মানবশরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলো হার্ট , কিন্তু সেই হার্টের অসুখেই ভুগছে পৃথিবীর অগণিত মানুষ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর সাড়ে ৬ লক্ষাধিক মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় হৃৎপেশিকোষের তৈরি বায়োহাইব্রিড মাছ উদ্ভাবিত হয়েছে , যা হৃদরোগের চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ।
এই নতুন উদ্ভাবিত বায়োহাইব্রিড মাছটি যে হৃৎপেশিকোষ বা কার্ডিওমায়োসাইট (cardiomyocytes) দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, তা মূলত মানুষের স্টেম সেল থেকে উৎপন্ন । ঠিক মানুষের সত্যিকারের হৃৎপিণ্ড যেমন স্পন্দিত হয়, তেমনি মাছটির লেজও স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নির্দিষ্ট ছন্দে ডানে-বায়ে দুলতে পারে, কোনো বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই। এর শক্তির সরবরাহ আসে ঠিক আমাদেরই মতো লবণ ও গ্লুকোজ থেকে, যেগুলোর দ্রবণে মাছটি খুব সুন্দরভাবে সাঁতরে বাড়াচ্ছিল।

ম্যাকানিজম
কিন্তু টানা ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে বিট করে যাওয়া এই বায়োহাইব্রিড মাছের রহস্যটা কী?
বায়োহাইব্রিড মাছটিকে তৈরি করা হয়েছে আমাদের হার্টের দুটো মূল নিয়ন্ত্রক বৈশিষ্ট্য – স্বয়ংক্রিয়তা এবং যান্ত্রিক-বৈদ্যুতিক সিগনালিংয়ের দিকে লক্ষ রেখে। আমাদের হার্ট কোনো সচেতন উদ্দীপনা ছাড়াই নিজে নিজে বিট করতে পারে, এটি হলো হার্টের স্বয়ংক্রিয়তা। হার্ট তার স্পন্দনের নির্দেশ পায় তার যান্ত্রিক মোশন থেকে,একে বলা হয় যান্ত্রিক-বৈদ্যুতিক সিগনালিং।
বায়োহাইব্রিড মাছটির লেজের বিট চক্রাকারে আবর্তিত হয়। আমরা অনেকেই হয়তো জানি, আমাদের দেহের পেশিগুলো কাজ করে সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে। হৃৎপেশির দুটো লেয়ার দিয়ে তৈরি লেজের এক পাশের লেয়ারে যখন সংকোচন ঘটে, অন্য পাশের লেয়ার তখন প্রসারিত হয়। এই সংকোচন ও প্রসারণের ফলে একটি ফিডব্যাক ম্যাকানিজম ট্রিগারড হয়, যা পেশির আয়ন চ্যানেলগুলোকে সক্রিয় করে। আয়ন চ্যানেল তখন প্রসারিত লেয়ারকে সংকুচিত হওয়ার সিগনাল দেয় এবং পূর্বে সংকুচিত লেয়ার প্রসারিত হয়। তারপর আবার প্রসারিত লেয়ার সংকুচিত হয় ও সংকুচিত লেয়ার প্রসারিত হয়, এভাবেই এটি চক্রাকারে চলতে থাকে এবং মাছের লেজ ডানে-বায়ে স্পন্দিত হয়ে মাছটিকে সাঁতরাতে সাহায্য করে। লক্ষণীয় বিষয়, এখানে সংকোচন-প্রসারণ সম্পূর্ণ পেশির নিজস্ব ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় কোনো বাহ্যিক উদ্দীপকের সরবরাহ ছাড়াই, শুধু পেশির কোষগুলোর পুষ্টি বা শক্তির জন্য খনিজ ও গ্লুকোজই যথেষ্ট। আরো পড়ুনঃ জীবিত মানুষের দেহে শূকর হৃৎপিণ্ডের সফল প্রতিস্থাপন
সাফল্য ও ভবিষ্যৎ
ইতোপূর্বে ইঁদুরের হৃদপেশির তৈরি জেলিফিশ বায়োহাইব্রিড পাম্প ও সাইবর্গ স্টিংরে দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, কিন্তু এই প্রথম বায়োহাইব্রিড মাছের মধ্য দিয়ে আরো ভালো ফলাফল মিলল। জেব্রাফিশের আদলে তৈরি এ মাছ কেবল যান্ত্রিক রোবটকেই টেক্কা দেয়নি, গবেষণায় যুক্ত বায়োফিজিক্স রিসার্চার সুং-জিন পার্ক বলেন, “দুটো অভ্যন্তরীণ গতি সৃষ্টিকারী ম্যাকানিজমের ফলে আমাদের উদ্ভাবিত মাছটি টেকসই, দ্রুতগামী এবং পূর্বের উদ্ভাবনগুলোর চেয়ে অধিক দক্ষতার সাথে সাঁতার কাটতেও সক্ষম।”
হৃদরোগের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়তা এবং যান্ত্রিক-বৈদ্যুতিক সিগনালিংকে আরো ভালোভাবে নিরীক্ষণের জন্য এই গবেষণার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন গবেষকরা ।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বায়োইঞ্জিনিয়ার কেভিন কিট পার্কার বলেন, “আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এমন একটি কৃত্রিম হার্ট তৈরি করা, যেটি একটি শিশুর বিকল হার্টের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।”
- Scientists Made a ‘Fish’ From Human Cardiac Cells, And It Swims Like a Beating Heart-sciencealert.com
- An autonomously swimming biohybrid fish designed with human cardiac biophysics-science.org


