Can't find our books? Click here!
Spaceman wearing suit in start pose. Mixed media

নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন

মানুষের ইতিহাস শুরু হয়েছিল মানুষের হাতে ঈশ্বর সৃষ্টির মাধ্যমে এবং সেই ইতিহাসের সমাপ্তি হবে মানুষ যখন নিজেই ঈশ্বরে পরিণত হবে…! 

                                                                                                                   __ইউভাল নোয়াহ হারারি

 

 

 

 

স্যাপিয়েন্সরা যখন মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে পৌঁছাল তখন তাদের সাথে দেখা হয়েছিল নিয়ান্ডারথালদের। রিপ্লেসমেন্ট তত্ত্ব অনুসারে নিয়ান্ডারথালদের সাথে স্যাপিয়েন্সদের কোনো প্রজনন ঘটেনি। আবার ইনব্রিডিং তত্ত্ব অনুসারে স্যাপিয়েন্সরা যখন নিয়ান্ডারথালদের দেখা পেলো তখন তারা তাদের সাথে প্রজনন করেছিল! ২০১০ সালে প্রায় চার বছরের প্রচেষ্টার পর নিয়ান্ডারথালদের জিনোম রেকর্ড প্রকাশ হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা ফসিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ ডিএনএ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন আর তাদের এ ডিএনএর সাথে আধুনিক মানুষদের ডিএনএ তুলনা করে যে ফলাফল পাওয়া গেলো তা ছিল চমকে দেওয়ার মতো! সমীক্ষায় দেখা গেলো ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের ৪ শতাংশ মৌলিক ডিএনএ নিয়ান্ডারথালদের। কয়েকমাস পর আরও একটি চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত ফসিলে পরিণত হওয়া আঙুলের ডিএনএর ম্যাপিং তৈরি হলো, ফলাফলে দেখা গেলো আধুনিক মেলানেসিয়ান এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ডিএনএর সঙ্গে ডেনিসোভা মানবের ডিএনএ ৬ শতাংশই মিলে যায়।

 

 

 

আজ থেকে ৭০ হাজার বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্সদের কমপক্ষে এমন ছয়টি প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল এবং যাদের অনেকের সাথে তারা প্রজনন করতেও সক্ষম ছিল, যা থেকে প্রমাণ হয় যে জিনগত দিক থেকে ডেনিসোভা অথবা নিয়ান্ডারথালদের সাথে স্যাপিয়েন্সদের খুব একটা পার্থক্য ছিল না। নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভার সাথে স্যাপিয়েন্সদের জেনেটিক্যাল পার্থক্য শূন্যের প্রায় কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও, সেসব প্রজাতির সাথে স্যাপিয়েন্সদের বৈশিষ্ট্যগত অতি-ক্ষুদ্র পরিমাণ পার্থক্যের কারণে মানসিক দূরত্ব ছিল বহু আলোকবর্ষ। তা যদি না’ই হতো তবে স্যাপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতো না! শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের জেনেটিক্যাল পার্থক্য মাত্র এক শতাংশ (১.৫) কিন্তু শিম্পাঞ্জিরা কবিতা লিখে না, তারা সাহিত্য রচনা করে না, তারা তাদের জেনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝে না, তারা কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে কাজ করে না এবং তারা এটাও জানে না যে তাদের শরীর অ্যাটমের তৈরি! মাত্র এক শতাংশ জেনেটিক্যাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও শিম্পাঞ্জিরা জানে না কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে কোয়ান্টাম শূন্যতা থেকে আমাদের এ মহাবিশ্ব তৈরি হয়েছে, তাদের Sense of Tomorrow নেই আর তারা জানে না যে স্পেস-টাইম থ্রি-ডাইমেনশনাল, যেখানে তারা অস্তিত্বশীল, তারা জানে না যে তারা শিম্পাঞ্জি!

 

 

জেনেটিক্যালি একে অপরের প্রায় সমান হওয়া সত্ত্বেও শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে কোনো কবি, সাহিত্যিক অথবা দার্শনিক জন্ম হয়নি, আমাদের সাথে তাদের মানসিক দূরত্ব অসীম, আর এ অসীম মানসিক দূরত্বের কারণে শিম্পাঞ্জিদের কাছে মানুষের আচার আচরণ সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য, শিম্পাঞ্জিদের সামনে যদি আপনি আইনস্টাইনের সমীকরণ আলোচনা করেন তবে তারা এর কোনো কিছুই বুঝতে পারবে না! এটা অনেকটা ফিজিক্সের সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টের মতো, মহাবিস্ফোরণ বিন্দুর ভেতর স্পেস-টাইম ও ম্যাটার সম্পর্কে আমরা যেমন কোনো ধারণা তৈরি করতে পারি না ঠিক তেমনি শিম্পাঞ্জিরাও আমাদের মস্তিষ্কের চেতনা ও অনুভূতিগুলো সম্পর্কে কোনো ধারণাই করতে পারে না, আমাদের মস্তিষ্ক তাদের কাছে সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টের মতোই একীভূত! গ্যালাক্সিতে যদি অন্য কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব থেকে থাকে এবং তাদের সাথে যদি আমাদের দেখাও হয় তবুও হয়তো আমরা তাদের আবেগ অনুভূতি কোনোকিছুই বুঝতে পারব না, আমাদের কাছে তারাও হতে পারে অনির্ণেয়, অজ্ঞাত এবং কল্পনার অসীম ঈশ্বরের মতো নৈমাত্রিক। তাহলে দেখা যাচ্ছে সামান্যতম জিনগত পার্থক্য প্রজাতির মধ্যে সীমাহীন মনস্তাত্বিক পার্থক্য তৈরি করে, যেখানে আমরা প্রেমিকার সাথে সামান্য একটি মতের অমিল হলে অতীতের সকল স্মৃতিকে তুচ্ছ কণিকার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। যেখানে শুধু ভাষা, সংস্কৃতি আর ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করি সেখানে অল্প একটু জেনেটিক্যাল বৈচিত্রতার কারণে তৈরি হওয়া সীমাহীন মনস্তাত্বিক পার্থক্য কে আমরা কোন যুক্তিতে মেনে নেবো? আর ঠিক এ কারণেই স্যাপিয়েন্সরা তাদের অন্য প্রজাতিগুলোকে দেখতে প্রায় একইরকম হওয়া স্বত্বেও মেনে নিতে পারেনি! নিয়ান্ডারথাল ও ডেনিসোভাদের সাথে প্রজনন করার মতো নিকটবর্তী হওয়ার পরও তারা তাদের মেনে নিতে পারেনি। কোনো প্রাণীর সাথে এক ভাগ বা তারচেয়েও কম পরিমাণের জিনগত পার্থক্য থাকলেও মানুষ তাদেরকে মনস্তাত্বিকভাবে মেনে নিতে পারে না।  সে নিজেকে তাদের থেকে আলাদা মনে করে, মানুষ মনে করে তারা যে প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বে এসেছে ঠিক একই প্রক্রিয়ায় আমরা কোনোদিনও মহাবিশ্বে আসতে পারি না, জেনেটিক্যাল বিদ্বেষ, অহংকার আর বিরক্তি থেকেই এখনো মানুষ মনে করে তারাই একমাত্র প্রাণী যাদের ঈশ্বর নিজ হাতে তৈরি করেছে, একমাত্র তাদের জন্যেই আটাশ বিলিয়ন গিগাপার্সেক আয়তনের এ মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে, তারা মনে করে তারা মহাবিশ্বে আসবে বলেই স্টিফেন হকিং এর ওয়েভ ফাংশন অব দ্যা ইউনিভার্স কলাপ্স করে মাল্টিভার্স থেকে এ মহাবিশ্বের ফিজিক্স তাদের প্রাণের বিকাশের জন্য উপযোগী ভাবে নির্বাচিত হয়েছে!

 

 

 

যদি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি জেনেটিক্যাল পার্থক্য কে স্যাপিয়েন্সরা মেনে নিতে না পারে, সামান্য পার্থক্যের কারণে যদি তারা অন্য প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে, তাদেরকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে তবে এটা ভাবা একেবারেই অযৌক্তিক যে পৃথিবীর অন্য প্রাণীরা যে প্রক্রিয়ায় মহাবিশ্বে এসেছে স্যাপিয়েন্স নিজেদেরকেও একই প্রক্রিয়ার অধীন মনে করবে! আর লক্ষ্যণীয়ভাবে তারা নিজেদের কখনোই প্রকৃতির অধীন মনে করেনি, যে প্রকৃতি সমস্ত প্রাণকে এক সুত্রে গেঁথে রেখেছে, তারা নিজেদের মনে করেছে এর চেয়েও অনেক দূরে, তারা মনে করেছে তারা ঈশ্বরের বিশেষ পর্যবেক্ষণে তৈরি হয়েছে, তাদের তৈরির পেছনে জিন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের কোনো ভূমিকা নেই, এমনকি আজও মানুষের এটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয় তাকে কোনো ঈশ্বর তৈরি করেনি, সে বিবর্তিত হয়েছে। জেনেটিক্স, জিনোমিক্স, মাইক্রোবায়োলজি অথবা ফসিল রেকর্ড যেভাবেই তাদের সম্মুখে তাদের বিবর্তনের সত্যতা তুলে ধরুক না কেন তারা মনে মনে অস্বস্তিবোধ করে, তারা কষ্ট পায়, একেবারে কট্টর নাস্তিকের ভেতরেও স্বার্থপর জেনেটিক্যাল মন কাজ করে। আর স্যাপিয়েন্সরা প্রাণিজগতকে কখনো নিজের মতো করে ভাবতে পারে না কারণ তারা তাদের শতভাগ জিন ধারণ করে। এমনকি আমরা যেটাকে মানবতা বলি, মানবতা ব্যাপারটাও জেনেটিক্যাল, আপনি যদি মানব বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে না গিয়ে শিম্পাঞ্জির জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করেন, নিজের মায়ের অসুস্থতার সময় তিমি মাছের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দুচিন্তাগ্রস্থ থাকেন তবে নিশ্চয় কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের বন্ধু অথবা মা আপনার দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মস্তিষ্কটিকে স্বাভাবিক চোখে দেখবে না বরং আপনাকে হয়তোবা এ জন্য পাগলা গারদেও যেতে হতে পারে। কারণ জিনগতভাবে মানুষ মানুষের একশতভাগ জিন ধারণ করছে, শিম্পাঞ্জি বা তিমির নয়। অতএব আমরা কার প্রতি মানবিক হবো সেটিও আমাদের মধ্যে জিনগতভাবে লেখা থাকে!

 

 

 

একমাত্র জিনগত পার্থক্যের কারণেই আমরা বিশ্বের অন্য সকল প্রাণী থেকে মানসিক ভাবে আলাদা, হাজার আলোকবর্ষ দূরে, আর তাই আমাদের সৃষ্টি প্রক্রিয়াকেও আমরা নিজের মতো করে কল্পনা করি, আমরা আমাদের জীবনকে আমাদের মতো করে সাজাই আর সম্ভবত ধর্ম আমাদের এ স্বার্থপর উদ্দেশ্যেরই বহিঃপ্রকাশ! রাশিয়া, জাপান এবং কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার বরফে জমে থাকা একটি প্রাচীন ম্যামথের জিনের সম্পূর্ণ গঠন জানতে পেরেছিলেন। বর্তমানের একটি হাতির নিষিক্ত ডিম্বাণুতে তারা ম্যামথের ডিএনএ কে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ৫ মাস পরই প্রথম ম্যামথের জন্ম হতে পারার কথা ছিল পৃথিবীতে! কিন্তু শুধু ম্যামথের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই কি হবে? হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জজ চার্চ বলেছেন, যেহেতু নিয়ান্ডারথাল এর জিনোম সিকোয়েন্সিং শেষ হয়েছে সেহেতু নিয়ান্ডারথালদের ডিএনএ সংযুক্ত একটি ডিম্বাণু মানুষের গর্ভাশয়ে স্থাপন করা উচিত! ৩০ হাজার বছরের মধ্যে মানুষ সর্বপ্রথম নিয়ান্ডারথাল শিশুর মুখ দেখবে, চার্চ বলেছেন, মাত্র ৩০ মিলিয়ন ডলার পেলেই তিনি এ কাজটি শুরু করবেন! নিয়ান্ডারথালদের মস্তিষ্কের সাথে তুলনা করে আমরা জানতে পারব কোন জৈবিক প্রক্রিয়া নিয়ান্ডারথালদের সাথে আমাদের চিন্তা চেতনার পার্থক্যের জন্য দায়ী ছিল! ইতোমধ্যে কয়েকজন নারী তাদের গর্ভাশয় শেয়ার করতেও রাজী হয়েছেন, তারা নিয়ান্ডারথালের মা হবেন!

