বিগব্যাং তত্ত্বানুসারে,মহাবিশ্ব একটি ঘন ও অসীম উত্তপ্ত একক বিন্দু হতে শুরু হয়েছিল যা স্ফীত এবং প্রসারিত হয়েছিল শুরুতে অকল্পনীয় গতিতে এবং তারপরে পরবর্তী 13.8 বিলিয়ন বছর ধরে বর্তমান পর্যন্ত আরও পরিমাপযোগ্য হারে প্রসারিত হয়েছিল যা আজও বহাল আছে। সহজ ভাষায়, প্রায় 13.8 বিলিয়ন বছর আগে, সমগ্র মহাবিশ্বের সবকিছু একটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে অসীমভাবে একীভূত ছিল , যা ছিল অসীম ঘনত্ব এবং উত্তপ্ত। হঠাৎ, এটি আলো হতে দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হয়। একে বলা হয় কসমিক ইনফ্লেশন। এর স্থায়িত্বকাল 10^-32 সেকেন্ড। এ ক্ষুদ্র সময়েই আমাদের মহাবিশ্ব পূর্বের তুলনায় 10^26 গুণ বড় হয়েছে। কিন্তু এর পর মুহুর্তে তা স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত হতে থাকে।
বিগব্যাং থিউরির জনক জর্জেস লেমাইত্রে 1927 সালে প্রথম উল্লেখ করেছিলেন যে একটি সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বকে একটি উৎপত্তিস্থল একক বিন্দুতে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যাকে তিনি “প্রাথমিক পরমাণু” বলেছেন। তখনকার অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী তখনও এই ধারণা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন যে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।
উনারা মনে করতেন, মহাবিশ্ব স্থির। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহামতি আইনস্টাইন । তার জেনারেল রিলেটিভিটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে মহাবিশ্বকে অবশ্যই প্রসারিত বা সংকোচিত হতে হবে। যেখানে তার থিয়োরিই স্থির মহাবিশ্বের ধারণা নাকোচ করে, তিনিই তা মানতে নারাজ ছিলেন। তাই এর গাণিতিক সংশোধন হিসেবে মহাবিশ্বের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে তিনি কসমোলজিকাল কন্সট্যান্ট (1.1734 x 10^52m^-2) ব্যবহার করেন যা তিনি গ্রিক অক্ষর ল্যাম্বডা(Λ) দ্বারা চিহ্নিত করেন। হাবলের নিকটবর্তী গ্যালাক্সিগুলির পর্যবেক্ষণ যখন দেখায় যে মহাবিশ্ব আসলে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তখন আইনস্টাইন তার মার্জিত তত্ত্ব পরিবর্তন করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং কসমোলজিকাল কন্সটেন্ট শব্দটিকে তার “সবচেয়ে বড় ভুল” হিসাবে দেখেছিলেন। তো এখন পর্যন্ত এমন কোনো যন্ত্রপাতি নেই,যা বিগব্যাং থিউরিকে প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু কিছু পরোক্ষ প্রমাণ আছে যা এর পক্ষে জোড়ালো প্রমাণ দেয়-
গ্যালক্সি এর রেডশিফটঃ

গ্যালক্সি হতে আমরা যে আলো পর্যবেক্ষণ করি, তা সময়ের সঙ্গে প্রসারিত হয়। এটিকে তার মূল বর্ণ হতে লালচে দেখায়। এই রেডশিফট হল গ্যালাক্সিগুলি আমাদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলাফল। এটিকে আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে শব্দের ডপলার প্রভাব সম্পর্কে জানতে হবে। ডপলার প্রভাব মানে কোনো তরঙ্গের প্রকৃত কম্পাঙ্ক হতে বেশি বা কম পাওয়া যা উৎসের গতির জন্য হয়ে থাকে। আমরা জানি, শব্দশক্তি তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হয়। উদাহরণস্বরুপ – মনে করুন, একটি এম্বুলেন্স আপনার দিকে ধাবিত হচ্ছে। যতই এটি আপনার নিকটে আসছে, এর শব্দ তত তীব্রতর হতে চলেছে। দূরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্রতা হ্রাস পাবে। যদি উৎসটি কোনো স্থির জায়গায় থাকত, তখন তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের পরিসীমা থাকত। ঠিক একই বিষয় আলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা জানি তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম্পাঙ্কের ব্যস্তানুপাতিক।লাল বর্ণের তরঙ্গ সবচেয়ে বেশি যেখানে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সর্বনিম্নের দিক হতে দ্বিতীয়। তো গ্যালক্সিগুলো যতই দূরে সরে, তার নক্ষত্র হতে আসা আলোর কম্পাঙ্ক তত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তা আলোক বর্ণালীতে দেখলে মনে হয় এর বর্ণ লাল বর্ণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ব্লু শিফট ঠিক এর বিপরীত।
তো পর্যবেক্ষণগুলি দেখায় যে মহাবিশ্বের প্রায় সবকিছুই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। দূরবর্তী গ্যালাক্সির রেডশিফট বলে, আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।

