সময়টা ১৯০৫। প্যাটেন্ট অফিসে চাকুরিরত একজন মানুষ একটি নয়, দুটি নয়. পরপর চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত করেছেন। উনি আর কেউ নন, বর্তমানের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞানীদের একজন, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন্সটাইন।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুযায়ী ভর, সময়, দৈর্ঘ্য এই তিনটি পরম। কিন্তু আইন্সটাইন দেখান ভর, সময় ও দৈর্ঘ্য পরম নয়, বরং এগুলো আপেক্ষিক। এর আগে ১৯০৪ সালে বিজ্ঞানী লরেন্জ তার লরেন্জের রূপান্তর প্রদান করেন যা ব্যবহার করে আলবার্ট আইন্সটাইন তার আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এর গাণিতিক সমীকরণ সমাধান করেন। আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে দুইটি স্বীকার্য রয়েছে। স্বীকার্যগুলো হলো –
১। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রসমূহ সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে একই থাকবে।
২। আলোর বেগ সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে একই থাকবে। (অর্থ্যাৎ, আলোর গতিবেগ ধ্রুব।)
প্রথম স্বীকার্যটা দ্বিতীয়টার তুলনায় সরল। আমি যদি স্থির থাকি এবং আমার সামনে দিয়ে একটা ট্রেন যদি অতিক্রম করে, তাহলে আমার সাপেক্ষে ট্রেন গতিশীল এবং ট্রেনের সাপেক্ষে আমি গতিশীল। অর্থ্যাৎ ট্রেনের ভেতর যদি কোনো মানুষ থাকে, তাহলে তার মনে হবে সে স্থির আমি গতিশীল। এই বিষয়টিই বলা হয়েছে আপেক্ষিকতার তত্ত্বের প্রথম স্বীকার্যে। এবার কথা বলা যাক দ্বিতীয় স্বীকার্যটা নিয়ে।
ধরি, আমার সামনে দিয়ে একটি ট্রেন যাচ্ছে যার বেগ ৩০ মিটার/সেকেন্ড। এখন ট্রেনের উপরে একজন মানুষ সামনের দিকে একটা বল নিক্ষেপ করল ৫ মিটার/সেকেন্ড বেগে। এখন আমার কাছে পাথরটির বেগ মনে হবে (৩০+৫) মিটার/সেকেন্ড = ৩৫ মিটার/সেকেন্ড। কিন্তু যদি ট্রেনের উপরের মানুষটি টর্চলাইট থেকে সামনের দিকে আলো ফেলে তাহলে আমার কাছে আলোর বেগ যা আছে তাই মনে হবে অর্থাৎ আলোর বেগ অপরিবর্তনীয় থাকবে। অন্যরকম লাগলেও এটিই ঘটে। এখন আলোর এই ধ্রুব গতি কীভাবে বজায় থাকে তা বলা যাক। আলোর ধ্রুব গতি বজায় রাখার জন্য সময় ধীর হয়ে যায়। এই বিষয়টিকে সময়ের প্রসারণ বলে। অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছেন। বর্তমানে সবচেয়ে সূক্ষ্ম সময় পরিমাপের যন্ত্র হচ্ছে অ্যাটমিক ক্লক। অ্যাটমিক ক্লকের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে সময় ধীর হয়। এর থেকে বোঝা যায়, চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে যেই সময়কে পরম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেই সময় আসলে আপেক্ষিক। সময়ই শুধু নয়, দৈর্ঘ্য ও ভরও আপেক্ষিক। এই ক্ষেত্রে, গতিশীল বস্তুর ভর প্রসারিত হয় ও দৈর্ঘ্য সংকুচিত হয়। ভর ও দৈর্ঘ্যের বিষয়টিও অনেকটা সময়ের মতোই।
কিন্তু আপেক্ষিকতার তত্ত্ব এর গাণিতিক সমীকরণে কোনো বস্তু আলোর বেগে চললে অসংজ্ঞায়িত ফলাফল আসে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তা তখনো গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, তখনও বিজ্ঞানীদের কাছে এমন কোনো তত্ত্ব ছিল না যা দ্বারা এটি ব্যাখ্যা করা যাবে যে কেন, আলোর গতি লাভ করা সম্ভব নয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে পদার্থবিদ পিটার হিগস্ বলেন, পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে এমন একটি ফিল্ড আছে যা বস্তুর ভর সৃষ্টির জন্য দায়ী। এই ফিল্ডের নাম হিগস্ ফিল্ড। এই ফিল্ডের কারণেই কোনো ভরযুক্ত বস্তু আলোর গতি লাভ করতে পারবে না। সর্বোচ্চ আলোর গতির ৯৯.৯৯% গতি অর্জন করা সম্ভব হবে। আর ২০১২ সালে সার্নের লার্জ হাইড্রন কলাইডার হিগস্ ফিল্ড থেকে উৎপন্ন কণা হিগস্ বোসন সনাক্ত করে। যার ফলে হিগস্ ফিল্ডের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়। যার ফলে বোঝা যায়, ভরযুক্ত বস্তু আলোর গতি লাভ করতে পারবে না।
আইস্টাইনের এই আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের থেকেই বের হয়ে আসে ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় সমীকরণ E = mc2। এই সমীকরণটি আসলে মূল সমীকরণ না। মূল সমীকরটি হলোঃ