 

 

 

          A reconstruction of Neanderthal man in the Gallo-Roman Museum in Tongeren. © Paul Hermans / Wikimedia

 

 

জেনেটিক্সের আলোকে আমরা এখন জানি যে অন্য প্রজাতিগুলো থেকে সেপিয়েন্সের জিনগত পার্থক্য খুবই কম, একটি নেংটি ইঁদুরের জিনোমে ২৫০ কোটি নিউক্লিওবেস থাকে আর মানুষের জিনোমে নিউক্লিওবেস থাকে ২৯০ কোটি! মানুষের সাথে নিয়ান্ডারথাল অথবা ডেনিসোভার মনস্তাত্বিক পার্থক্য সম্পূর্ণ জিনগত নয়, যদি মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য সম্পূর্ণ জিনগত হতো তবে নিয়ান্ডারথালদের সাথে তাদের শূন্যের কাছাকাছি মানসিক পার্থক্য কাজ করতো, মূলত মানুষের মস্তিষ্কের আভ্যন্তরীণ কিছু পরিবর্তনই বুদ্ধিভিত্তিকভাবে তাদেরকে নিয়ান্ডারথালদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে, আর বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের ভেতর দিয়ে তারা তাদের অন্য প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্ত করে দিতে সক্ষম হয়েছে, তার মানে অল্প একটু জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন স্যাপিয়েন্সদের ব্রেনকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। যদি এটাই সত্য হয় তবে এটা ঠিক যে কোনো একদিন আমরা শুধু নিউরাল কানেকশন বদলে দিয়ে অতি-বুদ্ধিমান প্রাণী তৈরি করতে পারব।

 

 

 

৩০ হাজার বছর পূর্বের বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব আমাদের পৃথিবীর সমস্ত বাস্তুসংস্থানকেই বদলে দিয়েছে। শুধু বুদ্ধির জোরে স্যাপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথালদের মতো এত শক্তিমান একটা প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। তাহলে নতুন এ বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব আমাদের জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে কল্পনা করার চেষ্টা করুন! যে ক্ষুদ্র পরিমাণ জিনগত তারতম্য মানুষের অন্য প্রজাতিগুলোকে তার থেকে আলাদা করেছে ঠিক একই জিনগত পরিবর্তন স্যাপিয়েন্সরা তাদের নিজেদের ভেতরেই ঘটাতে পারে। শিম্পাঞ্জিদের সাথে আমাদের মাত্র এক শতাংশ জিনগত পার্থক্য, যদি এ এক শতাংশই তাদের থেকে আমাদের মানসিক তারতম্যকে আকাশছোঁয়া করে তোলে তবে স্যাপিয়েন্সরাও যে জিনোম সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে মানসিক ভাবে নিজেরা নিজেদের থেকে মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে চলে যাবে তা সহজেই অনুমেয়, আর যদি এটি সত্য হয় তবে আমরা এমন এক মানব সভ্যতা পাব যাদের চেতনা হবে চেতনার গতানুগতিক উপলব্ধি থেকেও অনেক বেশিকিছু, আমরা সত্যিকার অর্থে দেখা পাব আর একটি সিঙ্গুলারিটির!

 

 

কিন্তু কীভাবে মানুষের এ বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হলো, কীভাবে স্যাপিয়েন্সরা সম্পূর্ণ বাস্তুসংস্থানকে নিজেদের দখলে নিয়ে গেল, ইন্টারগ্যালাক্টিক স্পেস ছাড়িয়ে তাদের কনশাসনেসকে লেজার রশ্মির মাধ্যমে মহাকাশের গভীর স্পেসে পাঠানোর জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটানোর স্বপ্ন দেখল? যে মানুষ আজ কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে চিন্তা করে, যারা নিজেদের চেতনার ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করে, এমনকি আমাদের এ পরিচিত মহাবিশ্বের সীমানা পেরিয়ে হাইপারড্রাইভের মাধ্যমে চলে যাওয়ার চিন্তা করে মেটা ইউনিভার্সে! আমরা আজ হাইপারস্পেস নিয়ে চিন্তা করছি, কম্পিউটারের ভেতর মস্তিষ্কের চেতনাকে আপলোড করার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি, মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যাল দিয়ে ব্রেনগেটের মাধ্যমে এক্সটারনাল জগতকে পরিচালনা করার চেষ্টা করছি, আজ যে মানুষ মেট্রিওস্কা মস্তিষ্ক নির্মানের স্বপ্ন দেখে কীভাবে তাদের প্রাকৃতিক এ মস্তিষ্কটি বিকশিত হয়েছিল? যা তাদের এ বৈপ্লাবিক বুদ্ধিমত্তার অধিকারী করে দিয়েছিল? ঠিক কোন জেনেটিক্যাল ড্রাফট অথবা নির্বাচনী চাপ মানব মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশনকে পৃথিবীর অন্যসকল প্রাণীজগত থেকে পৃথক করে দিয়েছিল? একটি কড মাছ প্রতি ঋতুতে কয়েক মিলিয়ন ডিম পাড়ে। একটি কড মাছ জানেই না যে তার কয়টি সন্তান আছে আর তাদের নাম ও পরিচয়টাই বা কী! কড মাছের কাছে SENSE OF INDIVIDUALITY নেই।

 

 

কল্পনা করুন, আপনার গার্লফ্রেন্ড স্যাপিয়েন্সদের মধ্যে একটু ভিন্ন রকম, সে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা দেয়। যদি এমন হয় যে তিনি প্রতিবার এক মিলিয়ন ডিম পাড়ে তখন আপনি কী করতেন? কীভাবে সন্তানের দেখাশোনা করতেন, কীভাবেই বা করতেন তাদের ভরণ পোষণ? হয়তোবা আপনার পক্ষে কম্পিউটার এলগোরিদমের সহযোগিতায় এক মিলিয়ন সন্তানের দেখাশোনা করা অথবা তাদের নাম প্রদান করাটা সহজ ছিল। এমনকি সার্বজনীন কল্পনা ও সামষ্টিক গল্পের মাধ্যমে সম্ভব ছিল সে কয়েক মিলিয়ন সন্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। কড মাছ সেটি পারে না, তার কাছে ন্যানোচিপ নেই, অ্যালগোরিদম নেই, সে ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না তার চেয়ে বরং সে তার শিশুদের SENSE OF WHOLENESS থেকে দেখে এবং পদার্থ বিজ্ঞানের সুত্রের ওপর ছেড়ে দেয়, থার্মোডায়নামিক্সের সেকেন্ড “ল’’ অথবা গ্র্যাভিটিই তাদের ঈশ্বর, “ল’’ অব এভারেজই তাদের দেখাশোনা করে, আর এতে করে মিলিয়ন মিলিয়ন কড মাছ নিজেদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয় ও অধিকাংশই মারা যায়। আর অপরদিকে স্যাপিয়েন্সরা বছরে মাত্র একটাই সন্তান জন্ম দেয় এবং আমরা এটাও জানি যে মানব শিশু অনেক অসহায় পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করে। তাদের মস্তিষ্ক ও শরীর তখনও সঠিকভাবে অভিযোজিত হয়নি। যার জন্য তারা পুরোপুরিভাবে প্যারেন্টাল কেয়ারের ওপর নির্ভরশীল। আপনি একজন মানব শিশুকে ফিজিক্সের নিষ্কাম সুত্রের কাছে “ল অব এভারেজের’’ ভিত্তিতে ছেড়ে দিতে পারেন না, নির্ঘাত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রতি বছরে একজন মা শুধুমাত্র একবার এবং মাত্র একটা শিশুই জন্ম দিতে সক্ষম, তার কয়েক মিলিয়ন সন্তান নেই যে সে তাদের প্রাকৃতিক আইনের স্বেচ্ছাচারী মাতৃত্বের কোলে উঠিয়ে দেবে। একজন মানব শিশু অনেক বেশি আন্তরিকতা ও যত্ন দাবি করে।

 

 

 

যদি স্যাপিয়েন্সরা তাদের এই সীমিত সংখ্যক সন্তানের যত্ন না নিয়ে তাদেরকে প্রকৃতির উদাসীন বুদ্ধিমত্তার ওপর ছেড়ে দিতো তবে তাদের স্বার্থপর জিন পরবর্তী প্রজন্মে তার কোনো অনুলিপিই রেখে যেতে পারতো না, আর সেলফিশ জিনতত্ত্ব অনুসারে জিনের উদ্দেশ্য জিনের সংখ্যাবৃদ্ধি করা, মানুষ কয়েক মিলিয়ন বাচ্চা দেয় না, তাদের বাচ্চার সংখ্যা সীমাবদ্ধ, আর প্রতিটি শিশুই তাদের জিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আর তাই এ শিশুদের প্রতি সামান্য পরিমাণ অযত্ন ও অবহেলা তাদের জিনের বিলুপ্তির জন্য যথেষ্ট। অতএব জিন একদিকে যেমন চাইবে না শিশুটি অনেক বেশি শক্তপোক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করুক আবার জিন এটাও চাইবে না যে তাদের পিতা অধিক সংখ্যক নারীর সাথে যৌন প্রজনন করতে গিয়ে ওই শিশুটির প্রতি অবহেলা করুক। এ জন্য স্বার্থপর জিনের জন্য এটাই সবচেয়ে উপযোগী হবে, যদি জিন এমন কিছু শরীর তৈরি করতে পারে যারা নিজেদের টিকে থাকার জন্য পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রসিংওভারজনিত কোনো ভুলের কারণে হয়তো জিন এমন কিছু মানব শিশু জন্ম দিয়েছে যারা জন্মগতভাবে খুবই নমনীয় ও দুর্বল। আর অন্যদিকে এ দুর্বলতা ও নমনীয়তার কৌশল ব্যবহার করে মানব শিশুরাও তাদের পিতামাতার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে পেরেছে নিজেদের জন্য অতিরিক্ত প্যারেন্টাল কেয়ার আদায় করার জন্য? পিতামাতা যদি প্রজননের পেছনে দীর্ঘ এক বছর সময় অপচয় করার পর কোনো কারণে সন্তানের মৃত্যু হয় তবে নিশ্চয় সেটা তাদের জন্য এতবেশি সুবিধাজনক হবে না। তাই একজন মানবশিশুর নমনীয়তার জেনেটিক কৌশল পিতামাতার মস্তিষ্ককে প্রতারিত করবে পরিবার গঠনের জন্য, ঐক্য সম্প্রীতি ও ভালোবাসার ভিত্তিতে একসাথে বসবাস করার জন্য? একটি মানব শিশু এতটাই মূল্যবান যে তার ভরণপোষণ ও লালন পালনের সাথে একটি বিশাল গোষ্ঠী জড়িয়ে যায়। একজন মানব শিশুর জন্য কোনো শক্তিশালী কম্পিউটার অ্যালগোরিদম প্রয়োজন নেই, ইন্টারনেট বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টলিজেন্ট প্রয়োজন নেই তার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক ঐক্য ও সহনশীলতা। আর এভাবে যখন কড মাছদের মিলিয়ন মিলিয়ন সন্তান ফিজিক্সের সূত্রের সাথে টিকে থাকার জন্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করে ঠিক তখন মানব শিশু তার দুর্বল শরীর ও সংখ্যালঘুতার কৌশলকে ব্যবহার করে একটি বিরাট গোষ্ঠীর কাছ থেকে যত্ন পায়। আর এ প্রক্রিয়া হাজার হাজার বছর পর্যন্ত ক্রমবর্ধবানভাবে চলতে থাকে।

 

 

 

মানুষ এ কোমল ও দুর্বল শিশুদের গলিত সিসার মতো আকার বদলে নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী গঠন করে তুলতে পারে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার পেছনে প্যারেন্টাল কেয়ার ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতাবোধের গুরুত্বকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। মানুষের সন্তান যদি সংখ্যায় কড মাছের মতো কয়েক মিলিয়ন হতো তবে আমরা হয়তোবা স্যাপিয়েন্সদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক অথবা বিজ্ঞানী কাউকেই খুঁজে পেতাম না। সংখ্যাধিক্যতা বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য উপযোগী শর্ত নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতা সবসময় উন্নতির মানদন্ডও নয়। যা আমরা স্যাপিয়েন্সদের বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের ইতিহাস থেকে বুঝতে পারি। আগুন এবং রান্নার আবিষ্কারও যে স্যাপিয়েন্সদের বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশের পেছনে উল্লেখযোগ্য একটি ব্যাপার ছিল তা আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। সাধারণত ৬০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক গড়পড়তায় ২০০ ঘনসেন্টিমিটার। আর অন্যদিকে প্রায় আড়াই লাখ বছর সেমি মানুষদের মস্তিষ্কের ওজন ছিল গড়পড়তায় ২০০ ঘনসেন্টিমিটার। আর বর্তমানে আধুনিক মানুষদের মস্তিষ্কের ওজন ১২০০ থেকে ১৪০০ ঘনসেন্টিমিটার।

 

 

প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদের সে সকল বৈশিষ্ট্যের প্রতি আনুকূল্যতা প্রদর্শন করে যে সব বৈশিষ্ট্য টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাড়তি উপযোগিতা প্রদান করে। আমাদের বড়ো মস্তিষ্কের কী এমন বিশেষ সুবিধা ছিল? বড়ো মস্তিষ্ক দিয়ে যদি ভালো চিন্তা করা যায় তবে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর মাঝে চিন্তাশীল ও গণিতজ্ঞ কেন পাওয়া যায় না? সিংহদের মধ্যে কি কেউ অ্যারোমেটিক বুঝতে সক্ষম? তাদের পক্ষে কি সম্ভব গোডেল থিয়োরেমের অসম্পূর্ণতা অনুভব করা? বাস্তবে কুকুর, বেড়াল কেউই দার্শনিক সক্রেটিস হয়নি, কোনো শিম্পাঞ্জির মধ্যে E = MC 2 পাওয়া যায়নি! প্যারেন্টাল কেয়ার ছাড়া কী এমন দায়ী ছিল যা স্যাপিয়েন্সদের মধ্যে মহাবিশ্ববোধ তৈরি করেছে, তাদের মধ্যে উন্নত বুদ্ধির জন্ম দিয়েছে? আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক তাদের দেহের মোট ওজনের ২-৩ শতাংশ, কিন্তু মানুষ যখন বিশ্রামে থাকে তখন তাদের দেহের মোট শক্তির ২৫ শতাংশ শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্যেই খরচ হয়। অন্যদিকে অন্যান্য এপসদের ক্ষেত্রে এ শক্তি ব্যায়ের পরিমাণ ৮ শতাংশ।

