কিভাবে ফসিলের বয়স নির্ণয় করা যায়?
আমাদের দূরবর্তী পূর্বসূরিরা কেমন দেখতে ছিলেন, সেটি আমরা কিভাবে জানতে পারি, আর কিভাবেই বা আমরা জেনেছি যে তারা কখন বেঁচে ছিলেন? মূলত জীবাশ্ম থেকে।
জীবাশ্মগুলো পাথর দিয়ে তৈরী। এগুলো হচ্ছে সেই পাথর যারা মৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের মূল আকৃতিটি ধারণ করে। বেশীর ভাগ প্রাণী মারা যায় কখনোই জীবাশ্ম হতে পারবে না এমন সম্ভাবনা নিয়েই। কৌশলটি হচ্ছে, যদি আপনি জীবাশ্ম হতে চান, তাহলে আমরা সঠিক ধরনের কাদায় বা পলিতে সমাহিত হতে হবে, যে ধরনের কাদা পরবর্তীতে একসময় শক্ত হয়ে ‘পাললিক শিলা’ তৈরী করে।
ইগনিয়াস শিলা ( ল্যাটিন ‘ইগনিস’ শব্দ থেকে, যার অর্থ আগুন) একসময় গলিত ছিল, তপ্ত লাভার মত যা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বের হয়ে এসেছিল পৃথিবীর গভীর থেকে এবং এটি ঘনীভূত হয়ে শক্ত শিলায় রূপান্তরিত হয় যখন শীতল হয়। যেকোনো ধরনের শক্ত শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, বাতাসে অথবা পানিতে, তারপর এটি সাগর, হৃদ কিংবা নদীর তলদেশে তলানী হয়ে জমা হয়। অনেক দীর্ঘ সময় ধরে এই তলানী শক্ত হয়ে স্তর ( বা স্ট্র্যাটা) তৈরী করে। যদিও সব স্তরই আনুভূমিক হয়ে শুরু হয়, কিন্তু প্রায়শই তারা কাত হয়ে যায় বা পুরোটা উল্টে কিংবা বিকৃত হয়ে যায়
যখন আমরা তাদের বহু মিলিয়ন বছর পর দেখি।
এখন, মনে করুন, একটি মৃত প্রাণী কোনোভাবে ভেসে এসে কাদায় এসে পড়ে, হয়তো কোনো একটি নদীর মোহনায়। যদি কাদা পরে শক্ত হয়ে পাললিক শিলায় রূপান্তরিত হয়, প্রাণীর শরীর হয়তো পঁচে যাবে, শুধু অবশিষ্ট থাকবে শক্ত পাথর, এর আকারের একটি ছাপ, যা আমরা পরে একসময় খুজে পাই। এটি জীবাশ্ম প্রাণীটির একধরনের এক ধরনের ‘নেগেটিভ’ চিত্র। অথবা সেই প্রাণীর ফাপা ছাপটি ছাঁচ হিসাবে কাজ করতে করে যেখানে নতুন তলানী পড়ে, পরে শক্ত হয়ে প্রাণী শরীরের একটি ‘পজিটিভ’ অনুলিপি তৈরী করে। এটি দ্বিতীয় ধরনের জীবাশ্ম। এবং তৃতীয় এক ধরনের জীবাশ্ম আছে, যেখানে প্রাণী শরীরের প্রতিটি অণ-পরমাণুকে প্রতিস্থাপিত করে পানিতে থাকা খনিজ, যা পরে স্ফটিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পাথরে রূপান্তরিত হয়। এটি সবচেয়ে সেরা ধরনের জীবাশ্ম কারণ, ভাগ্য ভালো থাকলে কোনো প্রাণীর অভ্যন্তরীণ খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর চিরস্থায়ী অনুলিপি তৈরী করে, ঠিক এর ভিতর থেকে।(বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন “এখানে”) (ভাবে ফসিলের বয়স নির্ণয় করা হয়?)
জীবাশ্মদের সময় নিরুপন করা যেতে পারে। মূলত পাথরে উপস্থিত তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপগুলো পরিমাপ করার মাধ্যমে আমরা বলতে পারি তারা কতটা প্রাচীন। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে আইসোটোপ আর পরমাণু সম্বন্ধে জানবো। তবে সংক্ষেপে, একটি তেজষ্ক্রিয় আইসোটোপ হচ্ছে এক ধরনের পরমাণু, যা ক্ষয়ীভূত হয়ে ভিন্ন ধরনের একটি পরমাণু তৈরী করে: যেমন একটি, ইউরেনিয়াম-২৩৮ রূপান্তরিত হয়ে সীসা-২০৬ তৈরী করে। যেহেতু আমরা জানি কতক্ষণ সময় লাগে এমন কিছু ঘটতে, আমরা আইসোটোপদের একধরনের তেজষ্ক্রিয় ঘড়ি হিসাবে ভাবতে। তেজষ্ক্রিয় ঘড়িগুলো সেই পানির আর মোম ঘড়ির মতই, যে ঘড়িগুলো পেন্ডুলাম ঘড়ি আবিষ্কারের আগে মানুষ ব্যবহার করতো। পানির ট্যাঙ্কের একটি ছিদ্র থাকে, যেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাপযোগ্য হারে পানি বের হয়ে যায়। যদি ট্যাঙ্কটি ভোরে পূর্ণ করা হয়, আপনি বলতে পারবেন দিনের কতটা সময় অতিক্রম হয়েছে পানির বর্তমান স্তর পরিমাপ করে। একইভাবে সময় পরিমাপ করা হয় মোম ঘড়ি দিয়ে। মোম একটি নির্দিষ্ট হারে গলতে থাকে, সুতরাং আপনি বলতে পারবেন কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে কতটুকু মোমবাতি এখনও গলেনি সেটি পরিমাপ করে।
