Can't find our books? Click here!
অমরত্ব অর্জনের উপায়?

অমরত্ব অর্জনের উপায়?

হাইপারস্পেস অভি কনটেস্ট -২০২২, তূর্য রহমান

আজীবন কে না বেঁচে থাকতে চায়? বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রবল থাকে মানুষের মনে। মৃত্যু আসবেই আর তা মেনেই জীবনে পথ চলতে হবে এ বিষয়টি সকলেরই জানা। তবে ছোটবেলা থেকে একদম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকার আগ্রহ কমে না কারো! যুগ যুগ ধরে অনেক মানুষই বিভিন্ন উপায়ে অমরত্ব লাভের চেষ্টা করে আসছে। ভারতীয় পুরাণ , গ্রিক পুরাণ সহ আরও অনেক মিথোলজিতে অমরত্বের কথা শোনা যায়। অমরত্ব লাভে ব্যর্থ হয়ে মিশরীয় রাজারা মৃত্যুর পর নিজেদের মমি করে রাখা শুরু করলো। সেখান থেকেই পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা আশ্চর্য পিরামিড তৈরি হয়েছিল। অনেক মানুষই অমরত্ব লাভের জন্য আধ্যাত্মিক উপায়ে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিংবা অন্য আরও কোন উপায়ে অমরত্ব লাভের চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফলতার কোন ইতিহাস পাওয়া যায় নি।

প্রথমেই বলা যাক বিজ্ঞানের ভাষায় অমরত্ব কি? অমরত্ব মানে কিন্তু মৃত্যুই হবে না এমন কিছু না। মৃত্যুই হবেনা এমন কিছু ম্যাথেমিটিক্যালি অসীমের ভিতর চলে যায় যা কিন্তু বাস্তবে সম্ভব না। কিন্তু আমরা তো বাস্তবেরই অংশ। অমরত্ব হলো এমন কিছু যেখানে কোন প্রাণীর জৈবিক মৃত্যু হবে না। যেমন বার্ধক্যজনিত কারণে রোগ, যেকোন ধরনের অসুস্থ্যতা, দেহের অভ্যন্তরীণ অর্গানগুলোর ক্ষতি হওয়া এসব কারণে মৃত্যু হবেনা। তবে সাডেন ডেথগুলো জৈবিক মৃত্যুর ভিতর ধরা হয়না। যেমন রোড এক্সিডেন্ট, পানিতে ডুবে কিংবা আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ইত্যাদি।

পৃথিবীতে অমরত্বের কনসেপ্ট কিন্তু একেবারেই নতুন না। আমরা ছোটবেলা থেকে হয়তো পড়ে এসেছি “জন্মিলে মরিতে হবে” কিন্তু এ কথা অনেকাংশেই সত্য না। পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী আছে যাদের কিন্তু জৈবিক মৃত্যু নেই। যেমন হাইড্রা, কিছু প্রজাতির জেলিফিশ, উপযুক্ত পরিবেশে ব্যক্টেরিয়া( radiation resistant bacteria), tardigrade এবং কিছু ইস্টও প্র্যাক্টিক্যালি অমর প্রাণী।  এমন অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীই আছে যাদের জৈবিক মৃত্যু হয় না।

অমরত্বের চেষ্টায় মানুষ অতীতে সফল হতে না পারলেও আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান সফলতায় মানুষ সে আশা দেখছে। আমরা যদি খেয়াল করে থাকি তাহলে দেখব, আমরা এখনো অমরত্বের সেই মহোঔষুধ না পেলেও বিজ্ঞানের অগ্রগতীর সাথে সাথে মানুষের জীবনকাল কিন্তু ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ঊনবিংশ শতাব্দির আগেও মানুষের গড় আয়ু ছিলো মাত্র ৩০-৪০ বছর। অথচ এখন মানুষের গড় আয়ু ৭৫ বছর। ভবিষ্যতে যে মানুষের জীবনকাল আরও বাড়বে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কে জানে হয়তো আমরা কোনদিন অমরত্বের স্বাদও পেয়ে যাব।

