মানুষ তাদের জীবনের উদ্দেশ্য বিবর্তনের নৈর্ব্যাক্তিকতার মধ্যে উপস্থিত নেই এই সত্যটি বহু মানুষের বিবর্তন সংক্রান্ত মনোভাবেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ডকিন্সকে প্রায়শই প্রশ্ন করা হয়, কেন তিনি বেঁচে আছেন- বিজ্ঞানের সৌন্দর্য কিংবা মানব সৃজনশীলতা নিজেদের জীবনবোধের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ মানুষদের তিনি বলেছেন – বহু শত মিলিয়ন বছর ঘুমিয়ে থাকার পর আমরা এই অসাধারণ চমৎকার, বর্ণিল আর জীবনে ভরপূর পৃথিবীতে আমাদের চোখ মেলতে পেরেছি অবশেষে। তবে আর কয়েক দশকের মধ্যেই আমাদের অবশ্যই এই চোখ বন্ধ করতে হবে। এই স্বল্প সময়ে মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের জানার প্রচেষ্টা কী সবচেয়ে আলোকিত মহত্ত্বতম উপায় না?  তার অভিজ্ঞতালব্ধ একটি ঘটনার বিবরণে সুস্পষ্ট হয় যতই প্রমাণ দেখানো হোক না কেন বহু মানুষই বিবর্তন জীববিজ্ঞান নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা অনুভব করেন। সমস্যা হচ্ছে প্রমাণের কোনো অভাব নেই- জীবাশ্ম রেকর্ড, জৈবভূগোল, ভ্রূণতত্ত্ব, নিষ্ক্রিয় অঙ্গ, ডিজাইন ক্রটি এবং আরও অনেক কিছু – এবং এইসব কিছু শুধু ছোট ছোট  মাইক্রোবিবর্তনীয় পরিবর্তন নয়, আমরা এমনকি নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হতে দেখেছি, আমাদের সামনে এবং জীবাশ্ম রেকর্ডে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন প্রজাতিও খুঁজে পেয়েছি প্রধান জীবগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে, যেমন, তিমি এবং স্থলবাসী প্রাণী। প্রতিদিন, শত শত পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষার ফলাফল বিজ্ঞান প্রকাশনার ভাণ্ডারে যুক্ত হচ্ছে, এবং প্রতিটি তথ্য আমাদের জানান দিচ্ছে যে, বিবর্তন সত্য। প্রতিটি খুঁজে পাওয়া জীবাশ্ম, প্রতিটি ডিএনএ যা আমার অনুক্রম করি, প্রতিটি অঙ্গ যা আমার ব্যবচ্ছেদ করি, সবকিছুই আমাদেও সেই ধারণাকে সমর্থন করে উপাত্ত প্রদান করে যে, আমার সবাই বিবর্তিত হয়েছি একটি সাধারণ উত্তরসূরি থেকে। অসংখ্য সম্ভাব্য পর্যবেক্ষণ যা কিনা বিবর্তনকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারতো, আজ অবধি আমরা একটিও প্রমাণ পাইনি। এখন যখন আমরা বলি যে বিবর্তন সত্য, তার মানে ডারউইনবাদের মূল প্রস্তাবগুলো প্রমাণিত হয়েছে।