 

 

ইউভাল নোয়াহ হারারি বলেন, রাষ্ট্রের সরকার যদি সামরিক খাতে বাজেটের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে শিক্ষাখাতে বাজেটের পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে তবে সামরিক খাতের তুলনায় শিক্ষাখাত উন্নত হয়। ঠিক একইভাবে মানুষও তাদের পেশিকে শক্তিশালী না করে নিউরন সেলকে পুষ্টি দিয়েছে। ১৭ ভাগ শক্তির পার্থক্য স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্ককে অন্য নর বানরদের তুলনায় বুদ্ধিমান করে তুলেছে। আমরা এই ঐতিহাসিক সংখ্যা ১৭ এর ভেতরেই হয়তো মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের রহস্যকে খুঁজে পেতে পারি। মানুষের শিকারি সংগ্রাহক জীবনে তাদের এ বড়ো মস্তিষ্ক মোটেই সুবিধাজনক ছিল না। একটি শিম্পাঞ্জি সে সময় সেপিয়েন্সের সাথে যুক্তিতর্কে জিততে পারতো না ঠিকই কিন্তু শারীরিক শক্তির কারণে তারা স্যাপিয়েন্সদের ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারতো। ২০ লক্ষ বছর ধরে মানুষের মস্তিষ্কের আকার ক্রমাগতভাবে বেড়েছে কিন্তু এ বড়ো মস্তিষ্ক তাদের বিবর্তনের ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা দেয়নি। তাদের মস্তিষ্ক তীর ও বর্শার মতো জটিল কিছু অস্ত্র তৈরি করতে পেরেছিল কেবল, এরবেশি কিছু নয়। খুব বেশি উপযোগিতা না থাকার পরও এ বড়ো মস্তিষ্কটি নিয়ে স্যাপিয়েন্সরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানীরা এখনো সম্পূর্ণভাবে জানেন না! বড়ো মস্তিষ্কের বিকাশের পর মানুষ গ্র্যাভিটির সাথে ব্যালেন্স রেখে দু-পায়ে ভর করে দাঁড়াতে শেখে, আর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ফলে তারা তাদের চারপাশের পরিবেশকে আরও ভালোভাবে জানতে পারে। আগে আমাদের হাতগুলোও পা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, এখন সে হাতগুলিও হাঁটার ঝামেলা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হলো, যে হাত দিয়ে আমরা এক সময় হাঁটতাম, যা একসময় আমাদের পা হিসেবে ব্যবহার হতো সেগুলো দিয়েই এখন আমি মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে লিখছি, এক্সটারনাল জগতের সাথে যোগাযোগ করছি, বস্তুকে নিজের ইচ্ছেমতো মুভ করছি, আমাদের আজকের এ রোবটিক সভ্যতার পেছনে কাজ করছে দুটি হাত, যা দিয়ে আমরা এক সময় এ গ্রহে হেঁটে বেড়িয়েছি।

 

 

আমাদের পূর্বপুরুষরা এ রূপান্তরিত হাত দিয়ে দূর দুরান্তে পাথর ছুঁড়ে মারতো, পাথরের অস্ত্র তৈরি করত এবং সম্ভবত এ হাত দিয়েই আমরা পৃথিবীর বুকে প্রথম আগুন জ্বালাই! যার হাতের কৌশল যতো শক্তিশালী ছিল তার টিকে থাকার সম্ভাবনাও ছিল ততোটাই বেশি। মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশের পেছনে মধ্যাকর্ষের ও যে একটি ভূমিকা আছে তা হয়তো আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। সে ভূমিকার পরিমাণ মাপা যদিও আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবে সুক্ষ্ম পেশি, অধিকতর স্নায়ু সংযোগ তৈরির পেছনে মধ্যাকর্ষের যে অতি ক্ষুদ্র একটি ভূমিকা আছে তা চাইলেই অনুমান করা যায়। সোজা হয়ে হাঁটার কারণে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে আমাদের মস্তিষ্কের দূরত্ব বেড়ে গেলো এবং সে মস্তিষ্ক ও মুক্ত হস্ত গ্র্যাভিটি দ্বারা আকৃষ্ট হতো। আমরা যখন বসে থাকি তখন গ্র্যাভিটির টান আমাদের ওপর কম ক্রিয়াশীল হয়, আর আমরা তখন নিন্মমানের শক্তিস্তরে অবস্থান করি, বসতে একটু কষ্ট হয় কারণ যতোই আমরা উপরের দিকে উঠি ততোই গ্র্যাভিটির বিপক্ষে যাই আর যখন দাঁড়াই তখন এ টানের আধিক্য আরও বেড়ে যায়। গ্রেভেটির এ টানকে আমাদের পেশি ও মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র উপেক্ষা করতে পারে না।

 

 

হাজার হাজার বছরের গ্রেভেটির এ বাড়তি টান আমাদের স্নায়ুতন্ত্রগুলোকে এতোটাই সুক্ষ্ম করে তোলে যে এটি হয়তো আমাদের মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশনগুলোকে আরও নিবিড় করে তোলে। রজার পেনরোজ বলেছিলেন আমাদের সাইনাপ্টিক নেটওয়ার্ক এতোটাই সুক্ষ্ম যে সেখানে কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা তাৎপর্যবাহী হয়ে ওঠে। আর আমরা স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্কের বিবর্তনের ইতিহাস থেকে জানতে পারি ২০ লাখ বছর পূর্বে তারা যখন সোজা হয়ে দাঁড়াতে শেখে তখন গ্র্যাভিটির সাথে তাদের স্নায়ুতন্ত্রের দ্বন্দ্ব তাদের সাইনাপ্টিক নেটওয়ার্ক সুক্ষ্ম করে তোলে। তাহলে আমরা কি ২০ লাখ বছর পূর্বে মানুষের সোজা হয়ে পৃথিবীর বুকে দাঁড়ানোর সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে পেনরোজের “নিউ এম্পেরর অব দ্য মাইন্ড’’ এর সূচনা বলতে পারি? মানুষের ডিউস হয়ে উঠার পেছনে কি ২০ লাখ বছর পূর্বের সে ঘটনাটির কোনো সম্পর্ক নেই? আমি জানি না এসব নির্বোধ কল্পনা আমার পাঠকদের বিরক্ত করবে কি না! আমি আশা করছি আমি আমার এ নির্বোধ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের কাছে পাব!

 

 

 

যা হোক, এখন আমরা জানি যে ঠিক এ সময়টাতে আমাদের হাত ও হাতের তালু আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়। সবচেয়ে পুরাতন যে হাতিয়ারটি পুরাতত্ত্ববিদরা পেয়েছিলেন সেটি ২৫ লাখ বছর পূর্বের। এতএব এটা ধরে নেওয়া যায় যে ঠিক এ সময় আমাদের আধুনিক যান্ত্রিক প্রযুক্তির প্রাথমিক ভ্রুণ তৈরি হয়। আমরা এ সময়টিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভ্রুণের বিকাশ বলে ধরে নিতে পারি। বড়ো মস্তিষ্ক আমাদের অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। আমাদের শরীরের কঙ্কাল লাখ লাখ বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে আমাদের অপেক্ষাকৃত ছোটো মস্তিষ্কের ওজন সহ্য করার উপযোগী করে। অতএব বড়ো মস্তিষ্কের ওজন সহ্য করাটা কঙ্কালের জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিল। যদিও এখন আমরা প্রখর দৃষ্টি ও দক্ষ হাত পেয়েছি কিন্তু একইসাথে আমরা পেয়েছি মেরুদণ্ডের ব্যথাও। মধ্যাকর্ষের সাথে মেয়েদের দেহের কঙ্কাল ও বড়ো মস্তিষ্ক পাল্লা দিতে গিয়ে আরও তীব্র সমস্যার সম্মুখ্যীন হয়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে তাদের কোমর হয়ে যাবে চিকন, আর কোমর চিকন হওয়ার কারণে শরীরের ভেতরের স্পেস সংকুচিত হয়ে যায় যা জন্মনালীকে করে তোলে আরও সরু। একদিকে শিশুদের বড়ো মস্তিষ্ক আর অন্যদিকে সরু জন্মনালী এ দুটি সংকট একটি সার্ভাভাইভাল মেশিনকে মোকাবিলা করতে হয়। যার ফলে জন্মকালীন মৃত্যুর আশংকাও বেড়ে গেল। এ সমস্যাটিকে সমাধান করতে হলে একজন প্রকৌশলী কী সিদ্ধান্ত নিতেন? ডাক্তারদের মতো করে নিশ্চয় সিজার করতেন? কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন সিজার করেননি। আমাদের জিন যেহেতু সচেতন কোনো অ্যাজেন্ট নয় অতএব সে এ সমস্যাটিকে একজন বুদ্ধিমান প্রকৌশলীর চোখে হয়তো দেখেনি। ফ্লোরেস দ্বীপ মূল ভুখন্ড থেকে পৃথক হওয়ার পর সেখানে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, সে দ্বীপে যারা কম খেয়ে বেঁচে থাকতে পারতো তারা টিকে থাকে আর যারা অপেক্ষাকৃত লম্বা ও স্বাস্থ্যবান ছিল তারা না খেতে পেয়ে মারা পড়ে। আর লাখ লাখ বছর চলমান এ নির্বাচনী চাপের সাথে অভিযোজিত হতে গিয়ে সে দ্বীপের সব বড়ো প্রাণীরা বিলুপ্ত হয়ে যায়, শুধুমাত্র সে সকল প্রাণীদের জিন তাদের জিনপুলে ডোমিনেন্ট হয় যাদের শরীর অপেক্ষাকৃত ছোটো ও যারা খুব অল্প পরিমাণে খেয়ে বেঁচে থাকে।

 

 

আর আমরা এখন জানি ফ্লোরেনসিয়েসিসদের কথা, যাদের শরীর ছিল এক মিটার লম্বা। সে দ্বীপে হাতিরাও ছিল কয়েক মিটার আকারের যা পুরাতত্ত্ববিদেরা তাদের ফসিল রেকর্ড ও যন্ত্রপাতি দেখে জানতে পারে! যখন স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্ক বড়ো হয়ে গেল আর অন্যদিকে জরায়ুর ক্রমশ সরু হয়ে উঠল ঠিক তখন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, যে সকল ভ্রুণ পরিপূর্ণ শারীরিক বিকাশের পূর্বে নাদুসনুদুস অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে তাদের মায়েদের মৃত্যুহার কমে যায় আর এতে করে তাদের নাদুসনুদুস শরীর তাদের মায়ের যত্ন ও ভালোবাসার ভেতর টিকে থাকে আর অন্যদিকে যারা পরিপূর্ণ শারীরীক বিকাশ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের মধ্যে মৃত্যুহার বেড়ে যায়। আমরা জানি যে জিনের উদ্দেশ্য জিনের সংখ্যাবৃদ্ধি করা অতএব জিনের জন্য এটা উপযোগী হবে না যদি না সে সঠিক সময়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার জিনগুলোকে সক্রিয় করে তোলে, তার চেয়ে বরং জিন সে সকল শরীরের ভেতরই নিজেকে নিশ্চিত করতে পারবে যারা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই নাদুসনুদুস সন্তান জন্ম দেবে এবং জিনপুলে সে সকল জিনই সংখ্যাধিক্যতা অর্জন করবে। মায়ের শরীর হলো জিনের স্বার্থপর উদ্দেশ্য পূরণের একটি রোবট, যে রোবটটি সন্তানের ভ্রুণ বিকাশের জন্য গর্ভাশয় শেয়ার করেছে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দিয়েছে অতএব এ রোবটটি নিশ্চয় চাইবে না তাদের সন্তানরা তাদের অনপুস্থিতিতে অযত্ন ও অবহেলার ভেতর দিয়ে টিকে থাকুক এবং অপুষ্টিতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেহেতু একটি শিশুর সাথে মা তার পিতার চেয়ে বেশি জড়িত, অতএব পিতার তুলনায় শিশুটির প্রতি মায়ের যত্ন বেশি থাকবে।

 

 

ক্যানিভাল মাকড়সা ও ফড়িংদের মধ্যে দেখা যায় এদের পুরুষরা স্ত্রী সদস্যদের সাথে সঙ্গম করার সময় স্ত্রী সদস্য পুরুষ সদস্যটির মাথাটি জীবন্ত কামড়ে খেয়ে ফেলে! কিন্তু তাদের স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় থাকায় তারা তখনও সঙ্গম চালিয়ে যায়। আর একটু পর আস্তে আস্তে তাদের সমস্ত শরীর স্ত্রী মাকড়সাটির পেটে চলে যায় যেন বাবার শরীর খেয়ে শিশুদের ভ্রুণ প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান পায়। মৌমাছিদের মধ্যেও দেখা যায় রানী মৌমাছির সাথে সঙ্গম করার সময় ধর্মসভার পুরুষদের তলপেট সহ পেনিস ছিড়ে যৌনাঙ্গের ভেতর আটকে যায় এবং শূন্য থেকে মৃত শরীর গুলো একে একে নিচে পড়তে থাকে। একটি মিটিং ফ্লাইটে উড়ন্ত রাণী এভাবে একত্রে তার পছন্দ মতো বিশ থেকে ত্রিশজন পুরুষের সাথে সঙ্গম করে এবং তাদের প্রত্যেকের সাথে একই ঘটনা ঘটে।

