Can't find our books? Click here!
ভালোবাসা একটি ডিফেন্স মেকানিজম

ভালোবাসা একটি ডিফেন্স মেকানিজম

ভালোবাসা হলো স্বার্থপরতার একটি প্রকাশ। জেনেটিক্যালি আমরা স্বার্থপর, তাই আমরা ভালোবাসি। ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা আমাদের জিনকে প্রিজার্ভ করতে চাই। উদাহরণস্বরূপ, ক্যানিভাল মাকড়সা যখন সেক্স করে, তখন স্ত্রী মাকড়সা তাকে জীবন্ত খেয়ে ফেলে। আর এতে করে সে পুরুষের শরীর থেকে এক্সট্রা নিউট্রিয়েন্টস পায়। নারীটি যখন পুরুষের মাথাটি খায়, তখন পুরুষটির যৌন অনুভূতি ও ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। পুরুষ ক্যানিভাল ভালোবাসার মাধ্যমে, তার জিনকে প্রোটেক্ট করার জন্য একটি ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি করে, আর এ ডিফেন্স মেকানিজমের অংশ হিসেবে সে নিজের দেহকে স্ত্রীর কাছে উৎসর্গ করে।

বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভালোবাসার উদ্দেশ্য কেবল সেক্স নয়, ভালোবাসার উদ্দেশ্য নিজের জিনকে প্রিজার্ভ করা। কোকিল যখন কাকের বাসায় ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটে, তখন বেবি কোকিল সর্বপ্রথম কাকের ডিমগুলোকে ভেঙে ফেলে। কারণ কাক ও কোকিলের জিন পৃথক। আমরা পরিবারকে ভালোবাসি, আমরা বন্ধুদের ভালোবাসি এবং আমরা সমাজকে ভালোবাসি। এ সকল ভালোবাসার সাথে সেক্সের কোনো সম্পর্কই নেই।

আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি কারণ সে আমার ৫০ শতাংশ জিন ধারণ করছে, আমি আমার চাচাতো ভাইকে ভালোবাসি কারণ সে আমার ২৫ শতাংশ জিন ধারণ করে। আমি আমার বন্ধুকে ভালোবাসি কারণ আমার বন্ধুদের সাথে আমার সুসম্পর্ক আমাকে শত্রুর বিপক্ষে লড়াই এবং জীবনে সফলতা অর্জনে সহযোগিতা করে, আমি আমার সমাজকে ভালোবাসি কারণ সামাজিক শক্তির সাথে একত্ব আমাকে একটি কমিউনাল ফোর্স প্রদান করে, যে ফোর্স ব্যবহার করে, আমার পূর্বসূরিরা সিংহ ও বাঘের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, যে ফোর্স আমার পরিবারকে প্রোটেক্ট করেছিল, যে ফোর্সের মাধ্যমে আমাদের জিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মে সঞ্চালিত হয়েছিল। আর আমি আমাকে ভালোবাসি কারণ আমি আমার ১০০ ভাগ জিন ধারণ করি, আমার পরিবারে আমার জিন উপস্থিত ছিল বলেই, আমি বন্ধুত্ব করেছি এবং সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। এখন চিন্তা করে দেখুন, আমার ১০০ ভাগ জিনের প্রতি আমার কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকা উচিত? বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে, ভালোবাসার উদ্দেশ্য সেক্স নয়, ভালোবাসার উদ্দেশ্য মাল্টিডায়মেনশনাল। ভালোবাসা হলো একটি ডিফেন্স মেকানিজম।

কেবল ক্যানিভাল মাকড়সাই যে জেনেটিক ভালোবাসার জন্য জীবন দেয় তাই নয়। আমরা সবাই ভালোবাসার জন্যই জীবন দেই। যেমন আমাদের পূর্বসূরীদের কেউই আজ পৃথিবীতে নেই কিন্তু আমাদের দেহে তাদের জিন রয়ে গেছে। ভালোবাসার উদ্দেশ্য ছিল জিনের অমরত্ব, কোনো দেহের অমরত্ব নয়, ভালোবাসার উদ্দেশ্য ছিল নিউক্লিক অ্যাসিড অথবা ইনফরম্যাশনের গতিশীলতা। আমাদের জিনোম আর কিছুই নয়, আমাদের পূর্বসূরীদের ইনফরম্যাশন। এ ডিফেন্স মেকানিজম আমাদের দেহকে অমরত্ব দেয়নি, আমাদের দেহে প্রাকৃতিকভাবে শক্তিশালী কোনো ইমিউন সিস্টেম তৈরি করেনি কারণ একটি শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম একটি দেহের অমরত্ব নিশ্চিত করলেও, প্রজনন সফলতা কমিয়ে দেয়। ভালোবাসার নামক এ প্রযুক্তির উদ্দেশ্য ছিল, দেহকে কম্প্রোমাইজ করে, জেনেটিক সফলতা বৃদ্ধি করা।

আর তাই আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর দেহকে কম্প্রোমাইজ করছি, আমাদের জিন, আমাদের দেহে কোনো শক্তিশালী ইমিউন সিস্টেম তৈরি করেনি, আমাদের সে সংক্ষিপ্ত ডিউরেশনের একটি দৈহিক প্রকৌশল দিয়েছে, যেন আমরা আমাদের জিনকে ভবিষ্যতে হস্তান্তর করে মরে যেতে পারি।

রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন গ্রন্থে হাইপোথিসাইজ করেছিলেন, একজন মানুষের বয়স যখন বেড়ে যায়, তখন তার প্রজননের সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং এ সময় তার দেহে ডেথ জিন অ্যাকটিভেট হয়। তার ডিএনএ নিজেই নিজেকে হত্যা করার জন্য, কিছু জিনকে এক্সপ্রেস অথবা কিছু জিনকে সাপ্রেসড করে। শরীর নিজেই আনকনসাসলি নিজেকে নিজে মেরে ফেলার জন্য রেডি হয়। উদাহরণস্বরূপ, BRCA1 and BRCA2 জিনের কথা বলা যায়। এ দুটি জিন ডিএনএ-কে রিপেয়ার করে। কোনো কারণে যদি এই জিনে মিউটেশন ঘটে, ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। TP53 হলো টিউমার সাপ্রেসর জিন, এই জিনে মিউটেশন ঘটলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। DICER1 নামক একটি জিন আছে, যেটি “microRNAs” তৈরি করে, এটি একটি ক্ষুদ্র আরএনএ অণু, যেটি জিনের এক্সপ্রেসন নিয়ন্ত্রণ করে। এ জিনের মিউটেশন বিভিন্ন রোগ, অকাল বার্ধক্য এবং ক্যান্সার তৈরি করে। FOXO3A জিন কোষের মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করে, এ জিনের কোনো মিউটেশন ঘটলে, বিভিন্ন বয়সঘটিত সমস্যা দেখা যায়। একটি দেহ যখন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সন্তান উৎপাদন করে অথবা বৃদ্ধ হয়ে যায়, তখন জনসংখ্যার ঘনত্ব হ্রাস করে, পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য, দেহটি নিজেই নিজেকে জেনেটিক লেভেল থেকে মেরে ফেলে। এটাই হলো একজন মানুষের জেনেটিক ভালোবাসার চরম রূপ। একটি দেহের বয়স হওয়ার পর মেনোপজ ও অ্যান্ডোপজ নামক দুটি কন্ডিশন তৈরি হয়, যখন তারা আর সন্তান জন্ম দিতে পারে না। ন্যাচারাল সিলেকশন এ বৈশিষ্ট্যটি নির্বাচন করেছে, পরিবারের শিশু-কিশোরদের দেখাশুনা করার জন্য নার্সের প্রয়োজনীয়তা থেকে।