যদিও কীভাবে বিবর্তন সংঘটিত হয়েছে কিংবা সেই প্রক্রিয়াগুলোর কোনটির আপেক্ষিক গুরুত্ব কতটুকু সেই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু বিবর্তন তত্ত্বের মূল দাবীগুলো নিয়ে জীববিজ্ঞান বোঝেন এমন জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই। বিবর্তনকে এই বিতর্কগুলো ভুল প্রমাণ তো করেনি, বরং এই বিতর্কগুলোই আসলেই প্রমাণ করে বিবর্তন জীববিজ্ঞান জীবন্ত এবং ক্রমবর্ধিষ্ণু একটি জ্ঞানের ক্ষেত্র। বিজ্ঞানকে যা সামনের দিকে নিয়ে যায় সেটি হচ্ছে অজ্ঞতা, বিতর্ক এবং পর্যবেক্ষণ, এবং প্রমাণের মাধ্যমে বিকল্প প্রস্তাবগুলোকে যাচাই করার দেখার প্রক্রিয়া। কোনো বিতর্ক ছাড়া বিজ্ঞান হচ্ছে স্থবির – প্রগতি ছাড়া বিজ্ঞান। বিবর্তনকে আমোঘ সত্য হিসেবে গ্রহন করার জন্য কয়েন মনে করেন বহু মানুষের শুধু প্রমাণ ছাড়াও আরও কিছু দরকার । এইসব মানুষের জন্য বিবর্তন জীবনের উদ্দেশ্য, নৈতিকতা, অর্থ ইত্যাদি বিষয়ে গভীরতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। তারা কিছুতেই বিবর্তনের ধারণাটি গ্রহন করতে পারেন না, যত বেশি প্রমাণই তাদের দেখানো হোক-না কেন। আমরা যে এইপ বা নরবানর পূর্বসূরি থেকে বিবর্তিত হয়েছে এটি তাদের অত বেশি ভাবায় না, কিন্তু এই সত্যটির মুখোমুখি হলে যে আবেগীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে সেটি তাদের ভাবায়। এবং বিবর্তন সমর্থকরা যতক্ষণ সেই দুশ্চিন্তাটির প্রশমন করতে পারছেন না, বিবর্তনকে সর্বজনীন সত্য হিসেবে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলা খুবই কঠিন হবে। দার্শনিক মাইকেল রুজের একটি মন্তব্য আমরা দেখতে পাই, যেখানে তিনি বলেন যে, ‘জীবাশ্ম রেকর্ডে কী ঘাটতি আছে এটি ভেবে কেউ রাতের ঘুম নষ্ট করে না, বহু মানুষ যে বিষয়ে চিন্তা করে রাত জাগে যেমন, গর্ভপাত, মাদক, পরিবার প্রথার ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা, সমকামী বিয়ে  ইত্যাদি নানা কিছু যা তাদের তথাকথিক নৈতিক মূল্যবোধে আঘাত হানে’। ন্যানসি পিয়ারসে যেমন যুক্তি দিয়েছিলেন (এবং তার সাথে একমত বহু সৃষ্টিতত্ত্ববাদী) যে, বিবর্তনের সব কাল্পনিক ক্ষতিগুলোর উৎস দুটি দৃষ্টিভঙ্গি যা বিজ্ঞানের অংশ: ন্যাচারিলজম এবং ম্যাটেরিয়ালিজম ( প্রকৃতিবাদ এবং বস্তুবাদ)। ন্যাচারালিজম হচ্ছে সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা দাবী করছে মহাবিশ্বকে বুঝতে হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়েই বুঝতে হবে। বস্তুবাদ হচ্ছে একটি মাত্র বাস্তবতা, মহাবিশ্ব হচ্ছে ভৌত পদার্থ এবং চিন্তা, ইচ্ছা এবং আবেগসহ বাকি সবকিছই পদার্থের ওপর কাজ করা ভৌত নিয়মেরই পরিণতি। কিন্তু পিয়ারসে’র সেই ধারণা যে, বিবর্তনের এই শিক্ষাগুলোই অবশ্যম্ভাবীভাবে নীতিবিদ্যা, ইতিহাস এবং পারিবারিক জীবনে আগ্রাসন করবে, সেটি অবশ্যই অপ্রয়োজনীয়ভাবেই আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

বিবর্তন হচ্ছে জীববিজ্ঞানের একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যা জীবনের বৈচিত্র্য এবং সেই বৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করে। জীবনের উদ্দেশ্য অনুধাবন করার জন্য এটি কোনো সুবিশাল দার্শনিক পক্রিয়া নয়। বিবর্তন আমাদের বলতে পারে না কী করতে হবে বা কীভাবে আমাদের আচরণ করতে হবে। এবং বহু বিশ্বাসীর জন্য এটি সবচেয়ে বড় সমস্যা যারা আমাদের উৎপত্তির মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের কারণ এবং কীভাবে আমাদের আচরণ করতে হবে সেই ব্যাখ্যাটি খুঁজে বের করতে চান। আমাদের পূর্বসূরিরা হয়তো পুরোপুরিভাবে পশুসুলভ ছিল না, এমনকি জঙ্গলে, যেখানে বহু ধরনের জীবের বসবাস, যাদের অধিকাংশই খুব জটিল ও সমবায়ী সমাজ সৃষ্টি করে, যেভাবে মনে করা হয়, আসলেই তেমন নৈরাজ্যময় ছিল না। এখানে কয়েন মন্তব্য করেন সাম্প্রতিক বিবর্তন-মনোবিজ্ঞানে প্রস্তাবিত মানব আচরণের বিবর্তন সংক্রান্ত কোনো উপসংহারে আসতে হলে সেই গবেষণা মানুষ নয় এমন প্রাণীদের নিয়ে সম্পাদিত গবেষণার মতোই নিয়মমাফিক হতে হবে। জিন আমাদের নিয়তি নয়, জিনগত মানে কিন্তু অপরিবর্তনযোগ্যতা নয়। পরিবেশের বহু ধরনের নিয়ামক কোনো জিনটি সক্রিয়  বা নিষ্ক্রিয় হবে সেটি প্রভাবিত করতে পারে। এখন বিষয়টি স্পষ্ট যে, আমাদের জিনগত ঐতিহ্য যা-ই থাকুক না কেন, এটি আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখেনি, বা আমাদের পূর্বসূরীদের জান্তব আচরণ প্রক্রিয়ার সাথে চিরতরে আটকে রাখেনি। কয়েন অধিকাংশ বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে সন্দিহান, যদিও কিছু সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য হয়তো পূর্বসূরিদের কাছ থেকে আসা বিবর্তিত বৈশিষ্ট্য, কিন্তু কিন্তু অনেকেই মনে করেন বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রস্তাবনাগুলো বেশ কিছু সত্যতা প্রমাণের দাবী করতেই পারে, ( যাদের কোনো কোনোটি পরীক্ষা করে প্রমাণ করা সম্ভব)। কিন্তু মানব আচরণের বিবর্তনীয় ব্যাখ্যার অস্পষ্টতা এবং সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আমাদের ভিতরে বাস করা পশু সম্বন্ধে আমাদেরকে শঙ্কিত না করার যথেষ্ট আশ্বাস আছে, কারণ আমরা আমাদের জিন দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্ত নই যে, আমাদেরকে অবশ্যই অনৈতিক হতে হবে। সুতরাং এই সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে আমাদের ভয় প্রকান্তরে অমূলক।

