ম্যাটার বা পদার্থ বলতে আমরা বুঝি এমন জিনিস যার ভর আছে এবং জায়গা দখল করে। সাধারণত পদার্থের ভর পজিটিভ হয়ে থাকে কারণ আমরা জানি পদার্থের ভর কখনো নেগেটিভ হতে পারে না। কিন্তু আপনাকে যদি এখন বলি যে ভরও নেগেটিভ হয়। হয়তো এটা শুনে আপনি হাসতে থাকবেন। কিন্তু এটা সঠিক ভরও নেগেটিভ হতে পারে তবে সেটা আমাদের পরিচিত ম্যাটারের মত না। একেবারে ভিন্ন জগতের বস্তু যাকে বলা হয় ”নেগেটিভ ম্যাটার”। তো চলুন একটা চক্কর মেরে আসি নেগেটিভ ম্যাটার এর দুনিয়ায়।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স আবিষ্কারের পরে সবাই পারমাণবিক লেভেলের কণিকা এবং এদের ওয়েব-ফাংশন নিয়ে পড়েছিলেন। কেউ ভাবেওনি তখন যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমাধানের জন্য আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের প্রয়োজন পরবে। কিন্তু ১৯২৮ সালে পল ডিরাক সেটা চিন্তা করেছেন বিশেষ করে ভরবৃদ্ধির সমীকরণ। ইলেকট্রন তার নিজের কক্ষপথে যতই তরঙ্গ ধর্ম নিয়ে ঘুরুক না কেন। তার তো একটা বেগ আছে তাই ভরবেগ ও আছে এবং ভরবেগ থাকলে থাকবে গতিশক্তি। আর যখন কোন একটা বস্তু আলোর বেগের কাছাকাছি ছুটে তখন তো আপেক্ষিকতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।

আমরা জানি যে কোন বস্তু আলোর কাছাকাছি বেগে ঘুরলে তার ভরবেগ বৃদ্ধি পায়। এবং তখন বস্তুটার গতিশক্তি এবং ভরশক্তির সমীকরণে পরিবর্তন আসে। এখন যেহেতু ইলেকট্রনের ভরবেগ আছে সুতরাং এটি আইনস্টইনের ভরশক্তির সমীকরণ মানতে বাধ্য। এইখানে পল ডিরাক তার খেলা দেখালেন। গতিশীল বস্তুর জন্য ভরশক্তির সমীকরণ আছে। সেটাই ডিরাক মহাশয় প্রয়োগ করলেন পরমাণুর ইলেকট্রনের উপর এবং যা দেখলেন। তা কিছু এমন”
- E^2=p^2c^2+m০^2c^4………1
- E=√(p^2c^2+m০^2c^4)……..2
এখন বস্তু যদি স্থির হয় তাহলে ভরবেগ p=0. তাই ২ নং সমীকরণ হতে পাওয়ার কথা।
- E=+-√(m০^2c^4
- E=+-m০c^2
মানে, E=mc^2 আথবা E=-mc^2.
বা -E=-mc^2 কিন্তু বস্তুর শক্তি ঋনাত্মক হতে পারে না ঠিক এমনটি তখন ভাবা হতো। কোয়ান্টাম দুনিয়ায় সব অদ্ভুদ নিয়ম চলে তাহলে ঋণাত্নক শক্তি থাকলে সমস্যা কোথায়। তাই পল ডিরাক এই ঋণাত্নক শক্তির সমীকরণকে বাদ দিলেন না। এবং এটি থেকে গেলো বিজ্ঞানে।
সুতরাং ডিরাক এর মতে পৃথিবীতে যেমন ধনাত্মক শক্তি আছে তেমনি ঋণাত্নক শক্তিবাহী ইলেকট্রন ও রয়েছে।
কিন্তু সেই নেগেটিভ শক্তির ইলেকট্রন কোথায় থাকে?
