Can't find our books? Click here!

জীবিত মানুষের দেহে শূকর হৃৎপিণ্ডের সফল প্রতিস্থাপন

২০২১ সালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক অর্জন ছিল মানবদেহে শূকর কিডনীর সফল প্রতিস্থাপন, যদিও সেই প্রতিস্থাপন ছিল একজন ব্রেইন-ডেথ মানুষের দেহে। কিন্তু মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে চলতি বছরের শুরুতেই মিলল চূড়ান্ত অর্জন — একজন জীবিত মানুষের দেহে সম্ভব হলো শূকর হৃৎপিণ্ডের সফল প্রতিস্থাপন! এই অবিশ্বাস্য সাফল্য মিলেছে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টারের একদল সুদক্ষ চিকিৎসকের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।

৫৭ বছর বয়সী ডেভিড ব্যানেটের শারীরিক অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে একটি মানব হৃৎপিণ্ড তাঁর দেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব ছিল না। ‘টার্মিনাল হার্ট ডিজিজে’ আক্রান্ত ব্যানেট সার্জারির একদিন আগে বলেছিলেন, “এটি ছিল একটি ‘Do or Die’ প্রতিস্থাপন। আমি জানি এটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো ব্যাপার, কিন্তু এটিই আমার অন্তিম উপায়”। এই সার্জারির জন্য ইউএস মেডিক্যাল রেগুলেটরের কাছ থেকে ডাক্তারদের বিশেষ ছাড়পত্র নিতে হয়েছিল। এই সার্জারির জন্য ট্রান্সজেনিক শূকরের হার্ট ব্যবহার করা হয়েছিল।

চিকিৎসকদের কাছে এই প্রতিস্থাপন বহু বছরের গবেষণার সাফল্য, যা সারা বিশ্বের মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। সার্জন বার্টলে গ্রিফিথের মতে, এই সার্জারি বিশ্বকে প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের সংকট সমাধানে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। বর্তমানে আমেরিকায় গড়ে ১৭ জন মানুষ মারা যান প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের অভাবে, যেখানে এক লক্ষাধিক মানুষকে অপেক্ষা করতে হয় একটি মাত্র অঙ্গের জন্য। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান ড. ক্রিস্টিন লাউ, যিনি সার্জারিতে উপস্থিত ছিলেন, বলেন, যদি আমরা জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড শূকরের অঙ্গ ব্যবহার করতে পারি, অঙ্গের জন্য অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের অপেক্ষা ফুরোবে। তাছাড়া আমাদের আর সারা দেশ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গগুলোকে বাঁচানোর জন্য। উল্লেখ্য, আন্তঃপ্রজাতিক অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা জেনোপ্লান্টেশন এর অংশ হিসেবে শূকরের অঙ্গ দীর্ঘদিন ধরেই সম্ভাব্য প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গ বিবেচিত হচ্ছিল; শূকরের হার্ট ভাল্বের ব্যবহার এরই মধ্যে সাধারণ একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

ব্যানেটকে বর্তমানে একটি বিশেষ মেশিনের সাহায্যে সংযুক্ত রাখা হয়েছে এবং আগামী ছয় সপ্তাহ তাকে বিছানায় থাকতে হবে। ব্যানেট আশাবাদী, এই প্রতিস্থাপন তাঁকে একদিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং যখন প্রতিস্থাপনের মূল হাতিয়ার

