ক্রোমোজম কমরেডদের ভালোবাসা আমি পাইনি। আমার ক্রোমোজম কমরেডরা আমাকে সবসময় হিরো হিসেবে দেখতে চেয়েছে। তারা আমাকে সুপারম্যান হিসেবে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তাদের সুপারম্যান হতে পারিনি। তারা চেয়েছিল আমার মাঝে হলিউড ও বলিউড মেগাস্ট্যারদের ইমেজ দেখতে। তারা সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিউটি ইন্ডাস্ট্রির কনসেপ্ট দেখতে চেয়েছে আমার সমস্ত দেহ ও মনে। তারা চেয়েছে আমি শাহরুখ, সালমান অথবা রনবীর কাপুর হই। কিন্তু আমি হয়েছিলাম ৮০ কেজি ওজনের একটি ভারী পদার্থ।
একজন অতি-সাধারণ মানুষ। আমি হয়েছিলাম একটি বায়োলজিক্যাল দেহ, যার দেহে ১০০ ট্রিলিয়ন সেল আর বায়োকেমিক্যাল ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি পরিবার ও সমাজের সুপারস্ট্যার হতে পারিনি বলে, আমাকে সবকিছু ছেড়ে একা হতে হয়েছে। আমার ফ্যামিলি আমাকে হ্যারাস, বুলিং ও ট্রল করেছে এবং আমার আদরের ছোটবোনটিও আমাকে কোনোদিন আমার প্রাপ্ত সম্মান দেয়নি, বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, আমার চিন্তারজগত অর্থহীন। যে সুপারস্ট্যার হতে পারে না, তার ফ্যামিলির সাথে থাকার অধিকার নেই, সে অ্যান্টিসোশ্যাল।
মিডিয়া আর বিউটি ইন্ডাস্ট্রির কারণে আজ আমি রাস্তার ছেলে। কিন্তু আমি সত্যিকার একজন সুপারস্ট্যার দেখেছি। আর সে হলো জেসমিন আলমের ক্রোমোজম কমরেড মাহবুব সাঈদ মামুন। সে যখন তার বোনের সাথে কথা বলে তখন সে সুপারস্ট্যার হয়ে ওঠে, সে পিটার দ্য পেন হয়ে ওঠে, তার দেহে দুটি পাখা গজায়, সে অনন্ত মহাশূন্যে উড়তে থাকে। এমন বন্ধন পৃথিবীতে খুবই অনন্য ও অতুলনীয়। আমি দেখেছি এ মানুষটির কাছে তার বোন এক অতিমানবী, সুপারওম্যান এবং স্বয়ং ইউনিভার্স। নিজের বোনের প্রতি, এত মায়া, এত মমতা, এত অন্তহীন ভালোবাসা খুব কম মানুষেরই দেখা যায়।
আসলে, আমরা খুবই একা। পৃথিবীর ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে আমাদের বিশেষভাবে দেখার কেউ নেই। মহাকাশের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে কিন্তু সকল গ্যালাক্সি হাবল টেলিস্কোপের চোখে পড়ে না। মহাবিশ্বে অজস্র ব্ল্যাকহোল ও গ্যালাক্টিক ক্ল্যাস্টার আছে কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তাদের সবাইকে খুঁজে পায় না। যে ব্ল্যাকহোল বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণে ধরা দেয়, সেই ব্ল্যাকহোলই সেলিব্রেটি হয়। M87 থেকেও মহাবিশ্বে বিশাল বিশাল ব্ল্যাকহোল আছে। কিন্তু তারা মানুষের চোখে পড়েনি। এত বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের ভীড়ে আমাদের কেউ দেখার নেই। আমরা হলিউড অথবা বলিউডের মেগাস্ট্যার নই যে পৃথিবীর বড় বড় নিউজ পেপার অথবা ম্যাগাজিনে আমাদের ছবি পাবলিসড হবে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। শত শত ক্যামেরা আমাদের দিকে চোখ মেলে থাকবে।
আমাদের বিশেষভাবে দেখার জন্য পৃথিবীতে কোনো ক্যামেরা নেই। আমাদের দিকে কেবল একটা ক্যামেরাই সবসময় চোখ মেলে থাকে আর সেই ক্যামেরা হলো একজন মায়ের চোখ, একজন বোনের চোখ অথবা একজন প্রেমিকার চোখ। আমাদের দিকে আমাদের ক্রোমোজম কমরেডরা হাবল টেলিস্কোপের মতো তাকিয়ে থাকে, আমরা বাস করি তাদের পর্যবেক্ষণে, তাদের জিন, হর্মোন আর নিউরনে, তাদের চেতনা, চিন্তা ও কল্পনায়।
প্রতিটি ভাই তার বোনের কাছে এক একজন সেলিব্রেটি। প্রতিটি বোন একজন ভাইয়ের কাছে এক একজন সেলিব্রেটি। প্রতিটি বোন তার ভাইয়ের হাবল টেলিস্কোপ, প্রতিটি ভাই প্রতিটি বোনের হাবল টেলিস্কোপ। আর কবি মাহবুব সাঈদ মামুনের বোন জেসমিন আলম হলো এমনই এক নারী, এমনই এক কমরেড, যে তার ভাইয়ের জীবনে একটি হাবল টেলিস্কোপের ভূমিকা পালন করে। বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মধ্যে তাকে বিশেষ করে তোলে, তাকে সেলিব্রেটি করে তোলে, তাকে সুপারস্ট্যার ও মেগাস্ট্যার করে তোলে।
