অনেকে মনে করেন, ধনীরা বেশি খায়, তাদের পেট বড় হয়। লেখক মহিউদ্দিন আহমেদের একটি সেলিব্রেটি উক্তি আছে, একজন ব্যক্তির দেহে যদি মাংসের পরিমাণ বেশি হয়, তবে আপনাকে ভেবে নিতে হবে পৃথিবীর কোনো না কোনো অংশে কেউ না কেউ তার জন্য ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছে। কিন্তু আপনি যাই বলেন না কেন, এ সকল বক্তব্য সম্পূর্ণ সঠিক নয়। যার কাছে অ্যান্ড্রোয়েড, আইফোন, আইপ্যাড, ল্যাপটপ অথবা সুপারকম্পিউটার সবকিছুর উপর অ্যাকসেস আছে, তার এসবের প্রতি আকর্ষণ কমারই কথা।
কারণ একজন ব্যক্তি যখন একসাথে সকল কিছু পেয়ে যায়, তখন তার ডোপামিন লেভেল হ্রাস পায়, সে আগ্রহ ও কৌতুহল হারিয়ে ফেলে। মানুষের রিওয়ার্ড সার্কিট তাকে সে সকল উদ্দীপকের দিকেই পরিচালিত করে যা তার নেই, যা আছে তার প্রতি মানুষ কৌতুহল অনুভব করে না। যার কাছে খাবারের অভাব নেই সে প্রচুর পরিমাণ খায় না। প্রচুর পরিমাণ খাওয়ার তাড়না তার মধ্যেই বেশি, যার কাছে খাবারের পরিমাণ খুবই সীমাবদ্ধ, যার প্রচুর পরিমাণ খাবারের রিজার্ভ নেই। এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, ধনী মানুষের নয়, গরীব মানুষেরই পেট বড় হওয়ার প্রবণতা বেশি।
সামাজিক অনুক্রম হলো একটি র্যাংকিং সিস্টেম অথবা গ্রুপ বেইসড সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতা। বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট যেমন কর্মক্ষেত্র, স্কুল, পরিবার ও সামাজিক গ্রুপে আমরা এই র্যাংকিং সিস্টেম দেখতে পাই। গবেষণা দেখিয়েছে, একজন ব্যক্তির সামাজিক অনুক্রমে অবস্থান তার শারীরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রাণীদের রাজত্বে, সামাজিক অনুক্রমে অবস্থান অর্জিত হয় আগ্রাসী আচরণ ও শারীরীক প্রভাবের মাধ্যমে। এটি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, শিম্পাঞ্জির কমিউনিটিতে, যেখানে আলফা পুরুষ উচ্চ পর্যায়ের আসন দখল করে এবং সে সেরা সম্পদ ও আকর্ষণীয় প্রেমিকার উপর অগ্রাধিকার রাখে। এ প্রেক্ষাপটে, অধীনস্ত পুরুষরা ক্রোনিক স্ট্রেস ও উত্তেজনার শিকার হয়, কারণ তারা ক্রমাগত বেঁচে থাকার লড়াই করছে এবং অনুক্রমে তাদের অবস্থান বজায় রাখার জন্য সংগ্রাম করছে।
একইভাবে, মানব সমাজে, সামাজিক অনুক্রম সম্পদ, শিক্ষা ও পেশার মতো আরও অসংখ্য ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। যে সকল মানুষ সামাজিক অনুক্রমে নিন্ম আসন অধিকার করে, তারা ক্রোনিক স্ট্রেসের শিকার হয় কারণ পরিবেশের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এছাড়া তাদের সম্পদের ওপর সসীম অধিকার এবং সামাজিক সমর্থনের অভাব। এ ক্রোনিক স্ট্রেস বিভিন্ন শারীরীক সমস্যা জন্ম দেয় যেমন কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি, স্থুলতা এবং ডায়বেটিস। এছাড়া এটি বিভিন্ন নেতিবাচক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে যেমন হতাশা ও উত্তেজনা। এটি অসংখ্য রিয়েল টাইম এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে প্রমাণিত।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, সামাজিক অনুক্রম থেকে সৃষ্ট ক্রোনিক স্ট্রেসের সাথে স্থুলতার সম্পর্ক কী? এটি আসলে কয়েকটি মেকানিজমে ঘটে থাকে। একটি মেকানিজম হলো, স্ট্রেস হর্মোন কর্টিসলের বৃদ্ধি। কর্টিসল অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত হয়, এটি শরীরের ফ্যাট স্টোরেজ (চর্বির সংরক্ষণাগার) উদ্দীপিত করে, বিশেষ করে উদরের এলাকায়।
