মুখবন্ধঃ এই প্রবন্ধটিতে ব্যক্ত করা প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে একের অধিক বই লেখা সম্ভব। এছাড়া প্রবন্ধটিতে উল্লেখিত প্রত্যেকটি বিষয়ের গাণিতিক রূপ রয়েছে, যা অনেক জটিল ও দুরূহ। তাই এখানে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, কোনো গাণিতিক বিষয় আলোচনা করা হয়নি।
আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছরেরও আগে, আইজেক নিউটন তাঁর সার্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র প্রদান করেন। সূত্রটি ছিল এই রকমঃ “এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু কণাদ্বয়ের ভরেরগুণ ফলের সমানুপাতিক, এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এবং এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।”
তবে নিউটন মহাকর্ষ আবিষ্কার করলেও তিনি তার গবেষণা পত্রে লিখেছিলেন মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে তা তিনি বর্ণনা করতে পারেননি। চিরায়িত পদার্থবিজ্ঞানে মহাকর্ষকে একটি মৌলিক বল (যদিও এটি সকল মৌলিক বলের চেয়ে একটু বেশীই দুর্বল) হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, আইস্টাইন সেটি অস্বীকার করেন। আলবার্ট আইস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে মহাকর্ষকে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সাধারণ আপেক্ষিকতার গাণিতিক সমীকরণটি নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের সমীকরণ থেকে অনেক বেশি জটিল। সাধারণ আপেক্ষিকতার গাণিতিক প্রমাণে বক্রতলের জ্যামিতি ব্যবহার করা হয়েছিল। যার জন্য আলবার্ট আইস্টাইন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশে দশ বছর সময় নেন। অন্যদিকে, চিরায়িত পদার্থবিজ্ঞানে আলোকে তরঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা হলেও, কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ নিয়ে কাজ করার সময় ম্যাক্স প্লাংক লক্ষ করেন আলো উৎস থেকে কণা হিসেবে বের হয়। তিনি যার নাম দেন কোয়ান্টা ও পদার্থবিজ্ঞানে একটি নতুন শাখার তৈরী হয় যার নাম কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। পরবর্তীতে ডাবল স্লিট পরীক্ষায় প্রমাণিত আলোর তরঙ্গ ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পরে যান। তখন লুই ডে ব্রোগলি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে কণাসমূহ তরঙ্গের মতো আচরণ করে। যাকে বলা হয় ডে ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য।
এরপরে ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা তত্ত্ব প্রকাশ করেন যেখানে বলা হয় কোনো কণার অবস্থান সম্পর্কে যত বেশি নিশ্চিত হওয়া যাবে, ভরবেগ তত বেশি অনিশ্চিত হয়ে যাবে। তারপর এরউইন শ্রোডিঙ্গার এই বিষয়কে ওয়েব ফাংশনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন। যেখানে বলা হয়, কোনো কণার অবস্থান নির্ণয় করা যাবেনা শুধু কণাটি কোথায় থাকতে পারে তার সম্ভবনা নির্ণয় করা যাবে।
সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দুই দুইয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাধারণ আপেক্ষিকতার সাফল্য ভারী বস্তুর ক্ষেত্রে ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাফল্য অত্যন্ত ক্ষুদ্র বস্তুর ক্ষেত্রে। সাধারণ আপেক্ষিকতার জনক আলবার্ট আইনস্টাইন এবং অন্যদিকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক ম্যাক্স প্লাংক। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তা তত্ত্ব আইস্টাইন কখনোই পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক সূত্র হিসেবে গ্রহন করেননি (যদিও আলোর কণা ধর্ম প্রমাণ করার জন্যই আইস্টাইন নোবেল পুরস্কার পান)।
