মাল্টিভার্সের ধারণাটি পদার্থবিদ্যার (এবং দর্শনের) কয়েকটি ক্ষেত্রে উদ্ভূত হয়, তবে সবচেয়ে বিশিষ্ট উদাহরণটি এসেছে ইনফ্লেশন থিউরি থেকে।ইনফ্লেশন থিউরি বিগ-ব্যাং এর পরে মহাবিশ্বের প্রাথমিক মুহূর্তগুলি অন্বেষণ করার জন্য কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এবং কণা পদার্থবিদ্যা থেকে ধারণাগুলিকে একত্রিত করে।
বিগ ব্যাং থিউরি আমাদের মহাবিশ্বের তৈরি ও তার পূর্ব সংক্রান্ত অনেক বিষয়ের উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছে।বিগ ব্যাং থিউরি অনুযায়ী একসময় আমাদের মহাবিশ্ব অতি ক্ষুদ্র গাণিতিক বিন্দু হিসেবে বিদ্যমান ছিল যাকে বলে সিঙ্গুলারিটি। সময়ের সঙ্গে প্রসারণে তা বর্তমান অবস্থা লাভ করেছে।বিগ ব্যাং এর পর স্পেসের যে প্রসারণ হয়েছে,তাকে কসমিক ইনফ্লেশন বলা হয়।এটি সে সময় শুরু হয়েছিল যখন মহাবিশ্ব মাত্র 10^-36 সেকেন্ড পুরোনো ছিল আর শেষ হয়েছিল যখন আমাদের মহাবিশ্বের জন্মের 10^-32 সেকেন্ড অতিবাহিত হয়েছে।এ ক্ষুদ্র সময়েই আমাদের মহাবিশ্ব পূর্বের তুলনায় 10^26 গুণ বড় হয়েছে।কিন্তু এর পর মুহুর্তে তা স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হতে থাকে।
এত সবকিছুর জবাব দেওয়া সত্ত্বেও কিছু প্রশ্ন তখনও থেকে যায় যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল,বিগ ব্যাং আসলে কেনই বা হয়েছিল।বিগ ব্যাং থিউরি যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা,তার জবাব দেয় ইনফ্লেশন থিউরি।
মহাবিশ্বের একদম প্রাথমিক পর্যায়ে কিভাবে পার্টিকেল তৈরি হয়েছে,তা নিয়ে Alan Gauth একটি ধারণা দেন যাকে বলে ইনফ্লেশন।বিগ-ব্যাং এর ঠিক পরবর্তী মুহূর্তে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার নিয়ে কাজ করার সময় তিনি এ ধারণা পান।
তবে রাশিয়ান বিজ্ঞানী Alexander Vilenkin তার এ মডেল নিয়ে চিন্তা করার সময় ভাবছিলেন,Inflation তথা প্রসারণ তো হয়েছে।কিন্তু তা আবার থামল কেন?পরবর্তীতে তিনি ধারণা পেলেন,আমাদের স্পেসে প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিয়ত ইনফ্লেশন হয়।অর্থাৎ এক জায়গায় থামলে তা আরেকজায়গায় শুরু হয়।যেহেতু এ প্রক্রিয়া চিরন্তনব্যাপী চলে তাই এ থিউরির নাম ইটার্নাল(চিরন্তন) ইনফ্লেশন। যার অর্থ,বিগ-ব্যাং প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে।
ইনফ্লেশন থিউরির অনেক প্রকারভেদ রয়েছে যার মধ্যে সবচেয়ে সফল 3টি।তবে মাল্টিভার্স কেন হয়েছে,তা বুঝতে হলে Eternal Inflation Theory বুঝতে হবে ।
Inflation হয়েছিল Gravitational repulsion এর জন্য যেটি আবার হয়েছিল False Vacum নামক সত্তার negative pressure এর জন্য। False Vacum শব্দটা অনেকের কাছে অপরিচিত।এর অর্থ কোনো কিছু সাময়িক সময়ের জন্য স্থিতিশীল হলেও প্রকৃত অর্থে স্থিতিশীল নয় অর্থাৎ True Vacum নয়।চলুন বিষয়টি অন্যভাবে অনুধাবন করা যাক।