পল ডিরাক সেই পথটাও দেখিয়ে দিলেন। শোনালেন নতুন এক দুনিয়ার কথা। বললেন ইলেকট্রন পরমাণুর ভেতরে যে শক্তিস্তর গুলোতে থাকে। তার জন্য দুধরনের শক্তিস্তর বাঁধা থাকে। একটা পজিটিভ অন্যটা নেগেটিভ শক্তিস্তর। সাধারণ ইলেকট্রন থাকে ধনাত্মক শক্তিস্তরে আর নেগেটিভ শক্তিবাহী ইলেকট্রন থাকে ঋণাত্নক শক্তিস্তরে।
বিষয়টা আরো ক্লিয়ার হওয়ার জন্য একটা সংখ্যা রেখা কল্পনা করুন। যেমন আমরা একটা সংখ্যা রেখা আকার সময় মাঝখানে শূন্য দেই আর ডান পাশে সব পজিটিভ সংখ্যা দেই আর বাম পাশে নেগেটিভ সংখ্যা। তেমনি হয়তো পরমাণুর অতি-গভীরে গেলে আমরা তার এই শূন্য দাগটা পাবো যার অপর পাশে নেগেটিভ কণিকারা থাকে৷
পল ডিরাক আরো বলেন আমরা যেটাকে শূন্যস্থান বলি সেটা আসলে শূন্য না। সেটা মূলত শক্তির অসীম এক গর্ত সে অসীম গর্তের অনেকগুলো স্তর আছে। এবং একটা মিডল পয়েন্ট আছে।
একটি পরমাণুর অনেকটা শক্তিস্তর থাকে সে শক্তিস্তরে ইলেকট্রন থাকে। এখন ইলেকট্রন শক্তি শোষণ করে নিচের কক্ষপথ থেকে উপরে উঠে আসে আবার শক্তি বিকিরণ করে নিচে নামে। কিন্তু ইলেকট্রন শেষ কক্ষপথে গিয়ে আর নিচে যেতে পারে না। কারন একদম নিচে থাকে সেই শূন্য স্থান বা মিডল পয়েন্ট। যার নিচে থাকে ঋণাত্নক শক্তি স্তর সে শক্তিস্তরে চাইলে ধনাত্মক শক্তিস্তরের ইলেকট্রন যেতে পারে না।
কিন্তু কেন পারে না?
এটার ব্যাখ্যা পল ডিরাক বললেন। সেই অদ্ভুত কণিকাদের কথা যারা। নেগেটিভ শক্তি নিয়ে থাকে। ডিরাক বলেন ঋণাত্নক শক্তিস্তরেগুলোতে ঋণাত্নক কণা দ্বারা পূর্ণ থাকে । তাই ধনাত্মক শক্তিস্তরের ইলেকট্রন সেখানে যাওয়ার কোন সুযোগ থাকে না। ( এই ঋণাত্নক কণাকে Exotic matter ও বলা হয়)
আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি অনুযায়ী বস্তুর ভরের কারণে স্পেস-টাইমে বক্রতার সৃষ্টি হয়। এখন এখন সাধারণ যে বস্তু কারণে আমরা স্পেসএবং টাইম এর কার্ভেচার দেখি সেই সকল বস্তুর ভর পজেটিভ হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা এতক্ষণ যে নেগেটিভ ম্যাটার এর কথা বলছিলাম সেটার ভর তো নেগেটিভ হয়ে থাকে তাহলে সেটা স্প্যাচ টাইমকে নেগেটিভলি কার্ভ করবে। এবং হয়তো এই দুই দিকের কার্ভেরচার এর কারনে সৃষ্টি হবে একটা হোল বা গর্ত যা আমরা ওয়ার্মহোল হিসেবে জানি।

এতক্ষণ কথা বলছিলাম নেগেটিভ ম্যাটার এবং নেগেটিভ এনার্জি নিয়ে। চলুন এখন একটু এন্টিমেটার সম্পর্কে জেনে আসি!”
আমরা জানি, আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগৎ যা কিছু নিয়ে তৈরি, তার সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে ইলেক্ট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে। ইলেক্ট্রনের প্রতি পদার্থ যেমন পজিট্রন, ঠিক তেমনি প্রোটন এবং নিউট্রনেরও প্রতি পদার্থ রয়েছে, যাদের নাম যথাক্রমে এন্টি-প্রোটন এবং এন্টি-নিউট্রন। ইলেক্ট্রন আর পজিট্রন পরস্পরের সংস্পর্শে আসা মাত্রই একে অপরকে ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের সমস্ত ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আর এই শক্তির পরিমাণ হচ্ছে E=mc^2। বিগ-ব্যাং থিয়োরিকে প্রমাণ করতে প্রতিপদার্থের ভূমিকা ব্যাপক। লেখকের আরো লেখাঃ ফান্ডামেন্টাল ফোর্স
ও পল ডিরাক তাঁর একটিগবেষণাপত্রে এন্টিম্যাটারের আধুনিক তত্ত্ব ব্যখ্যা করেন। তিনি ইলেক্ট্রনের জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করতে গিয়ে সেখানে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি ব্যবহার করে ১৯৩১ সালে সর্বপ্রথম ইলেক্ট্রনের প্রতি-পদার্থের অস্তিত্বের কথা ধারণা করেছিলেন। তিনি ইলেক্ট্রনের এ প্রতি-পদার্থের নাম দেন “পজিট্রন”। এর ধারাবাহিকতায় শ্রডিঞ্জারের তরঙ্গতত্ত্বের আলোকে ইলেক্ট্রনের বিপরীত পদার্থ পজিট্রন তৈরির সম্ভাবনা দেখা যায় এবং ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী কার্ল ডি এন্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করেন। পরবর্তিতে আরো কিছু পারমাণবিক মূল কণিকা যেমন, এন্টিপ্রোটন, এন্টিনিউট্রন এবং এদের সমন্বয়ে এন্টি নিউক্লিয়াস তৈরি করা হয়। এন্টিনিউক্লিয়াস এবং পজিট্রনের সমন্বয়ে পরমাণুর বিপরীত