তো বিজ্ঞান কিভাবে আমাদের এই মৃত্যুর প্রক্রিয়া ধীরগতি করে দিতে পারে সে ব্যাপারে আলোচনা করা যাক।

সেনসেন্ট সেল (senescent cells) ধ্বংস করা

আমাদের যেমন জন্ম মৃত্যু আছে কোষের তেমন জন্ম মৃত্যু আছে। কোষ বিভাজনের মাধ্যমে জন্মের পর একটা নিদ্রিষ্ট সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এই সময়ে সে বেশ কয়েকবার নিজেও কোষ বিভাজন করে। কোষ বিভাজনের সময় কোষ তার ক্রমোজম কপি করে। কিন্তু এই কপি করার সময় কোষ অল্প পরিমাণ ডিএনএ হারায়। এই ডিএনএ হারানো রুখতে ক্রমোজমের প্রান্ত গুলোতে টেলোমিয়ার নামক ক্যাপ পরানো থাকে। কিন্তুই কোষ বিভাজন বাড়ার সাথে সাথে এই টেলোমেয়ারগুলো ক্ষয়ে যায়। এই টেলোমিয়ারগুলো একদম নিঃশেষ হয়ে গেলে কোষগুলো সেনসেন্ট সেলে পরিণত হয়। যাকে জম্বি সেলও বলা হয়। মানুষের বয়স যত বাড়তে শুরু করে এই জম্বি কোষের পরিমাণও বাড়তে শুরু করে। এর ফলেই মানুষ বৃদ্ধ হয়। আর আমরা জানি বৃদ্ধ হলে মানুষের শক্তি কমে যায়, বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে ভোগে এবং আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয় । 

তো আমরা যদি কোন ভাবে এই জম্বি সেল গুলো ধ্বংস করতে পারি তাহলে বৃদ্ধ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাব। কিন্তু এই জম্বি কোষগুলো ধ্বংস করতে গেলে যদি ভালো কোষগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়? এই সমস্যাটা নিয়েই গবেষণা চলছে। গবেষণার ফলাফল হিসেবে জিরোপ্রটেক্টার (Geroprotectors), সাস্প ইনহিবিটরস (SASP inhibitors), সেনোলাইটিকস (Senolytics), সেনোমারফিক(Senomorphics), জিন থেরাপি ইত্যাদি সমাধানগুলো আমাদের সামনে এসেছে। এগুলো বেশিরভাগই এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। এগুলোর সবগুলো মানুষের দেহে এখনো প্রয়োগ করা হয়নি। তবে আশা করা যায় হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই আমরা  সেনেসেন্ট সেল থেকে মুক্তি পাব। আরও পড়ুনঃ ইম্মর্টালিটি এন্ড গ্যালাক্টিক মাইন্ড

অমরত্ব অর্জনের উপায়?
চিত্রঃ সেনসেন্ট সেল

শরীরে NAD+ এর পরিমাণ বৃদ্ধি

একটা গাড়ির কথা চিন্তা করা যাক। একটা গাড়ি কিভাবে চলে? গাড়িতে তেল দেওয়ার পর গাড়ির ইঞ্জিনের মাধ্যমে তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। তারপর গাড়ি চলে। সময় বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির ইঞ্জিনগুলো ক্ষয় হতে শুরু করে। আমাদের শরীরেও এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলো আমাদের খাওয়া, ডায়েট, ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে। এমনই একটি উপাদান হচ্ছে NAD+ (Nicotinamide Adenine Dinucleotide) নামক এক ধরণের কোএনজাইম। আমাদের শরীরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তি উৎপাদনকারী হচ্ছে এই NAD+। আমাদের মাথার স্নায়ু কোষ থেকে পায়ের পাতা সব জায়গায় NAD+ উৎপন্ন হয়। NAD+ আমাদের কোষগুলোকে দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে NAD+ উৎপাদন কমতে শুরু করে। এভারেজে আমাদের দেহে ২০ বছর বয়সে যে পরিমাণ NAD+ উৎপন্ন হয় ৫০ বছর বয়সে কমে তা অর্ধেক হয়ে যায়। NAD+ বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যাওয়ার কারণ এখনো সঠিকভাবে জানা না গেলেও  NAD+ ক্ষয় হবার জন্য কিছু এনজাইম যেমন সারটুইন্স(Sirtuins), পার্প-১(PARP-1), সিডি৩৮(CD-38) কে দ্বায়ী করা হয়। 