 

 

শুনতে যতোই খারাপ লাগুক না কেন জিনের কাছে আপনার শরীর বা মস্তিষ্ক কোনোটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন হোন অথবা নাসার কোনো নভৌচারি হোন জিনের কাছে আপনার শরীর ও মনের কোনো অর্থ নেই, জিন এগুলোকে তার টিকে থাকার জন্য বায়োলজিক্যাল রোবট হিসেবে ব্যবহার করে! রবীন্দ্রনাথ যদি ধর্মসভার পুরুষ মৌমাছি হতো তবে তার তলপেট সঙ্গমের সময় ছিড়ে নারী মৌমাছির যৌনিতে আটকে যেত, নিউটন যদি ক্যানিভাল মাকড়সা হতো মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সে সঙ্গম চালিয়ে যেত এবং স্ত্রী সদস্যটি এক কামড়ে কিছুক্ষণ পরই নিউটনের মাথাটি খেয়ে ফেলত! আমাদের শরীর হলো একটি যন্ত্র, এর কাজ জিনকে এক শরীর থেকে প্রজননের মাধ্যমে অন্য শরীরে পৌঁছে দেওয়া আর এ কাজটি করার জন্য জিনকে যদি কোনো শরীর বা মনকে হত্যা করতে হয় জিন সেটি করবে! বংশরক্ষা করার জন্য পুরুষের শরীর অপেক্ষা নারীর শরীর গুরুত্বপূর্ণ বলে ক্যানিভাল মাকড়সারা তাদের জিনকে রক্ষা করার জন্য নিজের শরীরকে হত্যা করে কারণ জন্মের পর সন্তানের লালন পালন ও ভরণপোষণের জন্য একজন মায়ের উপস্থিতি একজন বাবার উপস্থিতির তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ঠিক একই কারণে স্বার্থপর জিন স্যাপিয়েন্স শিশুদের অপেক্ষাকৃত অপরিপক্ক অবস্থায় জন্ম দেওয়ার জন্য শরীরকে প্রোগ্রাম করবে যাতে করে বড়ো মস্তিষ্কের চাপ সামলাতে গিয়ে কোনোভাবে মায়ের মৃত্যু না ঘটে!

 

 

শিশুর বিকাশে মায়ের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও নিস্বঃঙ্গ মায়েরা শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে পারে না। একজন মানব শিশুকে লালন পালন করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার ও প্রতিবেশীদের। একটি মানব শিশুকে বড়ো করতে একটি গোত্রের প্রয়োজন হয়। বিবর্তন তাদেরকেই সহায়তা করেছে যারা নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ইট, মাটির পাত্র, চুনাপাথর ইত্যাদি পোড়ানো বা শুকানোর জন্য ব্যবহৃত চুল্লি থেকে যেমন চিনামাটির পাত্র বেরিয়ে আসে ঠিক তেমনি বেশিরভাগ স্তন্যপায়ীর জরায়ু থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। এখন আপনি যদি এ চিনামাটির ফুলদানী আকারের কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে চান তবে হয়তো এতে দাগ ফেলতে হবে অথবা ভাঙতে হবে। আর মানব শিশু জন্ম হয় এমনভাবে ঠিক যেমনি চুল্লি থেকে গলিত শিশা বের হয়ে আসে। এ জন্য আপনি চাইলে তাকে খ্রিস্টান বা বোদ্ধ, পুঁজিবাদী অথবা সাম্যবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। ২০ লাখ বছর পূর্বে মানুষ ছিল খাদ্য শৃংখলের মাঝামাঝি পর্যায়ের একটা প্রাণী। তাদের বড়ো মস্তিষ্ক ছিল, তারা যন্ত্রপাতি তৈরি করতে সক্ষম ছিল আর এটাও সত্য ছিল যে তারা এসব হাতিয়ারের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাভোগ করতো যা মানব জাতিকে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রাণীতে পরিণত করেছিল। বড়ো মস্তিষ্ক, বুদ্ধিমত্তা ও যন্ত্র থাকা স্বত্বেও মানুষ বেশিরভাগ সময় ফলমূল সংগ্রহ ও ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গ খেয়ে টিকে থাকত। তারা সবসময় বড়ো বড়ো প্রাণীদের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ থাকতো আবার বেশিরভাগ সময় অন্য প্রাণীদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়েই তারা জীবন কাটিয়ে দিত। একেবারে প্রথম দিকে পাথরের তৈরি যে সকল হাতিয়ার পাওয়া যায় সেগুলো দিয়ে তারা শুধুমাত্র অস্থিমজ্জা বের করে খেতে পারতো।

 

 

 

দশ লাখ বছর পূর্বের কথা ভাবুন। মনে করুন, একদল সিংহ একটি জিরাফকে শিকার করছে। আপনাকে তখন ঝোপের আড়ালে এ দৃশ্য লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে হতো। যদি তখন আপনি ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেন তখন সিংহের পরিবর্তে আপনি নিজেই শিকারে পরিণত হতেন। এ জন্য আপনার জন্য উচিত হবে বরং লুকিয়ে লুকিয়ে অপেক্ষা করা। আপনার প্রচন্ড ইচ্ছে জাগলো জিরাফের মাংস খাওয়ার কিন্তু এরপরই শুরু হলো হিংস্র শেয়ালের পালা, তারা দ্বিতীয় ধফায় ভক্ষণ করল আর ঠিক তারপরই সুযোগ এলো আপনার জন্য? আর এতোক্ষণে হাড়ের ভেতরের অস্তিমজ্জা ছাড়া আপনার জন্য অবশিষ্ট আর কোনোকিছুই রইল না। এই যে দশ লাখ বছর পূর্বের এ মনস্তত্ব, তা এখনো আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে, আমাদের ডিএনএ এখনো অবচেতনে দশ লাখ বছর পূর্বের সে জিরাফের মাংসের অতৃপ্তির কথা মনে রেখেছে যার জন্য এখনো আমরা চর্বি ও স্নেহ জাতীয় খাবার অত্যধিক পছন্দ করি। এখন আমরা চাইলেই যেকোনো প্রাণীর মাংস খেতে পারি, ফ্রিজের মধ্যে প্রচুর মাংস জমা রাখতে পারি কিন্তু জেনেটিক্যাল অতৃপ্তি আমাদের এসব খাবারের প্রতি আরও বেশি লোভী করে তোলে যা আমাদের শরীরের সাম্প্রতিক অনেক ওষুখের কারণ! Greedy Gene তত্ত্ব আমাদের অন্তত তাই বলে!

 

 

চার লাখ বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্সরা আকস্মিক খাদ্য চক্রের প্রথম সারিতে চলে যায়, এটা তাদের সাথে ঘটেছিল অনেকটা ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখার মতো, আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে ও অবচেতনে যেমনি ভাবে এ মহাবিশ্বটি আমাদের সামনে আমাদের অস্তিত্বকে উপস্থাপন করেছে আর ধুম করে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে এ সীমাহীন মহাকাশে আবিষ্কার করেছি ঠিক তেমনি স্যাপিয়েন্সরাও জানতো না তাদের আকস্মিক এক লাফে খাদ্য শৃঙ্খলের প্রথম পর্যায়ে উঠে আসার কারণ কী? কদিন আগেই যে প্রাণিটি তৃণভূমিতে চরে বেড়াতো আকস্মিক সে প্রাণিটি যখন নিজেকে নিজের সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় খাদ্য শৃংখলের প্রথম সারিতে আবিষ্কার করল ঠিক তখন তার মধ্যে জাগ্রত হলো তীব্র আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা। আর এ অন্তহীন অনিশ্চয়তা তাকে করে তুলল নৃশংস ও প্রলয়ংকরী। ভয়ানক যুদ্ধ আর পৃথিবীর বড়ো বড়ো প্রাকৃতিক দূর্যোগগুলো স্যাপিয়েন্সদের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা থেকে সৃষ্টি হওয়া আগ্রাসী আচরণেরই ফলাফল! তারা তাদের ভয় ও অনিশ্চয়তাকে আড়াল করার জন্যেই এমন নৃশংস হয়ে উঠেছিল! কারণ তারা বুঝতে পারেনি যে আসলে আকস্মিক তাদের সাথে এটা কী হলো! মূলত গ্রেভেটির হস্তক্ষেপ মুক্ত হাত ও জটিল স্নায়তন্ত্রকে ব্যবহার করে স্যাপিয়েন্সরা সোলার সিস্টেমের এ গ্রহটির বুকে সর্বপ্রথম আগুন জ্বালিয়ে দেয়, সে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে বনে জঙ্গলে সর্বত্র! একবার বন পুড়ে শেষ হলেই সেখানে তৈরি হতো পথ, আর সে পথে পড়ে থাকতো লক্ষ্য লক্ষ্য প্রাণীর পোড়া দেহ! এ আগুনই ছিল ঈশ্বরের পৃথিবীর বুকে আধিপত্যের প্রথম অলৌকিকতা!

 

 

তিন লাখ বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাস, নিয়ান্ডারথাল এবং স্যাপিয়েন্স প্রত্যেকেই নত্য প্রয়োজনীয় কাজে আগুনের ব্যবহার শিখে যায়। তারা আগুন জ্বালায় আর অন্য প্রাণীরা ভয়ে পালায় যদিও স্যাপিয়েন্সদের কাছে ঠিক তখনও প্রাণীদের স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পনের কোনো কারণ জানা ছিল না। ফিজিক্সের সূত্র কি জানে এ মহাবিশ্ব তারই সৃষ্টি? মূলত অন্যান্য প্রাণীরা কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে খাদ্য শৃংখলের প্রথম সারিতে এসেছিল, আর এ জন্য তারা বাস্তসংস্থানের সাথে নিজেদের খুব ভালোভাবে খাপখাইয়ে নিতে পেরেছিল কিন্তু স্যাপিয়েন্স এত অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্য শৃংখলের প্রথম সারিতে এসেছিল যে তারা সেটা বুঝে উঠারই সুযোগ পায়নি! বুদ্ধিমত্তার বিকাশের পেছনে রান্নারও যে একটা ভূমিকা আছে সেটা আমরা অনেকেই জানি না। কিন্তু মানব সভ্যতার বিকাশের পেছনে রান্নাকে একটি বড়ো পদক্ষেপ হিসেবে দেখা উচিত। রান্নার ফলে বৈচিত্রময় খাবারের একটি অনন্ত সম্ভাবনা তৈরি হলো। প্রকৃতিতে এমন অনেক খাবার ছিল যা স্যাপিয়েন্সরা হজম করতে পারতো না। যেমন- গম ও আলুর মতো খাবারগুলিতো মানুষ রান্না করা ছাড়া তো খেতেই পারতো না। রান্নার করার ফলে তারা বৈচিত্রময় খাবার খাওয়ার সুযোগ পেলো আর রান্নার আরও একটি সুবিধা হলো রান্নার ফলে জীবাণু ও পরজীবিরা মারা যায়। বিশেষ করে মাংসের ক্ষেত্রে। আরও অনেক খাবারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। যখনই মানুষ রান্না করা খাবার খেতে শুরু করল তখন তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও আকস্মিক কমে যেতে শুরু করল। যদি তা না হতো তবে জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করতো, বংশবিস্তার করতো এবং তারা মারা যেত। আমাদের নিকটবর্তী আত্মীয় শিম্পাঞ্জিরা গড়ে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা খাবার চিবানোর জন্য অপচয় করতো। তাদের পরিপাকতন্ত্র যাতে খুব সহজেই খাবার পরিপাক করতে পারে এ জন্যেই তারা এ কাজটি করতো। আর এখন স্যাপিয়েন্সরা আগুন দিয়ে রান্না করে খায় তাই দিনের মধ্যে এক ঘণ্টা সময়ই তাদের এ কাজের জন্য যথেষ্ট ছিল। রান্নার আবিষ্কারের ফলে তাদের খাবার চিবানো সহজ হয়ে উঠলো, আর এতে করে অপেক্ষাকৃত ছোটো দাঁত, চোয়াল ও খাদ্যনালী দিয়েই তারা অনায়াসে টিকে থাকতে পারতো। রান্নার আবিষ্কারের পূর্বে স্যাপিয়েন্সদের দাঁত, চোয়াল ও খাদ্যনালী অপেক্ষাকৃত অনেক বড়ো ছিল।

 

 

আজ আমরা নারী পুরুষের সৌন্দর্যের যে আদর্শ মডেল বিচার করে থাকি সে সৌন্দর্যের মডেল হয়তোবা তাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে খাটত না। আমাদের চেহারার সৌন্দর্য বিকাশের পেছনেও যে রান্নার একটি বিশাল অবদান আছে সেটাকে বিজ্ঞানীরা এখন কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারে না। যদিও জেনিফার লরেন্স, শালিনি উডলে অথবা বারবারা পেলভিন; তাদের আজকের সৌন্দর্যের পেছনে ৪ লক্ষ বছর পূর্বে পৃথিবীর বুকে স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা যে আগুন জ্বালিয়ে ছিল সে আগুন ও রান্নার গুরুত্ব সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই রাখে না, ফিজিক্সের সূত্র যেমন মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে তার ভূমিকা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না ঠিক তেমনি ঐশ্বরিয়া রায় অথবা কায়া গার্বারেরও জানা নেই তাদের রুপের রহস্য কী! হয়তো বা তাদের সৌন্দর্যের রহস্যের পেছনে এখন তারা ফেয়ার এন্ড লাভলি মাল্টিভিটামিন অথবা O-3 কে কৃতিত্ব দেবে!