সে হিসেবে আপনি যদি সময়কে পিছনের দিকে নিতে থাকেন, আপনি দেখতে পাবেন যে গ্যালাক্সিগুলি একসাথে কাছাকাছি আসছে। আপনি যদি যথেষ্ট দূরে দেখতে পারতেন(উদাহরণ স্বাপেক্ষে), তাহলে মহাবিশ্বের সবকিছু এক জায়গায় থাকত বলে মনে হতো। এ যুক্তি সেই একক বিন্দুর(সিঙ্গুলারিটি) অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে।

Cosmic Microwave Background Radiation(CMBR):
বিগব্যাং নিয়ে সবচেয়ে বড় পরোক্ষ প্রমাণ হচ্ছে CMBR। একে বিগব্যাং এর সবচেয়ে প্রাচীন ফসিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিগব্যাং শুরুর 3মিনিট পর নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণ শুরু হয়। নিউক্লিয়াস গঠনকারী নিয়ক্লিয়নের সংযোগকে নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণ বলে। সে সময় প্রোটন ও নিউট্রন মিলে নিউক্লিয়াস তো ঠিকই গঠিত হচ্ছিল কিন্তু নিরপেক্ষ পরমাণু গঠিত হতে পারছিল না। কেননা সে সময়ের তাপমাত্রা এত অধিক উত্তপ্ত ছিল যে ইলেক্ট্রন ও নিউক্লিয়াসের সংযোগ হচ্ছিল না। এসব ধনাত্মক নিউক্লিয়াসকে প্লাজমা বলে। এ প্লাজমা অনেক উত্তপ্ত ছিল। আমরা জানি, কোনো কিছু উত্তপ্ত হলে তা হতে রেডিয়েশন নির্গত হয়। কিন্তু মুক্ত ইলেক্ট্রন থাকায় এসব রেডিয়েশনের ফোটন স্পেসে মুক্তভাবে সোজাপথে যেতে পারছিল না। এগুলো মুক্ত ইলেক্ট্রনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে প্লাজমা সুপে আবদ্ধ ছিল। যেহেতু ফোটন মুক্ত হতে পারছিল না, সে সময়ের মহাবিশ্বও দৃশ্যমান ছিলনা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মহাবিশ্বের প্রসারণ ও তাপমাত্রা হ্রাসে নিরপেক্ষ অণু গঠিত হয়েছিল। নিরপেক্ষ পরমাণু গঠিত হওয়ার এ যুগকে বলে Epoch of Recombination(পুনর্মিলনের যুগ)। ফলে আর মুক্ত ইলেক্ট্রন অবশিষ্ট না থাকায় সেসব ফোটন রেডিয়েশন স্বতন্ত্র্যভাবে স্পেসে মুক্তভাবে সোজাপথে ছড়িয়ে পড়ে।স্পেসের প্রসারণে এর তরঙ্গ প্রসারিত হয়ে মাইক্রোয়েভ তরঙ্গের দৈর্ঘ্যে পৌছে ও এর তাপমাত্রাও হ্রাস পায়। এর তাপমাত্রা 2.275K.