ক্রোনিক স্ট্রেস আমাদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর খাবারের অভ্যাসকে নেতৃত্ব দেয় এবং সৃষ্টি করে শারীরীক নিষ্ক্রিয়তা, দুটোই শরীরের ওজন বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। যে সকল মানুষ ক্রোনিক স্ট্রেসের শিকার, তারা আরামদায়ক খাবার খেতে চায়, যেগুলো উচ্চমাত্রার সুগার, চর্বি এবং ক্যালোরি সমৃদ্ধ এবং তারা অলস প্রকৃতির হয়, কোনোপ্রকার শারীরীক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে চায় না এবং কোনো স্বাস্থ্যকর কাজেই তারা বিজড়িত নয়।
এছাড়া ক্রোনিক স্ট্রেস স্লিপ প্যাটার্নে আঘাত করে, যেটি আবারও ওজন বৃদ্ধির নেতৃত্ব দেয়। ঘুমের অভাবে আপনার শরীরে হর্মোন ঘেরলিন (ghrelin) বেড়ে যাবে, যেটি আমাদের ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং হর্মোন লেপটিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যেটি দেহকে সিগন্যাল দেয় কম খাওয়ার জন্য।
ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা বেবুনের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছিলেন, সামাজিক অনুক্রমে তাদের অবস্থানের ওপর তাদের শারীরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে। যে সকল বেবুন সামাজিক অনুক্রমে একদম নিচের সারিতে থাকে, তাদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় স্ট্রেস হর্মোন কর্টিসল পাওয়া যায়, যেখানে তারা উচ্চ পদমর্যাদার মানুষের তুলনায় বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা ফেস করে যেমন হৃদরোগ। মজার ব্যাপার হলো, যখন কোনো একটি সিংহ আলফা মেলকে খেয়ে ফেলে, সৈন্যদের সামাজিক স্তর বিন্যাস ভেঙে যায়। যে পুরুষটি এতদিন অধীনস্ত ছিল, সে এখন স্তরবিন্যাসে প্রথম পর্যায়ে উন্নীত হয় এবং তাদের স্ট্রেস হর্মোন কর্টিসল হ্রাস পায়।[i]
সামাজিক অনুক্রমের বিষয়টিকে ইভল্যুশনারী মিসম্যাচ হিসেবে দেখা যায়। যদিও মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে আমরা হাজার হাজার বছর পর্যন্ত সামাজিক অনুক্রম দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু অনুক্রমের নিচের সারির সদস্যরা যে সকল চাপ ও নেতিবাচক স্বাস্থ্য সমস্যা অনুভব করছে, এটি আমাদের বিবর্তনীয় অতীতের সাথে একটি ইভল্যুশনারী মিসম্যাচ। আমাদের আদিম পরিবেশে সামাজিক অনুক্রম এত বেশি শক্ত ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলফা মেল অন্য কোনো দল অথবা হিংস্র জানোয়ার দ্বারা শিকার হতো। আর এতে করে দলের সদস্যদের মধ্যে অনুক্রমে সহজেই অবস্থান পরিবর্তন হতো। আমাদের সমাজে আজ ন্যাচারাল প্রিডেটর নেই, আর আধুনিক যুগের সামাজিক স্ট্র্যাকচার সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি শেখ হাসিনার কথাই চিন্তা করুন। সে বছরের বছর বছর সামাজিক অনুক্রমে শীর্ষস্থান দখল করে আছে, কিন্তু এখন কোনো ন্যাচারাল প্রিডেটর নেই। আর আজকের সমাজে উচ্চ মর্যাদা অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা তুমুল যা অজস্র নতুন স্ট্রেসর যোগ করেছে।
- [i] The research paper is titled “Social rank, glucocorticoids, and injury risk in wild baboons” and was published in the journal Science in 2001.
- Sapolsky, R. M. (2005). Why zebras don’t get ulcers: An inquiry into stress, emotions, and general health. Henry Holt and Company.
- Marmot, M. (2014). The status syndrome: How social standing affects your health and longevity. Bloomsbury Publishing.
- Cohen, S., & McEwen, B. S. (2007). Allostasis and health. Academic Press.
- Lynch, J. W., & Kaplan, G. A. (2000). Socioeconomic position and health in developed countries: Findings from recent research. Social Science & Medicine, 51(1), 111-178.
আরও পড়ুন- প্রস্তরযুগ থেকে স্ক্রিনওয়ার্ল্ড