কয়েন স্বীকার করেছেন যে, বিবর্তনের পক্ষে উপস্থাপিত সব প্রমাণ, এই বাস্তবতার মুখোমুখি হবার পর আবেগজনিত পরিণতিগুলোর শঙ্কাকে জয় করতে পারে না – আমরা নরবানর পূর্বসূরি থেকে বিবর্তিত হয়েছি এই সত্যটাকে মেনে নেয়া খুব সহজ কাজ নয়। কয়েন যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, আমাদের আসলেই ভিতরের সেই পশুকে ভয় পাবার কোনো দরকার নেই, কারণ প্রায়শ কল্পনা করা হয় জিনগতভাবে নির্ধারিত স্বার্থপরতা এবং অমরত্ব ডারউইনবাদের অন্তর্গত অংশ, কারণ পরীক্ষা-নির্ভর বহু প্রমাণই দাবী করছে আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি, কোনো প্রজাতির সাথে যার তুলনা করা সম্ভব নয়, আমাদের সহমর্মিতা, দয়া এবং আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত তুলনাহীন। কয়েন যেমন মন্তব্য করেছেন, মানব বিসর্জন দেবার প্রথা পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেই রোমান যুগের মত রক্তাক্ত যুদ্ধ দেখার মানসিকতাও এখন নেই। পৃথিবীব্যাপী খুব কম সংস্কৃতি আছে যারা এই সব কর্মকাণ্ডকে বর্বরতা বলে চিহ্নিত করে না। তবে কয়েন স্বীকার করেছেন প্রথাগত ধর্মে যে সান্ত্বনা মেলে সেটি প্রতিস্থাপিত করা অসম্ভব, কিন্তু তার প্রচেষ্টা হচ্ছে অন্তত যে ভ্রান্ত ধারণাগুলো বিবর্তন নিয়ে মানুষের ভাবনা বৈরি আর ভীত করে তোলে, সেই ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে কিছুটা দূর করা। বইটি নিঃসন্দেহে সফল যে কোনো স্তরের পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায়। কোনো পাঠক যার কিনা ডিএনএ কী সেই সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা থাকে,  সে এই বইটিকে সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। এই কারণে বইটি সবার জন্যে প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে হাইস্কুলের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জীববিবর্তন নিয়ে জানতে আগ্রহী যে-কোনো পাঠকের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। এই বইটি লেখার যেমন প্রয়োজনীয়তা ছিল ঠিক তেমনি বইটি পড়ারও প্রয়োজন আছে।

শিকাগোর ব্যবসায়ীদের একটি মধ্যাহ্ন ভোজনে কয়েনের বক্তৃতার প্রতিক্রিয়ায় এক ব্যবসায়ী বলেছিলেন কয়েনের যুক্তি এবং উপস্থাপিত প্রমাণ যতই বিশ্বাসযোগ্য হোক-না কেন তিনি বিবর্তনে বিশ্বাস করেন না। বিষয়টি কয়েনকে বিস্মিত করেছিল যদিও তিনি জানতেন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বিস্ময়করভাবে বিবর্তনের ধারণার বৈরি। তবে তিনি বলেছিলেন এই বইটি তিনি তাদের জন্য লেখেননি। তিনি লিখেছেন খোলা মনের মানুষদের জন্য, হতে পারে তারা কোনো ধর্মবিশ্বাসী, অনেকেই যারা আক্ষরিকার্থে তাদের ধর্মগ্রন্থ মেনে চলেন না। এছাড়া তার দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনে বিবর্তন নিয়ে কিছুটা সন্দীহান এমন বহু মানুষকেই তিনি দেখেছেন, যারা উপযুক্ত প্রমাণ পেলে বিষয়টি নিয়ে যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। বইটি মূলত তাদের জন্য। এছাড়াও বইটি বিজ্ঞানীদের জন্যেও, বিবর্তনের সত্যকে যারা মেনে নিয়েছেন কারণ এটি তাদের পেশাগত ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু তারা হয়তো বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র থেকে এর পক্ষে জড়ো করা প্রমাণগুলো সম্বন্ধে জানেন না।

