আমরা আজ অনুসন্ধান করব পৃথিবীর প্রথম আস্তিক কে ছিলেন। তার সাপেক্ষে আমরা যে ফসিলটি উপস্থাপন করব সেটি আনুমানিক ৯০ হাজার বছর আগের। এই পেলিওলিথিক আস্তিক ৯০,০০০ থেকে ১০০,০০০ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আদি এ আস্তিকের ফসিল পাওয়া গিয়েছিল ইসরায়েলের নাহারেথের নিকটবর্তী কাফজেহ গুহায়।
আদিম আস্তিক পিঠের উপর ভর করে শুয়েছিল, তার বাহুগুলো ছিল উপরের দিকে বাঁকানো। তার বুকের উপর রাখা ছিল হরিণের শিং। এখান থেকে প্রমাণিত হয় সে পরকালে বিশ্বাসী ছিল অথবা পুনর্জন্মে! এ নিদর্শন আমাদের কাছে এটাই প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর বেশিরভাগ ধার্মিক ৯০,০০০ বছর পূর্বের একদল আদিম আস্তিক থেকেই তাদের ধর্ম বিশ্বাস পেয়েছিল। জেনেটিক অ্যাভিডেন্স আমাদের বলছে, তারা সংখ্যায় ২০,০০০ থেকে বেশি ছিল না!
পরকাল অথবা ঈশ্বরের ধারণা কোনো মহামানব থেকে আসেনি। এ সকল ধারণা এসেছিল আমাদের আদিম পূর্বসূরি আস্তিক থেকে! এক লাখ বছর আগে পৃথিবীতে কট্টর কোনো আস্তিকের অস্তিত্ব ছিল না! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধারণা এসেছিল আজ থেকে আনুমানিক ২.৬ মিলিয়ন বছর আগে। তার সাপেক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো হোমো হ্যাবিলিসদের পাথরের টুলস! যেটি “Oldowan Stone Tools“ নামে পরিচিত ছিল। তারা টুলসের ব্যবহার জানত! যার অর্থ হলো তারা যৌক্তিক চিন্তা করতে সক্ষম ছিল, তাদের মধ্যে উদ্ভাবনী মানসিকতা ছিল কিন্তু হোমো হ্যাবিলিসদের মধ্যে যে কোনো ধর্ম অথবা ঈশ্বর কনসেপ্ট ছিল না এ ব্যাপারে আমরা একদমই নিশ্চিত! শিম্পাঞ্জিরাও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিন্তু তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না! কাকও কার্য-কারণ সম্পর্ক বুঝে কিন্তু তাদের গড কনসেপ্ট নেই। সে হিসেবে আমরা হোমো হ্যাবিলিসদের আদি নাস্তিক বলতে পারি।

সামগ্রিক ডেটা বিশ্লেষণ করে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, উদ্ভাবনী মনস্তত্ব ও প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে না। যেমন মাইক্রোস্কোপিক অ্যাস ট্রেসিং করে দেখা গিয়েছে, হোমো ইরেক্টাসরা ৭,৯০,০০০ বছর পূর্বে আগুন জ্বালাতে পেরেছিল। আগুনের প্রকৃতি উদ্ভাবনের জন্য তাদের বিজ্ঞানমনস্কতা প্রয়োজন ছিল, ধর্মের প্রয়োজন ছিল না। অতএব যখনই এই প্রশ্ন এসে উপস্থিত হয়, কোনটি প্রথম এসেছিল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নাকি ধর্ম বিশ্বাস ? তার উত্তর হোমো হ্যাবিলিস ও হোমো ইরেক্টাসদের এই সকল উদ্ভাবন। প্রযুক্তি আমাদের সবচেয়ে আদিম প্রবণতা। আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ! আমরা মানব বিবর্তনের একদম শুরুতেই নাস্তিক ও বিজ্ঞানমনস্ক হিসেবে বিবর্তিত হয়েছিলাম!