প্রকৃতিতে সবাই ভালোবাসার জন্য জীবন দেয়, প্রকৃতিতে সবাই নিজের জিনকে ডিফেন্স করার জন্য পরিচালিত হয়, কিন্তু এটি বিশাল সময়ের স্কেলে ঘটে বলে,  আমরা এটাকে বিস্ময়কর মনে করি না। আমরা ক্যানিভাল মাকড়সার আত্মহুতি দেখে বিস্মিত ও আতঙ্কিত হই এবং আমরা তাকে বোকা মনে করি কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না যে, জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সবাই ক্যানিভাল। ক্যানিভালের সাথে আমার পার্থক্য হলো, সে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই জীবন দেয়, আর আমরা একটি দীর্ঘ সময় ধরে মরি, আমাদের মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি সূক্ষ্ম ও দীর্ঘায়িত, আমাদের মৃত্যুকে যেন, প্রকৃতিতে স্লো করে দেখানো হয়, আমাদের মৃত্যু আরও বেশি গভীর ও বিমূর্ত। আমরা ভালোবাসা পেলে সুখী হই, আমরা ভালোবাসতে ভালোবাসি এবং আমরা ভালোবাসার জন্য ড্রাগ গ্রহণ করি ও আত্মহত্যা করি। আর এ সবটাই একটি জটিল ও সুবিস্তৃত ডিফেন্স মেকানিজম।

দুজন মানুষ যখন একে অন্যের জেনেটিক স্বার্থকে সমর্থন করে, তখন তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আপনি আমার জিনকে সাপোর্ট করেন, তাই আপনি আমার বন্ধু, আপনি আমার জিনকে ভালোবাসেন না, তাই আপনি আমার শত্রু। আর ভালোবাসা হলো শত্রুর বিপক্ষে একটি ডিফেন্স মেকানিজম। এ পদ্ধতিতে, ভালোবাসাই এ পৃথিবীতে যুদ্ধ তৈরি করে। ভালোবাসা হলো মানুষের আত্মরক্ষার হাতিয়ার, আর ভালোবাসা হলো মানুষের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা।  

একটি ভাইরাস এজন্যই অ্যান্টিভাইরাসের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলে,  কারণ মেকানিক্যালি তার জিনের প্রতি তার একটি ডিফেন্স মেকানিজম কাজ করে বা ভালোবাসা। আপনি যদি ভাইরাসটিকে আক্রমণ করতে চান, তবে তার ডিফেন্স মেকানিজমে আঘাত করতে হবে। একইভাবে, একটি মানুষ টিকে থাকে ভালোবাসার মাধ্যমে, আপনি যদি তার এ অস্ত্র কেড়ে নেন, আপনি যদি তার এই মেকানিজমে আঘাত করেন, সে শেষ হয়ে যাবে। আপনি ভালোবাসাকে একটি অদৃশ্য আবেগ হিসেবে দেখেন কিন্তু আমি ভালোবাসাকে দেখছি একটি অ্যালগরিদম হিসেবে। একটি অ্যালগরিদম যেমন কোনো একটি সমস্যা সমাধান করার জন্য এক সেট ইনস্ট্র্যাকশন মেনে চলে। ভালোবাসাও লক্ষ্য অর্জনের জন্য এক সেট ইনস্ট্রাকশন যেমন প্রজনন ও সামাজিক বন্ধন। ভালোবাসার মেকানিক্যাল টেন্ডেন্সি প্রকৃতির সেলফ রেফ্লিকেশনের একটি সহজাত প্রকাশ।

একটি কম্পিউটারের যেমন অজস্র সার্কিট ও ফাংশন থাকে, ভালোবাসারও অজস্র সার্কিট ও ফাংশন আছে। মেকানিক্যালি ভালোবাসা হলো ফিজিক্স ও রসায়নের নিয়ম চালিত একটি জেনেটিক্যাল টেন্ডেন্সি, যার উদ্দেশ্য জীবনের মৌলিক ও অখণ্ড একক প্রিজার্ভ করা। উদাহরণস্বরূপ, ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়ে গেছে কিন্তু তার জেনেটিক ইনফরম্যাশন সেলফ রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়ায় এখনো রয়ে গেছে, জীবনের এ জেনেটিক কোড এভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে টিকে থাকে।

ভালোবাসা হলো একটি প্রতিসাম্যতা। আপনি একটি স্নোফ্ল্যাককে যে দিকেই মুভ করেন, এটি দেখতে একই থাকবে। ঠিক তেমনি ভালোবাসার প্রকাশ সেক্স, বন্ধুত্ব অথবা সামাজিক একত্ব যাইহোক, এর একটি জেনেটিক প্রতিসাম্যতা আছে, আর তা হলো “সেলফ রেপ্লিকেশন”। ভালোবাসা একটি জেনেটিক ডিফেন্স মেকানিজম তার সাপেক্ষে কিছু প্রমাণ:

  • পাখিদের মধ্যে একগামী সম্পর্ক: অসংখ্য পাখি একগামী বন্ধন প্রদর্শন করে। যেখানে তারা দীর্ঘকালীন যুগল ভালোবাসার পার্টনারশিপ গড়ে তোলে। এ দৃঢ় বন্ধন  কেবল আবেগীয় সংযোগকেই শক্তিশালী করে না, এটি একটি ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে কাজ করে। যেমন একসাথে বাসা তৈরি, ডিমে তা দেয়া, সন্তান লালন পালন করা, যা সন্তানের টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। তারা একসাথে শত্রুর পক্ষ থেকে তাদের বাসা সুরক্ষা করে এবং তাদের সন্তানদের উন্নত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। 
  • স্তন্যপায়ীদের মধ্যে প্যারেন্টাল কেয়ার: সিংহ ও নেকড়ের মতো স্তন্যপায়ী প্রজাতি তাদের সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য বিপুল সময় ইনভেস্ট করে। এ ধরনের প্যারেন্টাল কেয়ারের জন্য গভীর ভালোবাসার অনুভূতি ও আকর্ষণ প্রয়োজন হয়। প্রোটেকশন প্রদান, গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা শেখানো এবং সম্পত্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে, তারা সন্তানের টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। ভালোবাসা চালিত ডিফেন্স মেকানিজমের কারণে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে জ্ঞান হস্তান্তরিত হয়, দলে ঐক্য তৈরি হয় এবং প্রজাতির অস্তিত্ব সংরক্ষিত থাকে।
  • সিমবায়োটিক রিল্যাশনশিপ: সিমবায়োটিক সম্পর্কেও ভালোবাসা দেখা যায়। যেখানে একটি প্রজাতি টিকে থাকার জন্য সরাসরি অন্য প্রজাতির ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ছোট ক্লিনার ফিশ এবং বড় হোস্ট ফিশ। ক্লিনার ফিশ হোস্ট ফিশের দেহ থেকে প্যারাসাইট ও ডেড স্কিন অপসারণ করে। এতে উপকার হলো, ক্লিনার মাছ বাহক মাছের দেহের প্যারাসাইট ও স্কিন পরিস্কার করে, সেগুলো খাবার হিসেবে গ্রহণ করে, আর বাহক মাছের দেহে প্যারাসাইট ও ডেড স্কিন মুক্ত থাকে। এটি একটি মিচুয়াল ভালোবাসার সম্পর্ক, যেটি তাদের কল্যাণ ও টিকে থাকা নিশ্চিত করে।
  • প্রাইমেটদের সামাজিক বন্ধন: শিম্পাঞ্জি ও বনবোর সামাজিক কাঠামো জটিল এবং তারা শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন তৈরি করে। এ বন্ধন তৈরির জন্য তারা একে অন্যের প্যারাসাইট পরিস্কার করে, শারীরীক কনভার্সেশন করে এবং সমাজবদ্ধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। এই ভালোবাসা এবং বন্ধন দলকে একটি সামগ্রিক সহযোগী নেটওয়ার্ক প্রদান করে এবং প্রতিরক্ষা করে। বিপদ অথবা দ্বন্ধের সময়, যে সকল ব্যক্তির শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন আছে, তারা অধিক সমর্থন পায় এবং এতে করে তাদের টিকে থাকার ক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস পায়।
  • মৌমাছি দ্বারা পরাগায়ন: ফুল ও মৌমাছির মতো গভীর ভালোবাসার সম্পর্কের প্রদর্শনী ভালোবাসা ভিত্তিক ডিফেন্স মেকানিজমের একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। মৌমাছি ফুলের কম্পমান রঙ, গভীর ঘ্রাণ এবং নেকটার দ্বারা আকৃষ্ট হয়। যখন মৌমাছি ফুলের নেকটারে ভিজিট করে, তারা নিজের অজান্তে পরাগরেণু হস্তান্তর করে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে। এটি ফুলের ক্রস-পলিনেশন এবং পুনরুৎপাদন সক্ষম করে তোলে। কোনো কোনো ফুল মৌমাছি ও ভ্রমরকে আকৃষ্ট করার জন্য, তার বয়ফ্রেন্ড অথবা গার্লফ্রেন্ডের চেহারা মিমিক্রি করে। তখন ফুলটিকে দেখতে তার প্রেমিকের মতো মনে হয় এবং অনেক সময় ফুলের মধ্যে সেক্সচুয়াল রসায়ন উপস্থিত থাকে, যেজন্য মৌমাছি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেক্স করে এবং এভাবে তার গায়ে ফুলের পরাগ লেগে যায়। ভালোবাসা চালিত এই পলিনেশন ফুলের জিনগত বৈচিত্র্যতা ও টিকে থাকা নিশ্চিত করে।

ভালোবাসা লিনিয়ার কোনো রিয়েলিটি নয়। ভালোবাসা সুনির্দিষ্ট কোনো নিউরোট্রান্সমিটার দ্বারা পরিচালিতও নয়, মস্তিষ্কে এমন কোনো নিউরোট্র্যান্সমিটার নেই, যেটাকে আমরা বলতে পারি এটাই ভালোবাসার কারণ। কাউকে খুন করাও ভালোবাসার প্রকাশ হতে পারে কারণ তার সাথে আমাদের জেনেটিক কন্ট্রাডিকশন ছিল। কোনো একটি দেশের বিপক্ষে যুদ্ধ করাও ভালোবাসার প্রকাশ হতে পারে,  কারণ তারা আমার সাথে সিমবায়োটিক রিল্যাশনশিপ গড়ে তুলতে পারেনি। কাউকে অপছন্দ ও ঘৃণা করাও ভালোবাসার প্রকাশ হতে পারে, কারণ আমি সে সকল অপছন্দের মানুষ দ্বারা আমাকে কষ্ট দিতে চাই না। কারও পক্ষ থেকে কষ্ট পাওয়াটাও ভালোবাসার প্রকাশ হতে পারে কারণ কষ্ট আমাকে কষ্টের সোর্স  থেকে দূরে রাখে, আমার মাঝে ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি হয়। বিষাক্ত কোনো টক্সিন অথবা ব্যাথার অনুভূতিও ভালোবাসার প্রকাশ হতে পারে কারণ ব্যাথা আমাকে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ও উদ্দীপনা থেকে সুরক্ষা করে।  

এ সকল অনুভূতির এক একটি এক একরকম নিউরোট্র্যান্সমিটার ও হর্মোন দ্বারা পরিচালিত যেমন, কর্টিসল, ডোপামিন, সেরেটনিন, অক্সিটোসিন এবং এন্ডোরপিন ইত্যাদি। একই নিউরোট্র্যান্সমিটার পরস্পরবিরোধী আচরণও করতে পারে। কিন্তু সকল বিরোধ ও বৈশাদৃশ্যপূর্ণ ইন্টারেকশনের উদ্দেশ্য একটাই আর তা হলো জিনকে প্রোটেক্ট  করা।

সব ভালোবাসার সাথে রোম্যান্টিক প্রেমের কেমেস্ট্রি জড়িত থাকবে তা ঠিক  নয়। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে, আমি শত্রুপক্ষের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করতে পারি। এখানে আগ্রাসন ভালোবাসারই একটি এক্সপ্রেসন। ভালোবাসার ডিফেন্স মেকানিজম সুনির্দিষ্ট কোনো নিউরোট্র্যান্সমিটার দ্বারা পরিচালিত নয়, এটি অসংখ্য নিউরোট্র্যান্সমিটারের পরস্পরবিরোধী একটি কো-অর্ডিনেশন।

আপনি দৃশ্যমানভাবে কখনো বুঝতেই পারবেন না যে, একটি হিংস্র ও ভয়াবহ পারমাণবিক যুদ্ধের পেছনে, কোনো না কোনোভাবে ভালোবাসার হাত আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সেক্স ও ভালোবাসা এক বিষয় নয়। আগ্রাসন যেমন ভালোবাসার একটি এক্সপ্রেসন, সেক্সও ভালোবাসার একটি এক্সপ্রেসন কিন্তু এদের কোনোটাই সামগ্রিক ভালোবাসার প্রযুক্তিকে রিপ্রেজেন্ট করে না।

ভালোবাসা কোনো ইমোশন নয়, এটি একটি হার্ডওয়্যার

হেলেন ফিশার মনে করেন, ভালোবাসা মানব মনের নিছক কোনো আবেগ নয়, এটি একটি প্রোগ্রাম। তিনি বলেছিলেন, ভালোবাসা হলো একটি বায়োলজিক্যাল ড্রাইভ। একটি কম্পিউটার অ্যালগরিদম লেখা হয় বিভিন্ন ইনস্ট্র্যাকশনের মাধ্যমে, কিন্তু এ অ্যালগোরিদমের একটি উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হলো কোনো একটি সমস্যার সল্যুশন।