১৯৯১ থেকে ২০১৩, এই ২৩ বছরের ডেটা বিশ্লেষণ করে আমেরিকায় অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত এক ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। ১৯৯১  সালে যেখানে ২৩,১৯৮ জন মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ওয়েটিং লিস্টে ছিল,২০১৩ সালে এসে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ২১ হাজার ২৭২ জনে, অর্থাৎ প্রায় ৫ গুণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুই দশকে অঙ্গদাতার সংখ্যা ৬৯৫৩ থেকে বেড়ে হয়েছে মাত্র ১৪,২৫৭ জন, অর্থাৎ মাত্র দ্বিগুণ। প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গের এই ঘাটতি পূরণে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে শূকরের অঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আন্তঃপ্রজাতিক অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা xenotransplantation এর মূল বাধা হলো, অন্য প্রজাতির অঙ্গে বিদ্যমান কোনো মলিকিউলের প্রতি হোস্টের দেহ ইমিউন রেসপনসিভ হয়ে উঠতে পারে, অর্থাৎ হোস্টের দেহ অঙ্গটিকে বহিরাগত ও দেহের জন্য বিপজ্জনক বিবেচনা করে সেটিকে প্রত্যাখ্যান করে, ফলে অঙ্গটিকে আর কার্যকর করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বিশেষ ধরনের ইমিউনোসাপ্রেসিভ ( immunosuppressive) ড্রাগস প্রয়োগ করা যায়, তবে জেনোট্রান্সপ্লান্টেশনে এই ধরনের ড্রাগসের ব্যবহার ইতোপূর্বে সাফল্যের মুখ দেখেনি। মানুষ থেকে মানুষে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এ ধরনের ড্রাগস যদিও কার্যকরী, কিন্তু ব্যানেটের মতো যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থা যথেষ্ট জটিল, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ড্রাগসও ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে একমাত্র জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড অঙ্গ। শূকরের অঙ্গসমূহ মানবদেহের অঙ্গের সাথে আকার ও ফিজিওলজির দিক থেকে সাদৃশ্যপূর্ণ, কিন্তু এদের অঙ্গের কোষের উপরিভাগে এমন কিছু সুগার ও প্রোটিন মলিকিউল আছে, যেগুলো মানবশরীর প্রত্যাখ্যান করে। তাছাড়া শূকর ও মানুষের সামান্য জেনেটিক্যাল পার্থক্যও এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।এসব জটিলতা দূর করতে জেনেটিক্যালি মডিফাইড শূকর সর্বোত্তম উপায়। এর মাধ্যমে কেবল সুগার ও প্রোটিন মলিকিউলবিহীন শূকর উৎপাদন করাই সম্ভব হয়নি, শূকরের মধ্যে এমন কিছু মানব জিন প্রবেশ করানো সম্ভব হয়েছে যেগুলো শূকরের ইমিউন কোষগুলোকে মানুষের ইমিউন কোষগুলোর সাথে সফল ইন্টারেকশন সম্ভব করে তোলে। Read more: ২০২১ ও আমাদের বৈজ্ঞানিক অর্জন

শূকরের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আরেকটি পদ্ধতির প্রয়োগও চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা হলো ‘সহনশীলতা’ (tolerance approach)। এ পদ্ধতিতে সুনির্দিষ্ট অঙ্গ প্রতিস্থাপনের পূর্বে শূকরের অস্থিমজ্জা (বোন ম্যারো) মানুষের দেহে স্থাপন করা হয়। দাতা বোন ম্যারোর প্রিজেনিটর ইমিউন কোষগুলো  পরিণত ইমিউন কোষে উন্নীত হয় এবং সেগুলো তখন আর প্রতিস্থাপিত অঙ্গকে ইমিউন আক্রমণ করে না কেননা ইমিউন কোষগুলো তখন প্রতিস্থাপিত অঙ্গটিকে নিজস্ব অঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করে।

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং চিকিৎসাক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে ইনসুলিন তৈরির মাধ্যমে যেমন কোটি কোটি ডায়াবেটিস রোগীর জীবন বাঁচিয়েছে, তেমনি কোনো একদিন হয়তো জেনেটিক্যালি মডিফাইড শূকরের অঙ্গ লাখো মানুষকে একটি অঙ্গের বিনিময়ে সুস্থ জীবন উপহার দিতে সক্ষম হবে।

তথ্যসূত্রঃ

Adsense – জীবিত মানুষের দেহে শূকর হৃৎপিণ্ডের সফল প্রতিস্থাপন