পরবর্তী সমাধি ১০ হাজার বছর পূর্বের একজন হান্টারের। তাদের সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা ছিল, তারা স্প্রিচুয়ালিটিতে বিশ্বাস করত, তারা জুয়েলারি ব্যবহার করত, গান গাইত, নৃত্ত করত এবং গল্প বলতে পারত। তাদের পরিবেশ জটিল মিথোলজির প্রতিফলন ঘটায়। কিছুকিছু স্থানের কবরস্থান দেখলে তাদের স্প্রিচুয়াল বিলিফ প্রতিফলিত হয়। আটলান্টিক ইউরোপে, লাশ দাফন করার সময় তাদের সাথে বিভিন্ন সরঞ্জাম দেয়া হতো পরবর্তী জীবনে ব্যবহার করার জন্য যেমন: হাড়, শিং, পাথরের গয়না , ঝিনুকের খোলস অথবা কারুকাজ করা পোশাক। Read More: ৪০ লাখ বছর পূর্বের বিশ্বাস?

তৃতীয় সমাধিটি ৪,৫০০ থেকে ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের “VARNA COPPER AGE BURIAL”। এ সময়কার প্রায় ৩০০ টি সমাধি পাওয়া গিয়েছিল। এক একটি সমাধিতে এক এক প্রকার রিসোর্স দেখা যায়। তৃতীয় ছবিতে আপনি যে মানুষটিকে দেখছেন তার সাথে ৯৯০ টি গোল্ড অবজেক্ট রাখা হয়েছিল, এছাড়া আমরা তার পোশাকের মধ্যেও পুঁথির মালার অস্তিত্ব দেখতে পাই।

এসবকিছু আমাদের সাক্ষ্য দেয় যে, তারা মৃত্যুতে বিশ্বাস করত না, তারা মহাজাগতিক কনসাসনেসে বিশ্বাসী ছিল! তারা বিশ্বাস করত যে মৃত্যু অন্য জগতে প্রবেশের একটি টানেল মাত্র! মজার ব্যাপার হলো নিয়ান্ডারথালদের মধ্যেও পরকালে বিশ্বাস ছিল, তারা মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কবরে পুষ্প অর্পন করেছিল।
আমরা জানি না, পরকালে বিশ্বাস সর্বপ্রথম নিয়ান্ডারথাল অথবা স্যাপিয়েন্সের ভেতর জন্ম লাভ করেছিল। রেডিও কার্বন ডেটিং করে জানা যায়, আনুমানিক ৪০ হাজার বছর পূর্বে তাদের পরস্পর দেখা হয়েছিল,তারা সেক্স করেছিল এবং সম্ভবত তারা একে অন্যের সাথে নিজের পেলিওলিথিক সংস্কৃতি শেয়ার করেছিল( নিয়ান্ডারথালদের সাথে আফ্রিকার বাহিরের মানুষরা ১-৪ শতাংশ জিন শেয়ার করেছে) এমনও হতে পারে, আমাদের আজকের ঈশ্বর ও ধর্ম বিশ্বাস নিয়ান্ডারথাল দ্বারা প্রভাবিত? আপনি শুনলে হয়তো অবাক হবেন নিয়ান্ডারথালরাই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম পিকাসো। যার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম স্পেইনের গুহায় তাদের অংকিত ছবি দেখে।
১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদরা দক্ষিন পূর্ব তুরস্কে গোবেকলি তেপে নামক একটি জায়গার খনন কাজ শুরু করেছিলেন। তারা সেখানে দেখেছিলেন কারুকার্যখচিত বিশাল স্তম্ভ এবং ভাস্কর্য। প্রতিটি স্তম্ভের ওজন ছিল প্রায় ৭ টন এবং উচ্চতা ৫ মিটার। পাশাপাশি একটি কুয়োর ভেতর তারা ৫০ টন ওজনের ভাস্কর্য পেয়েছিলেন যার খোদাই কাজ অসম্পূর্ণ। এটি নির্মিত হয়েছিল নিউলিথিক সময়ে , প্রায় সাড়ে ৯ হাজার খ্রিষ্ঠপূর্বাব্দের। ভাস্কর্যগুলো তৈরি করেছিলেন শিকারী সংগ্রাহক গোষ্ঠী।