কবি মাহবুব সাঈদ মামুন বলেন, জেসমিন আলম-কে আমি জীবনে কোনদিন দেখি নি মিথ্যা কথা বলতে,এমন কি সাদা মিথ্যা কথাও সে বলতে পারে না। জীবনে কারো সাথে সে ঝগড়া করেছে এমন নজির-ও তাঁর জীবনে নেই। জীবনে এমন সৎ মানুষ আমি আমার জীবনে আর পাই নি বা দেখি নি। সে এতো বেশি সহিষ্ণু,আত্মত্যাগী,পরোপকারী এবং মানবিক মানুষ যে সারাজীবন শুধু নিজে নিজের বাবা-মা,ভাইবোন, নিজের ছেলেমেয়েদের এবং আত্বীয়-স্বজনদের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। তাঁর শশুর-শাশড়ী থেকে তাদের আত্বীয়-স্বজন নিজের পাড়া-পড়শি সবাই তাঁকে এমন শ্রদ্ধা ও সম্মান করে যে যেটা সত্যিই দেখার মতো এবং তারা সেটা করে একেবারেই মনের আন্তরিকতা থেকে।
আমি যখন মাহবুব সাঈদ মামুনকে তার বোনের পারসোনালিটি সম্পর্কে প্রশ্ন করি, তিনি বলেন, সে এতো বেশি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যে কেউ তাঁকে দেখে তা অনুভব করে। আর তার মানবিকগুনাবলীগুলো চোখে পড়ার মতো। সবচেয়ে তাঁর আরো একটা বড় গুণ হলো সে জীবনে কারো পিছনে কূটকথা বলে না।এবং নিজের জীবনে খুব সু-শৃংখল মানুষ। তাঁর সবচেয়ে আর একটি বড় গুণ হলো যে কেউ তাঁর কাছে কোন কথা বললে সে কথা জীবনেও অন্যের কাছে প্রকাশ করে না। নিজের মাঝেই রেখে দেয়। সে সেদিক থেকে একজন দক্ষ কূটনৈতিক বা বিশ্বাসযোগ্য মানুষ।
জেসমিন আলম আসলে সাধারণ কোনো মানুষ নন। তিনি তার চিন্তা ও চেতনায় একজন অসাধারণ ও অনবদ্য মানুষ। তিনি বিজ্ঞানের দর্শন ধারণ করেন। রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সম্বন্ধে তিনি খুব সচেতন। মানুষ প্রেমিকাকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখে কিন্তু কবি মাহবুব সাঈদ মামুন তার বোনের এত বড় ফ্যান ও ফলোয়ার যে রীতিমত তিনি তাকে নিয়ে এক অসাধারণ ও অনবদ্য কবিতাও লিখে ফেলেছিলেন-
আমাদের বুবু, আমাদের বাতিঘর
জীবনের বাতিঘর আমাদের বুবু
যার বাতিতে আমরা উজ্জ্বল হই।
জীবনের বটগাছ আমাদের বুবু
যার ছাঁয়ার বিশ্রাম নিই আমরা
চৈত্র মাসের খরার যেন শীতলপাটি
সুখনিদ্রা যাই সে পাটিতে আমরা ছোটরা
সুখনিদ্রায় আমরা সতেজ, সুখি হই
নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখি
নতুন জীবনের অবগাহন করি।
সকল সুখ-দুখের সাথী আমাদের বুবু
জীবনের সবকিছু ভাগাভাগি হয় বুবুর সাথে আমাদের ।
বুবু হলো গোলাপ-বকুল-রজনীগন্ধা ফুল
যার সুবাতাসে আমাদের জীবন সুবাসিত হয়,
যার সুবাসিত ফুলের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে যায়
আশেপাশে, চারিদিকে।
শেষত বুবু হলো এক শাশ্বত মা-জাতি
তার সন্তানদের সে যেমন আগলে রাখে বুকে
আমাদেরকেও তেমনি মায়ের মতো
আগলে রাখে দুখের দিনে…
জয়তু আমাদের বুবু
আমাদের জন্যই তোর বেঁচে থাকা জীবনে
আবার আমরাও যেন বাঁচি তোরই জন্য।
১৫.০২.২০১৯
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে এমনও ভাই আছে যারা এক কোটি বছর অপেক্ষা করলেও নিজের বোনকে নিয়ে এমন একটি কবিতা লিখতে পারে না। কারণ পৃথিবীর হাজার হাজার ভাই নিজের বোনকে তার জীবনের দেবী, মা ও প্রেমিকা হিসেবে স্বীকার করে না। মাহবুব সাঈদ মামুন তার বোনকে মহাবিশ্বের জন্মের ২৬ বিলিয়ন বছর পর পেয়েছে, মহাবিশ্বের অনু-পরমাণু তাদের জেনেটিক কোড খোদাই করেছে, গড়ে তুলেছে এক অনুপম জৈবিক ও মানসিক সম্পর্ক। এ দুজন ভাইবোন যেন একই কক্ষপথের দুটি ইলেক্ট্রন, যারা একই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তারা দুজন যেন একই ওয়েভ ফাংশনের দুটি পার্টিক্যাল, যারা বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকেও একে অন্যের সংবাদ পায়।
তার এই বোনের মাঝে সে অনন্ত মহাবিশ্বের একতা দেখতে পায়। তাই তো যখন তাকে তার বোনের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়, তিনি গভীর শিশুসূলভ নীরবতায় নিশ্চুপ হয়ে থাকেন। কবির মনে একটি সমুদ্র নেমে আসে। সেই সমুদ্রে নৌকা ভাসায় দুই ভাই-বোন অনন্ত মহাবিশ্ব, মাল্টিভার্সের অসীমে।