Can't find our books? Click here!

ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন ও অ্যালকোর

লেখক: শাহরিয়ার অভি

মৃত মানুষকে প্রিজার্ভ করে মৃতদের জীবিত করার’ দাবি করছেন (Alcor) অ্যালকর। অ্যালকর হলো যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার লাইফ এক্সটেনশন ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত মৃতদের জীবিত করতে নানা বৈজ্ঞানিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। (Reuters and Alcor Life Extension Foundation

অ্যালকর তরল নাইট্রোজেনে ভরা ট্যাঙ্কে ১৯৯টি মৃতদেহ ও মাথা এবং ১০০টি পোষা প্রাণীকে সংরক্ষণ করে রেখেছে পুনরুজ্জীবিত করার আশায়। যারা ভবিষ্যতে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার ইচ্ছা থেকে (Cryopreservation) ক্রায়োপ্রিজার্ভেশন গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অ্যালকোরের লক্ষ্য হল “ভবিষ্যতের চিকিৎসা প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব মানুষদের জীবন সুস্থভাবে পুনরুদ্ধার করা।

সংরক্ষিত মৃতদেহগুলোকে বলা হয় ‘Cryopreserved‘. অ্যালকর এর বিশ্বাস এসব মৃত ব্যক্তিদের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া হবে যখন প্রাণ ফেরানোর মতো উন্নত প্রযুক্তি বর্তমানে বা ভবিষ্যতে আবিষ্কার করা হবে তখন। আর এমন আশায় এখনো মৃত ব্যক্তিদের পরিবার দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে।

★ কিন্তু (Cryopreservation) ক্রায়োপ্রিজারভেশন কি?..

ক্রায়োপ্রিজারভেশন হচ্ছে এমন এক প্রযুক্তি যা দিয়ে মৃতদেহকে হিমায়িত বা ফ্রোজেন করে রাখা হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় হাজার বছর তাদের সতেজ রাখা যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না বর্তমান বা ভবিষ্যতে মৃত দেহকে আবার জীবিত করার সেরকম কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়। মানে ক্রায়োনিক্স হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে মৃত মানুষকে সংরক্ষণ করা হয় এই আশায় যে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির সাহায্যে তাদেরকে জীবিত করা যাবে।বর্তমানে জীবিত মানুষের শরীরে ক্রায়োনিক্স নিষিদ্ধ তাই ক্লিনিক্যালল ডেথ- সম্পন্ন হওয়ার পর একজন মানুষকে ক্রায়োপ্রিজারভেশনে রাখা হয়।

ক্লিনিকাল ডেথ বলতে বুঝায় হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ মস্তিষ্কের কোষ জীবিত ও কর্মক্ষম থাকে। এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে দেখা যায় কিছুক্ষণ হার্টবিট বন্ধ থাকার পর মানুষটি আবার বেঁচে ফিরেছে। তাই, ক্রায়োবিদরা মনে করেন যে মস্তিষ্ক যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষকে মৃত দাবী করা যায় না৷ তাদের মতে ভবিষ্যৎ সময়ে এমন অনেক প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হবে যার সাহায্যে তাদের মস্তিষ্কে থাকা সকল তথ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।

ক্রায়োনিক্স এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের সব কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া বা সরাসরি বলতে গেলে মৃত্যুকে স্থগিত করে দেওয়া। ক্রায়োনিক্স প্রক্রিয়ায় কিছু কোষের ফাংশন সংরক্ষণ করা হয় যা থেকে থিওরেটিক্যালি তাদের আবার জীবিত করা সম্ভব। কোনো মানুষ মারা যাওয়ার পর তার শরীরকে স্থির অবস্থায় আনতে অক্সিজেন ও রক্ত সরবরাহ করা হয় যাতে শরীরের কিছু ক্রিয়া চলতে থাকে। তারপর শরীরে অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট দেওয়া হয় যাতে রক্ত জমে না যায়।

