মানুষ হলো প্যাটার্ন অনুসন্ধানকারী প্রাণী। আমরা এ জটিল,অদ্ভুত ও আনুষঙ্গিক বিশ্বে মিনিং সার্চ করি। কিন্তু আমরা গল্প বলা প্রাণী। চার হাজার বছর পূর্বে আমাদের মিথ ও ধর্মগুলো আমাদের গল্পের মধ্যেই মিনিংফুল প্যাটার্ন অনুসরণ করে বাস্তবতা লাভ করেছিল। যে গল্পগুলোর মধ্যে আছে ঈশ্বরবৃন্দ, ঈশ্বর, অতিমানবিক সত্তা এবং রহস্যময় ফোর্স। মানুষের ছিল অন্য মানুষ আর ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক এবং এই মহাবিশ্ব মানুষের অবস্থান। আর এটা একটা কারণ যে জন্য মানুষ আজও ম্যাজিক্যালি চিন্তা করতে পছন্দ করে, আমাদের বৈজ্ঞানিক চিন্তার বয়স হয়েছে কয়েকশত বছর মাত্র। প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর এ মহাবিশ্বে কী করেছি? আমাদের ব্রেন সে বিজ্ঞানহীন ভিন্ন সময়ের গ্রহটিতে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছিল তার সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার জন্য?
এ সমস্যাটি ফেস করেছেন ইভল্যুশনারী সাইকোলজিস্টরা৷ যারা ব্রেনকে বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা করেন। তারা একটি যৌক্তিক দাবি উপস্থাপন করলেন যে, অস্ট্রালোপিথেসাইনদের ছোট আকারের ব্রেন থেকে আধুনিক হোমো সেপিয়েন্সদের এই তরমুজ আকৃতির মস্তিষ্কটি বিবর্তিত হতে প্রায় ২ মিলিয়ন ( ২০ লাখ) বছর সময় লেগেছে। আর আমাদের সিভিলাইজেশন জাগ্রত হয়েছে মাত্র ১৩,০০০ বছর পূর্বে। মানুষ সিভিলাইজড হওয়ার সাথে সাথে ৯৯% উদ্ভিদ ও প্রাণী গৃহপালিত উদ্ভিত ও প্রাণিতে রূপান্তরিত হয়।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের মস্তিষ্কে স্পেশালাইজড কম্পিউটেশনাল ডিভাইসের বিশাল এক সংগ্রহ আছে। আমাদের পূর্বসূরি শিকারী সংগ্রাহকদের প্রাত্যহিক জীবনে মস্তিষ্কের এই কম্পিউটেশনাল ডিভাইসগুলির এক একটি এক এক উদ্দেশ্যে কাজ করে। মানুষ যেহেতু একে অন্যের সাথে একটি ইউনিভার্সাল আর্কিটেকচার / বিশ্বজনীন স্থাপত্য শেয়ার করেছে, তাই প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার নিজস্ব পছন্দ, উদ্দেশ্য, বিভাজিত কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক, ইমোশন প্রোগ্রাম, সুনির্দিষ্ট যুক্তিগঠন প্রক্রিয়া, বিশেষায়িত ব্যাখ্যাকরণ পদ্ধতি উন্নত করেছে__ যা আমাদের প্রকাশ্য সংস্কৃতির অন্তরালে থেকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা সৃষ্টি করে এবং যার নকশা মানব প্রকৃতির সুনির্দিষ্ট ডেফিনিশন তৈরি করে।
“How the mind work” নামক একটি বইতে স্টিভেন পিঙ্কার বলেছিলেন, এই স্পেশালাইজড কম্পিউটেশনাল ডিভাইসকে আমরা মেন্টাল মডিউল বলতে পারি। মডিউল শব্দটি এখানে রূপকার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে কেননা মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট কোনো অংশে এটি লোকেট করে না। আর ঊনিশ শতকের ফ্রেনোলোজিস্টদের দ্বারাও আমাদের আসলে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।। যারা মস্তিষ্কের এক একটি