এ মহাবিশ্বে উপস্থিত প্রত্যেক জিনিসেরই নিজস্ব শক্তিস্তর আছে।যখন কোনো সিস্টেমে উচ্চ শক্তির উপস্থিত তাকে,তা শক্তি ত্যাগ করে স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে চায়।যেমন-আমরা পরিবেশে তাপের আদান-প্রদান দেখতে পাই।আবার পারমাণবিক স্তরে ইলেক্ট্রন শক্তি লাভ করে উচ্চ কক্ষপথে গেলে তাকে পুনরায় গ্রাউন্ড স্টেটে আসতে হয়।কিন্তু তাহলে মিথ্যা স্থিতিশীল তথা False Vacum কথাটার অর্থ কি?একটি সহজ উদাহরণ দেয়া যাক- ধরুন কোনো একটি বোতলে পানি আছে।পানির অবস্থান বোতলে আপাতত স্থিতিশীল মনে হয়।কিন্তু যখনই তাতে ছিদ্র করে দেওয়া হয়,তখন সব পানি নিচে পড়ে যায়।বোতলে সঞ্চিত পানিকে সাময়িক সময়ের জন্য স্থিতিশীল রাখলেও তা কিন্তু প্রকৃত স্থিতিশীলতা নয়।ছিদ্র করাতে সে ঠিকই মাটিতে তথা গ্রাউন্ড স্টেটে চলে আসে।
ঠিক False Vacum কন্সেপ্টাও একই। কোনো সিস্টেম কোনো কারণে আপাত স্থিতিশীল অবস্থায় থাকলেও তা কিন্তু ঠিকই তার গ্রাউন্ড স্টেটে যাওয়ার প্রবণতা দেখাবে।তার অর্থ প্রকৃতির সকল কিছুই Concept of Stability অনুসরণ করে এমনকি তা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো অদ্ভুদ ক্ষেত্রেও।
এ কোয়ান্টাম ফিল্ড সর্বদাই নিম্ন শক্তিস্তরে যেতে চেষ্টা করে যাকে আমরা ভ্যাকিউম স্টেট বলে।কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তা মেটাস্টেবল স্টেটে চলে যায় যা অস্থিতিশীলতার সেই অবস্থা যা দীর্ঘ সময় বিরাজ করে।এর ফলে সে শক্তি নির্গত করতে পারেনা। এতে এটি অনেক শক্তির সঞ্চয় করে। এরকম ফিল্ডকে আমরা False Vacum বলি। False Vacum অস্থিতিশীল ও অত্যধিক ঘনত্বের হওয়ায় তার মধ্যে মহাকর্ষ বল আকর্ষণের জায়গায় বিকর্ষণ প্রকৃতির হয়। যার ফলে এটি তার চারপাশে উপস্থিত স্পেসকে দ্রুত গতিতে প্রসারিত করতে বাধ্য করে। এ প্রসারণ রৈখিক না হয়ে সূচকীয় হয়। অস্থিতিশীল হওয়ায় তা শক্তি হারাতে থাকে ও এলোমেলোভাবে এলোমেলো অংশবিশেষে ক্ষয় হতে থাকে। ক্ষয় হওয়ার ফলে এর অংশবিশেষ নিম্ন শক্তিস্তরে থাকে যার ফলে এর প্রসারণের গতি ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। এসব নিম্ন শক্তির Vacuum অঞ্চল মাইক্রোস্কোপিক বাবল তৈরি করে যার প্রসারণ হতে থাকে। এবং তার প্রসারণ প্ল্যাংক সাইজ হতে শুরু করে আমাদের অবজারভেবল ইউনিভার্স হতেও বিশাল হয়ে যায়।
এসব বাবলের অভ্যন্তরীণ প্রসারণই মূলত বিগ-ব্যাং । এভাবে প্রত্যেক বাবলেই নতুন মহাবিশ্ব তৈরি হয়।যার ফলে একটা নয়,বহু মহাবিশ্বের জন্ম হয় যাকে Multiverse বলে।কিন্তু এসব মহাবিশ্ব শনাক্ত করা সম্ভব নয়।কেননা মহাবিশ্ব নিজেই প্রসারিত হচ্ছে।সাথে দুটি মহাবিশ্বের মধ্যকার দূরত্বও বাড়ছে।এমনকি আলোও এক মহাবিশ্ব হতে আরেক মহাবিশ্বে যেতে পারবেনা।
তার মানে Eternal Inflation এর সূত্রই হচ্ছে মাল্টিভার্সের মূল ভিত্তি। তবে CMB(Cosmic Microwave Background) সম্ভাব্য উপায় হতে পারে মাল্টিভার্সের উপস্থিতি প্রমাণের ক্ষেত্রে। যদি আমাদের মহাবিশ্বে অন্য কোনো মহাবিশ্ব চলে আসে বা সংঘর্ষ হয়, তবে CMB এর মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে যা মাল্টিভার্স প্রমাণের সুযোগ করে দেয়। তবে আরো দুটি বিষয়ের মাধ্যমে মাল্টিভার্সের ধারণা পাওয়া যায়।