অর্থাৎ ক্রায়োপ্রিজারভেশনের জন্য শরীরের ভিতর থেকে রক্ত এবং অন্য জলীয় অংশ যত বেশি পরিমাণ পারা যায় বের করে ফেলা হয়, তারপর রক্ত এবং জলীয় অংশের পরিবর্তে অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য যে মেডিকেল গ্রেড অ্যান্টি-ফ্রিজ দ্রবণ ব্যবহার করা হয়, সেটা শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে পরবর্তী সময় মৃত শরীরকে ঠাণ্ডা করা হলেও কোষের ভিতরে স্ফটিক তৈরি হতে না পারে। সহজ কথায়, দেহ থেকে রক্ত এবং অন্যান্য তরল বের করে তার পরিবর্তে শরীরে বিশেষ কেমিক্যাল প্রতিস্থাপন করা হয়, যা মৃতদেহের পচন প্রতিরোধ করে।

মানুষের কোষের বেশিরভাগ অংশই পানি হওয়ায় শরীরের পানি সরিয়ে ক্রায়োপ্রোট্যাক্টট্যান্ট বা (Glycerol) গ্লিসারল দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে ভিট্রিফিকেশন। পানি না সরালে তা বরফ হওয়ার পর আয়তনে বেড়ে যাবে এবং সব কোষ নষ্ট হয়ে হয়ে যাবে। মানে দেহটি অতিরিক্ত ঠান্ডা তাপমাত্রায় নাইট্রোজেন ট্যাঙ্কে সংরক্ষণ করা হয়। এই সময়টাতে কৃত্রিমভাবে রক্ত সঞ্চালনের জন্য একটি যান্ত্রিক সিপিআর যন্ত্র ব্যবহার করা হয় যাতে কোষগুলোকে ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়। ভিট্রিফিকেশন এর পর ড্রাই আইস দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা (২০২) ফারেনহাইট পর্যন্ত ঠান্ডা করা হয়, একে বলে প্রি-কুলিং। এরপর শরীরকে তরল নাইট্রোজেন এর ট্যাঙ্কে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং শরীরের তাপমাত্রা (৩২০) ফারেনহাইট এ নেমে আসে।

★ এই পর্যন্ত কাউকে জীবিত করা সম্ভব হয়েছে?...

সবচেয়ে জটিল বিষয় হচ্ছে এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনে দেহ স্বাভাবিক করা, এখনো পর্যন্ত কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীকে এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনা যায়নি, কেবল কিছু নেমাটোডদের এই প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক করা গিয়েছে। তবে ভবিষ্যতে এমন কোন প্রযুক্তি আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত শুধু আমাদের অপেক্ষাই করতে হবে। ক্রায়োনিক্সের প্রবক্তারা আশাবাদী এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির উল্লেখ করেছেন যাতে শুক্রাণু, ভ্রূণ এবং স্টেম কোষগুলি ক্রায়োপ্রিজারভেশন এবং সফলভাবে ও সংরক্ষণ করা যায়।

ভবিষ্যতের জন্য নিজেদেরকে হিমায়িত করার এই ধারণাটি সায়েন্স ফিকশনের মতোই মনে হয়। তবে আপনি যাই মনে করুন না কেন, অ্যালকর লাইফ এক্সটেনশন ফাউন্ডেশন, মৃতদের প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার এই প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ আশাবাদী তবে প্রাণ ফেরানোর মতো উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত তাদের দেহ এভাবেই সংরক্ষণ করা হবে।………..

( Max More) ম্যাক্স মোর, অ্যালকোরের প্রাক্তন সিইও যিনি এখন ফাউন্ডেশনের একজন অগ্রদূত এবং প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস হিসাবে কাজ করছেন তিনি রয়টার্সকে বলেছেন, আধুনিক ওষুধ এবং প্রযুক্তি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখনো পিছিয়ে আছে।

তবে অ্যালকর কিছু রোগীর এমন অসুখের টার্মিনাল কেস ছিল যেগুলো এই বর্তমান যুগে নিরাময় নেই, রোগীরা ছিলেন ক্যানসার, ALS প্যারালাইসিস বা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত। তবে অ্যালকর রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী ছিলেন দুই বছর বয়সী থাইল্যান্ডের ম্যাথেরিন নাওভারতপং নামক একজন মেয়ে। এই শিশুটি মাত্র ২ বছর বয়সে ব্রেন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং ২০১৫ সালে ক্রায়োপ্রিজার্ভড করা হয়েছিল।