কণিকা এন্টি এটম বা প্রতিপরমাণু তৈরি করা হয় ১৯৯৫ সালে। প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে গবেষণাগারে তুলনামূলক বড় আঙ্গিকে(সেই বড় আঙ্গিকের পরিমানও বেশ সামান্য) এন্টিম্যাটার তৈরি করা হয়। এন্টিম্যাটার তৈরির পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটাকে টিকিয়ে রাখা। কারণ একে যে পাত্রে রাখা হবে সেটা কোন না কোন পদার্থ দ্বারা তৈরি করতে হবে। ফলে সেই পদার্থ প্রতিপদার্থের সাথে মিলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। তবে বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধান করেন। তাঁরা বিশেষ স্থিতিশীল চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে তার ভিতরে এন্টিম্যাটার সংরক্ষণ করেন। চৌম্বকক্ষেত্র কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় না। এটা শুধুমাত্র একটি বলক্ষেত্র যেখানে প্রতিপদার্থ আকৃষ্ট হয়ে আটকে যায় এবং কোন পদার্থের সংস্পর্শে না আসতে পারায় সংরক্ষিত থাকে। অতি-সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা অনেক প্রচেষ্টার পরে এন্টি-হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করতে পেরেছেন। এটাই এখনো পর্যন্ত তৈরি করা সব থেকে জটিল প্রতিকনা। রিচার্ড ফাইনম্যান-এর মতে বিগব্যাং সময়ে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ সমান সমান সৃষ্টি হয়েছিলো যাদের মধ্যে এন্টিমেটার বিপরীতে যায়। এবং নরমাল ম্যাটার দিয়ে যেমন আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেরকমভাবে এন্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ দিয়ে সৃষ্ট আরেকটা মহাবিশ্ব থাকার বিপুল সম্ভবনা রয়েছে যা দেখতে আমাদের মহাবিশ্বেরই প্রতিরূপ।

এছাড়াও অনেকে মনে করেন বিগব্যাং এর পরে এন্টিমেটার ম্যাটার থেকে এন্টিমেটার কিছুটা কম সৃষ্টি হয় যারফলে ম্যাটার কিছুটা থেকে যায় যা দিয়ে পরে আমাদের এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি।
তাই কোন দিন ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন হুবহু আপনার মত দেখতে কেউ আপনার দিকে তার বাম হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ভুলেও হাত মিলাবেন না। কারণ ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার পরষ্পর সংস্পর্শে এলে উভয়েই ধ্বংস হয়ে যায় এবং Annihilation এর মাধ্যমে বিপুল পরিমান শক্তি উৎপন্ন হয়।
হয়তো অনেকেই চিন্তা করেন যে নেগেটিভ ম্যাটার আর এন্টিমেটার একই জিনিস কিন্তু না। এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
- নেগেটিভ ম্যাটার এর শক্তি ঋণাত্মক কিন্তু প্রতিপদার্থের বা এন্টিমেটার এর শক্তি ধনাত্মক।
- এন্টিমেটার এর ভর নরমাল ম্যাটার এর মতোই পজিটিভ হয়ে থাকে কিন্তু নেগেটিভ ম্যাটার এর ভর নেগেটিভ হয়ে থাকে।
- নেগেটিভ ম্যাটার একটি হাইপোথিসিস কিন্তু এন্টমলটার বাস্ত
- নরমাল ম্যাটার আর এন্টিমেটার এর মধ্যে শুধু একটাই তফাৎ সেটা হলো তাদের বিপরী চার্জ। তাছাড়া কিন্তু বাকি সবকিছু একই। কিন্তু নরমাল মেটার আর নেগেটিভ ম্যাটার এর মধ্যে সবকিছু আলাদা যেমন ভর, শক্তি।
এন্টিমেটার এতো দামী কেন?
সুইজারল্যান্ড এর জেনেভায় রয়েছে একটি রিসার্চ সেন্টার যাকে বলা হয় চার্ন ( Cern) সেখানে তৈরি করা হয় এন্টিমেটার। ঐ মেশিনের মধ্যে উচ্চ গতিতে পার্টিকেলদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে তৈরি করা হয় এই প্রতিপদার্থ। এই মেশিনটা টানা এক বছর চালালে সেখানে মোটামুটি ১০০ ট্রিলিয়ন প্রতিপদার্থ (কণিকা) তৈরি হয়। যদিও এটা অনেক মন হয় কিন্তু এই পরিমানটাকে ওজন এ পরিণত করলে তা ১ গ্রাম এর মতো হবে আর এই ১ গ্রাম তৈরি করতে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
( এই নেগেটিভ ম্যাটার আর এন্টিম্যাটার উভয়েই পল ডিরাক সমীকরণ থেকে আসে)
সোর্সঃ
https://home.cern/science/experiments/osqar
শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল (আব্দুল গাফফার রনি)
https://en.wikipedia.org/wiki/Negative_mass
https://www.daviddarling.info/encyclopedia/E/exotic_matter.html