মার্কিন বিজ্ঞানী Ralph Alpherin বিগব্যাং থিউরির ধারণা থেকে CMBR এর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যখন তিনি বিগব্যং এর পর নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণ নিয়ে কাজ করছিলেন। তো পরবর্তীতে এর আবিষ্কার নিয়ে মজার ঘটনা আছে। এটি দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত হয়েছিল 1965 সালে, বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরির দুই গবেষক (আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন) একটি রেডিও রিসিভার তৈরি করছিলেন এবং এটি যে আওয়াজ উঠছিল তা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তারা শীঘ্রই বুঝতে পেরেছিল যে সমস্ত আকাশ থেকে শব্দ একইভাবে আসছে। একই সময়ে, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির একটি দল (রবার্ট ডিকের নেতৃত্বে) সিএমবিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। ডিকের দল বেল পরীক্ষার আভা পেয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে সিএমবি পাওয়া গেছে। তো থিউরী ও পরিমাপ উভয় অনুসারে এর তাপমাত্রা উপরে বর্ণিত মানের সমান হয়েছিল। আরও পড়ুনঃ বিগব্যাং থেকেও আদি ব্লাকহোলের CMB ফসিল!
পুরোনো তারার আলোক উপাদানের অনুপাত হতেঃ
তো Ralph Alpherin, Robert Herman এবং George Gamow এর সঙ্গে বিগব্যাং এর পরবর্তী নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা সময় মৌলসমূহের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।শুরুতে অধিক শক্তি ঘনত্বের জন্য নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণ হচ্ছিল না অর্থাৎ নিউক্লিয়ন এর মধ্যে সংযোগ হচ্ছিল না।শক্তি ঘনত্বের আধিক্যের ফলে উৎপন্ন এ বাধাকে Bottleneck বলে। তো যখন নিউক্লিয়নসমূহ এ বাধা অতিক্রম করে, তখনই ফিউশন প্রক্রিয়া শুরু হয়। সর্বপ্রথম বিগব্যাং এর 3 মিনিট পর প্রথম এ বাধা অতিক্রম করে ডিউটেরিয়ামের নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল। এটিই ছিল আমাদের মহাবিশ্বের আদি পরমাণুর নিউক্লিয়াস।পরবর্তীতে এটি ফিউশন প্রক্রিয়ায় আরো ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে হিলিয়াম-৪ এর নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। কিন্তু শক্তি ঘনত্ব হ্রাসের ফলে তা আর ফিউশন প্রক্রিয়া চালিয়ে ভারী নিউক্লিয়াসে পরিণত হতে পারছিলনা। তবে কিছু ক্ষেত্রে লিথিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল। বেশিরভাগ প্রোটন ও নিউট্রনই হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস গঠন করেছিল। বাকি অবশিষ্ট প্রোটন ছিল শুধুমাত্র হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস হিসেবে। নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণের এ ম্যাকানিজম হতে বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী আদি মহাবিশ্বে নিউক্লিয়ার সংশ্লেষণের প্রথম ঢেউয়ে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমান ছিল মোটামুটি 75% ও 25%.কিন্তু সমস্যা ছিল এ তথ্যকে যাচাই কিভাবে করা যায়।
তো আমাদের প্রয়োজন ছিল একদম প্রথম দিকের আদি তারার সঙ্গে নতুন তারার পার্থক্যকরণ।কেননা পুরোনো তারা হতে মূলত আদি মহাবিশ্বে উপাদান সমূহের অনুপাত পাওয়া যাবে। নতুন তারা এ জন্য নয় কেননা তার গঠন প্রক্রিয়া ও উপাদান একদম শুরুর দিকের তারাগুলোর মতো নয়। আমরা জানি, তারা তৈরি হয় মূলত গ্যাস ও ধুলীকণার ঘনীভূত হওয়া নেবুলা থেকে। কিন্তু এখনকার তারাগুলোর নেবুলা তৈরি হয় আরেক তারার সুপারনোভার বিস্ফোরণ হতে।এ সুপারনোভার বিস্ফোরণে এর আশেপাশে গ্যাস ও ধূলীকণা একত্রিত হয়ে নেবুলা গঠন করে যা আরেক তারার জন্ম সূচনা করে। কিন্তু আদি তারা তো এরকম বহিঃশক্তি হতে সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া আদি তারা শুধুমাত্র পরমাণু হতে সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু নতুন তারাতে যেখানে অতিরিক্ত গ্যাস ও ধূলীকণা যুক্ত হয়। তো WMAP পুরোনো গ্যালক্সির তারাগুলোর উপাদানসমূহের অনুপাত নির্ণয় করে,যা একদম থিউরির ভবিষ্যদ্বানী করা রিলেটিভ এভিন্ডেসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

সময়ের পিছনে ফিরে তাকানোঃ
বিগ ব্যাং থিউরির বিকল্প আছে যাকে বলা হয় স্টেডি স্টেট থিউরি। এই তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্ব সময়ের সাথে খুব বেশি পরিবর্তিত হয় না। মনে রাখবেন – আলো মহাবিশ্ব জুড়ে যেতে অনেক সময় নেয়। তাই যখন আমরা দূরবর্তী গ্যালক্সির দিকে তাকাই , আমরা আসলে সময়ের পিছনের দিকে ফিরে তাকাই। এর মানে আমরা দেখতে পাই যে খুব পুরানো গ্যালক্সিগুলো নতুন গ্যালক্সি থেকে অনেক আলাদা। এটি দেখায় মহাবিশ্ব পরিবর্তিত হয়েছে। এই প্রমাণটি স্টেডি স্টেট তত্ত্বের চেয়ে বিগ ব্যাং তত্ত্বের সাথে ভাল মানানসই।