অংশের উপর এক একটি কার্যাবলী আরোপ করে। মডিউল বলতে পিঙ্কার যেটা বুঝিয়েছেন, মস্তিষ্ক বিভিন্ন এলাকায় বিভক্ত তবে ফাইবার দ্বারা ইন্টারকানেক্টেড যে জন্য মস্তিষ্কের প্রতিটি এলাকা ইউনিট হিসেবে কাজ করতে পারে। এখানে এক বান্ডেল নিউরন অন্য আর এক বান্ডেল নিউরনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে আমরা যে অগোছালো টানটান স্ফিতি এবং ফাটল দেখতে পাই তা সম্ভবত একটি মডিউল গঠন করতে পারে। এগুলোর আন্তঃসম্পর্কই মূলত মডিউলের কার্যক্রম বা ফাংশনের জন্য জরুরি, কোন লোকেশন নয়।
যেখানে অধিকাংশ মেন্টাল মডিউলকে পুরোপুরি সুনির্দিষ্ট মনে করা হয়, যাইহোক, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা নির্দেশনা দিচ্ছেন যে, আমাদের মানসিক মডিলউগুলো “ডোমেইন স্পেসিফিক ভার্সাস ডোমেইন জেনারেল”। টোবু, কোসমাইড এবং পিঙ্কার ডোমেইন-জেনারেল প্রসেসরকে অস্বীকার করেছেন, যেখানে বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানী গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স ধারণা গ্রহণ করেছেন, যেটাকে “g” বলে ডিফাইন করা হয়। নৃতাত্বিক স্টিভেন মিথেন বলেন, ডোমেইন জেনারেল প্রসেসরই আমাদের মানুষ করেছে। বিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, মনকে অনেকটা চাইনিজ আর্মি নাইফের (ছুরি) মতো করে ডিজাইন করা, যেন সেখানে জ্ঞানগত তারল্য কাজ করে। চাইনিজ আর্মি ছুরির মধ্যে অনেকগুলো ছুরি একত্রে থাকে। সুযোগ মত যে কোন সময় কোন এক ধরণের ছুরির সুইচ অন করা যায়। আর তাই এ ছুরিগুলো পটেনশিয়াল। একের ভেতর অনেক গুলো সম্ভাবনা কাজ করে। যা এটিকে ব্যবহার করার জন্য নমনীয় করে তোলে। ঠিক তেমনি আমাদের মস্তিষ্কে অনেক সম্ভাব্য চিন্তা আছে যা আমাদের আধুনিক বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যে জন্য আমাদের মস্তিষ্কেও জ্ঞানীয় তারল্য কাজ করে।
মডিউলের রূপক ব্যবহার করা সত্ত্বেও আমি বলতে চাই যে, আমরা অধিক সাধারণ বিলিফ ইঞ্জিন হিসেবে বিবর্তিত হয়েছি, যার ফলে আমাদের মধ্যে ম্যাজিক্যাল চিন্তা কাজ করে__ এই ম্যাজিক বিলিফ ইঞ্জিন; ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যে সায়েন্টিফিক চিন্তারও নেতৃত্ব দেয়। আমরা চিন্তা করতে পারি যে বিলিফ ইঞ্জিন হলো আমাদের মস্তিষ্কের সেন্ট্রাল প্রসেসর, যেটি সুনির্দিষ্ট মডিউল হিসেবে একদম তলদেশে অবস্থান করে।
আসুন বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করি। আমরা দক্ষ প্যাটার্ন অনুসন্ধানকারী হিসেবে বিবর্তিত। আমরা সবসময় কার্যকারণ অনুসন্ধান করি। যে সকল মানুষ সবচেয়ে বেশি প্যাটার্ন শনাক্ত করতে পারে, তারা অধিক সংখ্যক সন্তান রেখে যেতে পারে। আমরা হলাম তাদের উত্তরসূরী।
