জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ একটি ইনফ্রায়েড টাইম মেশিন। এটি ১৩.৫ বিলিয়ন বছর অতীত পর্যন্ত দেখতে সক্ষম। মহাবিশ্বের প্রথম আলোর ভেতর এটি দেখতে সক্ষম প্রথম গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র যারা মহাবিস্ফোরণের অন্ধকার যুগের পর গঠিত হয়েছিল।
কেন ইনফ্রায়েড?
কেন প্রথম গ্যালাক্সি দেখার জন্য ইনফ্রায়েড টাইম মেশিনই প্রয়োজন? আর কেনোই বা আমরা প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি দেখতে চেয়েছি? এর একটি কারণ হলো….. আমরা এখনো প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি দেখিনি। COBE এবং WMAP মাইক্রোওয়েবের মাধ্যমে মহাবিস্ফোরণের ৩৮০,০০০ বছর পরের সিগনেসার দেখেছিল। কিন্তু এ সময়কালে তখনও কোনো নক্ষত্র অথবা গ্যালাক্সি গঠিত হয়নি। এ সময় মহাবিশ্ব ছিল অন্ধকার একটি স্থান।
আদিম ইউনিভার্স:
মহাবিস্ফোরণের পর মহাবিশ্ব ছিল উত্তপ্ত একটি স্যুপ পার্টিকেল( প্রোটন,নিউট্রন এবং ইলেক্ট্রন)। যখন মহাবিশ্ব শীতল হতে শুরু করেছিল তখন প্রোটন এবং নিউট্রন হাইড্রজেনের আয়নিত পরমাণুতে একত্রিত হতে শুরু করেছিল (এবং অবশেষে কিছু হিলিয়াম)। এই আয়নিত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম অ্যাটম ইলেক্ট্রনকে আকর্ষণ করতো এবং তাদেরকে নিউট্রাল অ্যাটমে পরিণত করতো। আর এভাবেই সর্বপ্রথম আলো প্রথমবারের মতো মুক্তভাবে ভ্রমণ করতে শুরু করেছিল। যেহেতু আলো মুক্ত ইলেক্ট্রন দ্বারা এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়না। মহাবিশ্ব এখন আর অস্পষ্ট নয়! অন্ধকার যুগ শেষ হয়ে আলোর সোর্স তৈরি হতে কিছুটা সময় লেগেছিল( সম্ভবত কয়েকশত মিলিয়ন বছর)। মূলত কখন মহাবিশ্বে প্রথম আলো দেখা দিয়েছিল অথবা কখন প্রথম নক্ষত্র জন্ম হয়েছিল তা জানা যায়নি। আর এ জন্যই জেমস ওয়েব ইনফ্রায়েড টাইম মেশিন ডিজাইন করা হয়েছিল প্রথম গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের সন্ধানে।
লাইট শিপট
কল্পনা করুন প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি তাদের আলো ত্যাগ করেছিল ১৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে যেগুলো স্পেস-টাইমে ভ্রমণ করে আমাদের টেলিস্কোপে প্রবেশ করবে। আর আমরা এ সকল বস্তুকে ঠিক সেভাবেই দেখবো ১৩.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বে তারা দেখতে ঠিক যেমন ছিল। যে সময়ের মধ্যে আলো আমাদের কাছে আসবে, এর কালার অথবা ওয়েবল্যাংথ লাল রঙের দিকে শিপট করবে যেটাকে রেড শিপট বলে। কেন? কারণ এক্ষেত্রে আমরা দূরবর্তী বস্তুর কথা বলছি। আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি এক্ষেত্রে গণনায় আসবে। এটি আমাদের বলে যে , দুটি বস্তুর মধ্যে মহাবিশ্বের স্পেসের সম্প্রসারণ ঘটবে যার ফলে বস্তুগুলো পরস্পর দূরে সরে যাবে। তাছাড়াও স্পেসের সেই অংশের সকল আলো সম্প্রসারিত হবে যা আলোক তরঙ্গকে দীর্ঘায়িত করবে। এটি বস্তুটিকে খুব ঝাপসা করে দেবে দৃশ্যমান তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকে কারণ এ ধরণের আলো আমাদের কাছে আসছে ইনফ্রায়েড রশ্মি হিসেবে। রেডশিপ্ট আমাদের বোঝায়, যেই আলো প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি থেকে নির্গত হয়েছিল, দৃশ্যমান আলো অথবা আল্ট্রা ভায়োলেট যাইহোক সেগুলো সময়ের সাথে লালের দিকে সরে যাচ্ছে (লালসরণ)। খুবই উচ্চমাত্রিক রেডশিপ্টের কারণে দৃশ্যমান আলো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পেক্ট্রামের নিয়ার এন্ড মিড ইনফ্রায়েড অংশে সরে যায়। আর এই কারণে প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সি দেখার জন্য আমাদের শক্তিশালী নিয়ার এন্ড মিড ইনফ্রায়েড টেলিস্কোপ প্রয়োজন ছিল এবং জেমস ওয়েব যথাযথভাবেই সেরকম!