আমরা জানি, আমদের মহাবিশ্ব একসময় একটি কণায় কেন্দ্রীভূত ছিল এবং তারপরে মহাবিস্ফোরণ সংঘঠিত হওয়ার পরে আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। ওই কণাটি ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং প্রচন্ড ভারী। যার ফলে ওই কণাটির ক্ষেত্রে সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যা উভয়ই প্রয়োগ করা যায়। কিন্তু যখনই এই দুটো তত্ত্বকে একত্র করার চেষ্টা করা হয়, তখন মনে হয় যেন পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রসমূহ অকার্যকর হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞানীরা এই দুটো তত্ত্বকে একসাথে করার চেষ্টা অনেক বছর ধরেই করছেন এবং ফল হিসেবে বিভিন্ন রকমের তত্ত্ব সামনে আসছে। এই সকল তত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভবনাময় তত্ত্ব হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্ব।
স্ট্রিং তত্ত্বের অনুসারে, অতিপারমাণবিক কণাসমূহ শক্তির স্পনদিত ধারা দ্বারা গঠিত যার নাম দেওয়া হয়েছে স্ট্রিং কিংবা সুতা। এই স্ট্রিংগুলো এক-মাত্রিক। এই স্ট্রিং মূলত দুই প্রকারঃ মুক্ত স্ট্রিং ও বন্ধ স্ট্রিং। স্ট্রিং সমূহের বিভিন্ন রকম কম্পনের ফলে ভিন্ন ভিন্ন কণা সৃষ্টি হয়। স্ট্রিং তত্ত্বের গাণিতিক গণনা অত্যন্ত সুন্দর। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে একত্রিত করার জন্য সবচেয়ে উন্নত তত্ত্ব হচ্ছে স্ট্রিং তত্ত্ব। স্ট্রিং তত্ত্ব দ্বারা মহাবিস্ফোরণ পূর্বের ঘটনার ব্যাখ্যা করা যায়। স্ট্রিং তত্ত্বে বহুমহাবিশ্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা আমাদের বলে আমাদের মহাবিশ্বের বাইরেও আরো অনেক মহাবিশ্ব রয়েছে। মহাবিশ্বকে স্ট্রিং তত্ত্বে বুদবুদ এর মতো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যখন দুটি মহাবিশ্ব সংঘর্ষ করে, তখন নতুন মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে যখন একটি মহাবিশ্ব বিভক্ত হয়, তখন নতুন দুটি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। আর এই বিষয়কেই আমরা সাধারণত মহাবিস্ফোরণ বলে জানি। স্ট্রিং তত্ত্বে আমাদের এই মহাবিশ্বকে এগারো-মাত্রিক মহাবিশ্ব হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা জানি, প্রত্যেক মৌলিক বলের জন্য একটি করে বোসন-কণা দায়ী। কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষ বলের জন্য কোনো বোসন কণা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, মহাকর্ষ বলকে আইস্টাইন বল হিসেবে ব্যাখ্যা না করে তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে স্থান-কালের বক্রতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। স্থান-কালের বক্রতাই আমাদের কাছে বল হিসেবে মনে হয়। মহাকর্ষকে কোয়ান্টাম স্তরে বর্ণনা করার জন্য বিজ্ঞানীরা একটি প্রকল্পিত কণা বিবেচনা করেছেন। এই কণার নাম গ্র্যাভিটন। স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে, মহাকর্ষ বল এতো দুর্বল কারণ মহাকর্ষের জন্য দায়ী কণা গ্র্যাভিটন বন্ধ স্ট্রিং দিয়ে তৈরী। যার ফলে এটি কোনো মহাবিশ্ব বা কোনো মাত্রায় স্থির থাকতে পারে না। এটি অন্য মহাবিশ্ব বা অন্য মাত্রায় চলে যায়। যার ফলে, মহাকর্ষ এতো দুর্বল। এটি আমাদের মহাবিশ্বে স্থির থাকেনা বিধায়, এটিকে সনাক্ত করা একটি কঠিন কাজ। তবে বিজ্ঞানীরা গ্রাভিটন সনাক্তের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আর এর থেকে বোঝা যায়, আমাদের মহাবিশ্বের বর্হিভূত অন্য মহাবিশ্বগুলোতে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো হয়তো আলাদা। কারণ, আমাদের মহাবিশ্বে মহাকর্ষ দুর্বল হলেও অন্য মহাবিশ্বে মহাকর্ষ অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে। আরও পড়ুনঃ ম্যাজিক এন্ড হাইপারস্পেস