প্যাটার্ন অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের সমস্যা হলো এজন্য আপনাকে জানতে হবে কোনটি মিনিংফুল আর কোনটি মিনিংফুল নয়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের মস্তিষ্ক এ পার্থক্যটি সবসময় করতে পারে না। এর কারণ হলো মিনিংলেস প্যাটার্নগুলো আমাদের কোন ক্ষতি করে না বরং এগুলো আমাদের জন্য ভালোকিছু করে, এ ধরনের মিনিংলেস প্যাটার্ন অনিশ্চিত সময়ে আমাদের উত্তেজনা হ্রাস করতে সহযোগিতা করে। আর এজন্য আমরা দু-ধরণের ভুল উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। টাইপ 1 এরর: ভুল কোনোকিছুতে বিশ্বাস করা। টাইপ 2 এরর: সত্যকে অস্বীকার করা। যদিও ভুল কোনোকিছু বিশ্বাস অথবা সত্যকে অস্বীকার করলে আমরা অপরিহার্যভাবে মৃত্যুবরণ করি না, এজন্য এগুলো চিরস্থায়ীভাবে আমাদের মস্তিষ্কে রয়ে গেছে। বিলিফ ইঞ্জিন এমন একটি প্রকৌশল হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে, যেটি আমাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে। কারণ যদিও আমরা Type 1 ও Type 2 ভুল করি কিন্ত আমরা আরও একটি কাজ করি যেটাকে বলে Type 1 Hit: মিথ্যাকে অবিশ্বাস করো এবং Type 2 Hit: সত্যকে বিশ্বাস করো।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে মস্তিষ্কের স্পেসিফিক ও জেনারেল দু-ধরণের মডিউলই থাকে। বিলিফ ইঞ্জিন হলো ডোমেইন জেনারেল প্রসেসর। এটি প্রকৃতপক্ষে, সকল মডিউলের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ কারণ এটি আমাদের শিক্ষার মূল কেন্দ্র। সবশেষে আমরা আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে একটা কিছু বিশ্বাস করি, এ বিশ্বাস আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখি। কিন্তু বিশ্বাস গঠনের প্রসেস একটি জেনেটিক্যাল হার্ডওয়্যার। এবার আসুন আমরা এ সত্যটি গণনায় নেই, বিলিফ ইঞ্চিন Type1 ও Type 2 ভুল করতে সক্ষম আবার সে Type1 Hit এবং Type2 Hit করতেও সক্ষম। আমরা দুটি পরিস্থিতি বিবেচনা করতে পারি, যেগুলোর অধীনে আমরা বিবর্তিত হয়েছিলাম।
১) ন্যাচারাল সিলেকশন: বিলিফ ইঞ্জিন আমাদের সার্ভাইভালের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি মেকানিজম। শুধুমাত্র বিপজ্জনক ও সম্ভাব্য প্রাণঘাতী পরিবেশকে শেখার জন্যই নয় (যেখানে টাইপ ১ ও টাইপ ২ হিট আমাদের সার্ভাইভ করতে সাহায্য করে), এটি পরিবেশ সম্পর্কে ম্যাজিক্যাল থিংকিং- এর মাধ্যমে আমাদের অনিশ্চয়তা হ্রাস করে। এরকম প্রমাণ আছে যে ম্যাজিক্যাল থিংকিং আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে উত্তেজনা হ্রাস করে। মেডিক্যাল অ্যাভিডেন্সে দেখা গেছে প্রার্থনা, ধ্যান এবং উপাসনা আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য রাখে। আমাদের কাছে নৃতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে যে, ম্যাজিশিয়ান এবং শামান এবং যে সকল রাজা তার পাশে এদের রাখে, তারা অধিক সংখ্যক মানুষের সাথে সহবাস করার সুযোগ পায় এবং ম্যাজিক্যাল থিংকিং- এর মাধ্যমে তারা তাদের জিনকে সম্প্রসারিত করে।