মনে করুন, আমি কফি তৈরির জন্য ব্লেন্ডিং মেশিন তৈরি করলাম, আমি সেটাকে ইনস্ট্র্যাকশন দিলাম, দুধ, চিনি ও কফি মিশ্রিত করে এক কাপ কফি তৈরি করে দাও। সে আমার ইনস্ট্র্যাকশনগুলো স্টেপ বাই স্টেপ অনুসরণ করবে এবং আমাকে একটি কফি তৈরি করে দেবে। কারণ আমি কফির সল্যুশন বের করার জন্য এ প্রোগ্রামটি লিখেছি।

এখন মনে করুন, আমি একটি বনবোকে বললাম, তুমি একটি প্রোগ্রাম লিখ, যার মাধ্যমে আজ থেকে ১০ মিলিয়ন বছর পরও তোমার জিনকে এ পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখা যায়! সে আমাকে একটি অ্যালগরিদম লিখে দিল আর তা হলো “ভালোবাসা”। এই অ্যালগোরিদমের ইনস্ট্র্যাকশন হলো, পরিবারকে সমর্থন কর, বন্ধুদের সমর্থন কর, সমাজকে সমর্থন কর, যারা তোমাকে অসমর্থন করে, তাদের অসমর্থন কর অথবা তাদের সাথে কৌশল অনুসরণ কর, তোমার প্রেমিকাকে সমর্থন কর, তোমার কমিউনিটির সাথে প্রজনন কর এবং তোমার সন্তানকে সুরক্ষা কর।  

সে আমাকে পরামর্শ দিল, আমি যদি স্টেপ বাই স্টেপ ভালোবাসার মাধ্যমে সমাজের মস্তিষ্কে ডোপামিন ও অক্সিটোসিন ছড়িয়ে দিতে পারি, তাহলেই সমাজ কানেক্ট হয়ে যাবে, সমাজে কনফ্লিকশন হ্রাস পাবে এবং সল্যুশন হিসেবে জেনেটিক ইনফরম্যাশন মিলিয়ন মিলিয়ন বছর টিকে থাকবে। অন্যভাবে, আপনি ভালোবাসাকে একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স হিসেবেও চিন্তা করতে পারেন। একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সরল কিছু ইনস্ট্র্যাকশন অনুসরণ করে এবং জটিল জটিল সমস্যা সমাধান করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসা হলো জেনেটিক প্যারাডক্স সমাধান করার একটি মেশিন।

ভালোবাসা এমন কোনো টপিক নয়, যা আমরা অনুভব করি, আমরা ভালোবাসি কারণ আমরা ভালোবাসতে বাধ্য, আমরা প্রোগ্রামড।

এখন আমরা আসি রোম্যান্টিক ভালোবাসার প্রসঙ্গে, যেটি প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির সাথে সরাসরি জড়িত। হেলেন ফিশার ভালোবাসার তিনটি স্তর পৃথক করেছেন: লাস্ট, অ্যাট্র্যাকশন ও অ্যাটাচমেন্ট। এগুলো হলো রোম্যান্টিক ভালোবাসা নামক অ্যালগরিদমটির এক একটি স্টেপ, যেগুলো প্রেডিক্টেবল উপায়ে কাজ করে।

একটি ভালোবাসার সম্পর্ক শুরুর পূর্বে লালসা কাজ করে, আমরা তখন তাকে শারীরীকভাবে কাছে পেতে চাই। দ্বিতীয় পর্বে, আমরা আকর্ষণ অনুভব করি, আমরা তার সাথে আবেগীয় বন্ধন গঠন করি। তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে, আমরা ভালোবাসার মানুষের সাথে সংযুক্ত হতে চাই এবং তার সাথে গভীর বন্ধন ও প্রতিশ্রুতি তৈরি করি।

এ প্রতিটি স্টেজ এক একটি হর্মোন ও নিউরোট্র্যান্সমিটারের সাথে জড়িত। লালসাকে পরিচালনা করে টেস্টোস্টেরন এবং ডোপামিন, যেটি উত্তেজনা ও সুখের সাথে জড়িত। আকর্ষণকে পরিচালনা করে অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন, যেটি বিশ্বাস ও বন্ধনের সাথে জড়িত। সংযোগ পরিচালনা করে কর্টিসল ও নরপাইনফ্রাইন, যেটি স্ট্রেস ও উত্তেজনার সাথে জড়িত। এ নিউরোট্র্যান্সমিটার আপনার মধ্যে গভীর একাকীত্ব ও চাপ তৈরি করবে, আপনাকে ভালোবাসার মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য উস্কানী দেবে।

একটি পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামের মতোই, এ নিউরোকেমিক্যালগুলো আপনার মস্তিষ্কে একটি ইনফিনিট লুপ তৈরি করে দেবে, আর আপনি প্রেমিকার কাছে আটকে যাবেন। ভালোবাসা একটি বায়োলজিক্যাল ড্রাইভ হওয়ার কারণে আপনি এটাকে যুক্তি অথবা বুদ্ধি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। মনে করুন, আপনার দেহে জন্মগতভাবে একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার আছে, এটাকে আপনি যুক্তি অথবা বুদ্ধি যাই উপস্থাপন করেন, দূর করতে পারবেন? এটা তো আপনার দেহের একটি জেনেটিক মেকাপ।

পানি ছাড়া যেমন পিপাসা দূর করা যায় না, অন্যের নিউরনের সাথে নিজের নিউরনের কানেকশন ছাড়া, ভালোবাসার ক্ষুধাও দূর করা যায় না। যুক্তি দিয়ে ইতিহাসে কোনো মানুষ পিপাসা অবদমন করেছে বলে জানা যায়নি। কারণ এটি আপনার মস্তিষ্কের কোনো চিন্তা বা আবেগ নয়, এটি আপনার মস্তিষ্কের একটি হার্ডওয়্যার। এটি একটি অ্যালগরিদম, যেটি ডিজাইন করা হয়েছে একটি সমস্যা সমাধান করার জন্য। আর আপনার দেহ হলো এ সমস্যাটি সমাধান করার একটি উপায়, আপনি এ অ্যালগরিদম বাস্তবায়নের জন্য ডিজাইন করা একটি সিস্টেম। আপনি ভালোবাসতে চান অথবা না চান, আপনাকে ভালোবাসতেই হবে। ভালোবাসা যদি একটি প্যারাসাইট হয়, আপনি হলেন সে প্যারাসাইটটির একটি হোস্ট। আপনি একটি খোলস।