আমাদের এই গ্রহে পাওয়া সবচেয়ে আদিম মন্দির। ধারণা করা হয় এটি তৈরি করার জন্য হাজার হাজার মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়েছিল। মৌমাছি যেমন একে অন্যের সাথে সম্মিলিত হয়ে মৌচাক তৈরি করে ঠিক তেমনি আমাদের আদিম পূর্বসূরিরা ইউনাইটেড ন্যাশন হয়ে তৈরি করেছিল এই অত্যাশ্চর্য মন্দির। এই মন্দির ছিল তাদের মস্তিষ্কের ক্রেনিয়ামের প্রতিক। আমরা এ মন্দির বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারি তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স ছিল খুবই উন্নত,তাদের ডোপামিন কন্ট্রোল সার্কিটও উন্নত ছিল, তাদের মস্তিষ্ক অস্তিত্বহীন বাস্তবতকে কল্পনা করতে পেরেছিল। FOX2 জিনের মিউটেশনের কারণে তারা তাদের কল্পনাকে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছিল, তাদের মধ্যে এক ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে সর্বজনীন বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। তারা দলবদ্ধভাবে উপাসনা করেছিল। তারা একে অন্যের ইনটেনশন ও মোটিভ পড়তে পেরেছিল। জিনতত্ত্ববিদরা গবেষণা করে দেখেছিলেন, চাষযোগ্য গমের মধ্যে অন্তত একটি প্রজাতির উৎপত্তি ঘটেছিল দক্ষিণ তুরস্কের একটি পাহাড়ি এলাকায়। যে স্থানটি গোবেকলি তেপে থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে ছিল। যাযাবর শিকারী সংগ্রাহক জনগোষ্ঠী তাদের শিকারী জীবন ছেড়ে দিয়ে ঠিক কেন কৃষিকাজ করতে শুরু করেছিল তা আমাদের কাছে রহস্যজনক! তবে ইউভাল হারারি বলেন, সম্ভবত এ মন্দিরকে প্রিজার্ভ করার জন্যই স্যাপিয়েন্সরা তার পাশ্ববর্তী এলাকায় কৃষিকাজ শুরু করেছিল। ধর্মই স্যাপিয়েন্সকে যাযাবর থেকে কৃষকে পরিণত করেছিল।
যাইহোক। ধর্ম ও ঈশ্বর ধারণার উদ্ভব প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। হোমো হ্যাবিলিস ও হোমো ইরেক্টাস ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাসী ছিল না ঠিকই কিন্তু তাদের মস্তিষ্কে গড বিলিফের হার্ডওয়্যার ছিল। তারা জটিল মিথোলজির প্রতিনিধিত্ব করেনি ঠিকই কিন্তু তাদের মধ্যেই সর্বপ্রথম এজেন্ট দেখার প্রবণতা বিবর্তিত হয়েছিল। এটা ঠিক যে তারা ন্যাচারাল এথিস্ট কিন্তু তারা কুসংস্কার ও অজানার প্রতি অযৌক্তিক আতঙ্ক থেকে মুক্ত ছিল না। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে আমার ” স্যাপিয়েন্স আফ্রিকা ছাড়েনি” নামক নতুন একটি গ্রন্থে।

তথ্যসূত্র:
- Neanderthal Burials Confirmed as Ancient Ritual, National Geographic
- World’s Oldest Cave Art Found—And Neanderthals Made It, National Geographic
- Neanderthals had funerals with flowers, study suggests
- The Symbolic World of Göbekli Tepe and the First Cities: An Eliadean Approach, The Symbolic World
- The Paleolithic Burials at Qafzeh Cave, Israel,Open Edition Journal
- The Human Story, Alice Robert
এক লাখ বছর আদি আস্তিক এক লাখ বছর আদি আস্তিক এক লাখ বছর আদি আস্তিক