সারাজীবন শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে NAD+ উৎপাদন অব্যাহত থাকলে আমরা হয়তো বার্ধক্য ঠেকাতে সক্ষম হব। এমনকি এটা আমাদের বার্ধ্যকের বদলে তরুণ্যের দিকেও নিয়ে যেতে পারে। ২০১৬ সালে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর ডেভিড সিনক্লেয়ার (David Sinclair) কিছু সমবয়সী ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করেন। যেখানে NR এবং MNM নামক উপাদান যা NAD+ উৎপন্ন করতে পারে, একদল ইদুরের দেহে প্রবেশ করানো হয় এবং আরেকদল ইঁদুরের দেহে করানো হয়না। গবেষণায় দেখা যায় NR এবং MNM পুশ করানো ইঁদুরগুলোর ডিএনএ ক্ষয় হয়নি এবং তার দেহের শরীরবৃত্তীয় কাজ অনেক ভালোভাবে চলছে। 

অমরত্ব অর্জনের উপায়?
চিত্রঃ NAD+ এর কাজ
অমরত্ব অর্জনের সায়েন্স
চিত্রঃ NR, MNM ব্যবহারকৃত ইঁদুর

স্টেম সেলের ব্যবহার

মানুষের দীর্ঘ জীবন লাভে আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হতে পারে স্টেম সেলের ব্যবহার। স্টেমসেল হচ্ছে এমন এক ধরণের কোষ বা সেল যাকে একদম প্রাথমিক কোষ বা কোষের কাঁচামাল বলা যেতে পারে। তিন ধরণের স্টেমসেলের উল্লেখ পাওয়া যায়। এডাল্ট স্টেমসেল, ইমব্রোয়নিক (Embryonic) স্টেম সেল বা প্লুরিপোটেন্ট (Pluripotent)স্টেমসেল এবং iPSCs (Induced Pluripotent Stem Cells)। আমাদের হাত পা কেটে গেলে ক্ষত সেরে ওঠে সাধারণত এডাল্ট স্টেমসেলের মাধ্যমে। ক্ষত সারাতে এডাল্ট স্টেমসেল ব্যবহৃত হয়। ইমব্রোয়নিক স্টেমসেলের কাজ ডিম্বাণূ নিষিক্ত হবার পর থেকেই শুরু হয়। আমাদের হাত , পা, চোখ ,নাক সামগ্রিকভাবে আমাদের মানুষ্য আকৃতি দানই করেছে ইমব্রোয়নিক স্টেমসেল। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ইমব্রোয়নিক স্টেমসেল বিলীন হয়ে যায়। iPSCs খুবই ইন্টারেস্টিং একটা স্টেমসেল। এটা মূলত কৃত্রিম স্টেমসেল। এটা প্রকৃত কোষ থেকে আদি কোষে রুপান্তর করে এবং সেখান থেকে আবার কোন প্রকৃত কোষে রুপান্তর হয়। যেমন ধরা যাক একটা কেক থেকে আটা ময়দা বের করে তা দিয়ে আবার বিস্কুট বানানোর মতো। 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের অঙ্গপ্রতঙ্গ গুলো ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। তবে কোনভাবে যদি আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো নতুনভাবে তৈরি করা সম্ভব হয় তাহলে হয়তো আমরা দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারব। যেমন হাইড্রা স্টেমসেল ব্যবহার করে বায়োলজিক্যাল ডেথ এড়াতে পারে। নিউইয়ার্কে আলবার্ট আইন্সটাইন কলেজ মেডিসিনের প্রফেসর ডংসেং সাই (Dongsheng Cai) কিছু ইদুরের উপর গবেষণা চালান। তিনি কিছু মধ্যবয়স্ক ইদুরের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে এবং হার্টে বেবি ইদুরের  এমব্রায়োনিক সেল প্রবেশ করান। এতে দেখা যায় বয়স্ক ইদুরের দেহ এবং  মাসল অন্য সব বয়স্ক ইদুরের থেকে বেশি ভালো কাজ করছে, তাদের লোম অনেক দ্রুত গজাচ্ছে এবং এদের কাজ করার হারও অন্য তাদের বয়সী ইঁদুর থেকে বেশি। 