আদি গ্যালাক্সির ছবি:
দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ প্রকাশ করলো তরুণ ও শিশু মহাবিশ্বের ইনফ্রায়েড ছবি। তারা প্রথম যে গ্যালাক্সি ক্লাস্টারটির ছবি তুলেছে তার নাম SMACS 0723। এ গ্যালাক্সি ক্লাস্টারটি ৪.৬ বিলিয়ন বছর পূর্বের। কিন্তু এটি একই সাথে একটি মহাজাগতিক জুম লেন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। যে জুম লেন্সের ভেতর দিয়ে আমরা মহাবিশ্বের ১৩ বিলিয়ন বছর অতীত দেখতে পাই। কিন্তু কীভাবে? একটি ছবি একইসাথে কী করে দুটি আলাদা আলাদা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে? উত্তর হলো, এ ছবিটি নিজেই মহাকাশ। আর মহাকাশে একই সাথে বিভিন্ন সময়কালের গ্যালাক্সি অবস্থান করছে। আপনি যদি বুঝতে চান কীভাবে এই গ্যালাক্সি ক্লাস্টার জুম লেন্সের মতো আচরণ করছে তবে আপনাকে বুঝতে হবে গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং সম্পর্কে। আরও পড়ুন: জেমস ওয়েব দুরবিন : প্রথম গ্যালাক্সির খোঁজে
গ্র্যাভিটি কোনো ফোর্স নয়, এটি স্পেস-টাইমের বক্রতা। সর্বপ্রথম, গণিতবিদ রিম্যান বক্র জ্যামিতির কথা বলেছিলেন। যদিও তিনি এর ভৌত প্রয়োগ সম্পর্কে জানতেন না। বিষয়টি বোঝানোর জন্য তিনি কাগজের একটি উপমা ব্যবহার করেছিলেন। আপনি কাগজের পৃষ্ঠে দুটি পিঁপড়ার ছবি অংকন করুন। পৃষ্ঠটি যেহেতু ফ্ল্যাট, সে পৃষ্ঠে বসবাসকারী প্রাণীরাও ফ্ল্যাট। তারা ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে মুভ করতে পারবে কিন্তু তাদের জগতে আপ ও ডাউন নেই। আপনি যদি কাগজের পাতাটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কুচকে দেন, তবে ফ্ল্যাট পৃষ্ঠ ‘উপরের’ দিকে বক্র হয়ে যাবে। পিঁপড়া গুলো যদি মুভ করার চেষ্টা করে তবে তারা কুচকানো ফাটল থেকে সৃষ্ট একপ্রকার ফোর্স অনুভব করবে যা তাদের ডানে ও বামে মুভ করতে বাধ্য করবে যেটাকে তারা মনে করবে গ্র্যাভিটি [ যদিও আপনি জানেন গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স সম্পর্কে তাদের ধারণা ইল্যুশন ] । এ কুচকানো জগতে যদি আলোকরশ্মি ভ্রমণ করে তবে দ্বিমাত্রিক স্পেসের বক্রতা আলোর গতিকেও ডিফ্লেক্ট করে দেবে বা আলো তার স্বাভাবিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে।
ঠিক তেমনি আইনস্টাইন মনে করতেন ম্যাসিভ অবজেক্টের উপস্থিতিতে স্থান-কালের জ্যামিতি পঞ্চম মাত্রায় কুচকে যায়। সূর্যের উপস্থিতি তার চারপাশের স্পেসের মধ্যে বক্রতা তৈরি করে। আর তাই দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে আলো সূর্যকে অতিক্রম করার সময় বক্রতাজনিত প্রভাবে তার স্বাভাবিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। এতে করে দূরবর্তী নক্ষত্রগুলোর অবস্থান ও দূরত্ব দর্শকের চোখে পরিবর্তিত হয়ে দেখা দেয়। আমরা সে সকল নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিকে ফলস লোকেশন ও দূরত্বে দেখতে পাই। এটাকেই গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং বলা হয়। গ্রেভিটেশনাল লেন্সিং দুইপ্রকার: স্ট্রং গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং এবং উইক গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং।