ইউরেনিয়াম-২৩৮ ঘড়ির ক্ষেত্রেও, আমরা জানি যে অর্ধেক ইউরেনিয়াম-২৩৮ ক্ষয় হয়ে সীসা-২০৬ এ পরিণত হতে সময় লাগে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর। এটাকেই বলা হয় ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর ‘হাফ লাইফ’ বা অর্ধ-জীবন। সুতরাং, পাথরে কত পরিমান সীসা-২০৬ আছে সেটি পরিমাপ করে, অবশিষ্ট ইউরেনিয়াম-২৩৮ এর পরিমানের সাথে তুলনা করা হয়। এখান থেকে আপনি পরিমাপ করতে পারবেন কতটা সময় পার হয়েছে সেই সময় থেকে যখন কোনো সীসা-২০৬ ছিল না, শুধু ছিল ইউরেনিয়াম-২৩৮। অন্যভাবে যদি বলি, কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে ঘড়িটি যখন শূন্যে স্থির হয়েছিল।
আর কখন ঘড়িটি শূন্যে স্থির হয়েছিল? বেশ, এটি ঘটে শুধুমাত্র আগ্নেয় শিলার সাখে, যার ঘড়িগুলো সব এক মুহূর্তে শূন্যে স্থির হয় যখন গলিত শিলা ঘনীভূত হয়ে শক্ত হয়, পাললিক শিলার ক্ষেত্রে এটি ঘটে না, সেখানে কোনো সেই শূন্যে স্থির হবার মুহূর্ত নেই, খুব দূঃখজনক, কারণ জীবাশ্মদের পাওয়া যায় শুধুমাত্র পাললিক শিলার স্তরে। সুতরাং আমাদের পাললিক শিলা স্তরের নিকটবর্তী আগ্নেয় শিলা খুজে বের করতে হয়, এবং সেটাকেই ঘড়ি হিসাবে আমাদের ব্যবহার করতে হয়। যেমন, যদি একটি জীবাশ্ম এমন পাললিক শিলা স্তরে থাকে যার উপরে ১২০ মিলিয়ন পুরোনো আগ্নেয় শিলা এবং নীচে ১৩০ মিলিয়ন বছর প্রাচীন আগ্নেয় শিলা থাকে। আপনি বলতে পারবেন যে এই জীবাশ্মটির বয়স ১২০ মিলিয়ন থেকে ১৩০ মিলিয়ন বছরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ের। এই অধ্যায়ে উল্লেখিত সব সময়গুলো পরিমাপ করা হয়েছে এভাবে। এই সবগুলো মূলত একটি নিকটবর্তী একটা সময়, একেবারে খুব সুনির্দিষ্টভাবে তাদের গ্রহন করা যাবেনা।ইউরেনিয়াম-২৩৮ একমাত্র তেজস্ত্রিয় আইসোটোপ নয়, যা আমরা ঘড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। চমৎকারভাবে বিস্তৃত অর্ধ-জীবনসহ আরো অনেক এমন ঘড়ি।
আছে। যেমন, কার্বন-১৪ র অর্ধ-জীবন ৫৭৩০ বছর, মানব ইতিহাস সংক্রান্ত সময় পরিমাপ করার জন্য যা প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য উপযোগী। একটি সুন্দর বাস্তব তথ্য হচ্ছে বহু ভিন্ন ধরনের তেজষ্ক্রিয় ঘড়িগুলোর পরস্পরের সাথে সম্পূরক সময় মাপার স্কেলও আছে, সুতরাং পারস্পরিক ফলাফল যাচাই করে দেখার জন্যেও আমরা তাদের ব্যবহার করতে পারি এবং এই প্রক্রিয়াগুলোয় সবসময়ই আমরা একই ফলাফল পেয়েছি।( কিভাবে ফসিলের বয়স নির্ণয় করা হয়?)
অন্য ঘড়িগুলো থেকে খানিকটা ভিন্ন উপায়ে কার্বন-১৪ ঘড়ি কাজ করে। এখানে আমাদের আগ্নেয় শিলার দরকার পড়ে না, বরং জীবিত শরীরের অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করা হয়, যেমন, পুরানো কাঠ। এটি আমাদের সবচেয়ে দ্রুততম তেজষ্ক্রিয় ঘড়ি, কিন্তু ৫৭৩০ বছর তারপরও অনেক দীর্ঘ সময় কোনো মানুষের জীবনকালের চেয়ে, সুতরাং আপনি হয়তো জানতে চাইবেন, কিভাবে আমরা জানি কার্বন-১৪ এর অর্ধ-জীবন এটাই বা কিভাবেই বা জানি ইরেনিয়াম-২৩৮ এর অর্ধ-জীবন ৪.৫ বিলিয়ন বছর! এর উত্তরটা সহজ। অর্ধেক পরিমান পরমাণুর ক্ষয় হবার জন্য সেই সময় অবধি আমাদের অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমরা খুব সামান্য পরিমান পরমাণুর ক্ষয়ের হার পরিমাপ করতে পারি এবং সেখান থেকে অর্ধ জীবন আমরা গণনা করে বের করতে পারি ( এক চতুর্থাংশ জীবন, শতভাগের এক অংশ জীবন ইত্যাদি)।(এ সম্পর্কিত পোস্ট পড়ুন একাকীত্বের বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা)
(কিভাবে ফসিলের বয়স নির্ণয় করা হয়)
তথ্যসুত্রঃ
১. ম্যাজিক অব দ্যা রিয়েলিটি, রিচার্ড ডকিন্স, Amazon