অমরত্ব অর্জনের উপায়?
চিত্রঃ স্টেমসেল 

এগুলোর বাইরেও বিজ্ঞানে দীর্ঘজীবী হবার আরও নতুন উপায়গুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে বেশিরভাগ গবেষনায় এখনো ইদুরের উপর প্রয়োগেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এগুলো ইঁদুরের উপর কাজ করলেও মানুষের উপর করবে কিনা এর কোন নিশ্চয়তা নেই। তবে আমাদের দীর্ঘজীবী হবার প্রসেস তারপরও থেমে নেই। নিয়মিতই আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন নতুন আবিষ্কার যুক্ত হচ্ছে যা আমাদের জীবনে বেঁচে থাকার সময়সীমা নিয়মিতই বাড়িয়ে চলছে। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে আমরা বায়োলজিক্যাল ডেথ এড়াতে পারবো।

তবে বায়োলজিক্যাল ডেথ এড়িয়ে অমরত্ব লাভ করলে আমরা যেমন উপকার পাব তেমনি অপকারও পাব। আমাদের পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছেই। এই জনসংখ্যার চাপে পৃথিবীতে খাদ্য সংকট, প্রকৃতি দূষণ পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে।  তার উপর মৃত্যুহার যদি অনেক কমে যায় তবে সেটা হয়তো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। তাছাড়া খারাপ শক্তিধর মানুষগুলো দীর্ঘজীবন নিয়ে খারাপ কর্মকান্ড চালিয়ে যাবে। তবে এসব খারাপ ব্যাপারের পাশাপাশি ভালো দিকগুলোও আছে। আমরা এখনো সৌরজগৎ এ শুধু চাঁদেই যেতে পেরেছি। হয়তো খুব দ্রুত মঙ্গল গ্রহেও যাব। কিন্তু আমরা অমরত্ব পেলে হয়তো বিশাল এই মহাবিশ্বে চষে বেড়াতে পারবো। কি হতো যদি আজ আইন্সটাইন বেঁচে থাকতো। তিনি হয়তো আরও নতুন আইডিয়া, আরও নতুন আবিষ্কার দিয়ে বিজ্ঞানে সামগ্রিকভাবে এই পৃথিবীকেই সহায়তা করতে পারতেন। এমন আরও অনেক বিজ্ঞানী, লেখক, ডাক্তার, প্রকৌশলী সহ সকল বুদ্ধিজীবীমানুষগুলো হয়তো আরও বেশি পৃথিবীর সেবা করার সুযোগ পেতেন। হয়তো আপনার প্রিয় মানুষগুলো আপনার কাছ থেকে হারাতো না। 

আপনার কি মনে হয়, মানুষের কি দীর্ঘজীবন বা অমরত্ব পাওয়া উচিৎ?

লেখক
তূর্য রহমান
কন্টেন্ট
অমরত্ব অর্জনের সায়েন্স
পজিশন
কন্ট্রিবিউটর হাইপারস্পেস
প্রফেশন
শিক্ষার্থী