এখানে, E = শক্তি, m = বস্তুর স্থিতিভর, c = আলোর গতি, v = বস্তুর বেগ। এই সূত্রের হরের অংশটি হচ্ছে লরেন্জের রূপান্তর। আইন্সটাইনের সমীকরণটি থেকে আমরা জানতে পারি, ভর মূলত শক্তির আরেকটি রূপ। এই সমীকরণটি ব্যবহার করে পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করা হয়েছে, যা নিতে পারে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ। কিন্তু আবার আমরা এই সমীকরণকে ভালো কাজেও ব্যবহার করতে পারি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র -এ এই সমীকরণ ব্যবহারের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। এই সমীকরণে কণার বেগ যদি ০ হয়, তাহলে আমরা পাই আমাদের সুপরিচিত সূত্র E = mc2।
এখন আসা যাক, আলোর বেগের বিষয়ে। শূন্যস্থানে আলোর বেগ সর্বোচ্চ। তা হচ্ছে ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার/সেকেন্ড। আলোর ভর শূন্য। আলো ভরহীন। কিন্তু আলোর ভরবেগ আছে। এই বিষয়টি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্তর্গত। আমরা জানি, ভরযুক্ত কোনো বস্তু আলোর বেগের চলতে পারে না। আর যেই ভরহীন বস্তু আলোর গতিতে চলে, সেই বস্তুর ক্ষেত্রে সময় স্থির হয়ে যাবে। সময়ের প্রসারণের গাণিতিক সূত্রের থেকে পাওয়া যায় আলোর বেগে চলা বস্তুর ক্ষেত্রে সময় হবে স্থির। আর যেই বস্তু আলোর বেগে চলবে, তাকে স্বাভাবিকভাবে আমরা দেখতে পাবো না। তাহলে আলোর বেগের বেশি বেগে কোনো কণা যদি চলে তাহলে তার ভর হবে কাল্পনিক। অবাক লাগলেও সত্যি। এই ধরনের একটি প্রকল্পিত কণার নাম ট্যাকিয়ন। ট্যাকিয়ন কণার ভর হচ্ছে -১ । এই ভর কাল্পনিক ভর বিশিষ্ট কণার ক্ষেত্রে সময় হয়ে যাবে উল্টা। অর্থাৎ , যদি একটি বস্তু টেবিল থেকে নিচের দিকে পড়ে তাহলে ট্যাকিয়নের সাপেক্ষে বস্তুটি নিচের থেকে টেবিলে উঠবে। যা পদার্থবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করে, সেই নীতির নাম কার্যকারণ নীতি। এই নীতি অনুসারে প্রতিটি কাজের কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। আর আমরা প্রথমে কাজের কারণ দেখব ও এরপরে কাজ দেখব। কিন্তু কোনো বস্তু আলোর বেগের বেশি চললে ওই বস্তু আগে কাজ দেখবে, এরপর কাজের কারণ দেখবে। আবার এই ট্যাকিয়নের দৈর্ঘ্য হবে উল্টা। যা ফলে মাথার দিকে পা থাকবে ও পায়ের দিকে মাথা থাকবে (কণার তো আসলে পা-ও থাকে না আবার মাথা-ও হয় না, পা-মাথা দিয়ে কণার শুরু-শেষ বুঝিয়েছি)।
এবার একটু বিজ্ঞানকল্প নিয়ে কথা বলা যাক। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে সময়যাত্রা করা সম্ভব এবং আমরা প্রতিনিয়ত সময়যাত্রা করছি। যেকোনো গতিশীল বস্তুর ক্ষেত্রে সময় ধীর হয়। অর্থাৎ, যদি কোনো বস্তু অনেক বেশি বেগে চলতে থাকে তাহলে সে আমাদের সাপেক্ষে ভবিষ্যতে চলে যাবে। কিন্তু সে আর ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে ফিরে আসতে পারবে না। আচ্ছা ধরে নিই সে অতীতে যেতে পারে আবার অতীত থেকে ভবিষ্যতেও আসতে পারে। এইখান থেকে নতুন একটি কূটাভাস বা প্যারাডক্সের জন্ম হয়, যার নাম গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। এই প্যারাডক্সটি বোঝা যাক। ধরুন, একজন মানুষ সময়ের অতীতে যেতে পারেন আবার অতীত থেকে ভবিষ্যতেও আসতে পারেন। এখন মানুষটি যদি অতীতে গিয়ে তার গ্র্যান্ডফাদারকে মেরে দেন, তাহলে মানুষটারই জন্ম হবে না। মানুষটার জন্ম না হলে মানুষটা তার গ্র্যান্ডফাদারকে মারতেও পারবেন না। এই কূটাভাসের নামই হচ্ছে গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। কিন্তু অতীতে ভ্রমণ সম্ভব না হলেও, অতীত দেখা সম্ভব। ইতিমধ্যেই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। যার অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে আদি গ্যালাক্সির ছবি তোলা, যা মহাবিষ্ফোরণের পরে সৃষ্টি হওয়া সর্বপ্রথম গ্যালাক্সি।
আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানে অনেক বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে এবং এই তত্ত্ব ব্যবহার করে মানুষ অনেক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব জ্ঞান আর জ্ঞানের ব্যবহার প্রযুক্তি। জ্ঞান কখনো খারাপ হতে পারে না। জ্ঞান দ্বারা উদ্ভাবিত প্রযুক্তির ব্যবহার খারাপ হতে পারে। আলবার্ট আইস্টাইনের E=mc2 জ্ঞান হলে, পারমাণবিক বোমা এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে প্রযুক্তি। কিন্তু পারমাণবিক বোমা মরণঘাতী অন্যদিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মানুষের উপকারী। একই জ্ঞানের ভিন্ন দুটি প্রযুক্তি, একটি ভালো আরেকটি মন্দ। তাই আমাদের সর্বদা জ্ঞানের ভালো ব্যবহার করতে হবে।