এখন বলা যাক আমাদের মহাবিশ্বের দ্বি-মাত্রিক দিকের কথা। অনেক বছর আগে, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও জেকোব বেকেস্টাইন দেখান যে, কৃষ্ণ গহ্বরে কোনো বস্তু প্রবেশ করলে, সেই বস্তুর সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য মহাবিশ্ব থেকে চিরতরে মুছে যায়। যা পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে, যা হচ্ছে তথ্যের সংরক্ষণশীলতা। পরবর্তীতে স্ট্রিং তত্ত্বের জনক লিওনার্দ সাসকাইন্ড এবং গেরার্টেট হোফ্ট দেখান যে, কৃষ্ণ গহ্বরের বাইরে একটি অংশ রয়েছে যার নাম ঘটনা দিগন্ত। কোনো ত্রিমাত্রিক বস্তু কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করলে, ঘটনা দিগন্তে ত্রি-মাত্রিক বস্তুটির একটি দ্বি-মাত্রিক রূপ থেকে যায়। যার ফলে, ঘটনা দিগন্ত দ্বি-মাত্রিক। আর কৃষ্ণ গহ্বর যত বেশি পদার্থ গ্রাস করছে, ততই ঘটনা দিগন্তের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার এখান থেকে নতুন আরেকটি তত্ত্বের জন্ম হয়, যার নাম হলোগ্রাফিক মহাবিশ্ব।
এখন আবার ফিরে আসা যাক স্ট্রিং তত্ত্বে। স্ট্রিং তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্ব এগারো-মাত্রিক। কিন্তু তা আমরা কেন দেখিনা কিংবা অনুভব করি না তা বলা যাক। এর জন্য একটি চিন্তার পরীক্ষা করতে হবে। চিন্তা করুন অনেক দুরে আপনি একটি রেখা দেখতে পাচ্ছেন। আমরা জানি, রেখা এক-মাত্রিক। এখন, আপনি আরেকটু কাছ থেকে দেখলে বুঝতে পারবেন, এই রেখাটি আসলে কেবল রেখা নয়, বরং একটি দ্বি-মাত্রিক বস্তু। কিন্তু আরো একটু কাছে গেলে লক্ষ করবেন যে, বস্তুটি এক-মাত্রিকও নয় আবার দ্বি-মাত্রিকও নয়। বস্তুটি ত্রি-মাত্রিক একটি তার। এখন, আমরা সাধারণত ত্রি-মাত্রিক বস্তু দেখতে পাই। এখন এই তিন মাত্রার সাথে সময়কে যুক্ত করলে পাবো চতুর্থ মাত্রা (আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুসারে সময় পরম নয়, এটি আপেক্ষিক)। এগারো মাত্রার মধ্যে আমরা কেবল চারটি মাত্রা অনুভব করতে পারি। বাকি মাত্রাগুলো হয় অনেক বেশি ক্ষুদ্র পর্যায়ে অবস্থিত, নয় অনেক বেশি বৃহৎ পর্যায়ে অবস্থিত। যার ফলে আমরা এই বাকি মাত্রাগুলো দেখতে কিংবা অনুভব করতে পারিনা। আরও পড়ুনঃ দশমাত্রিক জগতের কল্পনা
কথা বলছিলাম স্ট্রিং তত্ত্বের তত্ত্বিক বিষয় নিয়ে। এবার কথা বলা যাক স্ট্রিং তত্ত্বের পরীক্ষণ নিয়ে। আমি আগেই বলেছি, স্ট্রিং তত্ত্ব অনেক অনেক ক্ষুদ্র অবস্থানের বিষয়। পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরী প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে, প্রোট্রন ও নিউট্রন তৈরী কোয়ার্ক নামক আরেকটি অতিপারমাণবিক কণা দিয়ে এবং স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে এই কোয়ার্কসহ অন্যান্য অতিপারমাণবিক কণাসমূহ হচ্ছে কম্পিত শক্তির ধারা। আবার স্ট্রিং তত্ত্ব অনুসারে, আমাদের মহাবিশ্ব এগারো মাত্রার। এতো ক্ষুদ্র কিংবা এতো বৃহৎ পর্যায়ে পরীক্ষণ করার জন্য কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার করা অনেক কষ্টসাধ্য একটি বিষয়, যা এখনো সম্ভব হয়নি। তাই স্ট্রিং তত্ত্ব এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়েই আছে। তবে বিজ্ঞানীরা স্ট্রিং তত্ত্বকে পরীক্ষণের জন্য কাজ করে চলেছেন। আশা করা যায়, আমরা খুব দ্রুত স্ট্রিং তত্ত্ব পরীক্ষণ করতে পারব।
- লিওনার্দ সাসকাইন্ড, স্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়
- ব্রায়ান গ্রিনি, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
- মিচিও কাকু, সিটি কলেজ অব নিউইয়র্ক
- স্ট্রিং তত্ত্ব, উইকিপিডিয়া
- সাধারণ আপেক্ষিকতা, উইকিপিডিয়া
- কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, উইকিপিডিয়া