স্ট্রিং থিউরি অনুযায়ী সকল মৌলিক কণা ক্ষুদ্র কম্পিত শক্তি।স্ট্রিং এর বিভিন্ন কম্পনের ফলে বিভিন্ন কণা সৃষ্টি হয়।কিন্তু এদের কম্পনের জন্য প্রয়োজন 10 ডাইমেনশন যা আমাদের পরিচিত 3 ডাইমেনশন হতেও 7টি বেশি।কিন্তু অতিরিক্ত ডাইমেনশনে সম্ভাব্য আকৃতির সংখ্যা অসংখ্য।অনেকে মনে করেন অতিরিক্ত ডাইমেনশনের অসংখ্য আকৃতির মধ্যে কোনো একটা আকৃতিই আছে আমাদের মহাবিশ্বে।এবং প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা আকৃতির জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা মহাবিশ্ব।সুতরাং,স্ট্রিং থিউরীর অতিরিক্ত ডাইমেনশন থেকে মাল্টিভার্সের ধারণা পাওয়া যায়।
ডার্ক এনার্জির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা আমাদের মহাবিশ্বে যে পরিমাণ শক্তির উপস্থিতি পেয়েছেন এবং থিউরি অনুযায়ী যে পরিমাণ ডার্ক এনার্জি পাওয়া উচিত, তাতে আকাশ-পাতাল তফাৎ।কিন্তু মাল্টিভার্সের ধারণা অনুযায়ী তা আর রহস্য থাকেনা।মাল্টিভার্সের ধারণা অনুযায়ী অসংখ্য ইউনিভার্স আছে ও তৈরি হচ্ছে এবং একেক ইউনিভার্সে ডার্ক এনার্জির উপস্থিতি একেক রকম। আর এত সংখ্যক মহাবিশ্ব পরস্পরের সাথে কিভাবে অবস্থান করবে তা বলে প্যারালাল ইউনিভার্স যার ধারণা অনুযায়ী মহাবিশ্বগুলো একে অপরের সাথে সমান্তরালে অবস্থান করবে।
ইটার্নাল ইনফ্লেশন,স্ট্রিং থিউরি, ডার্ক এনার্জি তিনটি আলাদা বিষয় সে একই দিকের প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যদিও মাল্টিভার্স এখনো হাইপোথেটিকাল কনসেপ্ট তবুও এটাকে পাগলামী বলে উড়িয়ে দেওয়ার কিছুই নেই।যারা ভাবছেন,এতগুলো মহাবিশ্ব তৈরির উদ্দেশই কি,তাদেরই বলি, এটি আমাদের অস্তিত্বকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে।যেমন-লক্ষ্ম-কোটি শুক্রাণু হতে শুধুমাত্র কেন একটি শুক্রাণু হতেই আপনি অস্তিত্বে এসেছেন?তাহলে কি বলা যায়না,লক্ষ্ম-কোটি শুক্রাণুর মধ্যে অন্তত একটি দ্বারা সন্তান জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে।শুধু পৃথিবীই একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ,তাহলে বাকিগুলোরই প্রয়োজন কি?এত গ্রহ থাকার জন্যই আপনি বুঝতে পারছেন,কেন পৃথিবীই বাসযোগ্য।সূর্যই তো আমাদের প্রয়োজনে আসে,বাকি নক্ষত্রের ভূমিকা কি?
তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, যদি শুধুমাত্র একটি মহাবিশ্ব থাকত, তাহলে সম্ভবত এতে প্রাণ থাকার কথা নয়। কিন্তু অসংখ্য মহাবিশ্বে অন্তত একটি মহাবিশ্বে জীবনের উপস্থিতির জন্য যথেষ্ট “সম্ভাবনা” রয়েছে।তাই মাল্টিভার্স থাকুক না থাকুক,তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু এই তত্ত্বটি বিশেষভাবে জোড়ালো নয় , তাই অধিকাংশ বিজ্ঞানী মাল্টিভার্সের ধারণা নিয়ে সন্দিহান থাকেন।
- What is multiverse theory?Live Science
- This Is Why The Multiverse Must Exist, Forbes
- Description & Origins of Inflation Theory, ThoughtCo
- String Theory May Create Far Fewer Universes Than Thought, Live Science
- Hypothesis of the Hidden Multiverse Explains Dark Matter and Dark Energy, Journal
- CMB could be evidence for a multiverse, room.Eu.com
আমরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মহাবিশ্বকে দেখি?