 

 

কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন রান্না করা খাবারের সাথে আমাদের অন্ত্রনালী ছোটো হওয়া এবং মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধির সরাসরি একটি সম্পর্ক আছে? রান্নার ফলে খাবার নরম হয়ে যেত, আর নরম খাবার পরিপাক করতে আমাদের অন্ত্রের সময় ও শক্তি ক্ষয়ের পরিমাণও কমে যেত। এতদিন যে শক্তি আমরা খাবার পরিপাকের জন্য খরচ করতাম সে শক্তির এভাবে সাশ্রয় ঘটল। এর এতে করে এ বাড়তি শক্তি আমরা আমাদের বড়ো মস্তিষ্কের জন্য খরচ করতে পারতাম? আমরা জানি বিবর্তন সময় ও শক্তির অপচয় রোধে খুবই কৃপণ। সে অপেক্ষাকৃত কম সময় ও শক্তি অপচয় করে অধিক সুবিধা আদায় করতে চায়। আর এভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন আমাদের অন্ত্রের আকার ছোটো করে দিয়ে মস্তিষ্কের আকার বড়ো করে দিয়েছিল যা স্যাপিয়েন্স ও নিয়ান্ডারথালদের বিকাশ ঘটায়! আগুন যদি আবিষ্কৃত না হতো তবে রান্নার অস্তিত্ব ছিল অসম্ভব আর যদি রান্না করা খাবার না খেতে পারতাম তবে বড়ো মস্তিষ্কের বিকাশ হয়ে উঠত অসম্ভব অতএব আজ আমরা যে বড়ো মস্তিষ্কের প্রাণীদের দেখতে পাচ্ছি, যাদের নিউরন সেল থেকে এ রোবটিক্স সভ্যতার জন্ম, যাদের সাইনাপ্টিক নেটওয়ার্ক থেকে রকেট, বিমান এবং সুপার কম্পিউটার বেরিয়ে এসেছে ঠিক যেমনি আমাদের পূর্ব পুরুষদের শরীর থেকে তাদের ফসিল বেরিয়ে আসে, আমাদের আজকের সম্পূর্ণ সভ্যতা হয়তো বা স্যাপিয়েন্স নারীদের (পুরুষও হতে পারে) পাতিলে উত্তপ্ত রান্না! আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে সম্ভবত ৩ লাখ বছর পর্যন্ত আমাদের পূর্ব পুরুষরা পাতিলের ভেতর রান্না করে এসেছে!

 

 

এক লাখ বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্সরা আফ্রিকার নীলনদ ঘুরে সিনাই উপদ্বীপ পেরিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পৌঁছায়। এই এলাকা তখন নিয়ান্ডারথালদের দখলে ছিল। স্যাপিয়েন্সরা সেখানে পৌঁছাবার পর প্রাথমিকভাবে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিল। স্থানীয় লোকজনের অসহযোগিতা, বৈরি পরিবেশ এবং অচেনা রোগ বালাই তাদের সে ব্যর্থতার কারণ হতে পারে। স্যাপিয়েন্সরা তখন পিছু হটে আসে এবং নিয়ান্ডারথালরাই তখন পুরো মধ্য এশিয়া জুড়ে একচ্ছত্র ভাবে বসবাস করত। স্যাপিয়েন্সদের এ পরাজয়ের ইতিহাস থেকে বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারে তাদের মস্তিষ্কের গঠন আমাদের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল, তাদের শেখার, মনে করার এবং পারস্পরিক তথ্য আদান প্রদান করার ক্ষমতা সীমিত ছিল। একজন স্যাপিয়েন্স যে অন্য কারও সাথে কথা বলবে, তথ্য আদান প্রদান করবে, ধর্ম প্রচার করবে অথবা বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করবে তাদের মস্তিষ্ক তখন ঠিক এতটা উন্নতভাবে বিকশিত হয়নি। স্যাপিয়েন্সরা কীভাবে চিন্তা করতো সেটা বোঝার চেষ্টা করা বর্তমান মানুষদের জন্য খুবই কঠিন। এরপরের ইতিহাস ছিল খুবই চমকপ্রদ। আনুমানিক ৭০ হাজার বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্সরা দ্বিতীয়বারের মতো আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। তবে এবার তারা নিয়ান্ডারথাল, হোমো ইরেক্টাস অথবা ডেনিসোভাদের এশিয়া থেকে তো বটেই, সমস্ত গ্রহ থেকে তাদের অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়! খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপ এবং এশিয়ায় পৌঁছে যায়।

 

 

প্রায় ৪৫ হাজার বছর পূর্বে তারা সাগর পাড়ি দিতে শেখে এবং অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে যায়। ৭০- ৩০ হাজার বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্স নৌকা, প্রদীপ ও সুঁই সুতা আবিষ্কার করে! শীতের দেশে গরম কাপড় বোনার জন্য এ সুঁই সুতা জরুরি ছিল। কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল স্যাপিয়েন্সদের পক্ষে? এর ব্যাখ্যা জানার জন্য আমাদেরকে জেনেটিক্সের সহযোগিতা নিতে হবে। জিন হলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের একক। একটি প্রাণী তার বংশগতভাবে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্য জিনের নিকট দায়ী। জিনপুলে জিনের বিভিন্নতার কারণে প্রজাতির মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এ জিনগত পার্থক্যের কারণে আমাদের এক এক জনের স্বভাব চরিত্র এক এক রকম হয়ে থাকে। কেউ শান্ত শিষ্ট আবার কেউ বদমেজাজি এবং রাগী। দেখা যায় কেউ খেলাধুলায় চোকস আবার কেউ বা লিখালিখিতে। জিনপুলের কোনো একটি জিনের সংখ্যাধিক্যের কারণে অথবা নতুন কোনো জিনের অনুপ্রবেশে অনেক সময় প্রজাতির মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন দেখা দেয়। জিনের পরিব্যক্তি বা মিউটেশনের মাধ্যমে আগের কোনো বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হতে পারে বা নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য যুক্ত হতে পারে।

 

 

৭০ হাজার বছর পূর্বে স্যাপিয়েন্সদের জিনের একটি আকস্মিক মিউটেশন তাদের নিউরনের সংযোগ পদ্ধতি বদলে দেয়। আর এর ফলে তারা একে অপরের সাথে স্বার্থকভাবে যোগাযোগ করার জন্য আয়ত্ত করতে পারে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষা! আর যে জিনগুলোর মিউটেশন মানব মস্তিষ্কের জ্ঞানের বিবর্তনের সাথে জড়িত ছিল তার একটি জিন হলো ASPM যেটি আমাদের ব্রেন ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীরা মনে করেন ASPM এবং আরও কিছু জিনের কারণেই মানুষ বুদ্ধিমান, এপসরা নয়। যাদের ASPM জিন ডিফেক্টিভ তারা microcephaly নামক একটি রোগে আক্রান্ত হয় যার জন্য তাদের খুলি আমাদের পূর্বপুরুষ অস্ট্রালোপিথেকাসদের মতো ক্ষুদ্র থাকে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন ASPM জিনটি ছয় মিলিয়ন বছরে ১৫ বার পরিবর্তিত হয়েছে শিম্পাঞ্জি থেকে আমাদের আলাদা হওয়ার সময় থেকে।

 

 

একশত হাজার বছর পূর্বে এ জিনটির একবার মিউটেশন ঘটেছিল যখন মডার্ন হিউম্যান আফ্রিকা থেকে বিকশিত হয়েছে। ৫৮০০ বছর পূর্বে এ জিনটির আবার মিউটেশন ঘটে যখন মানব সভ্যতা লিখিত ভাষা এবং কৃষিকাজ করতে শেখে। যদি এটি সত্য হয় তবে বিজ্ঞানীরা এর বর্তমান উপস্থিতি ডিটারমাইন করতে পারে এবং এর মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যত বুদ্ধিমত্তাকে পরিমাপ করতে পারে।

 

 

২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের বিজ্ঞানীরা RIM-94 নামক একটি জিন আইসোলেটেড করেন যেটি ইন্ডিপেন্ডেটলি একমাত্র হোমো সেপিয়েনদের মধ্যেই পাওয়া যায়! এই জিন ছয় মিলিয়ন বছর পূর্বে মানুষের জিনোমে Evolve হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা খুব দ্রুত আবিষ্কার করেন, কোনো সিঙ্গেল জিন নয়, সিরিজ অব জিন, একে অপরের সাথে কমপ্লেক্স পদ্ধতিতে ইন্টারেক্ট করে মানুষকে শিম্পাঞ্জিদের চেয়ে বুদ্ধিমান করে তুলেছে!

 

 

যদি HAR1 এবং ASPM জিন একে অপরকে tweaked করে তবে সহসা মানুষের মস্তিষ্ক শিম্পাঞ্জি থেকে এক্সপেন্ড হয়ে যায়। এতে করে তাদের গাড়ের পেশি শক্ত হয় এবং শরীরের আয়তন বৃদ্ধি পায় যেন প্রসারিত মস্তিষ্ককে সাপোর্ট দিতে পারে কিন্তু এই বড়ো মস্তিষ্ক যদি আঙুলের মাধ্যমে বস্তুকে নাড়াচাড়া করতে অক্ষম হতো তবে সম্পূর্ণ মস্তিষ্কটাই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠত। HAR2 জিনও অল্টার হয়েছিল আঙুলের ব্যবহার টাকে আরও নিপুণ করে তোলার জন্য? আরও একটি জিন অল্টার হয়েছিল যা আমাদের মেরুদন্ডকে শক্ত করে এবং আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারি আর যেটি আমাদের দুটি হাতকে মুক্ত করে দিয়েছিল। FOX2 জিনের কারণে আমরা একে অপরের সাথে কমিউনিকেট করতে পারি, নয়তোবা আমাদের বুদ্ধিমত্তা অর্থহীন হয়ে পড়ত। স্যাপিয়েন্সরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে FOX2 জিনের কারণেই।

 

 

এ অল্পকিছু জেনেটিক্যাল এডিশনের কারণেই আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স, নয়তো আমরা এপসই থেকে যেতাম। আর এতে করে মানব সভ্যতার অস্তিত্বই অসম্ভব ছিল। যদি বিজ্ঞানীরা জিন থেরাপির মাধ্যমে এপসদের মানুষে পরিণত করে তবে তারাও আমাদের মতো হতে পারবে, তাদের মেরুদন্ড দৃঢ় হবে, ভোকাল কর্ড থাকবে; আমাদের মতো তারাও হবে বুদ্ধিমান! কিন্তু প্রশ্ন হলো কোনো ইভোল্যুশনাল ফোর্সের কারণে আমরা এ জেনেটিক্যাল ইনহেরিটেজ পেয়েছি? কেন সর্বপ্রথম ASPM, HAR1 এবং FOX2 জিন বিকশিত হলো? একটি থিয়োরি অনুসারে, মিলিয়ন বছর পূর্বে আফ্রিকাতে ক্লাইমেট চেঞ্জ হয়। আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে এবং জঙ্গল গুলো ক্রমস অপসৃত হয়ে যায়। আমাদের পূর্ব-পুরুষরা বৃক্ষহীন মসৃন ভূমিতে নেমে আসে। এখানে তারা শিকার করতো আর এ জন্য প্রয়োজন ছিল অস্ত্র? ইভোল্যুশন তাদের শিকার ও সোজা হয়ে হাঁটার জন্য ফোর্স করেছিল। যা তাদের হাতগুলোকে মুক্ত করে দেয় এবং আঙুলের জন্ম দেয় যার মাধ্যমে তারা যন্ত্র নাড়াচাড়া করতে পারে। আর এই যন্ত্রপাতি তৈরির সাথে কো-অর্ডিনেট করতে গিয়ে তাদের মস্তিষ্ক বড়ো হয়ে ওঠে। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন আমরা যখন নতুন কিছু শিখি তখন আমাদের নিউরন সেলের সংখ্যা পরিবর্তিত হয় না ঠিকই কিন্তু নিউরনগুলোর ভেতরের সংযোগ পদ্ধতি সম্পূর্ণ বদলে যায়।

 

 

 