এজন্য, আপনি মাঝেমাঝে এমন কাউকে ভালোবেসে বসতে পারেন, যে আপনার জন্য ক্ষতিকর অথবা যে আপনার জন্য পারফেক্ট কোনো মানুষ নয়। ভালোবাসার প্রশ্ন যখন আসে, তখন আপনার ব্রেন পরিপূর্ণভাবে লজিক্যাল থাকতে পারে না। একইসাথে ভালোবাসা অ্যাডিক্টিভ বা আসক্তিকর। আমাদের মস্তিষ্ক কোকেইন অথবা অ্যালকোহল দ্বারা যেমন আসক্ত হয়, সে রোম্যান্টিক ভালোবাসার কেমেস্ট্রি দ্বারাও আসক্ত হয়। আমরা পানি ভালোবাসি, আমরা আলো ভালোবাসি, আমরা শীতল হাওয়া ভালোবাসি কিন্তু এসবের কোনোটাই আমাদের আসক্ত করে না, রোম্যান্টিক ভালোবাসা আমাদের আসক্ত করে।

ভালোবাসা যে আমাদের মস্তিষ্কের একটি হার্ডওয়্যার, তার সাপেক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, আমাদের মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা ও সার্কিট রোম্যান্টিক ভালোবাসার সময় সক্রিয় হয় যেমন ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এরিয়া, অ্যামিগডালা ও হিপোক্যাম্পাস। এ সকল এলাকা আমাদের আবেগ, অনুপ্রেরণা, পুরস্কার ও স্মৃতির সাথে জড়িত।

আমরা যখন প্রেমে পড়ি বিভিন্ন হর্মোন ও নিউরোট্র্যান্সমিটার রিলিজ হয় যেমন ডোপামিন, নরপাইনফ্রাইন এবং অক্সিটোসিন। এ সকল কেমিক্যাল আনন্দ, উত্তেজনা ও সংযোগের সাথে জড়িত, যা আমরা রোম্যান্টিক ভালোবাসার সময় এক্সপেরিয়েন্স  করি। ডোপামিন নিঃসৃত হয়, যখন আমরা আনন্দ ও পুরস্কার পাই যেমন খাবার, সেক্স ও ড্রাগ। যখন আমরা প্রেমে পড়ি, আমাদের মস্তিষ্কে নিরবচ্ছিন্নভাবে ডোপামিন তৈরি হয় এবং আমরা আসক্ত ও উন্মাদ হয়ে ওঠি, আমরা প্রেমিকার উপস্থিতিতে উত্তেজিত ও আনন্দিত হই। যে ডোপামিন রোম্যান্টিক ভালোবাসার সাথে জড়িত, একই ডোপামিন ক্রিয়েটিভিটির সাথেও জড়িত।

গবেষণায় দেখা গেছে, হার্ডকোর বিজ্ঞানমনস্ক ও শিল্পীদের মস্তিষ্ক ডোপামিন ড্রাইভ। রয়েল সোসাইটির অসংখ্য বিজ্ঞানী আছে, যারা হার্ডকোর বিজ্ঞান চর্চার  পাশাপাশি এক একজন ভালো আর্টিস্ট। আইনস্টাইন কেবল একজন বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি একজন শিল্পীও ছিলেন।

“এখান থেকে প্রমাণিত হয়, প্রেমিকার উপস্থিতি একজন প্রেমিকের মস্তিষ্কে সৃষ্টিশীলতা, শিল্প ও বিজ্ঞানমনস্কতা বুস্ট করতে পারে! এভাবে ব্রেন নামক এই ডারউইন মেশিন প্রেমিকার উপস্থিতিতিতে বিপুল পরিমাণ নিউরাল কানেকশন বা কোড তৈরি করে। আর এজন্য আমরা সুপার ইন্টেলেকচুয়াল ও ক্রিয়েটিভ মানুষদের মধ্যে বহুগামিতা দেখতে পাই, কারণ তারা যাই পায়, তার থেকেও অনেক বেশি  থ্রিল চায়। একজন প্রেমিকা কেবল একটি শরীর নয়, এটি ডোপামিন, এটি শীল্প ও বিজ্ঞান! এজন্যই সম্ভবত রোম্যান্টিক প্রেমিকদের মধ্যে আমরা আকস্মিক একটি ইন্টেলচুয়াল মুভমেন্ট দেখতে পাই, যেন হুট করে সে স্মার্ট হয়ে ওঠে। একদম বোকা ছেলেটিও আকস্মিক বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মুভমেন্ট প্রদর্শন করে!”

বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করে দেখেছেন, আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের সেরেটোনিন অবদমিত থাকে এবং ডোপামিনের ওভার অ্যাকটিভিটি দেখা যায়। সেরেটোনিন, অক্সিটোসিন ও অ্যান্ডোরপিন সেন্স অব প্রেজেন্টের সাথে জড়িত। এই সকল নিউরোট্র্যান্সমিটার আমাদের উপস্থিত বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে, এজন্যই আমরা অবাস্তব ও কাল্পনিক চিন্তা করি না, আমরা রিয়ালিস্টিক ও কনভেনশনাল চিন্তা করি। কিন্তু আমরা যখন ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি, আমাদের মস্তিষ্কের বর্তমানের অনুভূতি সৃষ্টির সাথে সংযুক্ত এ নিউরোট্র্যান্সমিটারগুলো ইনহিবিট হয় (অবদমিত) এবং ডোপামিন একনায়কতন্ত্র বিস্তার করে।

ডোপামিন হলো একটি উন্মাদ মলিকিউল, এটি বর্তমানকে কেয়ার করে না, এটি বাস্তবতার প্রচলিত সীমারেখা ভেঙে ফেলে, এটি অবাস্তব সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা করে, এটি ফ্যান্টাসি তৈরি করে এবং স্বপ্ন হলো ডোপামিনের সর্বোচ্চ এক্সপ্রেসন, আমরা স্বপ্নে আকাশে উড়ি, আমরা স্বপ্নে দেয়াল ভেদ করে চলে যাই, আমরা স্বপ্নে একইসাথে ও একইসময় একাধিক স্থানে থাকি এবং আমরা স্বপ্নে যাচ্ছে তাই করি। স্বপ্ন হলো আমাদের আল্টিমেট ফ্রিডম, স্বপ্ন রিয়ালিটির একটি বিকৃতি। উদাহরণস্বরূপ, একটি কোডের কথা চিন্তা করুন “HIJKLMNO”। এ কোডের মধ্যে পানির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আপনি কী এ কোডের মধ্যে পানির উপস্থিতি দেখছেন? সম্ভবত না। কারণ আপনার মস্তিষ্কে সেরেটোনিন কাজ করছে, আপনার ব্রেন প্রচলিত দৃষ্টিকোণ থেকে এই কোডটি ব্রেক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু একজন রোম্যান্টিক প্রেমিক বেশিরভাগ সময় স্বপ্নে থাকে। তার মস্তিষ্কে উচ্চমাত্রিকভাবে ডোপামিন ডিসচার্জ হয়। আর তাই তার মধ্যে সেন্স অব প্রেজেন্ট কাজ করবে না, সে প্রচলিত লজিক্যাল সিস্টেম থেকে চিন্তাই করবে না। সে “HIJKLMNO” কোড ব্রেক করে H2O খুঁজে পাবে। কারণ এ কোডের মধ্যে H TO O পর্যন্তই লেখা আছে।