বিবর্তন আমাদের জানায় আমরা কোথা থেকে এসেছি, কিন্তু কোথায় আমরা যাচ্ছি সেটি এর বিষয় নয়। সবচেয়ে সুন্দরতম বিষয়গুলো যা আমাদের অভিজ্ঞতার অংশ তারা আসলেই রহস্যময় – এটাই সেই মৌলিক আবেগ যা শিল্পকলা আর বিজ্ঞানের মধ্যে যোগসূত্র সৃষ্টি করে। যিনি এটি জানেন না তিনি কল্পনা করতে, আর বিস্ময় অভিভূত হতে পারেন না – তিনি মৃতপ্রায় – একটি নিভিয়ে ফেলা মোমবাতি। ‘এই রহস্যের অভিজ্ঞতা- এমনকি যদিও তা ভয় মিশ্রিত – যা ধর্মের জন্ম দিয়েছিল। কোনো কিছুর অস্তিত্বের একটি জ্ঞান যা আমরা খতিয়ে দেখতে পারি না, সেই গভীরতম যুক্তির প্রকাশ এবং সবচেয়ে দীপ্তিময় সৌন্দর্য, যা শুধুমাত্র আমাদের যুক্তির কাছেই উন্মুক্ত এর আদি মৌলিক রূপে। আর এই জ্ঞানটি এই আবেগটি সত্যিকারের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করে। এই অর্থে এবং শুধুমাত্র এই অর্থে আমি গভীরভাবে ধার্মিক একজন মানুষ’। আইনস্টাইনের এই উদ্ধৃতি আরও সম্প্রসারিত হয় – ‘আমার জন্যে যথেষ্ট অনন্ত জীবনের রহস্য, বাস্তবতার এই বিস্ময়কর গঠন, এবং সেই সাথে এরই একটি অংশ বোঝার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা যা কিনা প্রকৃতি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে, তা সেই অংশ যতই ক্ষুদ্র হোক-না কেন’। কিংবা ফাইনম্যানের সেই মন্তব্য – ‘না আমার কোনো উত্তর জানার প্রয়োজন নেই, কোনো কিছু না জানাটা আমাকে ভীত করে না। উদ্দেশ্যহীন কোনো রহস্যময পৃথিবীতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে – এবং সম্ভবত এটাই সত্যি যা কিনা আমি যতটুক বলতে পারি – আমাকে শঙ্কিত করে না। অপেক্ষাকৃতভাবে খুব কম মানুষই প্রকৃতির বিস্ময়ের মধ্যে চিরস্থায়ী সান্ত্বনা এবং বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পেতে পারে। এবং তার চেয়ে আরও কম মানুষই সেই বিস্ময়ের সাথে নিজের গবেষণার মাধ্যমে আরও কিছু যুক্ত করার সুযোগ পায়’।

বিবর্তন যেমন নৈতিক নয়, এটি আবার নৈতিকতা বর্জিত নয়। এটি যেমন তেমনই, আমরা এর অর্থ যেমন করব এটি ঠিক সেটাই। কয়েন তার বইতে সেই প্রচেষ্টাই করেছেন। একটি দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামো হিসেবে তিনি বিবর্তনকে দেখাতে চেয়েছেন, যেখান থেকে আমরা দুটি উপলব্ধি সংগ্রহ করতে পারি – এটি খুব সরল এবং এটি বিস্ময়কর সুন্দর। কিন্তু আরও বিস্ময়কর কিছুও আছে। আমরাই একমাত্র প্রাণী প্রাকৃতিক নির্বাচন যাকে একটি জটিল মস্তিস্ক প্রদান করেছে, যে মস্তিষ্ক এই মহাবিশ্বকে যে ভৌত সূত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে সেগুলো বোঝার জন্য যথেষ্ট পরিমান জটিল। আর আমাদের গর্ব করা উচিত আমরাই হচ্ছি একমাত্র প্রজাতি, আমরা কীভাবে এসেছি সেই রহস্যটি যারা সমাধান করতে পেরেছে।

তোমরা যদি বইটি অর্ডার করতে চাও দ্রুত করে ফেল। যোগাযোগ করো “হাইপারস্পেসে” অথবা আমাদের বুক স্টোরে ভিজিট করো “হাইপারস্পেস বুক স্টোর