এ থিয়োরি অনুসারে, মানুষ টুলস তৈরি করেনি টুলসই মানুষকে তৈরি করেছে। হ্যাঁ, এটি সত্য স্যাপিয়েন্সরা ভাষার বিকাশের পূর্বে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিখেছিল, সে যন্ত্রপাতির ব্যবহার শেখার সময় যন্ত্রপাতির সাথে তাদের ব্রেন কো-অর্ডিনেট করতো, আর এতে করে তাদের মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশনের সংযোগের সংখ্যা বেড়ে যায়, আমরা জানি যে HAR1, ASPM, FOX2 জিনের কারণেই আমাদের ব্রেন শিম্পাঞ্জি থেকে আলাদা, মস্তিষ্কের মাত্র ১.৫ ভাগ জিনগত পার্থক্য স্যাপিয়েন্সদের ব্রেনকে জটিল করে তুলেছে, তাদের মস্তিষ্কে ১০০ মিলিয়ন বিলিয়ন নিউরাল কানেকশন তৈরি হয়েছে, হতে পারে এটাই স্যাপিয়েন্সদের বড়ো মস্তিষ্কের গঠন ও সেটি এখনো টিকে থাকার কারণ! স্যাপিয়েন্সদের ভাষাই কিন্তু পৃথিবীর প্রথম ভাষা ছিল না। অন্যান্য প্রাণীরাও ধ্বনি সংকেতের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতো। এমনকি পোকামাকড় ও পিঁপড়া একে অপরের সাথে কমিউনিকেশন করতে পারে। কিন্তু তাদের ভাষার মধ্যে কোনো টেন্স ছিল না, স্যাপিয়েন্স ছাড়া অন্যকোনো প্রাণীর ভাষায় পাস্ট এবং ফিউচার টেন্স নেই। তাই তাদের ভাষা শুধু বর্তমানেরই প্রতিনিধিত্ব করতো। যেমন সোনালি পশমওয়ালা এক জাতীয় বানর তারা সংকেতের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। জীববিজ্ঞানীরা তাদের এমন একটি সংকেতের অর্থ উদঘাটন করতে সক্ষম হয় যার অর্থ সাবধান সিংহ আসছে! গবেষকরা এ সংকেতটি রেকর্ড করে যখন অন্য সবুজ বানরদের শুনিয়েছিল তখন বানর গুলো থেমে গেলো এবং ভয়ার্ত চোখে নিয়ে উপরের দিকে তাকালো। যখন একই বানরের দলকে দ্বিতীয় সংকেতটি শোনানো হলো তখন তারা লাফ দিয়ে গাছে চড়ে বসল।

 

 

কিন্তু প্রশ্ন হলো তোতা পাখিও তো মানুষের মতো কথা বলতে পারে, আইনস্টাইনের ভাষার সাথে তার ভাষার পার্থক্য কী? হ্যাঁ পার্থক্য আছে, মানুষের FOX2 এবং ASPM জিনের কারণে তাদের ব্রেন অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে আলাদা ছিল, স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্কে Sense of Tomorrow রয়েছে, যে ঘটনা এখনো ঘটেইনি তারা সে ঘটনা সম্পর্কেও কথা বলতে পারে, অস্তিত্বহীন বাস্তবতা নিয়ে ফিউচার সিমুলেট করার ক্ষমতাই স্যাপিয়েন্সদের ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা সীমিত সংখ্যক ধবনি ও সংকেতকে জোড়া লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য তৈরি করতে পারে। যেহেতু স্যাপিয়েন্সদের ভাষায় ক্রিয়ারকাল ছিল অতএব তাদের ভাষাও ছিল টাইম ট্রাভেলার্স। তাদের ভাষা চাইলে টাইম মেশিনের মতোই তাদের মস্তিষ্ককে অতীতে নিয়ে যেত এবং ভাষার টাইম মেশিনে ভ্রমণ করেই তারা ভবিষ্যত সম্পর্কে বিভিন্ন কাল্পনিক গল্প বলতে পারতো। স্যাপিয়েন্সরা ভাষার মাধ্যমে তাদের প্রতিবেশীদের কাছে পরিবেশের তথ্য আদান প্রদান করতো, গল্প করত, খুনসুটি করত, আড্ডাবাজি করত। আর এটা আমাদের জানা কথা যে বাইসন অথবা ডায়নোসরের গল্পের চেয়ে তাদের কাছে অন্য মানুষের গল্পই জনপ্রিয় ছিল।

 

 

একটি তত্ত্ব অনুসারে বাইসনের খোঁজখবর রাখার চেয়ে গোষ্ঠীর কে কাকে হিংসা করে, কার মেয়ে কোনো ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে , কে সৎ বা কে অসৎ এসব তথ্য জানা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফিজিক্সের সূত্রগুলো চিরকাল অপরিবর্তনশীল হলেও মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নিত্য পরিবর্তনশীল আর এ পরিবর্তনশীল সম্পর্কগুলোকে বুঝার জন্য যে পরিমাণ তথ্যের প্রয়োজন পড়ে তার পরিমাণ অনেক বিশাল। শুধু ৫০ জনের একটি দলে ১২৫০ ভাবে একজন মানুষ অন্য আর একজন মানুষের সাথে সম্পর্ক করতে পারে। অন্যান্য নরবানরদের মধ্যে ক্রিয়ারকাল সম্পন্ন ভাষা না থাকায় তাদের একে অপরের সাথে আড্ডাবাজি অথবা গল্প করাটা খুবই কঠিন ছিল। এমনকি নিয়ান্ডারথাল এবং আদিম যুগের স্যাপিয়েন্সরাও আড্ডাবাজি করতে পারতো না, একে অপরের সমালোচনা করতে পারতো না কিন্তু এ কথা বলাটা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার জন্য অপরিহার্য ছিল। গল্প করার মাধ্যমে স্যাপিয়েন্সরা একে অন্যের শরীর ও মন সম্পর্কে সংবাদ রাখতে পারতো, একে অন্যের মস্তিষ্কের নিউরনের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে অবগত হতো! তারা একজনের পেছনে অন্যজন সমালোচনা করতো আর এ গল্পবলা ও পরচর্চার মাধ্যমে তারা বিশাল বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের এ নতুন সমাজব্যাবস্থাকে বোঝাটা ছিল নিয়ান্ডারথালদের পক্ষে একেবারেই দুস্কর ও সুকঠিন।

 

 

গসিফ থিয়োরি অনুসারে স্যাপিয়েন্সদের ভাষার উদ্ভবই হয়েছে অন্যের সমালোচনা করার জন্যে, পেনরোজ নিশ্চয় কফি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ব্ল্যাকহোলের গাণিতিক মডেল সংক্রান্ত কোনো সম্মেলনের কথা আলোচনা করবেন না বরং তার পুরো আলোচনা জুড়ে থাকবে কোন প্রফেসর পরকিয়া করতে গিয়ে বউয়ের কাছে ধরা পড়ল অথবা কোন গবেষক তার গবেষণার টাকা মেরে দিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি কিনল। স্যাপিয়েন্সদের ভাষার একমাত্র বিশেষত্ব ছিল এ ভাষা টাইম ট্রাভেলার। এ ভাষা থ্রি-ডাইমেনশনাল স্পেসে ঘটেনি এবং কোনোদিন ঘটবে না এমন সব গল্প তৈরি ও সে গল্পে বিশ্বাস করতে পারে। আপনি একটা শিম্পাঞ্জিকে যদি কোনোভাবে বুঝিয়ে বলেন, আমাকে এই কলাটা দাও আমি তোমাকে স্বর্গে দশটা কলা দেবো। শিম্পাঞ্জি আপনার গল্পে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নির্লিপ্ত মনে কলাটি খেয়ে ফেলবে কারণ তার মধ্যে FOX2 এবং ASPM জিন নেই, যার জন্য তার মস্তিষ্কে আগামীকালকের অনুভূতি বা SENSE OF TOMORROW কাজ করেনা, তার মস্তিষ্ক PRISONER OF PRESENT? তার কনশাসনেস শুধু বর্তমান মুহূর্তটিকে ডিটারমাইন করতে পারে, তার কাছে কোনো গতকাল নেই এবং তার জীবনে কোনোদিন আগামীকাল আসবে না! আগামীকাল নিয়ে কথা বললে পৃথিবীর কোনো প্রাণীই আপনাকে রেসপন্স করবে না, তারা আপনাকে বিশ্বাস করবে না! কিন্তু একমাত্র স্যাপিয়েন্সই এসব গল্প তৈরি করে এবং সেগুলিতে বিশ্বাস করে।

 

 

প্রশ্ন হলো, কেন স্যাপিয়েন্সরা মিথ্যা গল্প বলবে, এসব মিথ্যা গল্পতো তাদের বিপথে পরিচালিত করতে পারে, যদি তারা বনদেবতায় বিশ্বাস করে সারাদিন তারা সে দেবতারই আরাধনা করে তবে শিকার করবে কে? কে যুদ্ধ করবে পরাশক্তির বিপক্ষে? আর প্রজনন ও বংশবিস্তারই বা করবে কে? কিন্তু স্যাপিয়েন্সদের কর্টেক্সের একটি ক্ষমতা ছিল তারা শুধু বাস্তবতার বাইরের ভার্চুয়াল রিয়েলিটিকে কল্পনাই করতে পারে না, তারা সবাই মিলে একইসাথে একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েও জল্পনা কল্পনা করতে পারে এবং সে গল্পে তারা সকলে মিলে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য তারা ঈশ্বরকে কল্পনা করে, আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য তারা কল্পনা দিয়ে তৈরি করে জাতিয়তাবাদ! যেখানে শিম্পাঞ্জি অথবা নিয়ান্ডারথালরা ১৫০ জনের বেশি সদস্যদের নিয়ে দল গঠন করতে পারে না, সেখানে গল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি স্যাপিয়েন্স একে অপরের সাথে দলবদ্ধ হতে পারে, দুজন স্যাপিয়েন্স সময়ের বিশাল দূরত্ব দিয়ে বিচ্ছিন্ন হলেও মনস্তাত্বিকভাবে তারা দুজনে এন্ট্যাংগেল পার্টিকেলদের মতোই একইস্থানে অবস্থান করে যেহেতু তাদের দুজন একটি সাধারণ তৃতীয় গল্পে বিশ্বাস করে! এ সাইকোলজিক্যাল এন্ট্যাংগেলমেন্টদের অভাবেই নেকড়ে ও শিম্পাঞ্জিদের জগতের পরিসর এত ক্ষুদ্র।

 

 

আপনি যদি ইউনিভার্সিটি  ক্যাম্পাসে একশজন শিম্পাঞ্জিকে ছেড়ে দেন তবে তারা চিৎকার চেঁচামেচি করে সে এলাকাটিকে নষ্ট করে ফেলবে কিন্তু স্যাপিয়েন্স সেটি করবে না, কারণ তারা মনস্তাত্বিক ভাবে একটি কাল্পনিক গল্পে বিশ্বাস করে। শুধু গল্প বলার ক্ষমতার কারণেই পিঁপড়ারা এখনো উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে আর বনের রাজা সিংহ এবং শিম্পাঞ্জিরা তালাবদ্ধ হয়ে আছে চিড়িয়াখানায় অথবা গবেষণাগারে! গল্পের মাধ্যমেই আমরা মানব পার্টিকেলদের মধ্যে এন্ট্যাংগেলমেন্ট তৈরি করি, সৃষ্টি করি মানবতাবাদ, রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র? ঈশ্বর, ডলার, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বিশ্বাস বিশ্বের মানুষের মাঝে প্রদান করে ঐক্য। নাসায় বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করে কারণ তারা ডলার নামক একটি সার্বজনীন কল্পনায় বিশ্বাস করে। এ কল্পনার জগত ভেঙে দিলে স্যাপিয়েন্সরা নিয়ান্ডারথাল এবং শিম্পাঞ্জির মতোই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে! আর এ বিচ্ছিন্নতার কারণেই স্যাপিয়েন্সদের গল্পের মাধ্যমে গড়ে উঠা সার্বজনীন মনস্তত্বের কাছে তাদের পরাজিত হতে হয়েছিল, বিলুপ্ত হতে হয়েছিল তাদের পৃথিবী থেকে, অন্যভাবে বললে FOX2 জিনই গল্প তৈরির মাধ্যমে নিয়ান্ডারথাল,হোমো ইরেক্টাস ও ডেনিসোভদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তাদের গল্পই ছিল সে সকল প্রজাতির বিপক্ষে পারমাণবিক বোমা!

 

 

একজন নিয়ান্ডারথাল শারীরিক শক্তির দিক থেকে দশ জন স্যাপিয়েন্সের সমকক্ষ হলেও সেপিয়েন্সের সার্বজনীন বিশ্বাসে গড়ে উঠা বিরাট জনগোষ্ঠীর ঐক্যের কাছে নিয়ান্ডারথালরা একটি থার্মো নিউক্লিয়ার ছাইও না! আজ এ গ্রহের প্রতিটি পরমাণু সেপিয়েন্সের কল্পনার জগতের বাস করে। রাষ্ট্রের মাটির প্রত্যেকটি পরমাণু তাদের কল্পনায় তৈরি রাষ্ট্রের জন্য! কাল্পনিক ঈশ্বরের জন্য প্রতি বছর তারা মিলিয়ন প্রাণী হত্যা করে, গাছপালা কেটে তৈরি করে মসজিদ বা মন্দির, ফুল দিয়ে পূজা করে কাল্পনিক দেবতার! যেন কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ; এমনকি পরমাণুরও তাদের কল্পনার জগতের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই কারণ তারা টুইনটাওয়ারেও হামলা করতে পারে তাদের দেবতার সন্তুষ্টির জন্য অথবা তৈরি করতে পারে দেবতার বিশ্বাস রক্ষার জন্য পরমাণবিক বোমা। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে তার অবাস্তব কল্পনার জন্য জীবনও দিতে পারে, দেবতার আরাধনা করার জন্য যে মানুষ সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে বিশালাকারের সূর্যমূখী ফুলের বিবর্তন ঘটিয়েছে। মজার ব্যাপার এ সার্বজনীন কল্পনা গুলো ভেঙে গেলে স্যাপিয়েন্সদের আর কোনো বিশেষত্বই থাকবে না এ পৃথিবীতে! একটি কল্পনিক জগত ভেঙে গেলে তাদের সংঘঠিত করার জন্য আরও অনেক কাল্পনিক জগত এসে ভিড় করে!