২) স্প্যান্ড্রেলঃ আমাদের বিলিফ ইঞ্জিনের একটি অংশ হিসেবে ম্যাজিক্যাল থিংকিং এর একটি স্প্যান্ড্রেলও আছে। স্টিফেন জে গুল্ড এবং রিচার্ড লেওনটিন এই রূপক ব্যবহার করেছেন, আমাদের Evolved Mechanism-এর একটি ইভল্যুশনারী বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে। তাদের বিখ্যাত পেপার “The Spandrels of San Macro and The panglossian Paradigm: A Critique of Adaptationist Programme” এ গুল্ড ও লেওনটিন এ আর্কিটেকচার ব্যাখ্যা করেন, একটি সরু ত্রিভাজাকৃতির স্থান, যেগুলো সমকোণে খিলান। একটি মধ্যযুগীয় পরিত্যাক্ত গীর্জা, যেটি বিভিন্ন উদ্দেশ্যমূলক নকশায় পরিপূর্ণ, যেটাকে দেখলেই আমাদের মনে হবে কোনকিছু বিশ্লেষণের সূচনাবিন্দু, এক্ষেত্রে বিশেষ করে চারপাশের স্থাপত্য। কিন্তু এটা আপনার বিশ্লেষণের সঠিক পথ উলটে দেয়। স্প্যান্ড্রালের উদ্দেশ্য কী__এ প্রশ্ন এমন যে পুরুষের নিপল থাকার অর্থ কী? সঠিক প্রশ্ন হলো , কেন নারীদের নিপল রয়েছে। এর উত্তর হলো নারীদের উচিত তাদের বাচ্চাকে লালন পালন করা। আর নারী ও পুরুষ দুজনকেই একই আর্কিটেকচারাল ফ্রেমে তৈরি করা হয়েছে। প্রকৃতির জন্য সম্পূর্ণ আর্কিটেকচার রি-কনফিগার করার পরিবর্তে মূল্যহীন নিপল তৈরি করা সহজ।
এই সেন্স থেকে আমাদের ম্যাজিক্যাল থিংকিং, যেটি আমাদের বিলিফ ইঞ্জিনের একটি অংশ, সেটি বিবর্তিত হয়েছে স্প্যান্ড্রেল থেকে। আমরা ম্যাজিক্যালি চিন্তা করি কারণ আমরা কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে চিন্তা করি। আমরা টাইপ ১ এবং টাইপ ২ এরর করি কারণ আমাদের প্রয়োজন টাইপ ১ এবং টাইপ ২ হিট করা। আমাদের মধ্যে ম্যাজিক্যাল থিংকিং ও কুসংস্কার কাজ করে কারণ আমাদের সুক্ষ্মচিন্তা ও প্যাটার্ন আবিষ্কার করতে হয়।
এ দুটি একে অন্যের চেয়ে আলাদা নয়। ম্যাজিক্যাল চিন্তা হলো কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে চিন্তা করার জন্য আমাদের মস্তিষ্কে বিবর্তিত একটি প্রয়োজনীয় বাইপ্রোডাক্ট। মাইকেল শেরমা “Why people Believe in God” গ্রন্থে এই প্রসঙ্গটির আরও সম্প্রসারিত ভার্সন আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছেন।
তিনি তার “Why People believe in Weird things” বইতে আমাদের পূর্বসূরীদের ম্যাজিক্যাল চিন্তাগুলো কীভাবে আধুনিক মানুষের মধ্যে কাজ করে সেটি দেখিয়েছেন। UFO, অ্যালিয়েন অ্যাবডাকশন, ESP অথবা অন্যান্য সাইকিক ফেনোমেনায় বিশ্বাস করাটাকে বলা হয় Type 1 এরর: তারা ভুল কিছু বিশ্বাস করে। সৃষ্টিবাদী ও হলোকাস্ট অস্বীকারকারীরা Type 2 এরর করে: তারা সত্যকে অস্বীকার করে। এর মানে এই নয় যে এই লোকেরা অজ্ঞ অথবা অজ্ঞাত; তারা বুদ্ধিমান কিন্তু ভুল তথ্য প্রাপ্ত। তাদের চিন্তা ভুল পথে যাচ্ছে।
টাইপ ১ এবং টাইপ ২ ত্রুটিগুলো টাইপ ১ এবং টাইপ ২ হিটকে অবদমন করে রাখে। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ প্রমাণ আছে যা আমাদের বলছে বিলিফ ইঞ্জিন ক্ষতিকর। সুক্ষ্মচিন্তা শেখানো সম্ভব। সন্দেহবাদ শিক্ষাযোগ্য। টাইপ ১ ও টাইপ ২- ত্রুটিগুলোকে শাসন করা যায়। মাইকেল শের্মার বলেন, এরকম অসংখ্য বিশ্বাস শোষণ করার পর আমি সন্দেহবাদী হয়েছি, আমি পুনরায় সন্দেহবাদী হিসেবে জন্ম নিয়েছি।