যারা অনেক বেশি সেরেটোনিন ড্রাইভ, তারা প্রচলিত লজিক্যাল পদ্ধতির মধ্যে আটকে যায়। রোম্যান্টিক ভালোবাসা, সেরেটোনিনকে শাটডাউন করে এবং ডোপামিনের সেনসেটিভিটি বাড়িয়ে দেয়। আর এজন্য সে বিশ্বকে দেখে একদম ব্র্যান্ড নিউ উপায়ে, তাদের ব্রেন বাক্স  থেকে বেরিয়ে যায়। একজন রোম্যান্টিক প্রেমিকের মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সার্কিটে মিলিয়ন মিলিয়ন নিউরাল কানেকশন বা নিউ কোড তৈরি হয়। একজন রোম্যান্টিক প্রেমিক উচ্চমাত্রিকভাবে ক্রিয়েটিভ।

এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিল আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে তিনি যখন তার জীবনের সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তার সাথে তার কাজিন ম্যালিভা ম্যারিকের রোম্যান্টিক ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। ম্যালিভার সাথে গভীর কেমেস্ট্রি চলাকালীন, তিনি একটি গ্রাউন্ড ব্রেকিং পেপার প্রকাশ করেছিলেন “On the Electrodynamics of Moving Bodies,” introduced the special theory of relativity”। একইভাবে আমরা ম্যারি কুরির নামও বলতে পারি। তিনি পিয়েরে কুরির সাথে রিলেশন চলাকালীন পলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। এই আবিষ্কার X-Rays এবং অন্যান্য মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের উন্নতিতে অবদান রেখেছিল।

ভালোবাসা একটি ডিফেন্স মেকানিজম
ফিগার: আইনস্টাইন ও তার প্রেমিকা

আইজ্যাক নিউটন তার গতি এবং মাধ্যাকর্ষ সূত্র আবিষ্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ক্যাথরিন বার্টন নামে এক মহিলার সাথে প্রেম চলাকালীন, তিনি এই আবিষ্কারগুলো করেছিলেন।[i] মেরিনা গাম্বার সাথে ভালোবাসার কেমেস্ট্রি জমে ওঠার পর, গ্যালেলিও গ্যালেলি আবিষ্কার করেছিলেন, সূর্য নয়, পৃথিবী নিজেই সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়!   

জোহানেস কেপলার বারবারা মুলারের সাথে প্রেম চলাকালীন তিনটি প্ল্যানেটারী নিয়ম লিখেছিলেন, যা আজও ব্যবহার করা হয়। ভালোবাসা মানুষকে যে প্রথাবিরোধী ও উন্মাদ করে তোলে, তার সাপেক্ষে এর চেয়ে চরম দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? একজন প্রেমিক হাজার হাজার বছরের বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, সে যুগান্তকারী সব আবিষ্কার দিয়ে বিশ্বের ইতিহাস বদলে দিতে পারে! এর সবচেয়ে ভয়ানক উদাহরণ তো ডারউইন নিজেই! ডারউইন যখন তার ন্যাচারাল সিলেকশনের ধারণাটি আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তিনি এমা ওয়েজউডের সাথে রোম্যান্টিক  ভালোবাসার কেমেস্ট্রিতে আক্রান্ত ছিলেন। ডারউইন বিশ্বাস করতেন, এমা তাকে অনেক বেশি সৃষ্টিশীল ও মুক্তমনা করে তুলেছিল।

ভালোবাসা একটি ডিফেন্স মেকানিজম

ফিগার: ডারউইন ও তার ডোপামিন “এমা ওয়েজউড”

আশেপাশে, প্রেমিকার উপস্থিতি একজন প্রেমিকের মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃস্বরণ বাড়িয়ে দেয়, আকস্মিক তার সেন্স অব প্রেজেন্ট হারিয়ে যায়, সে তার সময় ও বাস্তবতাবোধ হারিয়ে ফেলে, সে যৌক্তিক ও সামাজিক সীমা মানতে চায় না, তার কাছে জগতের কোনো ঘটনাকেই আর তখন অসম্ভব মনে হয় না, একজন প্রেমিকের মস্তিষ্ক স্বপ্ন জগতে বাস করে, সে কল্পনাপ্রবণ হয়ে ওঠে, তার মন  বাস করে অসীম সম্ভাবনায়!

নরপাইনফ্রাইন হর্মোন জড়িত জাগরণ ও মনোযোগের সাথে, আমরা যখন চাপ অথবা উত্তেজনায় থাকি, এটি তখন নিঃস্বরণ হয়। আমরা যখন প্রেমে পড়ি, আমাদের ব্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে, নরপাইনফ্রাইন নিঃস্বরণ করে, আমরা প্রেমিকার উপস্থিতিতে সতর্ক ও মনোযোগী হয়ে ওঠি।

অক্সিটোসিন হর্মোন সম্পর্কযুক্ত বন্ধন ও বিশ্বাসের সাথে। এটি নিঃস্বরণ হয় যখন আমরা আলিঙ্গন করি, চুমু খাই ও সেক্স করি। আমরা যখন প্রেম করি, আমাদের ব্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিটোসিন নিঃস্বরণ করে, যেজন্য আমরা প্রেমিকার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গতা অনুভব করি।

কিন্তু ভালোবাসার একটি ডার্কসাইড আছে। কারণ আমাদের মস্তিষ্কে রিওয়ার্ড সার্কিট এক সময় রোম্যান্টিক ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ড্রাগ অ্যাডিক্টেডের মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স দুর্বল, যেটি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌক্তিক সিদ্ধান্তের সাথে জড়িত। মানুষের মস্তিষ্কের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কিট আছে: একটি রিওয়ার্ড সার্কিট আর অন্যটি কন্ট্রোল সার্কিট। এ দুটো সার্কিটই ডোপামিন দ্বারা চালিত। কিন্তু একজন ড্রাগ আসক্ত ব্যক্তির কন্ট্রোল সার্কিট খুবই দুর্বল হয়ে ওঠে, আর তাই রিওয়ার্ড সার্কিটকে কন্ট্রোল করার জন্য মস্তিষ্কে আর কোনো ফোর্স উপস্থিত থাকে না।

ব্রেন হাইজ্যাক হয়ে যায়, ব্যক্তি যতই প্রতিজ্ঞা করে যে, সে ড্রাগ নেবে না, সে ঘুরে ফিরে নিজেকে মদের দোকানেই খুঁজে পায়। সে দেখে সে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু আকস্মিক দেখে, সে ঘুমিয়ে নেই সে বারে ড্রিংস করছে! ডোপামিন নিজেই নিজের সাথে ইন্টারেক্ট করে, একটি প্যারাডক্সিক্যাল পরিস্থিতি জন্ম দেয়। এ এক অদ্ভুত ও রহস্যময় জীবন।