 

 

কিন্তু সেটি আর বেশিদিন নয়, মানুষ এক সময় মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরের ধারণার আশ্রয় নিয়েছিল। আর সে গল্পের মধ্যমে তারা মিলিয়ন মানুষকে সংঘঠিত করেছিল কিন্তু আজ ঈশ্বরের স্থলে তাদের এ বিশ্বাসের জায়গা দখল করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এবং কম্পিউটার অ্যালগোরিদম। হ্যাঁ, আমি আপনাদের কাছে আজ একটি গল্প বলার জন্য এসেছি আর সে গল্পটি হলো মানব মস্তিষ্কের ভবিষ্যতের গল্প। একটা সময় ছিল যখন আমরা আমাদের জীবনের সমস্যা গুলো সমাধান করার জন্য ঋসি বা ঈশ্বরের দ্বারস্ত হতাম কিন্তু আজ আমরা যে কোনো তথ্যের জন্য গুগলের দ্বারস্থ হই, আমরা এখন আর কাল্পনিক ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না, কাল্পনিক ঈশ্বর এখন নেমে এসেছেন গুগল বা মাইক্রোসফটের ক্লাউডে? আমরা এতোদিন বিশ্বাস করে এসেছি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ঈশ্বরের পর্যবেক্ষণে থাকে কিন্তু আমরা এখন জানি যে অ্যালগোরিদম আমাদের জীবন ও মনস্তত্ব সম্পর্কে আমাদের থেকেও আরও বেশি জানে, একটা সময় আসবে শক্তিশালী কম্পিউটার অ্যালগোরিদমই আমাদের জীবন সম্পর্কে আমাদের কাছে পরামর্শ প্রদান করবে, আমাদের ভালো মন্দ সম্পর্কে সে আমাদের নিজের চেয়েও বেশি জ্ঞান রাখবে।

 

 

ইউভাল নোয়াহ হারারি বলেছেন, ২১ শতকের সবচেয়ে বড়ো সংগ্রাম হবে ব্যক্তি মানুষের গোপনীয়তা এবং স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যই জিতে যাবে। বেশিরভাগ মানুষই গুণগত স্বাস্থ্যসেবার বিনিময়ে নিজেদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিলিয়ে দেবে। তখন মানুষ তাদের শরীরের অভ্যন্তরে ২৪ ঘণ্টায় কী ঘটছে সেটা তদারকি করার সুযোগ দেবে। খুব শীঘ্রই মানুষ তাদের শরীরে এমনকি অভ্যন্তরের বায়োমেট্রিক সেন্সর লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে তখন হয়ত মানুষ ফেসবুক বা চীনা সরকার বা অন্য কাউকে তাদের শরীর অভ্যন্তরে কী ঘটছে সেটা সার্বক্ষণিক তদারকি করার অনুমতি দেবে। যেদিন থেকে তাদের শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু প্রথম বাসা বাঁধবে এবং ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে সঙ্গে সঙ্গে গুগল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তার শরীরের ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ শনাক্ত করে ফেলবে এবং অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেবে। যেদিন থেকে কোনো জ্বর মহামারী আকার ধারণ করবে সেদিন থেকেই কর্তৃপক্ষ জানতে পারবে কে রোগজীবাণু বহন করছে, ফলে তারা খুব দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে এবং স্বল্প খরচে রোগ প্রতিরোধ করতে পারবে।

 

 

 

বানরের মস্তিষ্কে ন্যানোচিপ ইনপুট করে ড. নিকোলিস তার মস্তিষ্কের সাথে ইন্টারনেট কানেক্ট করে দিতে সক্ষম হয় যার মাধ্যমে সে তার ব্রেন পালস দিয়ে জাপানের একটি রোবটকে নির্দেশনা পাঠিয়েছিল। ১৯৬৪ সালে আইজ্যাক আসিমভ The Human Brain নামক একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন কিন্তু তিনি বোঝাতে সক্ষম হননি কীভাবে মস্তিষ্কের একটি অংশ অন্য আর একটি অংশের সাথে ইন্টারেক্ট করে মন তৈরি করে। আর নিকোলিস এখান থেকেই তার জীবনের লক্ষ্য স্থির করেন মানব মস্তিষ্ক। তিনি দুটি ইঁদুরের মস্তিষ্কে ইলেক্ট্রিক্যাল সিগন্যাল সেন্ড করতে সক্ষম হয়েছিলেন যারা তাদের রঙের অনুভূতি একে অপরের সাথে শেয়ার করেছিল। তিনি প্রাণীদের মস্তিষ্কের সাথে মেশিনকে কানেক্ট করে দিতে পারতেন যার মাধ্যমে তারা ফিজিক্যালি স্থির থেকেই মানসিকভাবে ডিভাইস ইউজ করতে পারতো। সাম্প্রতিক তিনি বানরের মস্তিষ্কের প্রায় এক হাজার নিউরন শনাক্ত করেছেন যে নিউরন গুলো শরীরের বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিজের জন্য দায়ী। বর্তমানে বানরের পক্ষেও মেকানিক্যাল আর্ম এবং সাইভার স্পেসের ভার্চুয়াল ইমেজ কন্ট্রোল করা সম্ভব। নিকোলিস বলেছিলেন, বানরের পক্ষে Monkey Aviator নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কোনোপ্রকার ফিজিক্যাম মুভমেন্ট ব্যতীতই। মেন্টালি কন্ট্রোল করা যায় এমন রোবটের আর একটি দৃষ্টান্ত ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে পাওয়া যায়।

 

 

ড. রাজেশ রায় এমন এক ধরনের রোবট তৈরি করেছেন যেগুলোকে মস্তিষ্কের সিগন্যাল সেন্ড করে EEG সেন্সরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ জন্য আপনাকে একটি EEG হেলমেট পড়তে হবে। এই ক্ষুদ্র মানব সদৃশ রোবট দুই ফুট লম্বা যাদের বলা হয় মর্পিয়াস। একজন ছাত্র তার মস্তিষ্কে EEG হেলমেট পড়বে, এবং হাত অথবা পা দিয়ে ঈশারা করবে যা EEG সিগন্যাল তৈরি করবে যা কম্পিউটারের মাধ্যমে রেকর্ড করা হবে। কম্পিউটারের ভেতর রয়েছে EEG সিগন্যালের লাইব্রেরী যেটি লাইম্বের এক একটি মোশনের প্রতিনিধিত্ব করে। আপনি যদি হাত নাড়ান তবে রোবটের কাছে একটি EEG সিগন্যাল যাবে এবং সেও হাত নাড়াবে। আপনি সামনের দিকে গেলে মর্পিয়াস সামনের দিকে যাবে এবং আপনি পেছনের দিকে গেলে মর্পিয়াসও পেছনের দিকে যাবে। আমরা আমাদের ব্রেন পালস এর ব্যবহার করে EEG সেন্সরের মাধ্যমে কম্পিউটার গেমস প্লে করতে পারি, টিভি অন করতে পারি, জানলা বন্ধ করতে পারি, আমরা আমাদের নিউরাল পালস দিয়ে রোবট এবং সারোগেট দের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি! শুধু তাই নয় হ্যাপ্টিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি লেন্স পরিধাণ করে আমরা আমাদের ব্রেনকে ফোর্স ফিল্ডের সাথে কানেক্ট করতে পারি, ইন্টারনেটের ভেতর দিয়ে সেই ল্যান্স আমাদের মস্তিষ্কে একটি ভার্চুয়াল মহাবিশ্ব তৈরি করে, ইন্টারনেট সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর স্বপ্নের মতো একটি জগত তৈরি করে যে জগতের বাস্তব পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্ব নেই। ভবিষ্যতে আমাদের মস্তিষ্কের ইনফরমেশন ন্যানোচিপের মাধ্যমে ইন্টারনেটে সেন্ড করা যাবে।

 

 

গুগল আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তাকে প্রতি মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। রাষ্ট্রের সরকার চাইলে যেকোনো মুহূর্তে আমাদের নিউরন পড়তে পারবে! যে একাকিত্বের যন্ত্রণা আমাদের আজ দুঃখ্য দেয়। সে একাকিত্বের দাম একদিন বিলিয়ন ডলারের সমতূল্য হবে। আমাদের মস্তিষ্কে ন্যানোচিপ ঘুরবে, রক্তের মধ্যে ঘুরে বেড়াবে ন্যানোরোবট। একদিন আমাদের একাকিত্বের জন্য গুগলের কাছে আবেদন পত্র লিখতে হবে, তার কাছ থেকে আমাদের একাকিত্ব ক্রয় করতে হবে। তখন একাকিত্ব হবে ভয়ানক রকমের সন্দেহজনক। কেন না আমি যদি আমার ব্রেনকে ইন্টারনেট থেকে ডিসকানেক্ট করি তবে আমার চিন্তা সম্পর্কে অ্যালগোরিদম জানতে পারবে না। আর ওই মুহূর্তে আমি হয়তো ভয়ানক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

 

 

অ্যালগোরিদম তখন যুক্তি দেখাবে সবাই যেখানে আমাকে মেনে নিয়েছে সেখানে তোমার সমস্যাটা কোথায়? আমাকে তোমার শরীরের একটি অংশ মনে করো, মনে করো যে ইন্টারনেট তোমার মস্তিষ্কের নিউরন সেল আর সাইনাপ্টিক নেটওয়ার্কের মতোই তোমার দেহেরই একটি সম্প্রসারিত ভার্সন। স্যাপিয়েন্সরা ঈশ্বর নামক সার্বজনীন একটি কল্পনায় বিশ্বাস রেখে একটা সময় নিজেদের মধ্যে মানসিক ঐক্য তৈরি করেছিল, আর যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না তাদের নাস্তিক বলে হত্যা করা হতো? কল্পনা করুন অ্যালগোরিদম এসে ঈশ্বরের সে বিশ্বাসটি কেড়ে নিলো। তখন অ্যালগোরিদম হবে মানুষের সার্বজনীন বিশ্বাস, ঈশ্বর একটি সার্বজনীন বিশ্বাস হলেও সে শুধু কল্পনার জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু ইন্টারনেট ও কম্পিউটার অ্যালগোরিদম শুধু নিউরন সেলের সিগন্যালের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়, আনসেল্মের ঈশ্বরের মতো গুগল বাস্তব জগতেও প্রকাশিত, ঈশ্বর মানুষের জীবনে বাস্তবে হস্তক্ষেপ করে না কিন্ত অ্যালগোরিদম হস্তক্ষেপ করে! তবে অ্যালগোরিদম কারও ধর্ম বা বর্ণে আঘাত করবে না, তার কাছে ব্যক্তি স্বতন্ত্রতাবাদ গুরুত্বপূর্ণ, সে শুধু ব্যক্তির ইনফরমেশন দেখবে তার জাত অথবা ধর্ম নয়!

 

 

 