যেহেতু গ্যালাক্টিক ক্ল্যাস্টারটির বিপুল ভর তার চারপাশের স্পেসকে বক্র করে দেয়, দূরবর্তী গ্যালাক্সির আলো স্থানকালের এ বক্রতা দ্বারা ডিফ্লেক্ট ও ম্যাগনিফাই হয় যার ফলশ্রুতিতে সেই সকল নক্ষত্রও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের চোখে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ওয়েবের ৬.৫ মি প্রশস্ত গোল্ডেন মিরর এবং সুপার সেনসেটিভ ইনফ্রায়েড ইনস্ট্রিমেন্টস বিকৃত আকারের ( লাল ধনুক) গ্যালাক্সিগুলিও শনাক্ত করতে পারে যেগুলো মহাবিস্ফোরণের ৬০০ মিলিয়ন বছর পর অস্তিত্বশীল ছিল ( মহাবিশ্বের বয়স ১৩.৮ বিলিয়ন বছর)।
আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে আলোর গতি সীমাবদ্ধ। প্রতি সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল। আপনার তিন মিটার দূরের একটি আয়না থেকে আপনার চোখে আলো প্রবেশ করতে এক সেকেন্ডের এক বিলিয়ন ভাগের এক সময় লাগে। আর তাই আপনি আপনার এক সেকেন্ডের বিলিয়ন ভগ্নাংশ অতীত। সূর্য থেকে আলো আসতে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগে। আর তাই সূর্য আপনার থেকে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড অতীত। ঠিক একইভাবে আমরা যদি মহাবিশ্বের প্রারম্ভিক সময়ের ইনফ্রায়েড রশ্মি শনাক্ত করতে পারি তবে এটি আমাদের কাছে যে মহাবিশ্ব উপস্থাপন করে সেটি ১৩ বিলিয়ন বছর অতীত। হাবল এ ছবিটি তৈরি করতে সময় প্রয়োজন হয়েছিল এক সপ্তাহ। আর ওয়েব ১২.৫ ঘন্টার পর্যবেক্ষণেই সুপার ডিপ অবজেক্ট শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
স্টিফেন কুইন্টেট
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ স্টিফেন কুইন্টেট নামক ৫ টি গ্যালাক্সি গ্রুপের ছবি ধারণ করেছে যেটি আমাদের থেকে ২৯০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের। এ ছবি দেখাচ্ছে যে কেন্দ্রে সুপারম্যাসিভ ব্লাকহোল রয়েছে এবং দেখাচ্ছে কীভাবে নক্ষত্রের জন্ম হয়। এ ডেটা আমাদের বলবে, কীভাবে গ্যালাক্সি বিবর্তিত হয় এবং সুপারম্যাসিভ ব্লাকহোল কীভাবে বৃদ্ধি পায়।
ক্যারিনা নেভুলা
পরবর্তী ছবিটি দেখাচ্ছে ক্যারিনা নেভুলা যেটি অনেক বৃহৎ ও উজ্জ্বল নেভুলা।জেমস ওয়েব ইনফ্রায়েড রশ্মির মাধ্যমে ধুলিকণার ভেতর প্রবেশ করে এবং নাক্ষত্রিক নার্সারিটি প্রকাশ করে__যা আমরা আগে কখনো দেখিনি __কীভাবে তারার জন্ম হয় সে সম্পর্কে এটি আমাদের আরও বিস্তারিত জানাবে। ক্যারিনা নেভুলা আনুমানিক ৭,৬০০ আলোকবর্ষ দূরে। এ ছবি আমাদেরকে শতাধিক নতুন নক্ষত্র দেখায় এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট জেট ও বাবল। এছাড়া আমরা আরও বিস্তারিত দেখতে পাই যা এখনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি।
সাউথার্ন রিং অথবা এইট ব্রাস্ট নেভুলা
পরবর্তী বিস্ময়কর ছবিটি হলো সাউথার্ন রিং অথবা এইট ব্রাস্ট নেভুলা, প্লানেটারি নেভুলা। যেগুলো হলো গ্যাসের সম্প্রসারিত মেঘ। একটি মৃত নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে প্রসারিত। এক্ষেত্রে দুটি মৃত নক্ষত্র একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এটির ব্যাস অর্ধ আলোকবর্ষ এবং এটি পৃথিবী থেকে ২,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। ফোমের মতো কমলা রঙের শেলটি হলো মলিকিউলার হাইড্রোজেন যেখানে নীল কেন্দ্রটি ইলেক্ট্রিক্যালি চার্জড গ্যাস। ডান পাশের ছবিটিতে আপনি দেখতে পাবেন দুটি মৃত নক্ষত্র। এটি আমাদেরকে অভূতপূর্ব বিস্তারিত সহকারে নাক্ষত্রিক মৃত্যু অধ্যায়ন করার সুযোগ দেয়।
তথ্যসূত্র:
- NASA’s Webb Delivers Deepest Infrared Image of Universe Yet
- James Webb Space Telescope images broken down: What NASA’s images reveal
- JAMES WEBB SPACE TELESCOPE
- Early Universe, NASA