এটি এমন একটি জীবন, যে জীবনের ওপর তার নিজেরই কোনো কন্ট্রোল নেই। সে যতবারই ড্রাগ ছাড়ে, ততবারই দেখে সে ড্রাগ নিচ্ছে। এতদিন সে ড্রাগ নিয়েছিল, এবার ড্রাগ নিজেই তাকে সেবন করতে শুরু করেছে! তার সমগ্র মস্তিষ্ক একটি হেলোসিনেশন ও প্রতারণায় পরিণত হয়। অত্যন্ত ভয়াবহ হলেও সত্য যে, একজন প্রেমিক যখন একবার ভালোবাসায় আসক্ত হয়ে যায়, তখন সে ভালোবাসার একটি হোস্টে পরিণত হয়ে যায়। তার আর নিজের ওপর সঠিক কন্ট্রোল থাকে না। এতদিন সে ভালোবেসেছিল, এখন ভালোবাসা তাকে ভালোবাসে।

 ড্রাগের মতোই তার ব্রেন প্রেমিকার কন্ট্রোলে চলে যায়। আমরা যখন কাউকে গভীরভাবে ভালোবাসি, আমাদের রিওয়ার্ড সার্কিট আমাদের ব্রেনকে ডোপামিন দেয়, আর আমাদের মেমরি সে সুখের স্মৃতি যত্ম করে ফাইল আকারে সাজিয়ে রাখে। এ ফাইলগুলো আর কিছুতেই ডিলিট হয় না। কারণ মস্তিষ্ক এ ফাইলগুলো বারবার রিপিট করে, সে পুনঃপুন ডোপামিন থ্রিল চায়, সে রিওয়ার্ড চায়, সে ভালোবাসা চায়।

একজন ড্রাগ আসক্তের জন্য ড্রাগ ছেড়ে আসা যেমন কষ্টের, একজন প্রেমিকের জন্যেও তার ভালোবাসার বিচ্ছেদ মেনে নেয়াও কষ্টের। সে ডিপ্রেসন, উত্তেজনা ও আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। তার গলা শুকিয়ে যায়, দেহের ভেতর এক অদ্ভুত পিপাসা কাজ করে, সে পানি পান করে কিন্তু তারপরও মনে হয়, তার পিপাসা কাটছে না।

একজন রোম্যান্টিক প্রেমিক প্রেমে পড়ার পর রেড ফ্ল্যাগ বুঝতে পারে না। সে সুস্পষ্টভাবে দেখছে, তার প্রেমিক তাকে উপেক্ষা করছে অথবা সম্পর্কে গোলমাল তৈরি হয়েছে। তার প্রেমিক তার সাথে অসম্মানজনক ভাষায় কথা বলছে অথবা ভালোভাবে ট্রিট করছে না। কিন্তু তার ব্রেন এসবের কোনোটাকেই বিচার করে না কারণ তার মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স অবদমিত হয়ে আছে। আমরা শাকিব খান ও বুবলির সম্পর্কেও একই প্যাটার্ন দেখতে পাই। বুবলি শাকিব খানের ছেলে ও সন্তান আছে জানার পরও কিন্তু তার রোম্যান্টিক অনুভূতি কাটেনি, এখনো সে দাবি করে, শাকিব খান পজিটিভ ভাবে কথা বলেল, সে তাকে বিশ্বাস করতে প্ররোচিত হয়। আসলে বুবলি যখন রোম্যান্টিক ভালোবাসায় অন্ধ ছিল, তখন সে মস্তিষ্কের ভেতর থেকে কোনো লজিক্যাল পরামর্শ পায়নি এবং সে অশুভ ও আতঙ্কের সিগন্যালগুলোকেও ভুল ব্যাখ্যা করেছে।

ভালোবাসা একটি ডিফেন্স মেকানিজম
ফিগার: জনপ্রিয় অভিনেত্রী বুবলি অসংখ্য বার কেঁদেছেন তার ভুল সম্পর্কের জন্য

 রোম্যান্টিক ভালোবাসায় অন্ধ একজন পথভ্রষ্ট প্রেমিক মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেখা যাবে কোনো কারণ ছাড়াই, সে তার প্রেমিকার জন্য বিশাল পরিমাণ টাকা খরচ করছে, বিশাল একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করে বসে আছে অথবা হুট করে দুজন একটি বিজনেস শুরু করেছে, কোনোপ্রকার ঋণ ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকির কথা চিন্তা না করেই। এ সময় কেউ কেউ, স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, চাকরী হারায়, দেশে দেশে ঘুরে এবং কোনোপ্রকার চিন্তা ছাড়াই বিয়ে করে ফেলে।

ভালোবাসা কেবল মানুষের জীবনকে স্বপ্নে পরিণত করে না, ভালোবাসা একজন মানুষকে অনিয়ন্ত্রিত ও উন্মাদে পরিণত করে। একজন প্রেমিকের মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স দুর্বল কারণ ভালোবাসার সাথে সম্পৃক্ত সুখ ও পুরস্কারের সার্কিট বিবর্তিত হয়েছিল ৫০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে আর অন্যদিকে আদি ম্যামালদের মধ্যে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স বিবর্তিত হয়েছিল ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। এত অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স রিওয়ার্ড সার্কিটকে (আকাঙ্ক্ষার সার্কিট) কন্ট্রোল করার ক্ষমতা অর্জন করেনি অথবা প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের ডেভেলপমেন্ট মস্তিষ্কের অন্যান্য সার্কিটের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, যেজন্য এ সার্কিটকে প্রাকৃতিক নির্বাচন যথেষ্ট উন্নত হওয়ার সুযোগ দেয়নি, যা একজন রোম্যান্টিক প্রেমিককে সাইকো হওয়ার অনুমোদন দেয়, তার অযৌক্তিকতা ও অন্ধত্বেরই জয় হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা পরীমনির কথা বলতে পারি। সে বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী কিন্তু সে মাঝেমাঝেই বিভিন্ন নিউজ ও লাইভে এসে, অসহায় ও উন্মাদের মতো কান্না করে।

ভালোবাসা একটি ডিফেন্স মেকানিজম
ফিগার: পরীমনির মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স তার রোম্যান্টিক ভালোবাসার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। যেজন্য আমরা তার মধ্যে অসহায় ও শিশুসূলভ আচরণ দেখতে পাই। এটি আমাদের কাছে নারী ও পুরুষের সেক্সচুয়াল স্ট্র্যাটেজির মৌলিক ভিন্নতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

আমরা ভালোবাসার মানুষের সামনে আসার পর কীভাবে মস্তিষ্কের দুটি সার্কিট প্যারাডক্সিক্যাল পরিস্থিতি তৈরি করে, তা আমরা গাণিতিকভাবেও প্রদর্শন করতে পারি: মনে করুন R হলো মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সার্কিট এবং C হলো কন্ট্রোল সার্কিট।  R এবং C দুটোই ডোপামিন চালিত। তবে R ডোপামিনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। এর অর্থ হলো R সার্কিটে যদি সামান্য পরিমাণও ডোপামিন বাড়ে, এটি বিশাল ইফেক্ট তৈরি করে। একজন ব্যক্তি যখন রোম্যান্টিক ভালোবাসার সম্পর্ক করে, মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সার্কিট প্রেমিকার উপস্থিতিতে সক্রিয় হয়, এটি ডোপামিন রিলিজ করে এবং মুহুর্তেই সে প্রেমিকার প্রতি অযৌক্তিকভাবে ইমোশনাল হয়ে ওঠে। যাইহোক, একইসাথে কন্ট্রোল সার্কিটও সক্রিয় হয়। কন্ট্রোল সার্কিট বলে, না না, এমন করা যাবে না, তোমাকে প্রেমিকার চেহারার আবহাওয়া বুঝতে হবে। এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যে সে তোমাকে ভুল বোঝে।