ন্যানোবটের মাধ্যমে আমরা এক সময় রোগ ও বার্ধ্যকের বিপক্ষে ইমিউনিটি সিস্টেম গড়ে তুলব। আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই কিছু ন্যানোবট রয়েছে যারা আমাদের শরীরের ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়াগুলোর বিপক্ষে কাজ করে কিন্তু বিজ্ঞান খুব শীঘ্রই এমনকিছু ন্যানোবট তৈরি করবে যারা রোগ ও বার্ধক্যের বিপক্ষে কাজ করে। আর এতে করে আমরা অমরত্ব লাভ করতে সক্ষম হবো। কিন্তু সব মানুষ অমর হতে পারবেনা, ইমোর্টালিটি পাবে কিছু মানুষ যারা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ , তারা মিলিয়ন ডলার খরচ করে অমরত্ব ক্রয় করবে। কিন্তু এ অমরত্বেরও সমস্যা আছে। অমরত্ব ধনী গরীবের বৈষ্যম্যকে আরও স্পষ্ট করে তুলবে। এতদিন গরীবদের কাছে একটা সান্ত্বনা ছিল যে মানুষে মানুষে যতই বৈষ্যম্য থাকুক না কেন সকল মানুষই একদিন মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু যখন গরীবরা দেখবে যে ডলারের বিনিময়ে ধনীরা অমরত্ব ক্রয় করছে তখন তাদের দুঃখের কোনো শেষ থাকবে না। আবার অন্যদিকে ধনীরাও হয়তোবা অমরত্ব নিয়ে শান্তি পাবে না! কারণ অমরত্বের পেছনে তারা এত মিলিয়ন ডলার অপচয় করবে যে সামান্য ভুলের কারণেও তারা সেটি হারানোর ঝুঁকি নেবে না যা তাদেরকে হয়তোবা গৃহবন্দি করে তুলবে! আর অমরত্বের সাথে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা কেন অমর হতে চাই? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকে উত্তর দিতে পারেন, আমরা সুখী হওয়ার জন্য অমর হতে চাই! দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো সুখী হওয়ার জন্য অমরত্বের প্রয়োজন নেই, সুখী হওয়ার জন্য প্রয়োজন ডোপামিন, সেরেটোনিন ও অক্সিটোসিন। আপনি যদি সবসময় সুখী থাকতে চান তবে আপনার মস্তিষ্কের ভেতর নিরবিচ্ছিন্নভাবে ডোপামিন ও সেরেটোনিন তৈরি করতে হবে, আর যদি নিরবিচ্ছিন্নভাবে ডোপামিন ও সেরেটোনিন তৈরি হয় আপনার মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস ডেমেজ হয়ে যাবে, অকেজো হয়ে যাবে  রিওয়ার্ড  সিস্টেম, আপনার স্মৃতি ও স্মরণ ডেমোলিস হয়ে যাবে, আপনি নতুন কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন না, আপনার বয়স যদি হয়  ২৫ , আপনার নিকট সারাজীবনই আপনার বয়স ২৫ মনে হবে কারণ হিপ্পোক্যাম্পাস ডেমেজ হয়ে যাওয়ার কারণে আপনি নতুন নতুন মুহূর্তগুলোর মেমরি সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন!  ব্রেন রিওয়ার্ড সিস্টেম ডেমেজ হয়ে যাওয়ার পর আপনাকে যদি সমস্ত মাল্টি ইউনিভার্সের ক্ষমতাও দিয়ে দেয়া হয় , প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের  কোটি কোটি প্রেমিকা উপহার দেয়া হয় তবুও আপনার ব্রেনে আর  এক ফোটাও ডোপামিন ও সেরেটোনিন ক্রিয়েট হবেনা, কোয়ান্টাম ম্যানি ওয়ার্ল্ডসের সবচেয়ে সেক্সি নারীও যদি আপনার পেনিসে তার যৌনি ইনসার্ট করে কয়েক লাখ বছর বসে থাকে আপনার  কোনো ফিলিংসই কাজ করবেনা!  আপনি অমরত্ব পাবেন কিন্তু মানসিক সুস্থ্যতা চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে, অমরত্ব হারানোর ভয়ে আপনি নারীদের মতো ছুড়ি আর কানের দুল পরে ঘরে বসে থাকবেন, কারণ এত বিলিয়ন ডলারের অমরত্ব কারো ঘুষি খেয়ে নষ্ট হয়ে যাক এটা নিশ্চয় আপনি চাইবেন না! আপনি হবেন সাইকো, অস্থিতীশীল , এক মহান লজ্জাবতী নারী … হ্যাঁ , আর সাথে প্রচন্ড পরিমাণ অলস। আপনি কোনো কাজই সঠিক সময়ে করতে চাইবেন না , কারণ আপনার সামনে কাজ করার জন্য শত শত বছর সময় পড়ে আছে! একইসাথে অমর ও অসীম সুখী মানুষ মানসিকভাবে সুস্থ্য হতে পারেনা! সে হয় অসুস্থ্য, নৈতিকতা বিবর্জিত! মস্তিষ্কে স্টিমুলেশনের মাধ্যমে হাইপোথিটিক্যালি একজন অমর মানুষকে যদি হাসিখুশি রাখা হয়, সে অন্যায়, অনৈতিকতা, মৃত্যু ও অমানবিকতা দেখলেও খুশি হবে! আর তাই ঈশ্বর যদি সত্যও হয়, আর সে যদি আমাদের মৃত্যুর পর অসীম সুখের একটি স্বর্গ উপহারও দেয় , তবে সে ঈশ্বর কোনোদিন করুণাময় হতে পারেন না, সে সেলফিশ জিনের মতোই স্বার্থপর, মেগার্ভার্সের সবচেয়ে বড়  সাইকো (পাগলা) !  একজন করুণাময় ঈশ্বর জেনেশুনে তার প্রিয় ব্যক্তিদের পাগলাগারদে পাঠাতে পারেন না! এতে ঈশ্বরের নিজের সুস্থ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়!

 

 

 

আপনি অমর মানুষ হলেও আপনার মস্তিষ্কে জিনগতভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোপামিন ও সেরেটোনিনই তৈরি হবে, অন্য কথায় বলতে গেলে আপনার সুখ, দঃখ্য আগের মতোই থেকে যাবে। আর মধ্যখানে আপনি পাবেন বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ অস্বস্তিকর একটি জীবন এবং বিভিন্ন রকমের জটিল মানসিক সমস্যা! জীবন ও কনশাসনেস বলতে আমরা যা বুঝি দুটি জিনিস আমাদের কাছে তার ডেফিনিশন পরিবর্তন করে দিচ্ছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কম্পিউটার ভাইরাস আর অন্যটি কানেক্টম প্রজেক্ট। আপনি যদি কানেক্টম প্রজেক্টের মাধ্যমে দেহের বাইরে কম্পিউটারে আপনার মনকে রাখেন তবে সেই কম্পিউটারটিকেও কি জীবন্ত মনে করা হবে? তারও কি প্রাণ আছে? আপনার প্রেমিকার মন যদি কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে রাখা হয় আপনি কি আগের মতোই তাকে ভালোবাসবেন? হার্ডডিস্কটি ভেঙে ফেলার পর আপনি কি মানব হত্যার দায়ে জেলে যাবেন? বর্তমানে কম্পিউটারের জগতে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এই শাখাটি জিনগত বিবর্তনের নিয়মগুলোকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। অনেক প্রোগ্রামারই কল্পনা করেন তারা এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরি করবে যে প্রোগ্রামটি জিনের মতোই নিজে থেকেই বিভিন্ন জিনিস শিখবে এবং সেটি নিজের মতো করে বিবর্তিত হবে যার সম্পর্কে স্রষ্টার কোনো ধারণা থাকবে না। দেবতার মস্তিষ্কের নিউরন থেকে তৈরি একটি প্রোগ্রাম, প্রাথমিক নির্দেশনা নিয়ে, নিজে নিজে বিবর্তিত হবে কিন্তু দেবতার ব্রেন নিউরন তাকে আর খুঁজে পাবে না! শুধু দেবতা কেন, অন্য কোনো দেবতাও সে প্রোগ্রামটির বিবর্তন সম্পর্কে কোনোকিছু অনুমান করতে পারবে না। আর এরকম প্রোগ্রামের সাথে আমরা ইতোমধ্যে পরিচিত হয়েছি যার নাম কম্পিউটার ভাইরাস।

 

 

 

আমাদের ডিএনএ ভাইরাসের মতোই, এ ভাইরাস গুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, ইন্টারনেটই হলো তাদের জিনপুল, আর এভাবে তারা আরও কোটি কোটি ভাইরাসের অনুলিপি তৈরি করে, তারা তাদের প্রতিযোগী ভাইরাসদের সাথে যুদ্ধ করে এবং নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে। আমাদের শরীরের জিন বা অনুলিপিকারী অণু গুলো যেমন প্রিমর্ডিয়াল সুপে নিজেদের প্রতিলিপি তৈরি করতে গিয়ে প্রতিযোগী অনুলিপিকারী অণুগুলোর সাথে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছিল ঠিক তেমনি এ কম্পিউটার ভাইরাসিগুলিও ইন্টারনেটের ভেতর একই কাজ করছে! একদিন এ ভাইরাসটি আমাদের জিনের মতোই অনুলিপি তৈরি করার সময় একটু ভুল করে ফেলে, এটি হয় এ কারণে যে সম্ভবত প্রোগ্রামার তাকে তৈরি করার সময় এমনভাবে তৈরি করেছে যেন সে একটু গড়মিল করে ফেলে যাকে বলা হয় মিউটেশন বা পরিব্যপ্তি? যদি এ বিবর্তিত ভাইরাসটি কম্পিউটারকে দখল করার ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখে এবং তার প্রতিযোগী ভাইরাসদের প্রতিহত করে তবে একটা সময় এ ভাইরাসটি সম্পূর্ণ সাইবার জগতে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোকে কি আমরা জীবিত বলব? জীবন কী তা আমরা জানি না! ডিএনএ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে আমরা এটা জানি যে ডিএনএ অনেক জটিল, এতটাই জটিল যে একে কোনো গণিত দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায় না, অতএব জীবন এখনো আমাদের কাছে অসঙ্গায়িত। আমরা জীবনের গভীরতা জানি না! যদি জীবনের কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকে কিন্তু অনুলিপিকারক অণুগুলোর মতোই কম্পিউটার ভাইরাস কাজ করে তবে কোন অর্থে আমরা তাদের প্রাণহীন বলব?

 

 

আমরা এতোদিন ধরে ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন বা সৃষ্টিতত্বের বিরোধীতা করে এসেছি। বিশেষ করে কোনো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ কোনো বুদ্ধিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সম্ভবত খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের এ ধরনের ধারণা বদলে যেতে পারে। মানুষ ব্রিডাররা আজ নিজেদের ইচ্ছা মতো প্রজাতির জিনপুল পরিবর্তন করছেন, ল্যাবরেটরিতে নিজেদের ইচ্ছে মতো নতুন প্রকরণের ভাইরাস তৈরি করছেন। এ ভাইরাসের বিবর্তন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটছে না ঘটছে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে? মানুষ বডি বিল্ডারদের শরীরকে তুলনা করা যায় মানুষ নয় এমন কিছু প্রাণীর সাথে, যেমন বেলজিয়ামের Blue-ব্রিড এ কথাটি মনে করিয়ে দেয়। এ গরুর মাংসের কারখানা তৈরি করা হয়েছে নির্দিষ্ট কিছু জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে যার নাম ডাবল মাসলিং; মায়োস্ট্যাটিন নামে একপ্রকার রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যা মাংসের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে জিনটি মায়োস্ট্যাটিন তৈরি করে সেটি অকার্যকর করে দিলেই মাংসপেশি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এর আরও একটি উদাহরণ শুকর যাদের একটি জাত “দ্য ব্ল্যাক এক্সোটিক’’ এছাড়া কিছু জাতের কুকুর অতিরিক্ত মাংসল হয় একই কারণে। আপনি যদি একটি মানব শিশুকে পালতে চান যে বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় জিতবে তবে আপনি জিনগত ম্যানিপুলেশন দিয়ে শুরু করতে পারেন। আসলে বেশ কিছু মানুষ সম্পর্কে জানা গেছে যাদের এই মায়োস্ট্যাটিন জিনটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে তাদের বেশি মাংসল হওয়ার প্রবণতা আছে। মানব প্রজাতির ইউজেনিক ব্রিডিং এর বিপক্ষে রাজনৈতিক বিরোধিতা কখনো অবশ্যই মিথ্যা একটা দাবিতে পোঁছাতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স মনে করেন, যদি যথেষ্ট সময় ও রাজনৈতিক শক্তি ব্যয় করা হয় তবে উন্নত বডিবিল্ডার, হাইপারজাম্পার, মুক্তোশিকারি, দ্রুত দৌড়বিদ, কুস্তিগীর, উচ্চমানের সংজ্ঞীতজ্ঞ, কবি বা ওয়াইন টেস্টারের ব্রিড তৈরি করতে পারবেন। আপনি যদি একটি গাভীর থেকে অনেক গ্যালন বেশি দুধ চান তবে সিলেক্টিভ ব্রিডিং আপনাকে সেটি দিতে পারে।

 
 

৭০ হাজার বছর পূর্বে খাদ্যশৃঙ্খলের তৃতীয় পর্যায়ের তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো আতঙ্কিত ও ভীত সন্ত্রস্ত হোমো স্যাপিয়েন্স নামক সাধারণ সে প্রাণীটি আজ প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতিকে এখন তাদের বুদ্ধির দখলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, এতদিন প্রাকৃতিক নির্বাচন ছিল অন্ধ ও অচেতন যার জন্য রিচার্ড ডকিন্স এটিকে ব্লাইন্ড ওয়াচমেকার বলেছেন কিন্ত এখন প্রাণী ও উদ্ভিদ মানুষের মস্তিষ্কের পালস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মানুষের কম্পিউটার অ্যালগোরিদম ও সিমুলেশন থেকে প্রাপ্ত ফলাফল দ্বারা। চার বিলিয়ন বছর পর ন্যাচারাল সিলেকশন আংশিক চেতনা পেয়েছে, প্রাণীজগত ঈশ্বরের পর্যবেক্ষণে এসেছে। আজ থেকে চারশত বছর পর, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ হয়তো বা প্রকৃতিকে শুধুমাত্র অন্ধ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা ব্যাখ্যা করতে পারবেনা, প্রাণী জগতকে ব্যাখ্যার জন্য তাদের ঈশ্বরের ধারণার প্রয়োজন হবে, প্রয়োজন হবে ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন বা আইডির ধারণার! আজ থেকে ৭০ হাজার বছর পূর্বের তৃণভূমিতে চরে বেড়ানো এ প্রাণীটির মস্তিষ্ক রোবট অথবা কম্পিউটারের ভেতর অমর হয়ে থাকবে এবং লেজার রশ্মির মাধ্যমে তাদের কনসাসনেস ভ্রমণ করবে আমাদের পরিচিত সোলার সিস্টেমের সীমানা পেরিয়ে অন্য কোনো গ্রহে অথবা গ্যালাক্সিতে! ( জীব হলো এলগোরিদম )

 

                          

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

অ্যান্ড্রোস লিহন, গবেষক ও লেখক হ্যালিক্স ইউনিভার্সিটি

 

তথ্যসূত্র:

  1. The greatest Show on Earth
  2. Sapiens
  3. The Selfish gene
  4. Future of The mind
  5. Why the Evolution is true
  6. Magic of the Reality
  7. Homo Deus

নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহননিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহননিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো  নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহনডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন  নিউ এম্পেরর অব হোমো ডিউস- লিহন