কিন্তু ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া থাই মেয়েটির বাবা-মা দুজনেই ডাক্তার ছিলেন এবং মেয়েটির একাধিক মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সুস্থ না হওয়ায় মৃত্যুবরণ করেছিল দুই বছরের মেয়েটি। পরে তার বাবা-মা অ্যালকর সাথে যোগাযোগ করেছিলেন এই আশায় যে, হয়তো একদিন তার মেয়েকে ফিউচার টেকনোলজি ফিরিয়ে দেবে। ২০১৫ সাল থেকে এখনো শিশুটির দেহ সংরক্ষিত।

এছাড়াও, সফ্টওয়্যার বিকাশকারী এবং বিটকয়েনের অগ্রগামী হ্যাল ফিনি, যিনি ২০১৪ সালে ALS প্যারালাইসিসে প্রাণ হারিয়েছে তিনিও অ্যালকোর একজন সংরক্ষিত ব্যক্তি, ২০১৪ সালে প্রাণ হারানোর পর অ্যালকর তার মরদেহ সংরক্ষণ করে রেখেছিল।

এবং অন্যান্য রোগীদের মধ্যে রয়েছে বেসবল প্লেয়ার (Ted Williams) টেড উইলিয়ামস যিনি ২০০২ সালে হৃদরোগের জটিলতায় মারা গিয়েছিলেন। আরও পড়ুন: ইম্মর্টালিটি এন্ড গ্যালাক্টিক মাইন্ড

কেমন খরচ হয় ক্রায়োপ্রিজার্ভেশনের জন্য?…….

রয়টার্সের মতে, এজন্য কমপক্ষে হয় ২ লক্ষ ডলার প্রয়োজন এবং শুধুমাত্র একটি মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করতে চাইলে ৮০ হাজার ডলার।

অ্যালকর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত, অ্যালকর ১৯৭৬ সালে তার প্রথম মানব ক্রিওপ্রিজারেশন সঞ্চালিত করে। কিন্তু এইভাবে হিমায়িত হওয়া প্ৰথম মানবকে প্রায় এক দশক আগে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, যখন মনোবিজ্ঞানী জেমস এইচ. বেডফোর্ড ১৯৬৭ সালে কিডনি ক্যান্সারে ৭৩ বছর বয়সে মারা যান। বেডফোর্ডের দেহ বরফের উপর রাখা হয়েছিল এবং “ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রায়োনিক্স সোসাইটির বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছিল, যেমনটি ১৯৯৭ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন লিখেছিল। তখন থেকেই বেডফোর্ডের দেহ হিমায়িত অবস্থায় আছে এবং অ্যালকোরের একটি ক্রায়োনিক ট্যাঙ্কে শুয়ে আছে।

★ এখন প্রশ্ন হলো কোথায় করা যাবে ক্রায়োপ্রিজারভেশন (Cryopreservation)…..

( America Arizona) অ্যামেরিকার অ্যারিজোনা রাজ্যের (Alcor) ফ্যাসিলিটি এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ক্রায়োব্যাংক এই কাজটি করে। তবে ক্রায়োনিক ইনস্টিটিউট ল্যাবে এই খরচ আরও কম বলে জানা যায়। পুরো শরীর সংরক্ষণ করতে যেখানে ২৮ হাজার লাগতে পারে। এছাড়াও অ্যামেরিকার হোলব্রোক পৃথিবীর ২য় বৃহত্তর ক্রায়োনিক ফ্যাসিলিটি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তবে অ্যালকর ল্যাবে আপনি যদি সম্পূর্ন শরীর সংরক্ষণ করতে চান তবে সেক্ষেত্রে দু-লাখ ডলার খরচ করতে হবে এবং শুধু মস্তিষ্ক সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হবে ৮০ হাজার ডলার।