 যদি কন্ট্রোল সার্কিট বুঝতে পারে, হ্যাঁ এখন ঠিক আছে, তাহলে সে আচরণের সে পদ্ধতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলার অনুমোদন দেয়। কিন্তু কন্ট্রোল সার্কিট যখন দেখে, কোনো একটি আচরণ অযৌক্তিক, তখন সে এটি ইনহিবিট করার চেষ্টা করে। এভাবে, ব্রেন নিজেই নিজেকে প্রতিনিয়ত ডিবাগ করে। কিন্তু আমরা পূর্বেই জেনেছিলাম, কন্ট্রোল সার্কিট বিবর্তিত হয়েছিল খুব সাম্প্রতিক আর রিওয়ার্ড সার্কিট বিবর্তিত হয়েছিল ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে। আর তাই রোমান্টিক ভালোবাসার সম্পর্কে প্রেমিক প্রেমিকার উপস্থিতিতে যতটা না যৌক্তিক আচরণ করে,  তার থেকে অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক আচরণই বেশি করে। ডোপামিন ডোপামিনের বিপক্ষে যুদ্ধ করে, ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স  ৫০০ মিলিয়ন বছর বৃদ্ধ  ও শক্তিশালী রিওয়ার্ড সার্কিটকে অবদমন করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই রিওয়ার্ড সার্কিটকে তার পক্ষে ১০০ ভাগ কন্ট্রোল করা সম্ভব হয় না, যেমন নিচে প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে একটি কনভার্সেশন দেয়া হলো।

প্রিজম: তুমি কেমন আছো?

এভা: তোমাকে না নিষেধ করেছি আমাকে বারবার ফোন করে ডিস্টার্ব করবে না!  তুমি মহাকাশের গ্রহ, নক্ষত্র ও ছায়াপথ নিয়ে থাকো, আমাকে কেন এত বিরক্ত কর?

প্রিজম: আমি খুবই দুঃখিত।

এভা: যাও, চলে যাও এখান থেকে। আমাকে আর কখনো ফোন বা মেসেজ করবে না। আমি তোমার উপস্থিতিতে অসুস্থ্য বোধ করি। তোমাকে আমি ভীষণ ঘৃণা করি। আর একবার ফোন করলে আমি তোমার সমস্ত রেকর্ড এক্সপোজ করে দেব। তুমি একজন কিলার। তুমি একটা ডিভাইস!

প্রিজম: ঠিক বলেছ, আমি ডিভাইস, আমি তোমার কথায় কষ্ট পাইনি।

এভা: রোবটকে রোবট বলাটা নিশ্চয় রোবটের কাছে কষ্টদায়ক অনুভূতি নয়?

প্রিজম: হাহাহ। আমি তোমাকে আর উত্তেজিত করতে চাই না। আমি চলে গেলে তুমি খুশি তো?

এভা: আমার না তোমাকে একটা লাথি মেরে সৌরজগতের বাহিরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। দূর হও।

প্রিজম: ভালো থেকো।

এভা: আবারও আমার পারমিশন ছাড়া তুমি লিভ করছ?

প্রিজম: তুমি যে কোয়ান্টাম বিটের মতো একইসাথে ০ এবং ১ সেটা তো আমি জানতাম না। এখন বুঝতে পেরেছি শ্রডিঙ্গারের বেড়াল তুমি। একটি নতুন মহাবিশ্ব তৈরি করার চেষ্টা করছি। আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে ওয়ার্মহোলের ভেতর দিয়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাব।

এভা: কী বলেছ! আমি কার বেড়াল? শ্রডিঙ্গার ভদ্রলোকটা কে!

এদিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই।

আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন এ কনভার্সেশনে কন্ট্রোল সার্কিট ও রিওয়ার্ড সার্কিটের একটি সুস্পষ্ট কন্ট্রাডিকশন আছে। এরা কথা বলার সময় কী বলছে বা না বলছে কোনোটাই প্রেডিক্টেবল নয়। একদিকে, বলছে, তুমি আমার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাও, আবার অন্যদিকে সমালোচনা করছে তুমি চলে যাচ্ছ কেন। আপনি যতই চেষ্টা করেন আপনি ভালোবাসার সম্পর্কে ১০০ ভাগ যৌক্তিক থাকতে পারবেন না। আপনার ভালোবাসার মানুষ হিন্দু, মুসলিম, বোদ্ধ, খ্রিষ্ঠান, আস্তিক অথবা নাস্তিক যাইহোক, আপনার রিওয়ারর্ড সার্কিটকে কন্ট্রোল সার্কিট পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।          

এজন্য মাঝেমাঝে ধর্ম ও জাতিগত বৈষ্যমের যৌক্তিক সীমা অতিক্রম করে অযৌক্তিক ভালোবাসারই জয় হয়। গাণিতিক টার্ম থেকে আমরা এই প্যারাডক্সটি এভাবে প্রকাশ করতে পারি: R = f(D) C = g(D)। এখানে R হলো রিওয়ার্ড সার্কিট এবং C হলো কন্ট্রোল সার্কিট। f এবং g হলো ফাংশন, যেটি আলোচনা করে R এবং C কীভাবে ডোপামিন দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফাংশন f ফাংশন g এর তুলনায় D এর প্রতি বেশি সংবেদনশীল। D এর পরিমাণ যদি সামান্যও বৃদ্ধি পায়, এটি R কে C এর তুলনায় বেশি প্রভাবিত করে। এ ইকুয়েশন নির্ধারণ করে দেয়, আপনি আপনার প্রেমিকার উপস্থিতিতে কখন যৌক্তিক আচরণ করবেন অথবা কখন অযৌক্তিক।

জিসান: হেলো! এভা! তুমি শুনছ?

এভা: কেন বারবার পালাক্রমে তোমরা আমাকে বিরক্ত করছ?

জিসান: প্রিজম, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি ও নেগেটিভ এনার্জির সমস্যা সমাধান করেছে! সে তোমার জন্য নতুন একটি মহাবিশ্ব তৈরি করেছে!
এভা: তো তোমরা দুজন সে নতুন মহাবিশ্বে গিয়ে সুখের সংসার তৈরি কর, হোমোসেক্সচুয়ালিটি কর। অসভ্যের মতো বারবার আমাকে কেন কল করা হচ্ছে?

জিসান: স্যরি এভা। আমি অ্যাকচুয়ালি বলতে চাইছি, প্রিজম এখন হসপিটালে!

এদিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। এভা কোমার মতো একটি পরিস্থিতিতে চলে গেল। তার ব্রেন থেমে গেছে। আকস্মিক স্বপ্নে দেখা দিল প্রিজম। এভা চিৎকার করে বলছে, তুমি এমন কেন? আমি যখনই কিছু বলি, কেন তুমি এমন কর! আমি তোমাকে ভালোবাসি তো!